
‘মব জাস্টিস’ এখন বহুল আলোচিত একটি শব্দ। যখন একজন ব্যক্তিকে অপরাধী বলে সন্দেহ করে একদল লোক ভিড়ের মধ্যে মারধর করে বা হত্যা করে সেটাকেই মব জাস্টিস বলা হয়। গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে এই ‘মব জাস্টিস’ই আলোচনায় নতুন মাত্রা পেয়েছে। কারণ সরকারের নানা উদ্যোগের পাশাপাশি সুধী সমাজের প্রতিনিধিরা এর প্রতিরোধে নানা পরামর্শ দিচ্ছেন। এক ধরনের সচেতনতাও তৈরি হচ্ছে। কিন্তু তারপরও পুরোপুরি বন্ধ হচ্ছে না কথিত এই ‘মব জাস্টিস’।
কিন্তু কেন এই প্রবণতা সমাজে বাড়ছে? মানুষ কেনই বা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে? এমন প্রশ্ন এখন আইন অঙ্গন পেরিয়ে সচেতন জনগোষ্ঠীর মধ্যেও উঠছে।
কারণ সরকার পতনের পরে প্রতিহিংসা বা ঘৃণা-বিদ্বেষের মধ্য দিয়ে শুরু হলেও তিন মাস পরে এখনো বন্ধ হচ্ছে না এই ধরনের প্রবণতা বা অপরাধ। বরং সময়-সুযোগ বুঝেই জনগণের মধ্যে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। গ্রাম-মহল্লার পাশাপাশি শিক্ষাঙ্গন, আদালত প্রাঙ্গণেও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হচ্ছেন অনেকে। সরকারসহ বিভিন্ন মহল থেকে এ ধরনের অপরাধ ঠেকাতে কঠোর নির্দেশনা থাকলেও তা পুরোপুরি থামছে না। বরং এই অপরাধকে বৈধতা দেওয়ার জন্য ‘মব জাস্টিস’ হিসেবে অ্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে।
যদিও মব জাস্টিস এর একাডেমিকভাবে কোনো ভিত্তি নেই। এ অবস্থায়, অন্যান্য অপরাধের চেয়ে চ্যালেঞ্জিং এই অপরাধ বন্ধ করা যাবে কি না তা নিয়ে অনেকে সংশয় প্রকাশ করেছেন। অপরাধ ও সমাজ বিশেষজ্ঞরা মবের মাধ্যমে হত্যা বন্ধে ব্যাপক হারে সচেতনতা এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কথা বলেছেন।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. উমর ফারুক খবরের কাগজকে বলেন, ‘জনগণের মধ্যে সচেতনতাবোধ তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।’
গত মঙ্গলবার চট্টগ্রামে পুলিশের সঙ্গে ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস সমর্থকদের সংঘর্ষ চলাকালে সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চোর সন্দেহে তোফাজ্জল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শামীম মোল্লা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক নেতা মাসুদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। খাগড়াছড়িতে আবুল হাসনাত মুহাম্মদ সোহেল রানা নামে একজন শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত উচ্ছৃঙ্খল জনতা ১০০ জনকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। বিভিন্ন পত্রিকার তথ্য থেকে এই তালিকা প্রস্তুত করা হয়। বিভাগভিত্তিক হিসাবে দেখা যায়, উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে ঢাকায় ৪৪ জন, রাজশাহীতে ১৬ জন, চট্টগ্রামে ১৩ জন, খুলনায় ১১ জন, বরিশালে ৬ জন, সিলেটে ২ জন এবং রংপুর ও ময়মনসিংহে ৪ জন করে মারা যান। এ ছাড়া আদালত অঙ্গনে আসামিদের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে। বুধবার (২৭ নভেম্বর) হাইকোর্টে বিচারকের ওপর ডিম নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাসহ সবখানে এটিকে ‘মব জাস্টিস’ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও এটা ভুল বলছেন একাডেমিশিয়ানরা। তাদের মতে, মব জাস্টিস বলে কোনো কনসেপ্ট পৃথিবীর কোথাও নেই। এর প্রকৃত অর্থ আবেগতাড়িত কর্মকাণ্ড। মানুষ যখন আবেগ অনুভূতি দিয়ে কোনো অ্যাকশনে যায়, যেখানে তার বিচার-বুদ্ধি কাজ করে না। বিবেক বিবর্জিত হয়ে আবেগতাড়িত হয়ে যেকোনো কাজ করাটাই মব। যখন কোনো একটা বিষয়ের ওপর মানুষের প্রচণ্ড ক্ষোভ থাকে, তখন এটি প্রকাশিত হয়। সিনিয়র আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিকের মতে, ‘মব জাস্টিস’ বলতে আইনে কিছু নেই। এটা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতে, মানুষ মবের মাধ্যমে ক্ষমতা দেখাতে চায়। অনেক সময় নিজে একা ক্ষমতা দেখাতে পারে না। সেকারণে তারা সংঘটিত হয়ে তা প্রদর্শন করে। তিনি বলেন, এ ধরনের অপরাধ বন্ধে সরকারে পাশাপাশি রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতাদের ভূমিকা রাখতে হবে।
সংঘটিত হয়ে অপরাধ করার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণের কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রথমত, এভাবে অপরাধ করে সহজে পার পাওয়া যায়। কারণ অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করা কঠিন হয়। আবার অনেক পক্ষের লোকজন জড়িত থাকায় বিচার প্রক্রিয়াও কঠিন হয়ে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালমা আক্তার বলেন, মবের বিষয়ে সামাজিকভাবে ব্যাপক সচেতনতা বাড়াতে হবে। এটার শাস্তি তুলে ধরতে হবে সর্বত্র। সম্ভাব্য উচ্ছৃঙ্খল জনতা যেসব স্থানে সমবেত হয় সেসব স্থান নজরদারি করতে হবে। যেন আগে থেকে মব ঠেকানো যায়।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, গত ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে একটি দলের শাসনের কারণে মানুষের মধ্যে সৃষ্ট ক্ষোভ থেকে প্রথমে ‘মব জাস্টিস শুরু হলেও অনেক অনেক সুযোগসন্ধানী মানুষও নানা ঘটনার মধ্যে ঢুকে পড়ে পরিস্থিতি ঘোলা করছে। এর মধ্যে চুরি-ডাকাতি থেকে শুরু করে প্রতিপক্ষের জমি দখল, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা, অবৈধ উপায়ে অর্থ অর্জনের মতো ঘটনাও রয়েছে। এ ছাড়া গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পতন হওয়া রাজনৈতিক শক্তির উসকানি থাকা অস্বাভাবিক নয় বলে মনে করছেন তারা। সবকিছু মিলিয়ে সমাজে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ছে। জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে।
বিশিষ্টজনের অভিমত পড়ুন