
গত ৬ আগস্ট, বেলা ১টা। রাজধানীর মহাখালীর জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। রেডিওথেরাপির তারিখ নির্ধারণ ও ফলোআপ রোগীদের জন্য ডাক্তারদের বোর্ড মিটিংয়ের রুম। রুমের সামনে দুই পাশের বেঞ্চের কোথাও খালি নেই। রোগী বসিয়ে স্বজনদের অনেকেই দাঁড়িয়ে আছেন। রুমের ভেতর রোগী দেখায় ব্যস্ত চিকিৎসকরা। ভেতরে তখন চারজন রোগী। বাইরে থেকে কেউ কেউ উঠে উঁকি দিচ্ছেন ডাক্তারদের রুমে।
কেউ গিয়ে জিজ্ঞেস করে আসছেন, কখন তার সিরিয়াল। কত দেরি হবে? রুমের উল্টো পাশে বসে বারবার একজন বলছিলেন সেই সকাল থেকে বসে আছি! কখন যে সিরিয়াল আসে! তার সঙ্গে একজন নারীও আছেন। কথা হলো মাসউদ নামের ওই ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি জানান, তার বাড়ি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী মণ্ডলভোগ গ্রামে; এসেছেন স্ত্রীকে নিয়ে।
মাসউদ জানান, বছরখানেক আগে স্ত্রীর স্তনে ক্যানসার ধরা পড়ে। প্রথমে ঢাকার মোহাম্মপুরের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা শুরু করেন। ৩০ হাজারের বেশি খরচ করে দুটি কেমোথেরাপি দেন। সেখানে অপারেশন, কেমো ও রেডিওথেরাপি সব মিলিয়ে ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা লাগতে পারে বলে জানান চিকিৎসকরা। এ কথা শুনে বাজ পড়ে পেশায় গাড়িচালক মাসউদের মাথায়। খোঁজখবর করে স্ত্রীকে নিয়ে আসেন মহাখালীর ক্যানসার হাসপাতালে। এখানে আসার পর আরও ছয়টি কেমোথেরাপি দেন। এর মধ্যে দুটি থেরাপি দেওয়ার সময় কিছু ওষুধ কিনে দিতে হয়। যেগুলোর সাপ্লাই ছিল না। ৫ হাজার টাকার মতো ওষুধ কিনে দিতে হয়েছিল।
কেমো দেওয়ার পর ক্যানসার হাসপাতালেই অপারেশন করা হয়। অপারেশনের পর চিকিৎসকরা রেডিওথেরাপি দেওয়ার পরামর্শ দেন। এতদিন সব ঠিকঠাক থাকলেও এবার ঘটে বিপত্তি। রেডিওথেরাপির ডেট নিতে গিয়ে জানতে পারেন আগামী ছয় মাসে কোনো সিরিয়াল নেই। গত ১৫ মে অপারেশনের ছয় মাস পর গত ৮ অক্টোবর রেডিওথেরাপি শুরু হয়। ১৯ দিন থেরাপি দেওয়া হয়। শেষ হয় ৫ নভেম্বর।
৬ নভেম্বর আসেন ফলোআপের জন্য। বেলা ১টার পর তারা চিকিৎসক দেখাতে পারেন। মাসউদ জানান, রেডিওথেরাপির জন্য প্রতি মাসে একবার করে আসতেন। এলে বলা হতো পরের মাসে এসে খোঁজ নেন। এভাবে ছয় মাসে ছয়বার এসেছেন। প্রতিবার আসা-থাকা-খাওয়ার ব্যয় বহন করা তাদের মতো স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য খুবই কষ্টকর।
শুধু মাসউদের স্ত্রীরই নয়; দুই বছর ধরে সব রোগীরই রেডিওথেরাপি দেওয়ার জন্য অন্তত ছয় মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন যারা রেডিওথেরাপি নেওয়ার জন্য আসছেন, তাদের ২০২৫ সালের জুন-জুলাই মাসে তারিখ দেওয়া হচ্ছে। তার আগে কোনো সিরিয়াল নেই। রোগীরা জানান, কেমোথেরাপির সিরিয়াল পেতে সময় লাগছে না। বহির্বিভাগে টিকিট কেটে ডাক্তার দেখানোর কয়েক দিনের মাথায়ই কেমোথেরাপির ডেট পাচ্ছেন। কেমোতে দেরি হচ্ছে না। কিন্তু কেমো দেওয়ার পর বা অপারেশনের পর যখন রেডিওথেরাপির প্রয়োজন হচ্ছে, তখনই ঘটছে বিপত্তি। সিরিয়াল পেতে সময় লাগছে ছয় থেকে আট মাস!
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ছয়টি মেশিনে ক্যানসারের রোগীদের রেডিওথেরাপি দেওয়া হতো। চারটি মেশিন দুই বছর আগেই ব্যবহার অনুপযোগী ঘোষণা করা হয়। তার পর থেকে সচল মাত্র দুটি মেশিন। সেই দুটির একটিতে প্রায়ই সমস্যা দেখা দেয়। সেটিতে কোনো রকম জোড়াতালি দিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
পর্যাপ্তসংখ্যক রেডিওথেরাপির মেশিন না থাকায় মারাত্মকভাবে সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন ক্যানসার আক্রান্তদের একটি বড় অংশ। যারা সেবা পাচ্ছেন, তাদেরও সিরিয়াল দিয়ে অপেক্ষা করতে হচ্ছে মাসের পর মাস। দ্রুততম সময়ের মধ্যে রেডিওথেরাপি দেওয়া প্রয়োজন হলেও সেই রোগীর ছয় থেকে আট মাসের আগে মিলছে না এই সিরিয়াল। এসব পরিস্থিতি বিবেচনায় দুটি মেশিন ইনস্টলের কাজ চলছে। জানুয়ারিতে ওই দুটি মেশিনে রোগীর সেবা দেওয়া শুরু হতে পারে।
দেশে বর্তমানে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা কত, তার কোনো সঠিক হিসাব নেই। ধারণা করা হয়, দেশে বর্তমানে ২০ লক্ষাধিক ক্যানসার রোগী রয়েছেন। প্রতিবছর নতুন রোগী দেড় থেকে দুই লাখ যুক্ত হচ্ছেন। আর বছরে মারা যাচ্ছেন এক লাখের মতো।
বছরে দুই লাখের মতো নতুন রোগী হলেও ক্যানসার হাসপাতালে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার রোগীর চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাকি রোগীদের মধ্যে আর্থিকভাবে সচ্ছলরা বেসরকারি পর্যায়ে কিংবা ঢাকায় বা বাইরে অন্যান্য হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। একটা অংশ চলে যান দেশের বাইরে। আর দরিদ্রদের বড় একটা অংশ বঞ্চিত হন চিকিৎসা থেকে।
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, ক্যানসার রোগীদের চার ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হয়। অপারেশন, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি ও হরমোন থেরাপি। বেশির ভাগ রোগীরই এই চার ধরনের চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। নির্ধারিত সময়ে যদি কোনো একটার ব্যত্যয় ঘটে, সে ক্ষেত্রে ক্যানসার আবার ফিরে আসে এবং রোগী মৃত্যুঝুঁকিতে পড়েন। অনেক ক্ষেত্রে রোগী মারা যান।
ক্যানসার হাসপাতালের চিফ রেডিও থেরাপি টেকনোলজিস্ট মো. মামুনুর রশীদ বলেন, এখন প্রতিদিন রেডিওথেরাপি পাচ্ছেন মাত্র ২২০ থেকে ২৩০ জন রোগী। আরও দুটি মেশিন ইনস্টল (বসানো) করা হলে হয়তো ৪৪০ থেকে ৪৬০ জনকে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে। রোগীর চাপ সামলাতে এই মুহূর্তে লোকবল বাড়িয়ে অন্তত ১০টি মেশিন সচল রাখা প্রয়োজন।
জানা গেছে, এক-দুই দিন থেকে শুরু করে রোগী বুঝে ৩৩ থেকে ৩৫ দিন রেডিয়েশন দেওয়া হয়। এক-দুই দিনের রোগী একেবারেই কম। প্যালিয়েটিভ পর্যায়ের, অর্থাৎ শেষ পর্যায়ের রোগীকে কিছুটা ব্যথামুক্ত রাখার জন্য এক-দুই দিন রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়। স্তন ক্যানসারের রোগীদের ১৫ থেকে ২৫ দিন, জরায়ুমুখের ক্যানসারের রোগীদের ২৫ দিন, হেড-নেকজাতীয় ক্যানসারের রোগীদের ৩০ থেকে ৩৫ দিন পর্যন্ত দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রেডিওথেরাপি দেওয়ার জন্য বর্তমানে যে দুটি মেশিন সচল আছে, তার মধ্যে একটি মেশিনে তিন বছর ধরে প্রায়ই সমস্যা দেখা দিচ্ছে। কিন্তু সরকারিভাবে কোনো মেইনটেন্যান্স খরচ দেওয়া হয় না। প্রতিষ্ঠানের টাকায় এটি মেরামত করে কোনো রকম চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
রেডিওথেরাপি রোগীর শরীরের কোথায় দেওয়া হবে সেটি আগে প্ল্যান করতে হয়। সে জন্য তিনটি মেশিন ছিল। একটি কনভেনশনাল সিমুলেটর এবং অন্যটি সিটি সিমুলেটর। এর মধ্যে সিটি সিমুলেটর মেশিনটি নষ্ট। আর কনভেনশনাল সিমুলেটর মেশিনটি পাঁচ বছর ধরেই অচল। দুটি বাকি থেরাপি মেশিনের একটি চালু আছে। আরেকটি দ্রুত চালু হবে। প্ল্যানিং মেশিন না থাকায় এখন অ্যানালগ পদ্ধতিতে প্ল্যান করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিটি মেশিন চালানোর জন্য প্রতি শিফটে দুজন করে দক্ষ রেডিওথেরাপি টেকনোলজিস্ট প্রয়োজন। সকাল-সন্ধ্যা দুই শিফটে ভাগ করে রোগীর সেবা দেওয়ার জন্য ছয়টি রেডিওথেরাপি মেশিন ইনস্টল করা হলে এগুলোসহ অন্যান্য মেশিন চালানোর জন্য ৪৮ থেকে ৫০ জন দক্ষ রেডিওথেরাপি টেকনোলজিস্ট প্রয়োজন। কিন্তু আছেন মাত্র ১৩ জন। শুধু মেশিন বসালেই হবে না। মেশিন চালানোর জন্য দক্ষ জনবলও বৃদ্ধি করতে হবে।
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী নিজামুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। তার মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে।