ঢাকা ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪

বাবা এমপি, প্রভাব খাটাতেন মেয়ে জ্যোতি

প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১:০৫ এএম
আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১:২০ এএম
বাবা এমপি, প্রভাব খাটাতেন মেয়ে জ্যোতি
ডা. জাকিয়া ইসলাম জ্যোতি ও তার বাবা টাঙ্গাইল-৮ (সখিপুর-বাসাইল) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জোয়াহেরুল ইসলাম

ডা. জাকিয়া ইসলাম জ্যোতি। তার বাবা অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম ওরফে ভিপি জোয়াহের টাঙ্গাইল-৮ (সখিপুর-বাসাইল) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও তিনি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জোয়াহের। তিনি এমপি হওয়ার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তার বড় মেয়ে জাকিয়াকে।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বাবা এমপি হওয়ার পরই জাকিয়া চলে আসেন সখিপুরে। ক্ষমতার প্রভাব খাটাতে শুরু করেন। এর আগে কখনো তাকে সখিপুর ও বাসাইলে তেমন একটা দেখা যায়নি। ধীরে ধীরে টেন্ডারবাজি ও  পদ-বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন। একসময় স্থানীয় কলকারখানা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে শুরু করেন চাঁদাবাজি। দলীয় অনুষ্ঠানে অতিথি হতে থাকেন। চিকিৎসক হওয়ার সুবাদে সখিপুরের চিকিৎসকদের নেতা বনে যান। বাবার প্রশ্রয়ে সখিপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগে খবরদারি শুরু করেন। বাসাইলে নদী থেকে বালু তুলে বিক্রি ও সখিপুর বনে পাহাড় কাটার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

বাবার ক্ষমতার কারণে জাকিয়া ইসলাম জ্যোতি জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হন। কেবল তাই নয়, সখিপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য, টাঙ্গাইল জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সখিপুর উপজেলা ডক্টরস অ্যান্ড মেডিকেল স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদও বাগিয়ে নেন তিনি।  এসব ক্ষেত্রে বাবা ভিপি জোয়াহের তাকে সহযোগিতা করেন। 

অভিযোগ রয়েছে, জ্যোতি বিভিন্ন সময় দলবল নিয়ে সখিপুর ও বাসাইলের বিভিন্ন অফিসে চাঁদাবাজি করতে যেতেন। লোকজন নিয়ে পিকনিকের নাম করে বিশাল চাঁদাবাজি করে বেড়াতেন বলেও কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন। বাসাইল উপজেলা পরিষদের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কক্সবাজার যাওয়ার কথা বলে তার অফিস থেকে প্রায় ৫০ হাজার টাকা নিয়েছেন জাকিয়া। টাকা না দিলে বদলির হুঁশিয়ারিও দেন। কী করবে এমপি সাহেবের মেয়ে বলে কথা। না দিয়ে উপায় ছিল না।’

সখিপুরের হাতিবান্ধার মজনু মিয়া খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের এলাকায় মাঝে মাঝে এমপি সাহেবের মেয়ে আসতেন দলবল নিয়ে। তিনি এসেই বলতেন বনের গাছ কাটার সময় কেউ যদি বাধা দেন, তাহলে তাকে দেখে নেওয়া হবে। আমরা ভয়ে প্রতিবাদ করতে পারি নাই।’

২০২৩ সালের মে মাসে বাসাইলে তিন ফসলি জমি বিনষ্ট করে লেক ভিউ নামে একটি রিসোর্ট নির্মাণকে কেন্দ্র করে এমপি ভিপি জোয়াহের ও বাসাইল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী অলিদ ইসলামের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নেয়। এরপর কাজী অলিদ ইসলাম জোয়াহেরের বিরুদ্ধে বাসাইল উপজেলা পরিষদের হলরুমে ৮ মে সংবাদ সম্মেলন করেন। 

তিনি অভিযোগ করেন, তিন ফসলি জমি বিনষ্ট করে ‘লেক ভিউ’ নামে একটি ভুয়া প্রকল্পের বিরোধিতা করায় তার ওপর হামলা হলে এমপি অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিয়ার রহমান গাউস, সাধারণ সম্পাদক মির্জা রাজিক, উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি কাজী শহিদুল ইসলাম এবং বাদল এন্টারপ্রাইজের বাদল মিয়া দায়ী থাকবেন। তিনি বলেন,  লেক ভিউ প্রকল্পের নামে বাসাইলের তিন ফসলি জমির মাটি কেটে বিক্রি করতে দেওয়া হবে না। তথাকথিত লেক ভিউ প্রতিষ্ঠায় কাশিল ইউনিয়নের সায়ের মৌজার শতাধিক একর জমির মাটি ২০-৩০ ফুট গভীর করে কেটেছেন এমপিকন্যা। 

তিনি আরও অভিযোগ করেন, মাটিবাহী ২৫-৩০ টনের ড্রাম ট্রাকের চাকায় গ্রামীণ সড়ক বিনষ্ট হচ্ছে। লেক ভিউ নামক প্রকল্পের কাজের উদ্বোধন করেছেন এমপি অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম। ভূমি ব্যবস্থাপনা আইন ও প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট ঘোষণা উপেক্ষা করে কীভাবে এমপি তিন ফসলি জমির মাটি কাটার কাজ উদ্বোধন করলেন- প্রশ্ন রাখেন তিনি। সংবাদ সম্মেলনে কাজী অলিদ ইসলাম জানান, তিনি উপজেলা ও জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় একাধিকবার বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। তবে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে তিন লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

শুধু লেক ভিউ না, বাসাইলের বাথুলীতে ঝিনাই নদী থেকে বালু উত্তোলন করে কাশিল এলাকায় চায়না কোম্পানির জন্য মাটি ভরাট করার প্রকল্প হাতে নেন এমপিকন্যা জাকিয়া। বালু উত্তোলনের ওই জায়গা থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেন জাকিয়া। তার সহযোগী হিসেবে কাজ করেন ওই এলাকার কাজী বাদল নামে একজন। কাজী বাদল বিভিন্নজনের কাছ থেকে জমি দখল করে চায়না কোম্পানির কাছে হস্তান্তর ও বালু কেটে ভরাট করেন।

কাশিল এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, ‘এখনো জাকিয়া ও বাদল বাহিনীর সদস্যদের নাম বলতে মানুষ ভয় পায়। তাদের অত্যাচারে এলাকায় থাকতে পারি নাই। আমরা এখনো আতঙ্কে থাকি। আমাদের বাড়িঘরের ওপর দিয়ে ড্রেজারের পাইপ নিয়ে বাড়িঘর ধ্বংস করে ফেলছে। আবাদি জমির ওপর দিয়ে পাইপ নেওয়ার ফলে ফসল ফলেনি। নদীর পাড়ে যাদের বাড়ি তাদের বাড়ি তো নদীতে চলেই গেছে। এখন তাদের হাত থেকে আমরা মুক্তি চাই।’

সখিপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শওকত সিকদার খবরের কাগজকে বলেন, ‘জ্যোতি নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করতেন তাতে মনে হতো তিনি নিজেই সখিপুরের এমপি। এক কথায় সর্বমহলের ক্ষমতাবান ছিলেন তিনি। এমপি জোয়াহের সখিপুর-বাসাইলে বেশি আসতেন না। তবে তার মেয়েকে দিয়েই সব কাজ করাতেন। রাস্তা উদ্বোধন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি কাজেও মেয়ে উপস্থিত থাকতেন। এটি নিয়ে আমাদের আপত্তির কথা বারবার ঊর্ধ্বতন নেতা-কর্মীদের বলেছি। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি।’ 

জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ফরহাদ ইকবাল বলেন, তখন তো তার বাবা ছিলেন এমপি ও ক্ষমতাসীন দলের জেলার সাধারণ সম্পাদক। যার ফলে তার ক্ষমতার দাপট সবাই দেখেছে। বলা যায় যে এই জ্যোতিই এমপি ছিলেন। তবে ৫ আগষ্টের পর তাদের আর দেখা যায়নি। 

এ বিষয়ে সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম ওরফে ভিপি জোয়াহের ও তার বড় মেয়ে জাকিয়া ইসলাম জ্যোতির সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। গত ৪ আগস্ট দুপুরে টাঙ্গাইল বিবেকানন্দ স্কুল ও কলেজের ছাদের ওপর থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে গুলি ছোড়েন এমপি জোয়াহেরের লোকজন। এরপর স্কুলের ভেতরে থাকা এমপির গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ওই ঘটনার পর থেকে তাদের আর টাঙ্গাইলে দেখা যায়নি।

ব্যাটারিচালিত রিকশা মালিকের ব্যবসা, চালকের পেট

প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৩০ পিএম
মালিকের ব্যবসা, চালকের পেট
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

ব্যাটারিচালিত রিকশা বা ইজিবাইক- কারও জন্য বেঁচে থাকার অবলম্বন, কারও কাছে লক্ষ-কোটি টাকার বাণিজ্য। ‘নিয়ন্ত্রণহীন’ এই বাহন ঘিরে এখন নগরবাসীর মধ্যে রয়েছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। লাখ লাখ মানুষের রুটি-রুজির সঙ্গে জড়িয়ে গেলেও তিন চাকার এ বাহনে যেসব সরঞ্জাম ব্যবহৃত হচ্ছে সেগুলো আইনের চোখে অবৈধ। এই বাহনে ব্যবহার করা হয় সিসাযুক্ত বা পাউডার ব্যাটারি (লিড অ্যাসিড ব্যাটারি) এবং বৈদ্যুতিক চার্জিং স্টেশন। এর কোনোটি ব্যবহারের আইনগত বৈধতা নেই। বিআরটিএ বা সিটি করপোরেশন এই বাহনের কোনো লাইসেন্সও দেয় না। ইজিবাইকের বেপরোয়া গতি এবং কাউকে ‘কেয়ার না করার’ বিষয়টি নগরবাসী আর পুলিশের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাহনটি বন্ধের উদ্যোগও সফল হয়নি। 

বিভিন্ন পর্যায়ে আলাপ করে জানা গেছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্থানীয় পুলিশ ও ক্ষমতাধর নেতাদের ম্যানেজ করে ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইকের চলাচল শুরু হয়। প্রথমে তা দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় চলাচল শুরু করলেও পর্যায়ক্রমে তা ঢাকার শহরতলি বা রাজধানীর উপকণ্ঠে দেখা গেছে। এখন অল্প সময়ের ব্যবধানে ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান বা ইজিবাইক রাজধানীর অলিগলি ছাপিয়ে মূল সড়কে দাপটের সঙ্গে চলছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে এটি রাজধানীতে চলাচলের অনুমতি দেওয়ার পর থেকে ব্যাপক হারে বেড়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশার চলাচল। সুযোগটা লুফে নিয়েছেন রিকশা গ্যারেজের মালিক-ব্যবসায়ীরা। কোনো কোনো গ্যারেজ মালিকের দেড় শ থেকে দুই শ পর্যন্ত ব্যাটারিচালিত রিকশা রয়েছে। এগুলো ভাড়ায় চলে। ব্যক্তিমালিকানাধীন অনেক দরিদ্র চালকও তিন চাকার এই গাড়ির আয় দিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, এই বাহনকে এখন আর রুখতেও পারছেন না ট্রাফিক পুলিশ বা দায়িত্বশীলরা। এরই মধ্যে দাবি আদায়ের জন্য আবারও সংঘবদ্ধ কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইক-সংক্রান্ত শ্রমিক সংগঠনগুলো।

যা বলছেন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা
মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করেন পাবনার সাইদুর রহমান। কয়েক দিন আগে বাংলামোটর মোড়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে অবস্থানকালে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘ছয় মাস আগে ঋণ করে ৭০ হাজার টাকা দিয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা কিনেছি। মাঝখানে চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দিলে চিন্তায় পড়ে গেছিলাম। সপ্তাহে ৬ হাজার টাকা কিস্তি, পরিবারের সবার ভরণ-পোষণ- সবকিছু এখন রিকশার চাকার ওপর নির্ভর করে। সামনে কী হবে, তা নিয়ে টেনশনে আছি। আমরা গরিব মানুষ, বয়সও প্রায় ৬০ বছর। এ অবস্থায় প্যাডেলচালিত রিকশা চালানোর মতো শক্তি-সামর্থ্য আমার নেই। সরকার একটা ব্যবস্থা (নীতিমালা) করে দিলে বেঁচে যাই।’

গত মঙ্গলবার রাতে পান্থপথ স্কয়ার হাসপাতালের সামনে কথা হয় ব্যাটারিচালিত আরেক রিকশার চালক সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে। নওগাঁর মান্দা উপজেলার এই চালক থাকেন ঢাকার রায়েরবাজারে। সিরাজুল বলেন, ‘৭০ হাজার টাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা কিনেছি মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকার সরোয়ার মোল্লার গ্যারেজ থেকে। বর্তমানে ওই গ্যারেজে প্রতিদিন ১০০ টাকা চার্জ খরচ দিতে হয়।’ রাতেই বেশি রিকশা চালান তিনি। সব খরচ বাদ দিয়ে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা প্রতিদিন আয় হয়। এভাবেই ‘করে খেতে চান’ তিনি।

অবৈধ বাহন হিসেবে সমস্যায় পড়তে হয় কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এখন তো কেউ কিছু বলে না। আগে লোকাল পুলিশ ও নেতাদের টাকা দিয়ে চলতে হতো। বিনিময়ে একধরনের টোকেন দিত। আপাতত সমস্যা হচ্ছে না। তবে স্থায়ী সমাধানের জন্য নীতিমালা করে আমাদের চলাচলের বৈধতা দিলে ভালো হয়।’

অপর একজন রিকশাচালক আজিজুল ইসলামের বাড়ি গাইবান্ধার পলাশবাড়ী। মঙ্গলবার রাতে পান্থপথ সিগন্যালে আলাপকালে তিনি খবরের কাগজকে জানান, মোহাম্মদপুর স্লুইসগেট এলাকার হারুন মোল্লার গ্যারেজ থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশাটি ভাড়ায় নিয়ে চালাচ্ছেন। আজিজুল বলেন, ‘মূলত গড়ে ছয় মাস গ্রামে থাকি, ছয় মাস ঢাকায় এসে রিকশা চালাই। একবার এলে দুই-তিন সপ্তাহ টানা রিকশা চালিয়ে গ্রামে যাই। দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে এবারে ছেলে এসএসসি পরীক্ষার্থী। তাদের জন্যই মূলত এ কষ্ট করছি। আমি কোনো আন্দোলনের মধ্যে নেই। এ নিয়ে বড় বড় রিকশা গ্যারেজের মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা কাজ করেন।’

যেখানে তৈরি হয় ব্যাটারিচালিত রিকশা
জুরান আলী সিরাজগঞ্জের কাজীপুরের বাসিন্দা। থাকেন ঢাকার রায়েরবাজারে শিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশে জনৈক শুভর গ্যারেজে। গত মঙ্গলবার ওই এলাকায় আলাপকালে জুরান জানান, শুভর গ্যারেজটি মূলত ব্যাটারিচালিত রিকশা তৈরির কারখানা। সেখান থেকে তিনি নিজেও ৬৫ হাজার টাকায় দুই মাস আগে তার রিকশাটি কেনেন। শুভর গ্যারেজে শতাধিক ব্যাটারিচালিত রিকশা আছে। কেবল শুভর গ্যারেজ নয়, রায়েরবাজার, মোহাম্মদপুর, কামরাঙ্গীরচর এলাকায় শত শত এমন রিকশার গ্যারেজ আছে। এসব গ্যারেজেই বর্তমানে তৈরি হচ্ছে ব্যাটারিচালিত রিকশা।

অন্য একজন রিকশাচালক এ প্রসঙ্গে খবরের কাগজকে বলেন, ‘কমলাপুর স্টেডিয়াম এলাকা থেকে আমার ব্যাটারিচালিত রিকশাটি কিনেছি। ওখানে (কমলাপুর স্টেডিয়াম এলাকা) ব্যাটারি দিয়ে রিকশা তৈরি করা হয়। এর বাইরে আরও অনেক জায়গায় এ জাতীয় রিকশা কেনাবেচা হয় বলে শুনছি।’

এদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানীর চারপাশের সব এলাকাতেই এখন ব্যাটারিচালিত রিকশার শত শত গ্যারেজ ও কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানায় অবৈধ বৈদ্যুতিক চার্জিং স্টেশনও স্থাপন করা হয়েছে। এসব রিকশায় ব্যবহৃত হয় ১২-২৪ অ্যাম্পিয়ারের সিসার ব্যাটারি।

যা বলছেন গ্যারেজ মালিক-ব্যবসায়ীরা
মো. জসিম উদ্দিন অর্ধশতাধিক ব্যাটারিচালিত রিকশার মালিক। রাজধানীর দক্ষিণখান থানার আজমপুর কাঁচাবাজারের ৩৭৪ নম্বর বাড়িতে রয়েছে তার রিকশার গ্যারেজ। পাশাপাশি সেখানে গড়ে তুলেছেন ব্যাটারি চার্জ দেওয়ার স্টেশন। জসিম উদ্দিন মুঠোফোনে খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমার গ্যারেজের সামনে কিছুদিন ধরে রাস্তার কাজ চলছে। এ জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য (ভাড়ায় দেওয়া রিকশা) বন্ধ হয়ে আছে। গ্যারেজে চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা আছে, তবে সেটাও রাস্তার কারণে আপাতত বন্ধ।’ এক প্রশ্নে জসিম বলেন, ‘সরকার একটা নীতিমালা করে আমাদের বৈধভাবে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানোর বা ব্যবসা করার সুযোগ করে দিলে সব ঝামেলা মিটে যাবে।’

তুরাগের বাউনিয়া এলাকার অপর একজন গ্যারেজ মালিক মো. আশরাফুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘বর্তমানে আমার ২৯টি ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক আছে। আগে আরও বেশি ছিল। কিছু গরিব মানুষ রিকশা চালিয়ে সংসার চালাচ্ছেন, কাজেই এটা বন্ধ না করে বা জটিলতা সৃষ্টি না করে বিষয়টি মানবিকভাবে দেখা দরকার।’ কারখানা বা চার্জিং স্টেশন আছে কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে আশরাফুল বলেন, ‘হ্যাঁ, আমার গ্যারেজে সব ব্যবস্থা আছে।’

যা বলছেন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা
রিকশা ও ব্যাটারিচালিত ভ্যান-ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় সদস্য জনার্দন দত্ত নান্টু খবরের কাগজকে বলেন, ‘সারা দেশে কতগুলো ব্যাটারিচালিত রিকশা বা ইজিবাইক আছে তার সঠিক পরিসংখ্যান কারও কাছে নেই। তবে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে এ ধরনের তিন চাকার বাহন (রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক) বা এর সঙ্গে জড়িত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় উঠে এসেছিল, প্রতি রিকশার বিপরীতে চালক বা শ্রমিকের সংখ্যা ১ দশমিক ৫ জন। অর্থাৎ একটি রিকশা পালাক্রমে একাধিক ব্যক্তি চালাচ্ছেন।’

বৈধ-অবৈধতার প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ঢাকায় বড় বড় গ্যারেজ বা একক মালিকানায় কারও কারও অনেক রিকশা আছে। এটা তাদের ব্যবসা। তবে অনেকেই আছেন যারা কেবল জীবন-জীবিকা ও সংসার চালাতে ঋণের টাকায় রিকশা কিনে চালাচ্ছেন। এদের সংখ্যাই বেশি। এ রকম পরিস্থিতিতে বাস্তবভিত্তিক নীতিমালা করা হলে সব জটিলতার অবসান হবে।’

একই বিষয়ে রিকশা-ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা আব্দুল্লাহ কাফি রতন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আন্দোলন স্থগিত হওয়ার পর থেকে পুলিশ কমিশনারসহ ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে দুই দফায় আমাদের আলোচনা হয়েছে। কিন্তু পুলিশ যেভাবে বলছে তাতে সমস্যার অবসান হবে না। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ‘ব্যাটারিচালিত রিকশা-ইজিবাইক প্রধান সড়কে উঠতে পারবে না। এই প্রধান সড়ক বলতে তারা বলছেন যে রোডে বাস চলাচল করে সেই সব রাস্তার কথা। কিন্তু ঢাকার প্রায় সব রাস্তায় এখন বাস চলাচল করে। তাহলে সমাধানটা কী হবে? এভাবে বললে সংকট আরও বাড়বে।’

নতুন কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত
রিকশা ও ব্যাটারিচালিত ভ্যান-ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় সদস্য জনার্দন দত্ত নান্টু জানান, ব্যাটারিচালিত রিকশা-ইজিবাইকের চালক বা মালিকদের দাবিগুলো নিয়ে সংগঠনের পক্ষ থেকে নতুন কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৫ থেকে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ‘প্রচারপক্ষ’ পালন করা হবে। এ ছাড়া আগামী ১৮ ডিসেম্বর নানা শ্রেণি-পেশার নাগরিকদের নিয়ে ঢাকায় মতবিনিময়ের আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংখ্যা ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যা বলছে পুলিশ
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) খোন্দকার নজমুল হাসান এ প্রসঙ্গে খবরের কাগজকে বলেন, ‘ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক যা-ই বলি, সবই অবৈধ। অবৈধ বাহন হওয়ায় এর কোনো সংস্থা বা নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান নেই। সঠিক পরিসংখ্যানও নেই। তবে আমরা ধারণা থেকে বলতে পারি, ঢাকা শহর ঘিরে কমবেশি প্রায় তিন লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘ঢাকার চারপাশে বিভিন্ন পয়েন্টে বহুসংখ্যক অবৈধ চার্জিং স্টেশন রয়েছে। আমরা রাস্তার ট্রাফিকব্যবস্থা দেখি, অবৈধ এসব স্টেশন আমাদের আওতায় নেই। অনেক সময় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হলেও সেভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুলিশ কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে- এমন প্রশ্নের উত্তরে খোন্দকার নজমুল হাসান বলেন, ‘আমরা শুধু দেখব প্রধান সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা যাতে না চলে।’

কী কারণে ব্যাটারিচালিত রিকশা অবৈধ
সিসাযুক্ত বা পাউডার ব্যাটারি (লিড অ্যাসিড ব্যাটারি) মূলত এসব রিকশা-ভ্যান বা ইজিবাইকে ব্যবহৃত হয়। এসব ব্যাটারিতে প্রায় ৬০ শতাংশ সিসা থাকে। আগুনে পোড়ানোর সময় সঠিক পদ্ধতি ব্যবহার করা না হলে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতিসাধিত হয়। সিসা পোড়ানোর ফলে অনেক ক্ষেত্রে ক্যানসারের মতো ব্যাধির শঙ্কা তৈরি হয়। এ ছাড়া খোলা জায়গায় সিসা পোড়ানো এবং নাড়াচাড়া করার ফলে দ্রুত পরিবেশের সঙ্গে মিশে গিয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়।

পরিবেশের এই ঝুঁকির কারণে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সিসাযুক্ত ব্যাটারি বা পাউডার ব্যাটারি পরিত্যাজ্য বস্তু বলে ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ব্যাটারি ভাঙা বা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে সিসা প্রক্রিয়াজাত করতে পারবে না।

উল্লেখ্য, রাজধানীর সব সড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চলাচল তিন দিনের মধ্যে বন্ধ বা বিধিনিষেধ আরোপ করতে গত ১৯ নভেম্বর নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এর পরই বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাছ থেকে লাইসেন্স নেওয়াসহ ১১ দাবিতে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে অবস্থান নেন ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকরা। আন্দোলনে পরিস্থিতি বেগতিক হলে চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা এক মাসের জন্য স্থগিত করা হয়।

নীতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের, আদায়ে এনবিআর

প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:০৮ এএম
আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৩৭ এএম
নীতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের, আদায়ে এনবিআর
অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআর

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নীতিপর্যায়ে বড় পরিবর্তন আনা হতে পারে। এতে রাজস্বনীতি প্রণয়ন এবং আদায় কার্যক্রম আলাদা থাকবে। 

এনবিআরকে গতিশীল করতে যে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার, এটি তারই উদ্যোগ। এই উদ্যোগ কীভাবে কার্যকর করা হবে, তা নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্টরা কাজ শুরু করেছেন। 

৫২ বছর ধরে রাজস্ব খাতের নীতি প্রণয়নের পাশাপাশি রাজস্ব আদায়সংক্রান্ত কার্যক্রমও এনবিআর পরিচালনা করে আসছে।

এনবিআরের একটি সূত্র জানায়, রাজস্ব আদায়সংক্রান্ত কার্যক্রম এনবিআরের ওপর থাকলেও রাজস্বনীতি প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে অর্থ মন্ত্রণালয়কে। 

রাজস্ব বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, একই প্রতিষ্ঠান নীতি প্রণয়ন ও রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে থাকলে রাজস্ব খাতে দুর্নীতি করার সুযোগ তৈরি হয়। তারা আরও বলেন, অনেক সময় রাজস্ব আদায় বাড়ানোর স্বার্থে এনবিআর-সংশ্লিষ্টরা করদাতা ও ব্যবসায়ীদের সক্ষমতার কথা না ভেবেই নীতি প্রণয়ন করে থাকেন। এতে করদাতাদের ভোগান্তি বাড়ে।

অতীতে দেখা গেছে, এনবিআরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা প্রভাবশালীদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে সুবিধামতো নীতি প্রণয়ন করেছেন। রাজনৈতিক প্রভাবে রাজস্ব অব্যাহতি দিয়েছেন। এতে ব্যক্তিবিশেষ সুবিধা পেলেও সরকারের রাজস্ব আদায় কমেছে। 

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে এনবিআরের সদস্য (আয়কর নীতি) এ কে এম বদিউল আলম খবরের কাগজকে বলেন, রাজস্ব আদায়সংক্রান্ত কার্যক্রম এবং নীতি- দুটিই এনবিআর পরিচালনা করে থাকে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংক রাজস্বনীতি প্রণয়ন এবং রাজস্ব আদায়ের কাজ আলাদা করার পরামর্শ দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, রাজস্বনীতি প্রণয়ন এবং রাজস্ব আদায় কে বা কারা করবে, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। বিষয়টি নিয়ে একটি রূপরেখা প্রণয়ন করা হবে, সে অনুযায়ী সংস্কার করা হবে। 

রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর ৭৬-এর ভিত্তিতে ১৯৭২ সালে এনবিআর প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরু থেকেই সংস্থাটির মূল কাজ ছিল মূল্য সংযোজন কর (মূসক), আয়কর ও আমদানি শুল্ক আরোপ, আদায় এবং এ-সংক্রান্ত নীতি প্রণয়ন করা। 

আইএমএফের যুক্তি হচ্ছে, রক্ষক ভক্ষক হতে পারে না। যে সংস্থা নীতি প্রণয়ন করবে, সেই সংস্থাকে আদায়ের দায়িত্ব দিলে সেখানে দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়। তখন থেকে এনবিআরের নীতি বিভাগ ও আদায় বিভাগ আলাদা করার পরামর্শ দিয়ে আসছিল আইএমএফ। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সময়ে এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হলেও বেশি দূর এগোয়নি। এখন নতুন করে এই আলোচনা উঠে এসেছে। 

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আইএমএফের চলমান ৪৭০ কোটি ঋণ কর্মসূচির মধ্যে যেসব শর্ত আছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে এনবিআরের নীতি বিভাগ ও আদায় বিভাগ আলাদা করা। সরকার এখন সেই শর্তটি প্রতিপালন করতে যাচ্ছে। 

এনবিআরের সাবেক সদস্য আমিনুল করিম খবরের কাগজকে বলেন, এর আগেও রাজস্বনীতি ও আদায় আলাদা করার বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে উদ্যোগটি থেমে যায়। 

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আমাদের দেশে প্রতিবছর বড় আকারের ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন করা হয়। বাজেটের হিসাব মেলাতে এনবিআরের ওপর বড় অঙ্কের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা চাপিয়ে দেওয়া হয়। এনবিআর অনেকটা নিরুপায় হয়ে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে গিয়ে আদায় বাড়াতে রাজস্বনীতি প্রণয়ন করে থাকে। অর্থনীতি ও সাধারণের ওপর এর কী প্রভাব পড়ল, তা নিয়ে এনবিআর অতটা চিন্তা করে না। যতটা রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে তৎপর থাকে। 

দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু খবরের কাগজকে বলেন, রাজস্বনীতি প্রণয়নের আগে অবশ্যই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতির ওপর কী প্রভাব পড়বে তা খতিয়ে দেখতে হবে। সাধারণ মানুষের ওপর কী প্রভাব পড়বে, তাও গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। সবার জন্য স্বস্তিদায়ক নীতি প্রণয়ন করা হলে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে আদায় বাড়বে। 

তিনি আরও বলেন, কিন্তু আদায় বাড়ানোকে গুরুত্ব দিয়ে নীতি প্রণয়ন করা হলে সবার জন্য স্বস্তিদায়ক নাও হতে পারে। ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি না এলে রাজস্ব পরিশোধ কীভাবে হবে। এনবিআর আদায় বাড়ানোর দায়িত্বে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি নীতি প্রণয়নের চেয়ে আদায় করার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেবে এটাই স্বাভাবিক। 

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি এম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়কে গোটা অর্থনীতি নিয়ে চিন্তা করতে হয়। তাই আদায় বাড়ানোর পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার বিষয়টিও সমান গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় রাখতে হয়। নীতি প্রণয়নের দায়িত্ব এনবিআর থেকে আলাদা প্রতিষ্ঠানের ওপর থাকলে অর্থনীতির জন্য খারাপ হবে না।

তার মতে, দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যকলাপের ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্য সরকার রাজস্বনীতির ব্যবহার করে থাকে। ফলে অর্থনীতিতে রাজস্বনীতির গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। তাই আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান থেকে নীতি প্রণয়ন করলে ভালো ফল আসবে বলে মনে করি। 

আইএমএফের মতে, এনবিআরের নীতি বিভাগ ও আদায় বিভাগ আলাদা করলে রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আসবে। নীতি বিভাগকে এনবিআর থেকে আলাদা করে তা অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওপর ন্যস্ত করা যেতে পারে।

গতি ফিরছে প্রশাসনে

প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৫ এএম
আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৫ এএম
গতি ফিরছে প্রশাসনে
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের চার মাস পর এখন প্রশাসনে গতি ফিরতে শুরু করেছে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের পাশাপাশি প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আইন অনুযায়ী কর্মসম্পাদনের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তবে অধস্তনদের অনেকেই এখনো নির্ভার হতে পারছেন না। সচিবালয়ের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই প্রশাসনে শুরু হয় শুদ্ধি অভিযান। সাবেক সরকারের ‘অপকর্মের’ সহযোগী শীর্ষ কর্তাদের অনেককেই বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। গত সরকারের শেষ সময়ে মাঠ প্রশাসনে জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের উঠিয়ে এনে কম গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হয়েছে। তা ছাড়া সচিবালয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে কর্মরত বেশ কিছু কর্মকর্তার দপ্তর বদল করা হয়েছে।

এদিকে গত সরকারের আমলে বঞ্চিত অনেক কর্মকর্তাকে এবার পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও হচ্ছে। এক পক্ষ পদোন্নতি পাওয়ায় অন্য পক্ষে অসন্তোষ রয়েছে। কর্মকর্তাদের মধ্যে একধরনের নীরবতা রয়েছে, চেনাজানা অনেকেই এখন আর খোলামেলা কথাবার্তা বলছেন না। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা ও মেলামেশা কমিয়ে দিয়েছেন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গত ৮ আগস্ট ক্ষমতায় আসে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। এদিন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের ১৭ সদস্যবিশিষ্ট উপদেষ্টা পরিষদ সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে।

দায়িত্ব নেওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও প্রশাসনে কাজের গতি ফেরানোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয় সরকার। প্রাথমিকভাবে সরকারের নীতি বা কর্মপদ্ধতি কেমন হবে তা নিয়ে সারা দেশে প্রশাসন স্থবিরতা শুরু হয়। সেই সময়ে প্রশাসনের কেন্দ্র সচিবালয়কে ঘিরে শুরু হয় নানা পক্ষের দাবি-দাওয়া ও দাবি আদায়ের আন্দোলন। বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা সচিবালয় ঘেরাও এবং অবরুদ্ধ কর্মসূচিও পালন করেন। দাবি আদায়ে অসহিষ্ণু আচরণ করায় গ্রেপ্তার হয়েছেন শতাধিক বিক্ষুব্ধ কর্মচারীসহ বেশ কিছু শিক্ষার্থী। এখন ক্রমান্বয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম তিন মাসের কার্যক্রমসংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী এই সময়ে (আগস্ট-অক্টোবর) সিনিয়র সচিব ও সচিব পদে ১২ জন, অতিরিক্ত সচিব পদে ১৩৫, যুগ্ম সচিব পদে ২২৬, উপসচিব পদে ১২৫, অন্যান্য ক্যাডারে ২২১ এবং নন-ক্যাডারে সিনিয়র সহকারী সচিব পদে ৯ জন ও সহকারী সচিব পদে ৩৭ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। একই সময়ে সিনিয়র সচিব ও সচিব পদে ৪৩ জন, গ্রেড-১ পদে ১১, অতিরিক্ত সচিব পদে ১৩৭, যুগ্ম সচিব পদে ১৭৩, উপসচিব পদে ৩৯১, বিভাগীয় কমিশনার পদে ৪ এবং অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার পদে ৩ জনকে বদলি করা হয়েছে। তা ছাড়া ৫৯ জেলায় নতুন ডিসি, ১১৮ জন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, ১৬৫ জন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সিনিয়র সহকারী সচিব ও সহকারী সচিব পদে ৪১৪ জন, সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও সহকারী কমিশনার পদে ৮৩ জনসহ মোট ১ হাজার ৮৭০ জনের দপ্তর বদল করার পাশাপাশি ৪ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর, সহকারী সচিব থেকে সিনিয়র সচিব পর্যায় পর্যন্ত ৮০ জন কর্মকর্তাকে ওএসডি এবং ১০১ জন কর্মকর্তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করেছে জনপ্রশাসন।

তবে প্রশাসনের বর্তমান স্থবিরতা নিয়ে সচিবালয়ের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে আলোচনা-সমালোচনা থেমে নেই। আলোচনায় প্রায়ই উঠে আসছে সাবেক সরকারের মদদপুষ্ট প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তার দুষ্কর্ম। 

এদিকে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, প্রশাসনে যেকোনো ধরনের বিভক্তি ও রেষারেশি বাড়লে নোংরা রাজনীতি শুরু হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় সরকার বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব জানান, সম্প্রতি একটি সরকারের হঠাৎ পরিবর্তনে প্রশাসনসহ সব ক্ষেত্রেই একটা অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা, আতঙ্ক কাজ করছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কাজের গতি কম হবে। কারণ পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়ায় কাজের পরিবেশেরও অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। তা ছাড়া নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর স্বভাবতই গত সরকারের অনেক সিদ্ধান্ত, পরিকল্পনা বুঝতে কিছুটা সময় নিচ্ছে প্রশাসন। এ কারণে এই বিভাগে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত এখন নেই। কিন্তু স্বাভাবিক রুটিন কাজে কোনো ব্যাঘাত হচ্ছে না। তাই ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে প্রশাসনের কর্মকাণ্ড।

সংলাপকে সফল দেখছে সব পক্ষ

প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৪৫ এএম
আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৫৩ পিএম
সংলাপকে সফল দেখছে সব পক্ষ
প্রতীকী ছবি

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপকে সফল মনে করছে রাজনৈতিক দলগুলো। ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে গত সোমবার হামলা করেন দেশটির হিন্দুত্ববাদী একটি সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এই ঘটনার পর সারা দেশের মানুষ ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টা বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ ৪০টির বেশি রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন ধর্মের ৩২ জন প্রতিনিধির সঙ্গে সংলাপে বসেন।

বুধ ও বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত সংলাপের উদ্দেশ্য ও সফলতা নিয়ে নানা মহলে আলোচনা চলছে। সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে- জাতীয় ঐক্যের আহ্বানে এই সংলাপ শতভাগ সফল হয়েছে। আর সংলাপকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে রাজনৈতিক দলগুলো। তাদের মতে, ৫ আগস্টের পর সংলাপের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে মেসেজ দেওয়া গেছে যে ছাত্র-জনতার ঐক্যে কোনো যড়যন্ত্র করে চিড় ধরানো যাবে না। প্রতিবেশী ভারতের আগ্রাসন, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে অনমনীয় জাতীয় ঐক্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এবারের সংলাপে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে মৌলিকে সংস্কারের পর দ্রুত নির্বাচনের তাগাদা দেওয়া হয়েছে।

সংলাপে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের কয়েকজন শুক্রবার (৬ ডিসেম্বর) খবরের কাগজকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দেশের মানুষ ও বহির্বিশ্বকে দেখাতে সক্ষম হয়েছে- স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনো আপস করবে না বাংলাদেশ। ভারতীয় আগ্রাসন ও মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে প্রত্যেক নাগরিক আজ ঐক্যবদ্ধ। ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিজমের পুনরুত্থানের কোনো ধরনের অপতৎপরতা সফল হতে দেবে না। নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দিকে আগ্রসর হতে দ্রুত রোডম্যাপ ঘোষণা করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তারা।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক পেক্ষাপটসহ নানা সংকটের কারণে প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। বিএনপি সেই জাতীয় ঐক্যে সমর্থন জানিয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে আমরা নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারকাজ শেষ করে অতিদ্রুত নির্বাচন দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছি। কারণ দেশের জনগণ নির্বাচনমুখী হলে দ্রুতই যড়যন্ত্র বন্ধ হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, এই সরকার ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের সরকার। যারা জনগণের মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার এবং রাজনীতিতে বৈষম্য দূর করে গণতান্ত্রিক ধারা প্রবর্তন করবে।

নির্বাচনের রোডম্যাপ কবে নাগাদ পেতে পারেন সে বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা কিছু বলেছেন কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে খন্দকার মোশাররফ বলেন, ‘সংলাপে আমরা আমাদের অভিমত দিয়েছি। সরকার কী করবে, কীভাবে বিবেচনায় নিয়েছে তা এখনই বলা যাবে না। আমরা সরকারের নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার অপেক্ষা আছি। রোডম্যাপের জন্য আমরা আরও কিছু দিন অপেক্ষা করব।’

এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার খবরের কাগজকে বলেন, ‘এই সংলাপের মাধ্যমে আমরা বিশ্বের কাছে মেসেজ দিতে পেরেছি- গত ৫ আগস্টের পর ছাত্র ও জনতার ঐক্যের ভিত্তিতে দেশ চলছে। এখানে কোনো বিভেদ-বিভাজন নেই। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সবাই ঐক্যবদ্ধ। এখানে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করে লাভ হবে না। এই শক্ত মেসেজটাই বিশ্ববাসীর কাছে দিতে সক্ষম হয়েছি।’ 

তিনি বলেন, গত ৫ আগস্টের পর অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই দেশি-বিদেশি নানা শক্তি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। এ ছাড়া এ সময়ে দেশি ও বিদেশি নানা শক্তি ছাত্র-জনতার ঐক্যের মধ্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করে আসছে বলেও অভিযোগ।

প্রধান উপদেষ্টার সহকারী প্রেস সচিব আজাদ মজুমদার খবরের কাগজকে বলেন, ‘এবারের সংলাপ এটাই প্রমাণ করেছে যে, সব সক্রিয় রাজনৈতিক দল জাতীয় ইস্যুতে আক্ষরিক অর্থেই প্রধান উপদেষ্টার পাশে দাঁড়িয়েছে। এবারে আরও প্রমাণ হয়েছে, যেকোনো ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় আমরা জাতীয়ভাবে ঐক‍্যবদ্ধ। সংলাপ সফল হয়েছে।’

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা গণ-অভ্যুত্থানে দেশছাড়া হওয়ার পর ৮ আগস্ট ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। চার মাসের মাথায় এসে সরকার নানা সংকটে পড়েছে। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে অনেকটা বেকায়দায় সরকার। প্রথম থেকেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার জাতীয় ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছে। বিরাজমান সংকট নিরসনে জাতীয় ঐক্য গঠনের লক্ষ্যে ছাত্রনেতা, রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় সংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। মঙ্গলবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বুধবার রাজনৈতিক দল এবং বৃহস্পতিবার ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে বসেন প্রধান উপদেষ্টা। তবে এবারের সংলাপে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া কোনো দলই আমন্ত্রণ পায়নি। আমন্ত্রণ পেয়েও তালিকায় নাম না থাকায় সংলাপে অংশ নিতে পারেননি এলডিপি প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) অলি আহমদ (বীর বিক্রম)। তবে পরদিন বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে কর্নেল অলি বলেন, ‘বর্তমানে ভারতের দালাল হিসেবে আমরা কাউকে কাজ করতে দেব না। আমরা ভারতের বিপক্ষে না, যারা আমাদের সাহায্য-সহযোগিতা করেছে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। তবে বাংলাদেশ নিয়ে কেউ মিথ্যাচার করলে কাউকে ছাড় দেব না।’

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় নেতাদের বৈঠকে বেশ কিছু প্রস্তাব বা পরামর্শ উপস্থাপন করা হয়। এগুলো হলো- বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের দূতাবাসে আগের সরকারের নিয়োগপ্রাপ্তদের সরিয়ে বিপ্লবের পক্ষের শক্তিকে নিয়োগ দেওয়া, গত সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে যেসব চুক্তি হয়েছে তা প্রকাশ করা এবং স্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিল করা; বাংলাদেশ ডে অথবা জাতীয় ঐক্যের প্রতীকী সংহতি দিবস হিসেবে একদিন পতাকা হাতে পালন করা, জাতীয় নিরাপত্তা কমিশন গঠন, আন্তর্জাতিক মহলের প্রোপাগান্ডা প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয়ভাবে পাবলিক রিলেশন সেল গঠন করা এবং বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে প্রকাশ করা, জাতীয় নিরাপত্তা ও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে জাতীয় ঐক্যের সমঝোতা দলিল প্রণয়ন, আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলন করাসহ আরও কয়েকটি প্রস্তাব। সংলাপে উঠে আসা এসব প্রস্তাবের বিষয়ে পদক্ষেপ বা প্ল্যানের ঘোষণা দু-এক দিনের মধ্যে আসতে পারে।

এ বিষয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না খবরের কাগজকে বলেন, ‘সংলাপে দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সবাই পরামর্শ দিয়েছি। কারণ প্রস্তাব দিলে সবাই মিলে লিখিত আকারে দেওয়া হতো। কিন্তু এসব পরামর্শ সরকার ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করবে কি না এটা তাদের বিষয়। সংলাপে সবাই ভারতের আগ্রাসন এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ থাকার ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন।’ 

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) উপদেষ্টা খালেকুজ্জামান খবরের কাগজকে বলেন, ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসক শ্রেণি রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল, উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা ছড়াতে চেয়েছে এই অঞ্চলে। বাংলাদেশকে তারা একটি অঙ্গরাজ্যে পরিণত করতে চেয়েছিল, সেই অভিলাষ তাদের পূরণ হয়নি। ভারতের আগ্রাসন মোকাবিলার পাশাপাশি বাংলাদেশের অভ্যন্তরের সংকট তৈরি হয়েছে, সেই সব সংকট দ্রুত সমাধান করতে প্রতিটি রাজনৈতিক দল এক হয়েছে। এটাই এই সংলাপের সফলতা। 

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ খবরের কাগজকে বলেন, সংলাপে ধর্মীয় নেতাদের বক্তব্যে দেশের সংখ্যালঘুদের আসল চিত্র ফুটে উঠেছে। এর মধ্য দিয়ে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের জুলুম-নির্যাতন নিয়ে ভারতের মিথ্যাচার বন্ধ হবে। জাতীয় ইস্যুতে সব রাজনৈতিক দল এক জায়গায় জড়ো হয়েছে- এটা ইতিবাচক।

আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রথমত জাতীয় ইস্যুতে সব রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়েছে এটা বড় সফলতা। দ্বিতীয়ত, সাধারণত সরকারের ডাকে আগে কখনো একসঙ্গে সবা দল সংলাপে অংশ নেয়নি। দেশের ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দল ও সংগঠন এক- এটা বহির্বিশ্বকে দেখাতে পেরেছি। এটা ইতিবাচক দিক।’

ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের বরফ গলানোই হবে মূল লক্ষ্য

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৩৩ পিএম
আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:০৩ পিএম
ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের বরফ গলানোই হবে মূল লক্ষ্য
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চরম উত্তেজনা ও টানাপোড়েনের মধ্যে অবশেষে আশার আলো দেখা যাচ্ছে। গত কয়েক মাসে সম্পর্কের এই জটিল সমীকরণের মধ্যেই আগামী ৯ ডিসেম্বর ঢাকায় শুরু হচ্ছে দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের নিয়মিত বৈঠক। বৈঠকটি নিয়মিত বলা হলেও উভয় দেশের মধ্যে চলমান উত্তেজনা নিরসনে এই বৈঠক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, কূটনীতিকরা মনে করছেন এই বৈঠকই হবে এ মুহূর্তে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের বরফ গলানোর টার্নিং পয়েন্ট। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। 

সংশ্লিষ্ট কূটনৈতিক সূত্র খবরের কাগজকে জানান, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এবারের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে সম্পর্কের বরফ গলানোই হবে বাংলাদেশের মূল টার্গেট। এ লক্ষ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গত কয়েক মাসে অর্থাৎ ৫ আগস্টের পর দুই দেশের মধ্যে যে ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে, তা নিরসনে সব ধরনের চেষ্টা চালানো হবে। পাশাপাশি এই ভুল-বোঝাবুঝির কারণে যেসব বিষয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগ ও ক্ষোভ রয়েছে, তা ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সামনে বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। পারস্পরিক সমতা ও সম্মানের ভিত্তিতে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরা হবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের আগ্রহ ও উদ্যোগের বিষয়টি পরিষ্কার করা হবে। জানানো হবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে এই সরকার সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে আগ্রহী। গত কয়েক মাসে দিল্লির পক্ষ থেকে যেসব উদ্বেগ রয়েছে, তা নিরসনে আশ্বস্ত করা হবে। 

সূত্র আরও জানায়, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এবারের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠককে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে যাওয়ায় ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে যে জট লেগেছে তা উভয় দেশে গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। উভয় দেশের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উত্তেজনা বেড়েছে। এ কারণে সম্পর্কের এই জট খুলতে বা বরফ গলাতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নানাভাবে চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের অভাবে সেই চেষ্টা সফল হয়নি বরং গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতিবাচক ও উসকানিমূলক প্রচার সরকারি পর্যায়ে সংকট নিরসনে উদ্যোগের পরিবেশ সৃষ্টিকে বাধাগ্রস্ত করেছে। অবশেষে সব বাধা পেছনে ফেলে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে দুই দেশ সম্মত হয়েছে। এই বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির নবায়ন, সীমান্তহত্যা বন্ধ, চোরাচালান প্রতিরোধ, বাণিজ্য সম্প্রসারণসহ দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে আলোচনা হবে বলে জানায় সূত্র। 

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এই বৈঠকে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন দেশটির পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি। বৈঠকে বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধিত্ব করবেন পররাষ্ট্রসচিব জসিম উদ্দিন। 

পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের এই বৈঠকটি ইতিবাচক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে যে বাস্তবতা তৈরি হয়েছে সেটি ভারতকে মেনে নিতে হবে। এই বাস্তবতায় তিক্ততা না বাড়িয়ে কীভাবে লাভবান হতে পারে উভয় দেশ সেদিকে নজর দিতে হবে। দুই দেশের মধ্যে তিক্ততা যত বাড়বে তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো তত উপেক্ষিত হবে এবং তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নেবে। কলকাতায় বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ ও আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে হিন্দু উগ্রপন্থিরা হামলা করেছে, যার প্রভাব সম্পর্কের ক্ষেত্রে পড়েছে। অথচ ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকলে দুই দেশই যে লাভবান হবে, এই বিষয়টি অবশেষে বুঝতে পারায় বৈঠকে সম্মতি জানিয়েছে উভয় পক্ষ। এটাই প্রাথমিক অগ্রগতি। এরপর দুই দেশ বৈঠকে বসলে উভয়ের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝির অবসান হবে। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে পারবে দুই দেশ। 

ঢাকা-দিল্লি পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের এবারের বৈঠককে খুবই ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট ও সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর। তিনি বলেন, পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের যে বৈঠক হতে যাচ্ছে তাতে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা কমতে পারে। উভয় দেশের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে এ ধরনের আলোচনা আরও চলতে থাকলে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আরেকটি বিষয়, ভারত যদি বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট মেনে নিয়ে বৈঠকে যোগ দেয় তাহলে সম্পর্কে গতিসঞ্চার হবে। 

সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বলেছেন, ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে চলমান টানাপোড়েন নিরসনে আসন্ন পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ঢাকা ও দিল্লির পক্ষ থেকে চেষ্টা চালানো হচ্ছে। সম্পর্ক ভালো থাকলে উভয় দেশের স্বার্থ রক্ষিত হবে। বাইরে থেকে নানা ধরনের অপপ্রচার ও উসকানিতে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও বেড়েছে। এখন এসব বাদ দিয়ে আলোচনার টেবিলে ফিরে আসায় উভয় দেশের লাভ হবে। 

আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘এই বৈঠকটি অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল। এ ধরনের বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উত্তেজনা বিষয়ে খোলামেলা আলোচনার সুযোগ রয়েছে। তবে বৈঠকে ভারসাম্য বজায় রেখে আলোচনা হতে হবে, না হলে শুধু একটি দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে কী হয়, তা আমরা দেখেছি।’ দুই দেশের মধ্যে অন্যান্য পর্যায়েও দ্রুত এ ধরনের আলোচনা শুরু করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।