ডা. জাকিয়া ইসলাম জ্যোতি। তার বাবা অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম ওরফে ভিপি জোয়াহের টাঙ্গাইল-৮ (সখিপুর-বাসাইল) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও তিনি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জোয়াহের। তিনি এমপি হওয়ার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তার বড় মেয়ে জাকিয়াকে।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বাবা এমপি হওয়ার পরই জাকিয়া চলে আসেন সখিপুরে। ক্ষমতার প্রভাব খাটাতে শুরু করেন। এর আগে কখনো তাকে সখিপুর ও বাসাইলে তেমন একটা দেখা যায়নি। ধীরে ধীরে টেন্ডারবাজি ও পদ-বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন। একসময় স্থানীয় কলকারখানা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে শুরু করেন চাঁদাবাজি। দলীয় অনুষ্ঠানে অতিথি হতে থাকেন। চিকিৎসক হওয়ার সুবাদে সখিপুরের চিকিৎসকদের নেতা বনে যান। বাবার প্রশ্রয়ে সখিপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগে খবরদারি শুরু করেন। বাসাইলে নদী থেকে বালু তুলে বিক্রি ও সখিপুর বনে পাহাড় কাটার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
বাবার ক্ষমতার কারণে জাকিয়া ইসলাম জ্যোতি জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হন। কেবল তাই নয়, সখিপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য, টাঙ্গাইল জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সখিপুর উপজেলা ডক্টরস অ্যান্ড মেডিকেল স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদও বাগিয়ে নেন তিনি। এসব ক্ষেত্রে বাবা ভিপি জোয়াহের তাকে সহযোগিতা করেন।
অভিযোগ রয়েছে, জ্যোতি বিভিন্ন সময় দলবল নিয়ে সখিপুর ও বাসাইলের বিভিন্ন অফিসে চাঁদাবাজি করতে যেতেন। লোকজন নিয়ে পিকনিকের নাম করে বিশাল চাঁদাবাজি করে বেড়াতেন বলেও কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন। বাসাইল উপজেলা পরিষদের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কক্সবাজার যাওয়ার কথা বলে তার অফিস থেকে প্রায় ৫০ হাজার টাকা নিয়েছেন জাকিয়া। টাকা না দিলে বদলির হুঁশিয়ারিও দেন। কী করবে এমপি সাহেবের মেয়ে বলে কথা। না দিয়ে উপায় ছিল না।’
সখিপুরের হাতিবান্ধার মজনু মিয়া খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের এলাকায় মাঝে মাঝে এমপি সাহেবের মেয়ে আসতেন দলবল নিয়ে। তিনি এসেই বলতেন বনের গাছ কাটার সময় কেউ যদি বাধা দেন, তাহলে তাকে দেখে নেওয়া হবে। আমরা ভয়ে প্রতিবাদ করতে পারি নাই।’
২০২৩ সালের মে মাসে বাসাইলে তিন ফসলি জমি বিনষ্ট করে লেক ভিউ নামে একটি রিসোর্ট নির্মাণকে কেন্দ্র করে এমপি ভিপি জোয়াহের ও বাসাইল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী অলিদ ইসলামের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নেয়। এরপর কাজী অলিদ ইসলাম জোয়াহেরের বিরুদ্ধে বাসাইল উপজেলা পরিষদের হলরুমে ৮ মে সংবাদ সম্মেলন করেন।
তিনি অভিযোগ করেন, তিন ফসলি জমি বিনষ্ট করে ‘লেক ভিউ’ নামে একটি ভুয়া প্রকল্পের বিরোধিতা করায় তার ওপর হামলা হলে এমপি অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিয়ার রহমান গাউস, সাধারণ সম্পাদক মির্জা রাজিক, উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি কাজী শহিদুল ইসলাম এবং বাদল এন্টারপ্রাইজের বাদল মিয়া দায়ী থাকবেন। তিনি বলেন, লেক ভিউ প্রকল্পের নামে বাসাইলের তিন ফসলি জমির মাটি কেটে বিক্রি করতে দেওয়া হবে না। তথাকথিত লেক ভিউ প্রতিষ্ঠায় কাশিল ইউনিয়নের সায়ের মৌজার শতাধিক একর জমির মাটি ২০-৩০ ফুট গভীর করে কেটেছেন এমপিকন্যা।
তিনি আরও অভিযোগ করেন, মাটিবাহী ২৫-৩০ টনের ড্রাম ট্রাকের চাকায় গ্রামীণ সড়ক বিনষ্ট হচ্ছে। লেক ভিউ নামক প্রকল্পের কাজের উদ্বোধন করেছেন এমপি অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম। ভূমি ব্যবস্থাপনা আইন ও প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট ঘোষণা উপেক্ষা করে কীভাবে এমপি তিন ফসলি জমির মাটি কাটার কাজ উদ্বোধন করলেন- প্রশ্ন রাখেন তিনি। সংবাদ সম্মেলনে কাজী অলিদ ইসলাম জানান, তিনি উপজেলা ও জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় একাধিকবার বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। তবে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে তিন লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
শুধু লেক ভিউ না, বাসাইলের বাথুলীতে ঝিনাই নদী থেকে বালু উত্তোলন করে কাশিল এলাকায় চায়না কোম্পানির জন্য মাটি ভরাট করার প্রকল্প হাতে নেন এমপিকন্যা জাকিয়া। বালু উত্তোলনের ওই জায়গা থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেন জাকিয়া। তার সহযোগী হিসেবে কাজ করেন ওই এলাকার কাজী বাদল নামে একজন। কাজী বাদল বিভিন্নজনের কাছ থেকে জমি দখল করে চায়না কোম্পানির কাছে হস্তান্তর ও বালু কেটে ভরাট করেন।
কাশিল এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, ‘এখনো জাকিয়া ও বাদল বাহিনীর সদস্যদের নাম বলতে মানুষ ভয় পায়। তাদের অত্যাচারে এলাকায় থাকতে পারি নাই। আমরা এখনো আতঙ্কে থাকি। আমাদের বাড়িঘরের ওপর দিয়ে ড্রেজারের পাইপ নিয়ে বাড়িঘর ধ্বংস করে ফেলছে। আবাদি জমির ওপর দিয়ে পাইপ নেওয়ার ফলে ফসল ফলেনি। নদীর পাড়ে যাদের বাড়ি তাদের বাড়ি তো নদীতে চলেই গেছে। এখন তাদের হাত থেকে আমরা মুক্তি চাই।’
সখিপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শওকত সিকদার খবরের কাগজকে বলেন, ‘জ্যোতি নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করতেন তাতে মনে হতো তিনি নিজেই সখিপুরের এমপি। এক কথায় সর্বমহলের ক্ষমতাবান ছিলেন তিনি। এমপি জোয়াহের সখিপুর-বাসাইলে বেশি আসতেন না। তবে তার মেয়েকে দিয়েই সব কাজ করাতেন। রাস্তা উদ্বোধন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি কাজেও মেয়ে উপস্থিত থাকতেন। এটি নিয়ে আমাদের আপত্তির কথা বারবার ঊর্ধ্বতন নেতা-কর্মীদের বলেছি। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি।’
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ফরহাদ ইকবাল বলেন, তখন তো তার বাবা ছিলেন এমপি ও ক্ষমতাসীন দলের জেলার সাধারণ সম্পাদক। যার ফলে তার ক্ষমতার দাপট সবাই দেখেছে। বলা যায় যে এই জ্যোতিই এমপি ছিলেন। তবে ৫ আগষ্টের পর তাদের আর দেখা যায়নি।
এ বিষয়ে সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম ওরফে ভিপি জোয়াহের ও তার বড় মেয়ে জাকিয়া ইসলাম জ্যোতির সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। গত ৪ আগস্ট দুপুরে টাঙ্গাইল বিবেকানন্দ স্কুল ও কলেজের ছাদের ওপর থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে গুলি ছোড়েন এমপি জোয়াহেরের লোকজন। এরপর স্কুলের ভেতরে থাকা এমপির গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ওই ঘটনার পর থেকে তাদের আর টাঙ্গাইলে দেখা যায়নি।