৬ নভেম্বর সকাল সাড়ে ৯টা। ঢাকা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের গেট দিয়ে ঢুকতেই দেখা যায় পুরো আদালত চত্বর নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে। সেখানে সেনাবাহিনী ও পুলিশসহ অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করছিলেন। কোর্টের ৩ তলার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই দেখা মেলে দুজন ভিআইপি আসামির। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার। দুজনকে হাজিরা শেষে পুলিশি নিরাপত্তায় সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামিয়ে আনা হচ্ছিল। এ সময় তাদের ঘিরে আইনজীবী ও সাধারণ মানষের ঠাসা ভিড় দেখা যায়। তারা দুজনে বয়সের ভারে নতজানু। ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে ভিআইপি আসামিদের হাজিরা এখন নিত্যদিনের। মক্কেল ও আইনজীবীদের আনাগোনা আগের মতোই।
সরেজমিনে জজ কোর্ট ঘুরে দেখা যায়, সরকার পতনের পর বদলে গেছে সেখানকার চিত্র। একসময় যেখানে আওয়ামীপন্থি আইনজীবীদের দাপটে টেকা দায় ছিল সেখানে এখন ভিন্ন চিত্র। আদালতপাড়া দখলে নিয়েছেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা।
সরকারি নিয়োগপ্রাপ্ত পাবলিক প্রসিকিউটর, সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর, অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর, স্পেশাল প্রসিকিউটর, জিপি (গভর্নমেন্ট প্লিডার), অতিরিক্ত জিপি, সহকারী জিপিসহ সরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত বেশির ভাগ আইনজীবী চেম্বার ছেড়ে পালিয়েছেন। এই পদগুলোতে নতুনভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া শেখ হাসিনার সরকার পতনের এক দিন আগে ঢাকার আদালতপাড়ায় বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের চেম্বার ভাঙচুরের জেরে গত ৬ আগস্ট আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীদের চেম্বার ভাঙচুর করা হয়। নতুন করে এসব চেম্বার মেরামত করা হয়েছে। তবে আওয়ামীপন্থি আইনজীবীদের চেম্বারগুলো খোলা থাকলেও সেখানে তারা আসছেন না।
সরেজমিনে আরও দেখা যায়, যেসব দালাল একসময় আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীদের সঙ্গে কাজ করতেন বা মামলা এনে দিতেন, এখন বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের চেম্বারে এসব দালালের আনাগোনা বেড়েছে। এ ছাড়া আসামি ও আইনজীবীদের ওপর হামলা থেমে নেই।
ঢাকা জজ কোর্টের একাধিক আইনজীবী জানান, আওয়ামীপন্থি প্রায় ২০০ আইনজীবী এখন কোর্টে আসেন না। তাদের ব্যক্তিগত চেম্বারগুলো খোলা থাকলেও সেখানে আগের মতো মক্কেল ও মামলার ফাইলের চাপ নেই। এ ছাড়া সরকার পতনের পর রাজনৈতিক মামলা ও হামলার শিকার হয়েছেন অনেক আইনজীবী। বেশ কয়েকজনের চেম্বারও ভাঙচুর করা হয়েছে। কোর্টে না আসায় ও নিয়মিত শুনানিতে না থাকায় তাদের মামলাগুলো চলে যাচ্ছে বিএনপি আইনজীবীদের হাতে। এ ছাড়া দালালরাও তাদের চেহারা পাল্টেছে। বিএনপি আইনজীবীদের চেম্বারে তাদের আনাগোনা বেড়েছে। পুলিশের বেশির ভাগ কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়েছে।
সাবেক এক সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর খবরের কাগজকে বলেন, সরকারের পতনের এক দিন আগে ঢাকার আদালতপাড়ায় বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের চেম্বার ভাঙচুর করা হয়। ওই দিন ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার শাহাদত শাওনের নেতৃত্বে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের চেম্বারে দুর্বৃত্তরা হেলমেট পরে হামলা চালায়। এ সময় বেশ কয়েকটি চেম্বার ভাঙচুর করা হয়। এ সময় বর্তমান পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুখ ফারুকীর চেম্বারও ভাঙচুর করা হয়। এর জেরে সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীদের চেম্বার ভাঙচুর করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের এই ভরাডুবির জন্য আইনজীবীরাও দায়ী। তারা আওয়ামী সরকারের দাসে পরিণত হয়েছিল। তাদের একচেটিয়া অন্যায়-অত্যাচারের কারণে আমার মতো অনেকে চাকরি হারিয়েছেন।
তিনি আরও জানান, আওয়ামীপন্থি আইনজীবীদের মধ্যে শ ম রেজাউল করিম, আব্দুল দুলাল, সাইদুর রহমান মানিক, ফিরোজ রহমান মিন্টু ও মিজানুর রহমান মামুনসহ অনেকে এখন চেম্বার বন্ধ রেখেছেন। তাদের জুনিয়রদেরও এখন কোর্টে দেখা যায় না। এটা তাদের শাস্তি। এই পরিবেশ তারাই তৈরি করেছেন। আইন অনুযায়ী তাদের বিচার হওয়া উচিত।
আইনজীবীদের ওপর হামলা-মামলা
সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগ সমর্থক অনেক সুপরিচিত আইনজীবী আত্মগোপনে চলে গেছেন। আবার কেউ কেউ হামলার ভয়ে নিজ দলের গ্রেপ্তার নেতাদের পক্ষে আদালতে দাঁড়াবার সাহস পাননি। অনেক আইনজীবী আদালত প্রাঙ্গণে হামলার শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া একাধিক মামলার আসামিও হয়েছেন অনেকে।
গত ২২ অক্টোবর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের সামনে সাবেক স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনের পক্ষে শুনানি শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন আইনজীবী মোরশেদ হোসেন শাহীন। হঠাৎ বিএনপিপন্থি এক আইনজীবী এসে মোরশেদের মাথায় আঘাত করেন। এর কিছুক্ষণ পর তিনি যখন আবার কথা বলছিলেন, তখন আরেক আইনজীবী মোরশেদের সামনে গিয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে জোর করে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে বের করে দেন। মোরশেদের ওপর হামলার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
এ ছাড়া অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতাদের পক্ষে সিএমএম আদালতে দাঁড়িয়ে হামলার শিকার হন আইনজীবী শেখ ফরিদও। গত ১৭ অক্টোবর ফরিদ সিএমএম আদালত ভবন থেকে বের হওয়ার সময় বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা তাকে মারধর করেন, লাথি ও ঘুষি মারেন।
হামলার বিষয়ে আইনজীবী মোরশেদ হোসেন শাহীন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আদালত প্রাঙ্গণে আমিসহ শেখ ফরিদ ও গত বৃহস্পতিবার স্বপন চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজন আইনজীবী হামলার শিকার হয়েছেন। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমার ওপর হামলা করেছেন একজন আইনজীবী।’
তিনি বলেন, ‘আমরা একে অপরের ভাই। আমাদের সবারই বার কাউন্সিলের আইন-কানুন মেনে চলতে হবে। একজন আইনজীবী হয়ে অন্য আইনজীবীর ওপর হামলা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সরকার পতনের পর হামলা-মামলা ও চেম্বার ভাঙচুরের কারণে অনেকে এখন আদালতে যাচ্ছেন না। তিনি আইনজীবীদের নিরাপত্তার বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে সরকার ও বার কাউন্সিলের প্রতি জোর দাবি জানান।
এসব হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। এ বিষয়ে বিএনপিপন্থি আইনজীবী ওমর ফারুখ ফারুকী (পাবলিক প্রসিকিউটর) খবরের কাগজকে বলেন, ‘গত ৪ আগস্ট আমার চেম্বারসহ প্রায় ১০টি চেম্বার ভাঙচুর করা হয়। এ ছাড়া আওয়ামী আইনজীবীরা কোর্টে আসছেন না এটি সত্য নয়।’
ছাত্র আন্দোলনে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানার আজমপুরে রাইদা পরিবহনের চালক আলমগীর হোসেনকে (৩৪) মাথায় গুলি করে হত্যার অভিযোগে অ্যাডভোকেট মমতাজ উদ্দিন মেহেদীকে গতকাল কোর্টে তোলা হয়। তিনি বলেন, মেহেদির জন্য প্রায় ২০০ আইনজীবী ছিলেন কোর্টে। তারা কোর্টে আসছেন না, হামলার শিকার হচ্ছেন, এটি মিথ্যা। ঘৃণা থেকে সাধারণ মানুষ তাদের ওপর ডিম নিক্ষেপ ও হামলা করেছেন, বিএনপির কেউ এর সঙ্গে জড়িত নন।
আসামিদের ওপর হামলা
গত ১৪ আগস্ট একটি হত্যা মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজির করা হয়। ওই দুজনকেও ডিম নিক্ষেপ করা হয়।
গত ৭ অক্টোবর ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণে আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর ওপর হামলা হয়। সিএমএম আদালতের লকআপে নেওয়ার সময় সাবেরকে অন্তত তিনজন ঘুষি মারেন। তাকেও ডিম ছোড়া হয়। এ সময় বেশ কয়েকজন পুলিশকে হামলাকারীদের ঠেলে সরিয়ে দিতে দেখা গেছে।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে গত ২৪ আগস্ট সিলেটের আদালতে হাজির করা হয়। তিনি পুলিশের গাড়ি থেকে নামার সময় একদল লোক তার মাথায় আঘাত করেন এবং কেউ কেউ তার দিকে জুতা ছুড়ে মারেন। তাকে মারধর করা হয় এবং তার সুরক্ষায় পুলিশের দেওয়া হেলমেটও খুলে ফেলা হয়।
আইন অনুযায়ী হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের নিরাপত্তা দেওয়া পুলিশের দায়িত্ব। পুলিশ রেগুলেশনের ৩২৮ (ক) ধারায় বলা হয়েছে, থানা বা ফাঁড়িতে আনা সব বন্দির নিরাপদ হেফাজতের জন্য থানা বা ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দায়ী থাকবেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (প্রসিকিউশন বিভাগ) তারেক জুবায়ের বলেন, ‘কোর্ট পুলিশের সদস্যরা নিরস্ত্র হওয়ায় তারা আদালত প্রাঙ্গণে মানবঢাল তৈরি করে আসামিদের নিরাপত্তা দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া আইনজীবীদের নিরাপত্তা থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয় দেখভাল করেন বার কাউন্সিল। এ ছাড়া কোনো অভিযোগ পেলে আমরা তা রাষ্ট্রপক্ষকে জানাই। তারাও ব্যবস্থা নেয়।’
তিনি বলেন, আদালতে ভিআইপিসহ অন্য আসামিদের বিশেষ নিরাপত্তার জন্য বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন থাকে। এ ছাড়া তাদের হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটও পরিয়ে দেওয়া হয়।