পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) প্রকল্পে আর জমি দিতে চান না নীলফামারীর জলঢাকা ও ডিমলা উপজেলার মানুষ। এ কারণে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বুড়ি তিস্তা রিজার্ভার পুনর্খনন প্রকল্পের কাজ। ২০২২ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্প চলতি বছরের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল।
তবে কাজ হয়েছে মাত্র ৭ শতাংশ। ফলে প্রকল্পের মেয়াদ আরও দুই বছর বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে পাউবো।
এ বিষয়ে পাউবোর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. জুলফিকার রহমান বলেন, ‘জলঢাকা ও ডিমলা উপজেলার সীমায় ১ হাজার ২১৭ একরের মধ্যে ৬৬৭ একর পুনর্খননে ২০২২ সালের এপ্রিলে ৯৮ কোটি টাকায় নিয়োগ করা হয় ঠিকাদার। কিন্তু এলাকাবাসীর বিক্ষোভের মুখে মে মাসেই বন্ধ হয়ে যায় খননকাজ। এ সময় পুড়িয়ে দেওয়া হয় এক্সক্যাভেটর। মারধর করা হয় নিরাপত্তা কর্মীদের। এ ছাড়া হামলার শিকার হয়েছেন পাউবোর কর্মকর্তাসহ অনেকে।’
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, ভারত-বাংলাদেশের অভিন্ন নদী তিস্তা। পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করা তিস্তা নদীর ৬৯ কিলোমিটারের পানিপ্রবাহ কাজে লাগাতে ১৯৬০ সালে শুরু হয় ‘বুড়ি তিস্তা সেচ প্রকল্প’ বাস্তবায়ন কাজ। দেশের প্রথম এ সেচ প্রকল্পের কাজ শেষ হয় ১৯৬৭ সালে। এই বুড়ি তিস্তা সেচ প্রকল্পেরই অংশ ‘বুড়ি তিস্তা রিজার্ভার’।
এলাকাবাসী জানান, পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এলাকায় চাষাবাদ সহজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রায় ৬০ বছর আগে এ প্রকল্প বস্তবায়ন করা হয়। সে সময় প্রকল্পের কথা বলে তাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে জমিও নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু তারা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেচের পানি নিশ্চিত করতে পারেনি। এ অবস্থায় এলাকাবাসী পানি উন্নয়ন বোর্ডকে আর নতুন করে জমি দিতে রাজি নন।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, প্রস্তাবিত প্রকল্পের জন্য যে জমি নেওয়া হচ্ছে, তা সরকারি। কিন্তু এলাকাবাসীর দাবি, ‘যেসব জমি নেওয়া হচ্ছে তা ব্যক্তিমালিকাধীন। মালিকানা প্রমাণ করার মতো কাগজপত্রও আছে তাদের কাছে।’ এ নিয়ে দুই পক্ষের বিতর্ক। এর জেরে ধরে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে। এরপর সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে পাউবো ১০টি মামলা করেছে। এতে প্রকল্প এলাকার অন্তত ৯০০ মানুষকে আসামি করা হয়।
অন্যদিকে এলাকাবাসী পাউবোর বিরুদ্ধে নিম্ন আদালতের পাশাপাশি গেছেন উচ্চ আদালতেও। এ হামলা-মামলার কারণে এলাকাবাসী ও পানি উন্নয়ন বোর্ড এখন মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছেন। পাউবোর কর্মকর্তারা এখন প্রকল্প এলাকায় যেতে পারছেন না।
পাউবোর দাবি, মূলত কয়েকজন জনপ্রতিনিধিসহ এলাকার ২১৮ জন দখলদার প্রকল্পভুক্ত সরকারি জমি তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতেই সহজ-সরল মানুষকে ভুল বুঝিয়েছে।
এদিকে এলাকার মানুষের দাবি, এসব জমির খারিজ ও খাজনার রসিদসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তাদের কাছে আছে।
এ প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আতিকুর রহমান বলেন, ‘সফলভাবে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হলে এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হবে। বছরে প্রায় ২৬ হাজার টন ফসল উৎপাদন করা যাবে। যার মূল্য প্রায় ৭২ কোটি টাকা।
এ ছাড়া পানির গ্রাভিটি ইরিগেশন ১২ কোটি টাকার ফসল বেশি দেবে। এ ছাড়া জলাধার থেকে পাওয়া যাবে অতিরিক্ত মাছ। সেচের কাজে প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ টাকার জ্বালানি সাশ্রয় হবে। সার বাবদ খরচ কমবে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এতে সাশ্রয় হবে প্রায় সাড়ে ১৫ কোটি টাকা। শুধু তা-ই নয়, এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহারও কমবে।’
তিনি দাবি করেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হলে সড়ক যোগযোগ উন্নত হবে। কারণ এ প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হবে ৯টি ব্রিজসহ বেশ কিছু পাকা অবকাঠামো।
মো. নাছির উদ্দিন নামের ডিমলা উপজেলার শালহাটি গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, ‘এ প্রকল্পে আমার বাপ-দাদার ১৮ বিঘা জমি গেছে। তাতে নির্মাণ করা হয়েছে ৬টি গেট। কিন্তু এতে আমার কী উপকার হয়েছে?’
এ প্রকল্প বাস্তবায়নে বিরোধিতা করা একই উপজেলার সদরহাটা এলাকার মহির উদ্দিনের ছেলে মো. তৈহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আগে এ প্রকল্পে বাপ-দাদার ৩০ বিঘা জমি গেছে। কিন্তু তাতে আমাদের এলাকার তেমন কোনো লাভ হয়নি। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড আজও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেচ সুবিধা দিতে পারেনি। তারা এখন আবার জমি চাচ্ছে। আমরা তা দেব না।’
কিন্তু পাউবোর দাবি, প্রকল্প এলাকার বেশির ভাগ জমিই সরকারি এবং গত বছর পর্যন্ত তারা খাজনা দিয়েছে। ডিমলার কুঠির ডাঙ্গা গ্রামের মো. রজব আলীর ছেলে মো. জাহিদুল ইসলাম। তিনি দাবি করেন, প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকায় পাউবোর জায়গা আছে মাত্র ১০০ দশমিক ২৪ একর। অথচ পানি উন্নয়ন বোর্ড দাবি করছে ১ হাজার ২৬০ একর জায়গাই তাদের।
জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘তারা যে জায়গা দাবি করছে, সেসব জায়গা আমাদের বাপ-দাদার, কিছুদিন আগেও আমরা সরকারকে খাজনা দিয়েছি কিন্তু তারা হুকুম দখলের প্রস্তুতি নেওয়ার পর ‘লাল পতাকা’ লাগিয়ে দিলে ভূমি অফিস আমাদের খাজনা নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।’
এলাকার মানুষের অভিযোগ, তাদের বিরুদ্ধে পানি উন্নয়ন বোর্ড যেসব মামলা দিয়েছে সেগুলো হয়রানিমূলক। এসব মামলা প্রত্যাহারের দাবি তাদের একই সঙ্গে তারা ফিরে পেতে চান পূর্বপুরুষদের জমি।