ঢাকা ৯ মাঘ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫

সংলাপকে সফল দেখছে সব পক্ষ

প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৪৫ এএম
আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৫৩ পিএম
সংলাপকে সফল দেখছে সব পক্ষ
প্রতীকী ছবি

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপকে সফল মনে করছে রাজনৈতিক দলগুলো। ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে গত সোমবার হামলা করেন দেশটির হিন্দুত্ববাদী একটি সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এই ঘটনার পর সারা দেশের মানুষ ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টা বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ ৪০টির বেশি রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন ধর্মের ৩২ জন প্রতিনিধির সঙ্গে সংলাপে বসেন।

বুধ ও বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত সংলাপের উদ্দেশ্য ও সফলতা নিয়ে নানা মহলে আলোচনা চলছে। সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে- জাতীয় ঐক্যের আহ্বানে এই সংলাপ শতভাগ সফল হয়েছে। আর সংলাপকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে রাজনৈতিক দলগুলো। তাদের মতে, ৫ আগস্টের পর সংলাপের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে মেসেজ দেওয়া গেছে যে ছাত্র-জনতার ঐক্যে কোনো যড়যন্ত্র করে চিড় ধরানো যাবে না। প্রতিবেশী ভারতের আগ্রাসন, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে অনমনীয় জাতীয় ঐক্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এবারের সংলাপে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে মৌলিকে সংস্কারের পর দ্রুত নির্বাচনের তাগাদা দেওয়া হয়েছে।

সংলাপে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের কয়েকজন শুক্রবার (৬ ডিসেম্বর) খবরের কাগজকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দেশের মানুষ ও বহির্বিশ্বকে দেখাতে সক্ষম হয়েছে- স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনো আপস করবে না বাংলাদেশ। ভারতীয় আগ্রাসন ও মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে প্রত্যেক নাগরিক আজ ঐক্যবদ্ধ। ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিজমের পুনরুত্থানের কোনো ধরনের অপতৎপরতা সফল হতে দেবে না। নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দিকে আগ্রসর হতে দ্রুত রোডম্যাপ ঘোষণা করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তারা।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক পেক্ষাপটসহ নানা সংকটের কারণে প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। বিএনপি সেই জাতীয় ঐক্যে সমর্থন জানিয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে আমরা নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারকাজ শেষ করে অতিদ্রুত নির্বাচন দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছি। কারণ দেশের জনগণ নির্বাচনমুখী হলে দ্রুতই যড়যন্ত্র বন্ধ হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, এই সরকার ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের সরকার। যারা জনগণের মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার এবং রাজনীতিতে বৈষম্য দূর করে গণতান্ত্রিক ধারা প্রবর্তন করবে।

নির্বাচনের রোডম্যাপ কবে নাগাদ পেতে পারেন সে বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা কিছু বলেছেন কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে খন্দকার মোশাররফ বলেন, ‘সংলাপে আমরা আমাদের অভিমত দিয়েছি। সরকার কী করবে, কীভাবে বিবেচনায় নিয়েছে তা এখনই বলা যাবে না। আমরা সরকারের নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার অপেক্ষা আছি। রোডম্যাপের জন্য আমরা আরও কিছু দিন অপেক্ষা করব।’

এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার খবরের কাগজকে বলেন, ‘এই সংলাপের মাধ্যমে আমরা বিশ্বের কাছে মেসেজ দিতে পেরেছি- গত ৫ আগস্টের পর ছাত্র ও জনতার ঐক্যের ভিত্তিতে দেশ চলছে। এখানে কোনো বিভেদ-বিভাজন নেই। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সবাই ঐক্যবদ্ধ। এখানে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করে লাভ হবে না। এই শক্ত মেসেজটাই বিশ্ববাসীর কাছে দিতে সক্ষম হয়েছি।’ 

তিনি বলেন, গত ৫ আগস্টের পর অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই দেশি-বিদেশি নানা শক্তি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। এ ছাড়া এ সময়ে দেশি ও বিদেশি নানা শক্তি ছাত্র-জনতার ঐক্যের মধ্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করে আসছে বলেও অভিযোগ।

প্রধান উপদেষ্টার সহকারী প্রেস সচিব আজাদ মজুমদার খবরের কাগজকে বলেন, ‘এবারের সংলাপ এটাই প্রমাণ করেছে যে, সব সক্রিয় রাজনৈতিক দল জাতীয় ইস্যুতে আক্ষরিক অর্থেই প্রধান উপদেষ্টার পাশে দাঁড়িয়েছে। এবারে আরও প্রমাণ হয়েছে, যেকোনো ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় আমরা জাতীয়ভাবে ঐক‍্যবদ্ধ। সংলাপ সফল হয়েছে।’

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা গণ-অভ্যুত্থানে দেশছাড়া হওয়ার পর ৮ আগস্ট ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। চার মাসের মাথায় এসে সরকার নানা সংকটে পড়েছে। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে অনেকটা বেকায়দায় সরকার। প্রথম থেকেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার জাতীয় ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছে। বিরাজমান সংকট নিরসনে জাতীয় ঐক্য গঠনের লক্ষ্যে ছাত্রনেতা, রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় সংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। মঙ্গলবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বুধবার রাজনৈতিক দল এবং বৃহস্পতিবার ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে বসেন প্রধান উপদেষ্টা। তবে এবারের সংলাপে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া কোনো দলই আমন্ত্রণ পায়নি। আমন্ত্রণ পেয়েও তালিকায় নাম না থাকায় সংলাপে অংশ নিতে পারেননি এলডিপি প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) অলি আহমদ (বীর বিক্রম)। তবে পরদিন বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে কর্নেল অলি বলেন, ‘বর্তমানে ভারতের দালাল হিসেবে আমরা কাউকে কাজ করতে দেব না। আমরা ভারতের বিপক্ষে না, যারা আমাদের সাহায্য-সহযোগিতা করেছে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। তবে বাংলাদেশ নিয়ে কেউ মিথ্যাচার করলে কাউকে ছাড় দেব না।’

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় নেতাদের বৈঠকে বেশ কিছু প্রস্তাব বা পরামর্শ উপস্থাপন করা হয়। এগুলো হলো- বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের দূতাবাসে আগের সরকারের নিয়োগপ্রাপ্তদের সরিয়ে বিপ্লবের পক্ষের শক্তিকে নিয়োগ দেওয়া, গত সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে যেসব চুক্তি হয়েছে তা প্রকাশ করা এবং স্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিল করা; বাংলাদেশ ডে অথবা জাতীয় ঐক্যের প্রতীকী সংহতি দিবস হিসেবে একদিন পতাকা হাতে পালন করা, জাতীয় নিরাপত্তা কমিশন গঠন, আন্তর্জাতিক মহলের প্রোপাগান্ডা প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয়ভাবে পাবলিক রিলেশন সেল গঠন করা এবং বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে প্রকাশ করা, জাতীয় নিরাপত্তা ও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে জাতীয় ঐক্যের সমঝোতা দলিল প্রণয়ন, আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলন করাসহ আরও কয়েকটি প্রস্তাব। সংলাপে উঠে আসা এসব প্রস্তাবের বিষয়ে পদক্ষেপ বা প্ল্যানের ঘোষণা দু-এক দিনের মধ্যে আসতে পারে।

এ বিষয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না খবরের কাগজকে বলেন, ‘সংলাপে দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সবাই পরামর্শ দিয়েছি। কারণ প্রস্তাব দিলে সবাই মিলে লিখিত আকারে দেওয়া হতো। কিন্তু এসব পরামর্শ সরকার ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করবে কি না এটা তাদের বিষয়। সংলাপে সবাই ভারতের আগ্রাসন এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ থাকার ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন।’ 

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) উপদেষ্টা খালেকুজ্জামান খবরের কাগজকে বলেন, ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসক শ্রেণি রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল, উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা ছড়াতে চেয়েছে এই অঞ্চলে। বাংলাদেশকে তারা একটি অঙ্গরাজ্যে পরিণত করতে চেয়েছিল, সেই অভিলাষ তাদের পূরণ হয়নি। ভারতের আগ্রাসন মোকাবিলার পাশাপাশি বাংলাদেশের অভ্যন্তরের সংকট তৈরি হয়েছে, সেই সব সংকট দ্রুত সমাধান করতে প্রতিটি রাজনৈতিক দল এক হয়েছে। এটাই এই সংলাপের সফলতা। 

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ খবরের কাগজকে বলেন, সংলাপে ধর্মীয় নেতাদের বক্তব্যে দেশের সংখ্যালঘুদের আসল চিত্র ফুটে উঠেছে। এর মধ্য দিয়ে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের জুলুম-নির্যাতন নিয়ে ভারতের মিথ্যাচার বন্ধ হবে। জাতীয় ইস্যুতে সব রাজনৈতিক দল এক জায়গায় জড়ো হয়েছে- এটা ইতিবাচক।

আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রথমত জাতীয় ইস্যুতে সব রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়েছে এটা বড় সফলতা। দ্বিতীয়ত, সাধারণত সরকারের ডাকে আগে কখনো একসঙ্গে সবা দল সংলাপে অংশ নেয়নি। দেশের ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দল ও সংগঠন এক- এটা বহির্বিশ্বকে দেখাতে পেরেছি। এটা ইতিবাচক দিক।’

টাঙ্গাইলে ভয়ংকর পর্নোগ্রাফি চক্র, অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে

প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:০৫ এএম
আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:৫০ পিএম
টাঙ্গাইলে ভয়ংকর পর্নোগ্রাফি চক্র, অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে
প্রতীকী ছবি

টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে শিক্ষিকা ও ছাত্রীসহ বিভিন্নজনের ছবি ব্যবহার করে পর্নো ভিডিও বানিয়ে মেসেঞ্জার গ্রুপে পোস্ট করছে একটি ভয়ংকর অপরাধী চক্র। এরপর পর্নো ভিডিও দেখিয়ে চক্রটি সংশ্লিষ্টদের কাছে টাকা দাবি করছে। এ ঘটনায় এক স্কুলছাত্রীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত সোমবার পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। তবে অভিযোগ উঠেছে, স্কুলছাত্রীকে গ্রেপ্তার করা হলেও পর্নো ভিডিও তৈরির সঙ্গে মূল অপরাধী চক্রের সদস্যরা রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

ওই স্কুলছাত্রীকে গত রবিবার রাতে তার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদিকে ওই স্কুলছাত্রীকে গ্রেপ্তারের খবরে থানায় হাজির হন কয়েকজন ভুক্তভোগী। এ সময় তারা ওই ছাত্রীসহ তার অভিভাবকদেরও শাস্তি দাবি করেন।

পুলিশ জানায়, উপজেলার কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষিকা, ছাত্রী ও ব্যক্তিদের ছবি ব্যবহার করে তৈরি পর্নো ভিডিও একাধিক মেসেঞ্জার গ্রুপে পোস্ট করা হয়। পরে পোস্ট করা ভিডিওর সঙ্গে মোবাইল নম্বর দিয়ে লাখ লাখ টাকা চাওয়া হয়। ‘দিলরুবাথ ও রাকিবুল ইসলাম’ নামের আইডি থেকে মেসেঞ্জার গ্রুপ তৈরি করা হয়েছে। পরে সেই গ্রুপে পর্নো ভিডিও পোস্ট করা হয়। পুলিশ ফেসবুক ও গুগল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে আইডিগুলোর মালিক বা ব্যবহারকারীকে শনাক্ত করেছে। এই ঘটনায় জড়িত থাকার সন্দেহে ওই ছাত্রীর ফোন ও ল্যাপটপ জব্দ করে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জব্দ করা ফোন থেকে এসব পোস্ট ও ভিডিও ছড়ানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে।

গ্রেপ্তার স্কুলছাত্রী জানায়, তার ছবি ব্যবহার করে পর্নো ভিডিও বানানো হয়েছে। সেই ভিডিও দেখিয়ে তার পরিবারের কাছে টাকা চাওয়া হয়। ঘটনার সঙ্গে জড়িত মির্জাপুরের সীমান্ত ও গোপালপুরের সিফাতকে পুলিশ ডেকে এনেছিল। তারা স্বীকারও করেছে। কিন্তু তারপরও তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

গ্রেপ্তার স্কুলছাত্রীর বাবা বলেন, ‘এসব ঘটনার সঙ্গে আমার মেয়ে জড়িত নয়। তার ছবি দিয়ে নগ্ন ভিডিও বানিয়ে টাকা দাবি করা হয়েছিল। যেসব মোবাইল নম্বরে টাকা পাঠাতে বলা হয়েছিল তাদের পুলিশ ধরেছিল। তারা স্বীকারও করেছে এ ঘটনা। সে সময় তার মেয়ের মোবাইল ফোন চেক করে কোনো কিছু পাওয়া যায়নি। পরে মোবাইল ফেরত দিলেও রবিবার রাতে মেয়েকে গ্রেপ্তার করা হয়। সোমবার পর্নোগ্রাফি মামলায় তাকে আদালতে পাঠানো হয়েছে।’

ভূঞাপুর থানার তদন্ত কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, জি-মেইল দিয়ে একাধিক ফেসবুক আইডি খোলা হয়েছে ওই ছাত্রীর মোবাইল ফোনে। লোকলজ্জার ভয়ে অনেকেই কিছু বলতে চান না। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী একজন থানায় অভিযোগ করেন। পরে অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করা হয়। গুগল, ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়। পরে তদন্তে আইডি ব্যবহারকারীর পরিচয় শনাক্ত হওয়ার পরই ওই ছাত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ভূঞাপুর থানার এএসআই নজরুল ইসলাম বলেন, ওই ছাত্রীকে আদালতে পাঠানোর পর তাকে কারাগারে পাঠান বিচারক।

পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১২ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে অন্য কোনো ব্যক্তির সামাজিক বা ব্যক্তির মর্যাদাহানি করলে বা ভয়ভীতির মাধ্যমে অর্থ আদায় বা অন্য কোনো সুবিধা আদায় বা কোনো ব্যক্তির জ্ঞাত বা অজ্ঞাতে ধারণ করা কোনো পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে ওই ব্যক্তিকে মানসিক নির্যাতন করলে তিনি অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবে। এ ধরনের অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ৫ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং দুই লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে।

টাঙ্গাইলের ঘটনায় মানবাধিকারকর্মী তাসলিমা তিন্নি বলেন, বর্তমান সময়ে উঠতি বয়সের তরুণীরা এসব পর্নোগ্রাফিতে জড়িয়ে পড়ছে সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে। তাদের উচিত খারাপ সঙ্গ ত্যাগ করা।

তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি ঘটে যাওয়া টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে যে স্কুলছাত্রী আটক হয়েছে তার বয়স মাত্র ১৫ বছর। এই মেয়েটির বিষয়টা গভীরভাবে ভেবে দেখা উচিত প্রশাসনকে। এত কম বয়সের একটা মেয়ের এ ধরনের কাজ করতে অনেক সাহস দরকার। তার পেছনে কেউ না থাকলে এমন কাজ করা তার পক্ষে করা সম্ভব নয়। বিষয়টি আজকে তাকে কোন জায়গা নিয়ে গেছে এটা জানা খুবই জরুরি। স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে নিয়ম অনুযায়ী সামনের দিকে এগুলো অবশ্যই আমরা খুঁজে পাব।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার কাছে মনে হচ্ছে এই মেয়েটার পরিবারের অন্য সদস্যরাও এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত। কারণ একটা শিশু তো পর্নোগ্রাফিতে জড়িত হতে পারে না। এ ব্যাপারে তদন্ত হওয়া দরকার।’

ইসলামপন্থি দলগুলোর দিকে নজর বিএনপি-জামায়াতের

প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০৫:২০ এএম
আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:৫০ পিএম
ইসলামপন্থি দলগুলোর দিকে নজর বিএনপি-জামায়াতের
বিএনপি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (লোগো)

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে এখন নজর বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর। পৃথক পৃথকভাবে তারা ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মিত্রতা গড়ে তুলতে তৎপর রয়েছে। পাশাপাশি জোট গঠনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে দল দুটি। যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোকে নিয়ে ‘অলিখিত’ জোটের পরিধি বাড়ানোর চেষ্টা করছে বিএনপি। ‘বৃহত্তর ইসলামি’ জোট গঠন করার আশায় রয়েছে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন। নির্বাচনের আগে বৃহত্তর জোট গঠন করা যায় কি না, তা নিয়ে ভাবছে দুই দলই। এ ছাড়া অনিবন্ধিত ইসলামি দলগুলোও জোটবদ্ধ হতে চালাচ্ছে নানা তৎপরতা। তবে সবকিছু ধীরগতিতে এগোচ্ছে। বুধবার (২২ জানুয়ারি) একাধিক দলের নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে এসব তথ্য।

নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে ইসলামি দলগুলো নিয়ে জোট গঠনের চেষ্টা করছে জামায়াত। এ ছাড়া ভবিষ্যতে বিএনপির সঙ্গে বনিবনা নাও হতে পারে, এমনটি ধরে নিয়েই ইসলামপন্থিদের নিয়ে জোট গড়তে তৎপরতা চালাচ্ছে দলটি। বর্তমানে দল দুটির মধ্যে কিছুটা দূরত্বও বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গত মঙ্গলবার দীর্ঘদিনের দূরত্ব কমিয়ে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান ও ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম চরমোনাই পীর প্রকাশ্য হাত মিলিয়েছেন। পরে দুজনই একসঙ্গে কাজ করার ঘোষণাও দিয়েছেন। তবে বসে নেই বিএনপিও। তারাও জোটের পরিধি বাড়াতে চায়। এই মুহূতেই বিএনপি ও জামায়াত নিজেদের মধ্যে কোনো বিরোধে জড়াতে চায় না।

বুধবার গুলশানে এক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘‘বাংলাদেশে যারাই রাজনীতি করেন, তারা রাজনীতিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যাদের সঙ্গে মতের মিল হবে, তাদের সঙ্গে কাজ করার চিন্তা করতে পারে, সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এ নিয়ে কারও কোনো দুশ্চিন্তা থাকার তো কোনো কারণ নেই। তারা (জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন) তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে যা উচিত মনে করবে, নিশ্চয়ই তা করবে।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের আপাতত কোনো জোট নেই। সবাই যুগপৎভাবে ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের আন্দোলন করেছে। এখন আমরা একসঙ্গে আলোচনা করে কাজ করে যাচ্ছি।’ তিনি বলেন, জামায়াতের আদর্শ আলাদা, বিএনপির আলাদা দল। এখানে দূরত্বের কিছু নেই।

নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর এবার প্রথম ‘বৃহত্তর ইসলামি জোট’ গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো। জামায়াতের টার্গেট হলো- ইসলামী আন্দোলনের পাশাপাশি খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, খেলাফত আন্দোলন, নেজামে ইসলাম পার্টি, জাকের পার্টি, ফরায়েজী আন্দোলনসহ সমমনা বেশ কয়েকটি অনিবন্ধিত ইসলামি দলকে এই জোটে অন্তর্ভুক্ত করা। জোটের চমক হতে পারে হেফাজতে ইসলামের সমর্থন। ইতোমধ্যে প্রাথমিক বৈঠক ও যোগাযোগ চলছে। জোটের কার্যক্রম ধীরগতিতে এগোচ্ছে বলেও জানা গেছে। এ ছাড়া চরমোনাই পীরের নেতৃত্বে খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টি, খেলাফত আন্দোলন কওমি মাদ্রসাভিত্তিক ছয় ইসলামি দল একত্রিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে ‘ওয়ান-টু-ওয়ান’ বৈঠক করেছে ইসলামী আন্দোলন। বর্তমানে জোটের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা চলছে।

জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, তাদের লক্ষ্য আগামী নির্বাচনে ক্ষমতার অংশীদার হওয়া এবং সংসদে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। এ জন্য ইসলামি দলগুলো সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন এবং তাদের একটি ‘ভোট বাক্স’ নিশ্চিত করতে চাইছে। এ জন্য নিজেদের মধ্যে তারা প্রাথমিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন।

তাদের দাবি, কার্যত ‘আকিদা’ ও ‘হক’ নিয়ে ইসলামী আন্দোলনসহ কওমি ধারার আলেমদের সঙ্গে জামায়াতের দীর্ঘদিনের বিরোধ বা বিতর্ক ছিল। তবে বর্তমানে সেটি অনেকটাই কমিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। ইসলামপন্থি দলগুলোর নিজস্ব ভোটব্যাংক রয়েছে। একজোট হলে তাদের ভোটব্যাংক আরও বাড়বে। প্রতিটি আসনে ইসলামি দলগুলোর একটি ব্যালট ও ভোট বাক্স নিশ্চিত করতে হবে। এতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ভোট কমবে। যদিও আওয়ামী লীগের ভোটে আসার সুযোগ নেই বলেও মনে করে দল দুটি। তাই সম্ভাব্য জোটের একটি রূপরেখা দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে ইসলামি দলগুলো।

জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার খবরের কাগজকে বলেন, ‘সব দলের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। বেশ কয়েকটি দলের সঙ্গে মতবিনিময় ও বৈঠক হয়েছে। তবে কোনো কিছুই এখনো চূড়ান্ত হয়নি। জোটের রূপরেখা কী হবে, কোন পদ্ধতিতে জোট হবে- এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে।’

ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম (শায়খে চরমোনাই) খবরের কাগজকে বলেন, ‘জামায়াতের আমিরের সঙ্গে সাক্ষাৎটি ছিল সৌজন্যমুলক। আমরা চাই ইসলামি পক্ষের শক্তিগুলো একসঙ্গে কাজ করুক।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত জোটের ব্যাপারে নীতিগত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ইসলামি বৃহত্তর জোট গঠনের চেষ্টা চলছে। নির্বাচনের আগে ইসলামি দলগুলোর মধ্যে জোট বা আসন সমঝোতা হোক- এটা আমরা চাই। প্রতিটি আসনে একটি ইসলামি ব্যালট বাক্স থাকবে।’

দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘জোটগতভাবে নয়, ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন করার কথা চলছে। আসনভিত্তিক আলোচনা করে ইসলামি দলগুলো থেকে একজন প্রার্থী হতে পারেন। সব দল সেই প্রার্থীকে ভোট দেবে। এটা নির্ভর করছে আগামী নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে, কোন প্রক্রিয়ায় হবে। আমাদের প্রথম চাওয়া, সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে ভোট দেওয়া হোক।’

বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী বলেন, ‘আমরা ইসলামী আন্দোলনের ঐক্য চাই। আমরা দেখছি যে বিভিন্ন দল বিভিন্ন দলের সঙ্গে বসছে। এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত কেউ কিছু বলেননি। আমরা বড় দলগুলোকে জানিয়ে রাখছি যে, যদি ঐক্য হয় তাহলে আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি। আমরা আশা করছি নির্বাচনের আগে ঐক্য হবে।’

ইসলামি দলগুলোর বাইরেও তাদের যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা দলগুলোকে কাছে টানার চেষ্টা করছে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন। বিশেষ করে ১২-দলীয় জোট, লেবার পার্টি, গণ অধিকার পরিষদ (নুর), ববি হাজ্জাজের এনডিএমের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে দল দুটির। বেশ কয়েকটি দলের নেতারা আলাপকালে জানিয়েছেন, যুগপৎ আন্দোলনে থাকা কয়েকটি দলকে জামায়াতের নেতৃত্বাধীন জোটেও দেখা যেতে পারে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের ভোটে আসার ওপর নির্ভর করবে জোটের হিসাব। আওয়ামী লীগ যদি ভোটে অংশ না নেয়, তাহলে জামায়াতসহ ইসলামি দলগুলোকে আসন ছাড় দেবে বিএনপি। সে ক্ষেত্রে যুগপৎ থাকা ছোট দলগুলো জামায়াতের সঙ্গে জোট বাঁধলে তাদের আসন বাড়বে বলেও মনে করে দলগুলো।

জোটের পরিধি বাড়াতে বিএনপির তৎপরতা

যুগপৎ আন্দোলনে থাকা প্রায় ৪০টি দল নিয়ে বিএনপির একটি ‘অলিখিত জোট’ রয়েছে। এই জোটের পরিধি বাড়াতে তৎপর হয়েছে বিএনপিও। তাদের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত মিত্র খেলাফত মজলিস ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসকে জোটে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে দলটি। পাশাপাশি যুগপৎ আন্দোলনের অন্য ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ রেখে চলেছে। গতকাল বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করেছে খেলাফত মজলিস। তবে আমন্ত্রণ পেলেও সরাসরি বিএনপির সঙ্গে এখনো বৈঠকে বসেনি মাওলানা মামুনুল হকের বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। তবে তাদের সঙ্গে বিএনপির যোগাযোগ রয়েছে বলে জানা গেছে। 

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব জালালুদ্দীন আহমদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘ইসলামি দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে। সব দলই ঐক্য চায়। তবে জোট চূড়ান্ত পর্যায়ে না গেলে কিছু করা যাবে না। আমরা চাই, ইসলামি দলগুলো এবার নির্বাচনে জোটবদ্ধ হোক।’ তিনি বলেন, ইসলামি দলগুলো প্রথম একমত হলে এরপর বিএনপির সঙ্গে আলোচনা হতে পারে।’

যুগপৎ আন্দোলনের শরিক এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে কোনো জোট করব না। এটা আমাদের দলীয় সিদ্ধান্ত। এর বাইরে থাকা অন্য দলগুলোর সঙ্গে জোট হতে পারে।’

আবারও ঋণখেলাপিদের সুবিধা!

প্রকাশ: ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:২১ এএম
আবারও ঋণখেলাপিদের সুবিধা!
খবরের কাগজ ইনফোগ্রাফ

আবারও ঋণখেলাপিদের সুবিধা দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর যদিও ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা বলে আসছেন। তা সত্ত্বেও এখন ঋণখেলাপিদের ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দেওয়ার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যবসায়ীদের নানামুখী দাবির মুখে এমন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এরই অংশ হিসেবে ডাউন পেমেন্টের শর্ত শিথিল, সুদ মওকুফ ও ঋণের মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগ দেওয়া হবে। তবে ইচ্ছাকৃত এবং চিহ্নিত ঋণখেলাপিরা এই সুযোগ পাবেন না। এ জন্য একটি কমিটি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। 

জানা গেছে, পুরো কাজটি সঠিকভাবে করতে এই বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে, যার নাম দেওয়া হয়েছে বাছাই কমিটি। পুরো আর্থিক খাতের অংশীজনের সমন্বয়ে এই বাছাই কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান হচ্ছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের অফসাইট সুপারভিশন ডিপার্টমেন্টের দায়িত্বরত নির্বাহী পরিচালক (বর্তমানে মেজবাউল হক)। তিনি এই কমিটির আহ্বায়ক। আর সদস্যসচিব হচ্ছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের (বিআরপিডি) পরিচালক বর্তমানে (মোহাম্মদ শাহরিয়ার সিদ্দিকী)। এর বাইরে তিনজন সদস্য রয়েছেন। তারা হলেন সাবেক ব্যাংকার মামুন রশীদ, অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়িক প্রতিনিধি হিসেবে এফবিসিসিআই সভাপতি (বর্তমানে প্রশাসক আবদুল হাই শিকদার)। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, এটা শুধু খেলাপি ঋণের জন্য নয়। আমাদের যেসব নীতিমালা আছে- যেমন ঋণ পুনঃতফসিল নীতিমালা, সুদ মওকুফ নীতিমালা- সেগুলো পর্যালোচনা করা এবং সেই অনুযায়ী সাম্প্রতিক আন্দোলন, অগ্নিকাণ্ড, করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বন্যাসহ প্রকৃত ক্ষতির মুখে পড়া ৫০ কোটি টাকা বা তার বেশি ঋণে বিশেষ পুনঃতফসিলের প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সুপারিশ করাই কমিটির অন্যতম কাজ। মূলত তিনটি স্তরে এই কাজটা করা হবে। প্রথমত, আমাদের যে নীতিমালাগুলো আছে, সেগুলো পর্যালোচনা করা, ৫০ কোটি টাকার ওপরে যেসব ঋণ আছে, যেগুলো মনে করা হচ্ছে যে, বিভিন্ন সময়ে সমস্যায় পড়েছে অর্থাৎ কোভিড-১৯, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং বন্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে- এই ঋণগুলোর ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মাধ্যমে বাছাই কমিটির কাছে পাঠাবে। বাছাই কমিটি সেগুলো পর্যালোচনা করে একটা সুপারিশ বাংলাদেশ ব্যাংকে দেবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সেই সুপারিশ আবারও পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিবে। তৃতীয়ত, নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কারণে যেসব ঋণ শ্রেণিকৃত হবে সেগুলোর আবেদন প্রাপ্তিগুলোও পর্যালোচনা করবে। তবে যারা চিহ্নিত ঋণখেলাপি, তাদের কোনো বিষয় এখানে বিবেচনা করা হবে না। 

ব্যাংক খাত-সংশ্লিষ্টরা জানান, বিগত সরকারের সময় যাচাই-বাছাই করে ঋণ বিতরণ না করায় সেই ঋণগুলো আর আদায় হচ্ছে না। ব্যাংকগুলোও আদায়ে মনোযোগ না দিয়ে তাদের নানা ধরনের সুবিধা দিচ্ছে। আগের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার দায়িত্ব নেওয়ার পর পরই ব্যবসায়ীদের ঢালাওভাবে সুবিধা দেওয়া হয়। এতে ঋণখেলাপির তালিকা থেকে নাম পড়ে যায় অধিকাংশ ব্যবসায়ীর। সেই সঙ্গে বিভিন্ন নীতিছাড়ের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কম দেখানো হচ্ছিল। আবার প্রভাবশালীরা কিস্তি না দিলেও খেলাপি দেখানো হচ্ছিল না। 

তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে ৪৭০ কোটি টাকা ঋণ চুক্তির ফলে গত বছর থেকে খেলাপি ঋণের কঠিন শর্ত মানতে হচ্ছে। এর মধ্যে গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর অনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নেওয়া অনেক ঋণ এখন খেলাপি হতে শুরু করেছে। আগের মতো বিশেষ সুবিধা বন্ধ হয়েছে। এসব কারণে খেলাপি ঋণ দ্রুত বাড়ছে। গত বছরের ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশ। লাগামহীনভাবে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির মধ্যে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠন ঋণ পুনঃতফসিলে বিশেষ সুবিধার আবেদন জানিয়ে আসছিল। গভর্নর ব্যবসায়ীদের কোনো অনৈতিক সুবিধা দেওয়া হবে না বললেও বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ ছাড়ে পুনঃতফসিলের উদ্যোগ নিয়েছে।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মঈনুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক যে উদ্দেশ্যে এমন উদ্যোগ নিয়েছে, সেটা হবে না। এখান থেকে খুব বেশি অর্থ আদায় হবে না। কারণ এই অর্থ দেশের মধ্যে নেই। এটা বাইরে চলে গেছে। ফলে এসব সুবিধা দিয়ে সমস্যাকে দীর্ঘায়িত করতে পারবে। কিন্তু সত্যিকারভাবে কোনো সমাধান আসবে না। এর মাধ্যমে খুব ক্ষুদ্র একটা অংশ আদায় হতে পারে। বড় অংশটা আর কখনোই আদায় হবে না। কারণ এটা দেশের বাইরে চলে গেছে। এমন অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের করণীয় বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তাদের যেসব সম্পত্তি দেশে আছে, সেগুলো ক্রোক করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।’ 

এই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হোসনে আরা শিখা খবরের কাগজকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বন্যাসহ নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত বিভিন্ন কারণে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের ঋণ পুনঃতফসিলে বিশেষ ছাড়ের প্রয়োজন আছে কি না, তা যাচাই-বাছাই করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি সুদ মওকুফ, ঋণ পুনঃতফসিল, শ্রেণিকৃতসহ বিভিন্ন নীতি পর্যালোচনা করবে এই কমিটি। তবে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা এই বিষয়ে কোনো আবেদন করতে পারবে না।’ 

একই বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কারণে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে শুধু ক্ষতিগ্রস্তদের সুবিধা দেওয়া হলে ভালো হবে। আগের মতো কোনোভাবেই ঢালাও সুবিধা দেওয়া ঠিক হবে না।’ তিনি বলেন, ‘খেলাপি ঋণে সময় বাড়ানোর বিষয়টি ঠিক নয়। ২০১২ সালের আগ পর্যন্ত আমরা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে খেলাপি ঋণ নির্ধারণ করতাম। পরে সেখানে ছাড় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানে ছাড় দেওয়ায় কী লাভ হয়েছে! ২০০৯ সালে যেখানে আমাদের খেলাপিঋণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা; এখন তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা। ফলে আলটিমেটলি আমাদের কোনো লাভ তো হয়ইনি বরং ক্ষতি হয়েছে।’

এর আগে, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০১৩ সালে নিয়ম শিথিল করা হয়। নামমাত্র ডাউনপেমেন্ট দিয়ে বিশেষ বিবেচনায় ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর ২০১৫ এবং ২০১৮ সালে আবার ২ শতাংশ ডাউনপেমন্ট দিয়ে ঋণ নিয়মিত এবং পুনর্গঠনসহ বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া হয়। করোনা শুরুর পর ২০২০ সালে ১ টাকা না দিলেও ঋণ নিয়মিত দেখানোর সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর ২০২১ সালে কিস্তির ১৫ শতাংশ এবং ২০২২ ও ২০২৩ সালে অর্ধেক দিলেই নিয়মিত দেখানো যেত। আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নরের দায়িত্ব নিয়ে ২০২২ সালে ঋণ পুনঃতফসিলের নীতিমালায় ব্যাপক শিথিলতা আনেন। আগে যেখানে ঋণ পুনঃতফসিলে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ ডাউনপেমন্ট দিতে হতো, তা কমিয়ে আড়াই থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ করা হয়। পটপরিবর্তনের পর এখন আবার বিশেষ বিবেচনায় পুনঃতফসিলের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

ঢাকা মহানগর উত্তর আ.লীগ বজলু-কচির পদ বাণিজ্য

প্রকাশ: ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ০৫:১০ এএম
আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৫ এএম
বজলু-কচির পদ বাণিজ্য
খবরের কাগজ ইনফোগ্রাফ

ঘোষণা দিয়ে পদ-বাণিজ্য করেছেন (২০২১-২১ সালে) ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি। সভাপতি বজলুর রহমান তার কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক রানার মাধ্যমে চুক্তি করে পদপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে টাকা নিতেন। সাধারণ সম্পাদক কচি ‘বিনিময়ে’র মাধ্যমে কমিটি বাণিজ্য করেছেন। শীর্ষ এই দুই নেতার অনুসারীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও দখলদারত্বের অভিযোগের শেষ নেই।

সাবেক ছাত্রনেতা আজিজুল হক রানা ছিলেন সভাপতি বজলুর খুবই ঘনিষ্ঠ। এই সুবাদে তুলনামূলক অল্প বয়সেই নগর উত্তর আওয়ামী লীগের ১ নম্বর সাংগঠনিক সম্পাদক পদ পান রানা। এরপর দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে অসদাচরণ শুরু করেন তিনি। অনেক নেতাকে হেনস্তা করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। মহানগরের ওয়ার্ড ও থানার সম্মেলন শুরু হলে রানা আরও গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠেন। বজলুর অনুসারীরা পদের জন্য টাকা নিয়ে রানার কাছে ধরনা দিতেন। শীর্ষ পদ ছাড়া বাকি সহ-সভাপতি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদকসহ অন্য পদের জন্য রানা নিজেই মোটা অঙ্কের টাকা অথবা ফ্ল্যাট-প্লট নিতেন। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য টাকার পরিমাণ নির্ধারণ হলে বজলুর সঙ্গে প্রার্থীদের কথা বলিয়ে দিতেন রানা। পদের জন্য তৃণমূল নেতাদের ফোন করে টাকা লেনদেনের কয়েকটি রেকর্ড এই প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে। যাদের কাছে টাকা চাওয়া যাবে না- এমন পদপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে ফ্ল্যাট, প্লটও নিয়েছেন বজলুর। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বজলুর রহমানের একাধিক বাড়ি রয়েছে। তার একাধিক প্লট ও ফ্ল্যাট রয়েছে মোহাম্মদপুর-বছিলা ও উত্তরায়।

পদপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ে রানার ছিল অভিনব প্রক্রিয়া। দলের নাম বিক্রি করে তিনি নিজের আখের গুছিয়েছেন বেশ ‘দক্ষতার’ সঙ্গে। লালমাটিয়ায় রানা চারটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। এ ছাড়া আদাবর থানা আওয়ামী লীগের কমিটিতে পদ দেওয়ার কথা বলে দুই নেতার কাছ থেকে দুটি প্লট হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। মোহাম্মদপুরজুড়ে বিভিন্ন হাউজিংয়ে রানার রয়েছে অংশীদারত্ব। সেই সব হাউজিংয়ে তার একাধিক ফ্ল্যাট ও প্লট রয়েছে। এ ছাড়া হাউজিংয়ে প্লট বরাদ্দকারীদের কাছ থেকে গ্যাসলাইন, বিদ্যুৎ, সড়ক-পানির লাইনের নামে চাঁদাবাজিও করেছেন তিনি দলের নাম ভাঙিয়ে।

এদিকে দলের চেয়ে ব্যবসায় মনোযোগী ছিলেন উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিজিএমইএর সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। এই কারণে একপর্যায়ে নগরের থানা এবং ওয়ার্ড কমিটির কার্যক্রমে অমনোযোগী হয়ে পড়েন। বিজিএমইএতে কাঁচা টাকার প্রভাব থাকায় সেখানেই তিনি মনোনিবেশ করেন। নগরে দলকে শক্তিশালী করার জন্য তাকে বারবার ডাকা হলেও তিনি বিজিএমইএ নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন বলে জানিয়ে দায়িত্ব অবহেলা করেন। এর ফলে দুর্বল কমিটি ঘোষণা করা সম্ভব হয়নি।

এস এম মান্নান কচি ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় দলীয় প্রভাব একচেটিয়া কাজে লাগিয়ে সুবিধা নিয়েছেন তার ভাই কাউন্সিলর আব্দুর রউফ (নান্নু)। তার বিরুদ্ধে মিরপুর এলাকায় চাঁদাবাজি ও দখলের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।

মিরপুর সাড়ে ১১-তে কয়েক একর জায়গায় নান্নু তৈরি করেছেন বিশাল মার্কেট। এই মার্কেটের কিছু অংশ তিনি ক্রয় করেন। তবে এর বেশির ভাগটাই তিনি দখল করেন। ওই মার্কেটের তিন পাশে রয়েছে ফুটপাত। সেখান থেকে দৈনিক চাঁদা যেত নান্নুর পকেটে। নান্নুর রয়েছে নিজস্ব বাহিনী, যাদের অধিকাংশই কিশোর গ্যাং সদস্য। এই বাহিনীর বিরুদ্ধে থানায় মাদক ও চাঁদাবাজির একাধিক মামলা রয়েছে। চিহ্নিতরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও দলীয় প্রভাবের কারণে প্রশাসন এতদিন পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। সরকার পরিবর্তনের পর থেকে এই সন্ত্রাসীরা গা ঢাকা দিয়েছে।

এই মার্কেটের পাশেই রয়েছে এস এম মান্নান কচির বহুতল বাড়ি। গুলশান-২ নম্বরেও ৫ কাঠা জায়গায় একটি তিনতলা বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে কচির। উত্তরা, মিরপুর, বছিলা, তিনশ ফিটে তার একাধিক প্লট রয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন হাউজিংয়ে তার রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট। ঢাকা মহানগর উত্তরের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক পদের বিনিময়ে খসরু চৌধুরীর কাছ থেকে উত্তরার দক্ষিণখান এলাকায় তিন বিঘার প্লট নিয়েছেন কচি। পরবর্তী সময়ে খসরু এই পদকে অবলম্বন করে ঢাকা-১৮ আসনের এমপিও হন। খসরুকে নিজের ব্যবসায়িক পার্টনারও বানিয়েছেন কচি। এ ছাড়া মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে আব্দুস সালামকে মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক পদ দিয়েছেন কচি।

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের কয়েক মাস আগে নির্বাচন ছাড়াই বিজিএমইএর সভাপতি হন কচি। অভিযোগ রয়েছে, দলীয় প্রভাব খাটিয়ে নির্বাচন ছাড়াই ব্যবসায়ীদের বৃহৎ এই সংগঠনের সভাপতি হন তিনি। কচিকে নির্বাচিত করতে বিপুল টাকাও ঢালেন খসরু চৌধুরী। বিনিময়ে গার্মেন্টের বিভিন্ন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নেয় কচির সিন্ডিকেট। বিজিএমইএ সভাপতির পদে বেশি দিন থাকতে না পারলেও কচি ঠিকই নিজের আখের গুছিয়ে নেন। আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে ব্যবসা রয়েছে তার। সরকার পতনের পর লন্ডনে পাড়ি জমান ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি। সেখানে (লন্ডন) তার প্রপার্টি এবং ব্যবসা রয়েছে বলে জানিয়েছেন দলটির নেতারা।

ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বজলুর রহমান ও কচির মধ্যে একসময় চরম মতবিরোধ ছিল। দুই নেতার দ্বন্দ্বের কারণে থানা ও ওয়ার্ডের কমিটিগুলো আলোর মুখ দেখেনি। সভাপতি বজলুর রহমান কমিটিতে পদ দেওয়ার কথা বলে পদপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে টাকা নেন। আর সাধারণ সম্পাদক কচি দলের চেয়ে ব্যবসাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এই নিয়ে দুই নেতা এক টেবিলে বসলেই শুরু হতো বাগবিতণ্ডা। ২০২৩ সালের ২৮ আগস্ট সংগঠনের এক বৈঠকে বজলুর রহমান ও কচি বাগবিতণ্ডায় জড়ান। একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে পদ-বাণিজ্যের অভিযোগ তোলেন।

নগর উত্তরের তৃণমূল নেতারা বলেছেন, বজলুর ও কচি দলের শীর্ষ পদে থেকে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী আন্দোলন চলার সময়ে তৃণমূলে কোনো নির্দেশনা সঠিকভাবে আসেনি। কার নেতৃত্বে কর্মীরা মাঠে নামবেন তারও সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা ছিল না। কারণ থানা-ওয়ার্ড পর্যায়ে দলের কমিটি নেই। নেতাদের মাঠে নামার মতো দলীয় পরিচয়ও ছিল না। এর মূল্য দিতে হয়েছে দল ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার মধ্য দিয়ে।

তবে সরকার পতন হলেও থেমে নেই ওই দুই নেতার চাঁদাবাজি। ৫ আগস্টের পর সভাপতি বজলুর রহমান পালিয়ে ভারতে চলে যান। সাধারণ সম্পাদক কচি লন্ডনে পাড়ি জমান। আর দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নগরের বিভিন্ন স্তরের নেতাকে ফোন করে আওয়ামী লীগের নামে টাকা চাইছেন তারা।

উত্তরার দক্ষিণখান থানা আওয়ামী লীগের এক নেতা খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাকে বজলুর ভাইয়ের এক ঘনিষ্ঠ লোক ফোন করে কিছু টাকা চেয়েছেন। তারা নাকি নেতা-কর্মীদের জন্য খরচ করছেন। ফান্ডে টাকা দিতে হবে। উত্তরে আমি জানিয়েছি, সময় হলে দেব।’

সওজের ৯৫০ কোটি টাকা লুটপাট

প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:০২ পিএম
আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:১১ পিএম
সওজের ৯৫০ কোটি টাকা লুটপাট
ছবি : খবরের কাগজের গ্রাফিক্স

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) বিভিন্ন সেতু এবং সড়কের টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে ৯৫০ কোটি টাকা লোপাটের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে পাঁচ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো ইউডিসি, শামীম এন্টারপ্রাইজ, র‌্যাগনাম, তানভির ও সিএনএস। এসব প্রতিষ্ঠান ২০১২ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এ পরিমাণ অর্থ লোপাট করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

এসব কাজে সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্পবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী মির্জা আজম, সাবেক চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন, সাবেক এমপি মুজিবুর রহমান চৌধুরীর (নিক্সন চৌধুরী) মদদ ছিল বলে জানান সওজের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তারা জানান, সর্বনিম্ন দরদাতা না হয়েও কার্যাদেশ বাগিয়ে নিত পাঁচ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সাবেক সরকারের প্রভাবশালী নেতাদের পাশাপাশি সওজের অসাধু কর্মকর্তারা এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে অসাধু উপায়ে কাজ পেতে সহযোগিতা করেছেন। তৃতীয় দরদাতা হয়েও কাজ পেয়ে যায় ইউডিসি 

জানা গেছে, তৃতীয় দরদাতা হয়েও কাজ পেয়ে যায় ইউডিসি। এতে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয় ৩৩ কোটি টাকা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মেঘনা-গোমতী সেতু, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী সেতু (শাহ আমানত সেতু) ও পোর্ট এক্সেস সড়কের টোল, ঈশ্বরদীর পাকশী সেতু (লালন শাহ সেতু), নাটোরের নলকা-হাটিকুমরুল রোডের টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজটি পেয়েছিল ইউডিসি কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার মো. কামাল হোসেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজমের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন বলে জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে, মির্জা আজমের সঙ্গে যোগসাজশে কামাল হোসেন সর্বনিম্ন দরদাতা না হয়েও সওজের গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাগিয়ে নেন। বিভিন্ন পণ্য সরবরাহ, প্রযুক্তি সহায়তা করতে তিনি এই কার্যাদেশ পান। 

২০২১-২২ সালে সওজের অধীনে থাকা নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ এলাকার মেঘনা সেতু, কুমিল্লার দাউদকান্দি এলাকার মেঘনা-গোমতী সেতুর টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ পায় ইউডিসি। অভিযোগ রয়েছে, এসব কার্যাদেশের প্রথম দরদাতাকে (দর ৩৩ কোটি ৯৮ লাখ টাকা) টপকে কাজ দেওয়া হয় তৃতীয় দরদাতা ইউডিসিকে (দর ৬৭ কোটি ৪৭ লাখ)। এই কার্যাদেশ পেতে ইউডিসিকে সহায়তার অভিযোগ রয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন যুগ্ম সচিব মনিন্দ্র কিশোর মজুমদার, সওজের ঢাকা জোনের তৎকালীন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান (এখন ঢাকা বাইপাস প্রকল্পের পরিচালক), নারায়ণগঞ্জ সড়ক সার্কেলের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. নাজমুল হকের বিরুদ্ধে। সওজের নানা সূত্র বলছে, যোগ্য ঠিকাদারকে কাজ বুঝিয়ে না দেওয়ায় রাষ্ট্রের ৩৩ কোটি ৪৯ লাখ ৩৫ হাজার টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
 
সড়ক ও সেতু বিভাগের টেন্ডার জালিয়াতিতে ইউডিসির সঙ্গী হয়েছিল ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মো. ইকরামুল হক টিটুর প্রতিষ্ঠান শামীম এন্টারপ্রাইজ প্রাইভেট লিমিটেড। টিটুর ভাই মো. আমিনুল ইসলাম এই প্রতিষ্ঠান দেখভাল করতেন। তিনি সড়ক ও সেতু বিভাগ থেকে লোপাট করা অর্থে কক্সবাজারের ইনানী সমুদ্রসৈকতে সি পার্ল বিচ রিসোর্চ অ্যান্ড স্পা লিমিটেড নামে একটি পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ করেন, যা রয়েল টিউলিপ নামে পরিচিত। 

ইউডিসির অর্থ লোপাটের কর্মকাণ্ডে মোহাম্মদ হুসেইন জনির র‌্যাগনাম রিসোর্স লিমিটেড ও তানভির আহমেদ সানুর তানভির কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বিভিন্ন নথি বলছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডু, মানিকগঞ্জের বাথুলী, নরসিংদীর চরসিন্দুর, ময়মনসিংহের শ্যামগঞ্জ-ঝারিয়া-বিরিশিরি-দুর্গাপুর সড়ক, খুলনা-সাতক্ষীরা সড়কের ওজন স্কেল স্থাপনের কাজ বাগিয়ে নিয়েছে র‌্যাগনাম রিসোর্স ও তানভির কনস্ট্রাকশন। এতে প্রচ্ছন্ন মদদ ছিল সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের, যার নির্দেশে সওজের অনেক প্রকৌশলীও এই অপকর্মে সহযোগিতা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সওজে জমা হওয়া বিভিন্ন অভিযোগপত্র থেকে জানা যায়, র‌্যাগনাম ও তানভির কনস্ট্রাকশন, ইউডিসি ও এম এম বিল্ডার্সের নামে দরপত্র কিনে এসব প্রতিষ্ঠানের অসাধু কর্মকর্তারাই পূরণ করতেন ও সমর্থনকারী হিসেবে জমা দিতেন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দুটির কর্মীরা সড়কে মালামালবাহী গাড়ি থেকে চাঁদাবাজিও করেছেন। অতিরিক্ত মালামালবোঝাই গাড়ি থেকে সরকার যে জরিমানার অর্থ পেত, তাও এই দুই প্রতিষ্ঠান ভাগাভাগি করে নিয়েছে বলে সওজে অভিযোগ রয়েছে। 

ইউডিসি কনস্ট্রাকশনের প্রশাসন বিভাগের পরিচালক এহসানুল হক মুকুল এ বিষয়ে বলেন, ‘এখন তো একটি বিশেষ সময় চলছে। আর আমাদের তো শত্রুর অভাব নেই। কে কী অভিযোগ করেছে তা আমরা জানি না। তবে সওজের কাজ পেতে ইউডিসি কখনো কোনো অনিয়ম করেনি।’

গত ৫ আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্যান্য অভিযুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা গা ঢাকা দিয়েছেন। মোবাইল ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ ও ই-মেইলে বার্তা পাঠালেও একটি ছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে উত্তর আসেনি। ঠিকাদার র‌্যাগনাম রিসোর্সের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান বলেন, ‘সওজের প্রতিটা টেন্ডার ছিল উন্মুক্ত পদ্ধতিতে। এখানে আমরা যত কাজ পেয়েছি, তার সব কটিতেই আমরা লোয়েস্ট প্রাইস বিড করেছি। আমাদের টেন্ডার স্পেসিফিকেশনের কাজগুলো করেছেন সওজের প্রকৌশলীরা। সড়কে আমরা যত ওজন যন্ত্র বসিয়েছি তার সব কটিই করেছি সওজের পরামর্শে। তারা যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে আমাদের ওজন যন্ত্র কিনতে বলতেন, আমরা সেসব প্রতিষ্ঠান থেকেই কিনেছি। টেন্ডার জালিয়াতির অভিযোগ ভিত্তিহীন।’

অভিযুক্ত সওজ কর্মকর্তা সবুজ উদ্দিন খানের বক্তব্য জানতে তার কার্যালয়ে গেলে তিনি তার কক্ষে প্রবেশের অনুমতি দেননি।
 
নারায়ণগঞ্জ সড়ক সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. নাজমুল হক জানান, ইউডিসি কনস্ট্রাকশনের সঙ্গে সওজের চুক্তি রয়েছে আগামী জুন মাস পর্যন্ত। ইউডিসি, শামীম এন্টারপ্রাইজসহ অন্যান্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম সম্পর্কে নাজমুল হক বলেন, ‘এখন কোথাও কোনো অনিয়ম হয় না। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মেঘনা-গোমতী সেতু বলেন আর মেঘনা সেতুর কথা বলেন, আর মহাসড়কের নানা টোল; সবকিছু এখন সময়মতো সওজ কোষাগারে জমা হচ্ছে।’ আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যোগসাজশের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এগুলো মিথ্যা অভিযোগ।’

দরপত্র ছাড়াই কাজ পায় সিএনএস, আর্থিক ক্ষতি ৩০০ কোটি টাকা
মেঘনা সেতু ও মেঘনা-গোমতী সেতুর টোল আদায়ে আর্থিক দুর্নীতিতে নাম এসেছে সিএনএস লিমিটেডের। সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ভাইয়ের এ প্রতিষ্ঠানের প্রতি সদয় দৃষ্টি ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্পবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানেরও। জানা যায়, ২০১৫ সালে কোনো টেন্ডার আহ্বান না করে অভিজ্ঞতাবিহীন প্রতিষ্ঠান সিএনএসকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দুটি সেতুর টোল আদায়ের কাজ পাইয়ে দেওয়া হয়। ১৯ শতাংশ কমিশনে সিএনএসকে ৫ বছরের জন্য কাজ দেওয়া হয়। জানা যায়, এতে ৩০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কাজ পেলে মাত্র ৫-৬ শতাংশ কমিশনে ঠিকাদার পাওয়া যেত। 

এ ছাড়া চট্টগ্রামের শাহ আমানত সেতু, খুলনার খান জাহান আলী সেতু (রূপসা সেতু), পাকশীর লালন শাহ সেতু, চট্টগ্রাম বন্দর সংযোগ সড়ক, নাটোরের নলকা-হাটিকুমরুল সড়ক, ঘোড়াশালের শহিদ ময়েজ উদ্দিন সড়ক সেতু, ভৈরবের ব্রহ্মপুত্র সেতু, মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর সেতু, যমুনা সেতু এবং পটুয়াখালীর লেবুখালী সেতুর টোল আদায় থেকেও কোটি কোটি টাকা সিএনএস বাগিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসব সেতুর মালামাল সরবরাহ, প্রযুক্তি সংযোগ-পরিচালন-রক্ষণাবেক্ষণসংক্রান্ত বিভিন্ন দরপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব সেতুতে ওজন পরিমাপক যন্ত্র স্থাপন এবং যন্ত্র স্থাপনের পর আদায় করা জরিমানার টাকাও লোপাট করেছেন সিএনএসের কর্মীরা। 

এরও তিন বছর আগে ২০১২ সালে এই দুই সেতুর টোলপ্লাজার কাজ বাগিয়ে নিয়েছিল সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ঘনিষ্ঠ রতনের প্রতিষ্ঠান ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বিনা টেন্ডারে প্রায় ৬৫০ কোটি টাকার কাজ পাইয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। 

সেতুর টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ রয়েছে মো. মহিউদ্দিন মঈনের এম এম বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের বিরুদ্ধে। জানা যায়, সাবেক চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন, সাবেক এমপি মুজিবুর রহমান চৌধুরীর (নিক্সন চৌধুরী) সহায়তায় মো. মহিউদ্দিন সওজ ও সেতু বিভাগে টেন্ডার সিন্ডিকেট তৈরি করেছিলেন। ছোট ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দিতে তিনি কোটি কোটি টাকা ঘুষ নিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। 

জাল সার্টিফিকেট, ওয়েবসাইটে তথ্যের কারসাজি 
সড়ক ও জনপথ বিভাগের ঠিকাদারদের নানা অনিয়ম তদন্ত করেছেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প্রকিউরমেন্ট সার্কেল) মো. আহসান হাবিব। তিনি জানান, গত কয়েক বছর ধরে ১৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অভিজ্ঞতার জাল সনদ দিয়ে বারবার কাজ পেয়ে যাচ্ছে। এতে সওজের কিছু দায় আছে। এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা সওজের ওয়েবসাইটে খেয়াল-খুশিমতো তথ্য ও সনদ আপলোড করেন। দেখা গেছে, কোনো প্রতিষ্ঠান তার অভিজ্ঞতার প্রমাণ হিসেবে কয়েক শ সনদ আপলোড করেছেন। পরবর্তী সময়ে সব সনদ নিরীক্ষা করার সুযোগ থাকে না সওজের কর্মকর্তাদের। অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব সনদের অধিকাংশই ভুয়া। 

আহসান হাবিব বলেন, ‘এই ১৫টি প্রতিষ্ঠানই সওজের কাজগুলো পাওয়ার জন্য যথোপযুক্ত প্রতিষ্ঠান ছিল। অভিজ্ঞতার দিক থেকে তারা এগিয়ে থাকত বলে বারবার তারা কাজ পেয়েছে। যেমন টোলপ্লাজার কাজের সিএনএস থেকে দক্ষ প্রতিষ্ঠান সওজ খুঁজে পায়নি। কারণ সওজের তখন নিজস্ব টোল কালেকশন সফটওয়্যার বা সিস্টেম ছিল না। বাধ্য হয়ে তাদের সেবা নিতে হয়েছে। তবে এখন আমরা টোল কালেকশনের টেন্ডারে নন-স্ট্যান্ডার্ড টেন্ডার ডকুমেন্ট সিস্টেম চালু করে দিচ্ছি। এতে করে যারা সফটওয়্যার বেইজড ফাইন্যান্স কালেকশনের কাজ করছে তারা সবাই আবেদন করতে পারবে। আর এখন টোল কালেকশন সফটওয়্যারও সওজ তৈরি করেছে। এতে এখন দুর্নীতি থাকবে না।’
 
উন্মুক্ত দরপত্র প্রক্রিয়ায় কোনো কার্যক্রমের প্রাক্কলিত দাপ্তরিক দর যদি ১০০ টাকা হয়, তাহলে দরপত্রে অংশ নেওয়া ঠিকাদাররা যদি ওই দরের ১০ শতাংশ কম বা বেশির মধ্যে দর না দেন, তাহলে ওই ঠিকাদারকে অযোগ্য বিবেচনা করা হবে। 

এটিকে দরসীমা বা প্রাইস ক্যাপও বলা হয়। সরকারি কেনাকাটার একটি পদ্ধতির কারণেও সওজের ঠিকাদাররা দুর্নীতির আশ্রয় নেন বলে মন্তব্য করেন আহসান হাবিব। তিনি বলেন, ‘এই প্রক্রিয়ার কারণে ঠিকাদারদের মধ্যে একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। সবাই তো জানেই কোন কাজের রেট কত। এখানে টেন্ডার বিড করে দক্ষতা প্রমাণ করতে ভুল কাগজ, সার্টিফিকেট জমা দিচ্ছেন ঠিকাদাররা। তবে ১০ পার্সেন্ট প্রাইস ক্যাপ সিস্টেমটা সরকার তুলে দিতে চায়। তখন হয়তো এই টেন্ডার জালিয়াতি, ভুয়া সার্টিফিকেটের রমরমা বাণিজ্য বন্ধ হবে।’

সওজ বিভিন্ন সময়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ঠিকাদারদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিলেও সুফল মেলেনি। যাদের কালো তালিকাভুক্ত করা হয় তারা উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে এসে আবার কাজ বাগিয়ে নিচ্ছেন। এতে করে সওজের দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করা যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন সওজের তদন্ত কমিটির এই সদস্য।