
আগামী বছরের শেষে দেশে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সূত্রগুলো থেকে এমন আভাসই পাওয়া যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, নির্বাচনের আগে চলতি ডিসেম্বর মাসের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগ নেওয়া সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করার কাজ শেষ হতে পারে বলে আশা করা যাচ্ছে। জানা গেছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার কিছুটা চাপের মুখে রয়েছে। কারণ দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির পাশাপাশি সমমনা দলগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন দেওয়ার কথা বলছে। সংস্কার উদ্যোগসহ নানা ইস্যুতে এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার কিছুটা জটিলতার মধ্যেও পড়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে অবস্থান করায় সাম্প্রতিক জটিলতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তার ফাঁস হওয়া বক্তব্য, ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস গ্রেপ্তার-পরবর্তী পরিস্থিতি এবং ভারতীয় গণমাধ্যমের ব্যাপক নেতিবাচক প্রচারে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বেশ ঘোলাটে হয়েছে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে শিক্ষা ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ শনিবার (৭ ডিসেম্বর) এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আগামী বছর নির্বাচিত সরকার দেখা যাবে। গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) উদ্যোগে আয়োজিত এবিসিডি সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে তিনি এ কথা বলেন। তিনি অবশ্য বলেন, এটা তার একান্ত ব্যক্তিগত মত। শেষমেশ কী হবে তা জানেন না বলেও মন্তব্য করেন।
এর আগে গত ২৪ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে তা একমাত্র প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হবে। এ নিয়ে যারা কথা বলছেন তারা ব্যক্তিগত মতামত দিচ্ছেন বলেও জানানো হয় প্রেস উইং থেকে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরুর পর থেকেই বিএনপি যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। সর্বশেষ গত বুধবার বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপে বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ‘প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করা হলে আর কেউ ষড়যন্ত্রের সাহস পাবে না।’
বিএনপির অন্যতম প্রবীণ এই নেতা গতকাল খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা দিনক্ষণ বা মাস এখন বলছি না। তবে যত শিগগিরই সম্ভব নির্বাচন দেওয়া উচিত। দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক- এমন সময়ের মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচনমুখী হতে হবে। দেশের জনগণ একটি নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায়।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা যৌক্তিক সময়ের মধ্যেই নির্বাচন চাই, এ কথা একাধিকবার জানিয়েছি। এই কথা বুদ্ধিমান ও ভদ্রলোকদের দিনক্ষণ বলা লাগে না, তারা অনুমান করতে পারেন- আসলে কতটা সময় দেওয়া হয়েছে। তাই আশা করি, সরকার বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সময় নির্ধারণ করেই নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হবে।’
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা প্রয়োজনীয় সব সংস্কার কাজ শেষে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই, যেখানে ভোটাররা নিরপেক্ষভাবে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন। এখানে সময়ের চেয়ে নির্বাচনের পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আগের মতো নির্বাচন হলে জনগণ মানবে না। তাই প্রয়োজনীয় সংস্কারে পরই আমরা নির্বাচন চাই।’
জানা গেছে, সংস্কার প্রস্তাবসহ বিভিন্ন কারণে অন্তর্বর্তী সরকার দুই-এক বছর ক্ষমতায় থেকে সংস্কার প্রস্তাব কার্যকরসহ বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ বাস্তবায়নের পর নির্বাচন দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সরকারবিরোধী শক্তিগুলোর অপতৎপরতার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির মুখে ক্ষমতা আর দীর্ঘস্থায়ী করার পক্ষে নয় অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকে। তারা নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হন্তান্তর করে নির্বিঘ্নে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে চান।
সূত্রের দাবি, আগামী নির্বাচন নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের পর্দার আড়ালে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা ও বোঝাপড়ার চেষ্টা চলছে। বিএনপি ও জামায়াতসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল সরকারকে সময়ও দিতে চায়। কিন্তু সেটি কোনোক্রমেই এক বছরের বেশি নয়। কারণ বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো মনে করে, বেশি দিন এই সরকার ক্ষমতায় থাকলে তাতে বিএনপির ক্ষমতায় আসার পথ বিঘ্নিত হতে পারে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ পক্ষের শক্তির তৎপরতা বৃদ্ধি পেতে পারে। তাই সরকারের জন্য ভালো এবং বিএনপির জন্য নিরাপদ- এমন একটি আস্থার বার্তা দিতে চায় বিএনপি।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘সংস্কার ও নির্বাচন দ্রুত হলে ভালো। আমরা সংস্কারের পর নির্বাচনের কথা বলেছি। তাই সংস্কারকাজ আরও গতিশীল করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি কিছু সংস্কারকাজ আছে সেগুলো নির্বাচিত সরকার করবে। আবার নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত এমন কাজগুলো দ্রুত সংস্কার করতে হবে। তবে কোনো কাজেই কালক্ষেপণ করা যাবে না।’
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা ও গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকী খবরের কাগজকে বলেন, ‘নির্বাচন কবে হবে তার দিনক্ষণ চূড়ান্ত করতে রাজনৈতিক দল, স্টেক হোল্ডার ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা প্রয়োজন। গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর নতুন বন্দোবস্তের মাধ্যমে এবারের নির্বাচন হবে। তাই প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে কত দিন সময় লাগবে এটাও পরিষ্কার করা দরকার। অংশীদারদের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনের সবকিছু নির্ধারণ করা জরুরি।’
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, আগামী বছরের শেষ দিকে নির্বাচন হলে দেশের জন্য ভালোই হবে। এটা ইতিবাচক হিসেবে দেখবে রাজনৈতিক দলগুলো। ইসলামী আন্দোলনও শুরু থেকেই দেড় বছরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু এর আগে বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, সংবিধানসহ সংস্কার কাজগুলো শেষ করতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। এ জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।
গণ-অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর খবরের কাগজকে বলেন, ‘আগামী বছর নির্বাচন হবে- সরকারের পক্ষ থেকে এমন কোনো স্পষ্ট মেসেজ আমরা পাইনি। বিশেষ করে বিগত ৩টি মিটিংয়ে তারা কোনো কিছুই বলেনি। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ১০টি সংস্কার কমিশন এই মাসে (ডিসেম্বর) সংস্কার প্রস্তাব জমা দেওয়ার পর সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, আগামী এক বছরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব নয়। তাই আমাদের জাতীয় ঐক্য ধরে আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে সংস্কারকাজে মনোযোগ দেওয়া উচিত। সবার মতামতের ভিত্তিতে সময়োপযোগী দিনক্ষণ চূড়ান্ত করতে হবে।’
সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সরকারবিরোধী তৎপরতার পরে আগামী বছরের নির্বাচনের বিষয়টি জনগণের আলোচনায় স্থান পেয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপি কেউ চায় না- ‘ফ্যাসিবাদী’ শক্তির আবারও উত্থান হোক। এমন অবস্থান থেকেই সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একধরনের ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে ভারত প্রশ্নে সবাই একমত পোষণ করেছে। ফলে আগামী বছরের শেষ দিকে নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিটির প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কবে হবে- এ ব্যাপারে তার কোনো ধারণা নেই।