দেশের অর্থনীতিতে এখন স্বস্তি-অস্বস্তির প্রহর চলছে। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স ছাড়া অন্য খাতের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। পাঁচ মাস ধরে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স বেড়েছে। এটি ইতিবাচক দিক। নভেম্বরে রপ্তানিতেও ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
অর্থনীতির এই দুটি সূচক ছাড়া অন্য সব সূচক নেতিবাচক। দুই বছর ধরে চলছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ব্যাপক কমে গেছে। বিনিয়োগে দীর্ঘ সময় ধরে খরা চলছে। রাজস্ব ঘাটতি বিশাল। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি-এডিপি বাস্তবায়নের হার গত এক যুগের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থায় নেমে এসেছে।
ব্যাংক খাতের দুর্বলতা এখনো কাটেনি। জিডিপি বাড়ার অন্যতম চালিকাশক্তি উৎপাদন এবং কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি শ্লথগতি। রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় খাত তৈরি পোশাকশিল্পে শ্রমিক অসন্তোষ দূর হয়নি। সর্বোপরি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি। এসব কারণে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির অনেক ‘উপশাখাই’ স্থবির হয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত একটি ভঙ্গুর অর্থনীতি পেয়েছে। তার পরও অর্থনীতিকে সক্রিয় করার নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার সুফল এখনো সময়সাপেক্ষ।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, নানা চেষ্টার পরও দুর্বল অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তাদের মতে, অর্থনীতি সচল হওয়ার অন্যতম পূর্বশর্ত হলো স্থিতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, অর্থনীতিতে কিছুটা স্থিতিশীলতা আসতে শুরু করেছে। মূল্যস্ফীতি বড় চ্যালেঞ্জ। রিজার্ভের স্থিতিশীলতা ও সন্তোষজনক সুদের হারের মাধ্যমে এ অবস্থার উত্তরণ হবে। সম্প্রতি রাজধানীর একটি হোটেলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি আয়োজিত এক বাণিজ্য সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হালনাগাদ (গত অক্টোবর) তথ্যানুযায়ী, শিল্প উৎপাদনে মন্দার কারণে গত অর্থবছরে (২০২৩-২৪) বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা জিডিপি প্রায় অর্ধেকে নেমে ৩ দশমিক ৯১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অথচ এর আগের অর্থবছরে জিডিপির এই প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এই সময়ে কৃষি উৎপাদন ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধিও কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা বাড়লে উৎপাদন বাড়ে। বর্তমানে ঋণের চাহিদা একদম কমে গেছে। ফলে উৎপাদন খাতে এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। মূল কথা হচ্ছে, উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ড আরও বেগবান করতে হবে। তাহলে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা বাড়বে, যা উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। প্রবৃদ্ধি বাড়লে কর্মসংস্থানও বাড়বে।’
খাদ্যনিরাপত্তার জন্য একমাত্র অবলম্বন মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কৃষি খাতের অবদান ১১ শতাংশের বেশি। কিন্তু নানামুখী সংকটের কারণে এ খাতের প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যাচ্ছে না। বিবিএসের তথ্যানুয়ায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি কমে ৩ দশমিক ২১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ অনেক কমে গেছে। বেসরকারি খাতে ঋণ কমলে সেটা অর্থনীতির স্থবিরতার লক্ষণ বলে গণ্য করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ কমে গেছে। এই সময়ে ঋণপ্রবাহ বাড়ার হার ছিল ৯ দশমিক ১০ শতাংশ, আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল প্রায় ১৩ শতাংশ। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর- এই তিন মাসে ধারাবাহিকভাবে ঋণের প্রবৃদ্ধির হার নিম্নমুখী। চলতি অর্থবছরে জুলাই মাসে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ, আগস্টে তা কমে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশে। আর সেপ্টেম্বরে আরও কমে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ২০ শতাংশে।
মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এখন তা কমে গেছে, এটা উদ্বেগজনক। বেসরকারি খাতে ঋণ কমলে সেটা অর্থনীতির স্থবিরতার লক্ষণ বলে গণ্য হয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকটিও দেখতে হবে। সে জন্য উৎপাদনশীল খাতে যাতে যথেষ্ট ঋণপ্রবাহ থাকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দরকার একটা বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ। বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই আসবে।’ চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন এর জবাবে তিনি বলেন, ‘এই সময়টায় নানা ঘটনা ঘটেছে। ফলে সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্তিমিত হয়ে পড়েছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের এক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, ‘দুই বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। সেই সঙ্গে আমদানি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আমদানি কমে গেলে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি বাড়ে না। তবে শর্ত শিথিল করায় ধীরে ধীরে আমদানি বাড়ছে। আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ঘুরে দাঁড়াবে অর্থনীতি।’
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া, জ্বালানি পণ্যের সংকট, সুদহার বৃদ্ধি ও দুর্বল আর্থিক ব্যবস্থাপনার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি চাপে থাকবে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, টাকার অবমূল্যায়নের প্রভাবে মূল্যস্ফীতির চাপ অব্যাহত থাকবে। আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমবে। জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদানও কমে যেতে পারে।
বিশাল রাজস্ব ঘাটতি
চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রাজস্ব আদায় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় অনেক কমে গেছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় অর্থনীতি সংকুচিত হচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় চলতি অর্থবছরের এডিপি থেকে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা কাটছাঁট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এনবিআর আদায় করেছে ১ লাখ ১ হাজার ২৮১ কোটি টাকা। অর্থবছরের প্রথম চার মাসে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এটি ৩০ হাজার ৮৩১ কোটি টাকা কম। অর্থাৎ ঘাটতি হয়েছে প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, সরকারের বড় আয়ের উৎস হচ্ছে এনবিআর। সরকারের আয় কমে গেছে। কিন্তু ব্যয়ের চাপ বাড়ছে। ফলে বাধ্য হয়ে ব্যাংকঋণ নির্ভরশীল হতে হচ্ছে।
সামগ্রিকভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘দুটি জায়গায় স্বস্তি আছে। একটি প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। অন্যটি রপ্তানি। এ ছাড়া বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ, রাজস্ব ঘাটতিসহ অন্য খাতে সূচকের অবস্থান ভালো নয়। সরকার চেষ্টা করলেও এখনো সুফল মেলেনি। এক কথায় বলা যায়, সরকার চেষ্টা করছে। কিন্তু দুর্বলতা কাটেনি অর্থনীতিতে। ঘুরে দাঁড়ানোর তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।’
বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে- এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী? উত্তরে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘এখানে দেখতে হবে কোন অসুখ সারানোর জন্য কী ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে। অসুখ নানা রকমের হতে পারে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি একটি বড় অসুখ। ২০২১ সালের পর থেকে এর উত্থান। আর থামেনি। দ্বিতীয় অসুখ হচ্ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি। এটি দুর্বল হয়ে গেছে। ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। প্রকৃত মজুরি কমেছে। কর্মসংস্থানে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেখতে হবে মুদ্রানীতি ব্যবহার করা হচ্ছে প্রবৃদ্ধির জন্য না মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে। কারণ, দুটির জন্য একই ওষুধ কাজ করবে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে ওষুধ হচ্ছে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির ব্যবহার। আর জিডিপির প্রবৃদ্ধির জন্য দরকার সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি। কিন্তু দুটির সাইড ইফেক্ট বা প্রভাব আছে। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ব্যবহার করলে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো ব্যক্তিখাতে ঋণ বিতরণ কমবে। এতে বিনিয়োগে প্রভাব পড়বে।’
এখন দেখতে হবে কোন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সরকার মনে করছে, এই মুহূর্তে মুদ্রানীতি নিয়ন্ত্রণ করাই প্রধান কাজ। তাই সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছে। ফলে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। জাহিদ হোসেন মনে করেন, অর্থনীতি সচল হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির স্থিতিশীলতা। এখানে খুব একটা উন্নতি হয়নি। অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটছে, যা মোটেই কাম্য নয়।