
‘বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রায় ১০ দিন সহজে পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে দাম অনেক বেশি। তাই তেল রাখি না। সংকট কাটছে না।’ এভাবেই মোহাম্মদপুরের টাউন হল বাজারের মনির স্টোরের আনোয়ার হোসেন তেলসংকটের কথা বলেন। এই চিত্র শুধু মনির স্টোরের না। ঢাকা শহরের কারওয়ান বাজার, হাতিরপুলসহ সব বাজারের অধিকাংশ খুচরা দোকানের প্রায় একই চিত্র। পাড়া-মহাল্লার অবস্থা আরও খারাপ। বেশি দাম ছাড়া মিলছে না সয়াবিন তেল। ডিলার ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, দাম বাড়ানোর জন্য হয়তো মিলমালিকরা সংকট সৃষ্টি করেছেন।’
রবিবার (৮ ডিসেম্বর) রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেট, টাউন হল বাজার, হাতিরপুল বাজার ঘুরে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
রাজধানীর কৃষিপণ্যের পাইকারি বাজার কৃষি মার্কেট ও কারওয়ান বাজার। এসব বাজার থেকে খুচরা ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন পণ্য কিনে তা ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করেন। সয়াবিন তেল আছে কি-না, এমন প্রশ্নের জবাবে কৃষি মার্কেটের সিটি এন্টারপ্রাইজের আবু তাহের খবরের কাগজকে বলেন, ‘বোতলের কোনো সয়াবিন তেল নেই। সরবরাহ কমে গেছে। কোম্পানি দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে। এ জন্য সংকট সৃষ্টি করছে। তবে খোলা তেল পাওয়া যাচ্ছে। পাইকারিতে ১৭১-১৭৩ টাকা লিটার বিক্রি হচ্ছে। সেটা বিভিন্ন খুচরা দোকানে ১৭৫ টাকা লিটার বিক্রি হচ্ছে।’
এই বাজারের আরেক পাইকারি ব্যবসায়ী মেসার্স পারভেজ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী পারভেজ হোসেন বলেন, ‘টিকে গ্রুপের পুষ্টি কিছু তেল দিচ্ছে। তবে তারা সঙ্গে আটা নেওয়ার শর্তজুড়ে দিচ্ছে।’
বাজারের সিটি গ্রুপের পরিবেশক (ডিলার) মেসার্স খালেক অ্যান্ড সন্সের স্বত্বাধিকারী মো. আবদুল খালেক ভূঁইয়া বলেন, ‘বোতলের তেল যে একেবারে পাই না, তা নয়। চাহিদার তুলনায় তা খুবই কম। আগে ৫০০ থেকে ৭০০ কার্টন (এক কার্টনে ২০ লিটার) তেল পেতাম। এখন কোনো দিন হয়তো পাচ্ছি ১০০ কার্টন। তিনি আরও বলেন, বসুন্ধরাসহ দুটি গ্রুপের তেল উৎপাদন বন্ধ। তারাও তো বাজারে অনেক তেল সরবরাহ করত। ভোক্তারা তাদের তেল পাচ্ছেন না। এ জন্য তীর, ফ্রেস ও পুষ্টির ওপর চাপ পড়েছে।’ আটা ছাড়া তেল না দেওয়ার ব্যাপারে এই পরিবেশক বলেন, ‘সবার আটা সরিষার তেল লাগে। তাই তেল দেওয়ার সময় আটা ও সরিষার তেলের কথা বলা হয়। কাউকে নিতে বাধ্য করা হয় না।’
এদিকে কারওয়ান বাজারেও বোতলজাত তেলসংকটের একই দশা দেখা গেছে। এই বাজারের খুচরা বিক্রেতা জনি স্টোরের মো. জনি রায়হান বলেন, ‘ডিলারের কাছে গিয়েও তেল পাইনি। প্রভাবশালী পাইকারি ব্যবসায়ী ও সরবরাহকারী সোনালি ট্রেডার্সও তেল দিতে পারেনি। তারা বলছে, কোম্পানি থেকে তেল সরবরাহ করা হয় না।’
এই বাজারের মেঘনা গ্রুপের ডিলার মেসার্স জামান ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মো. জামাল হোসেন বলেন, ‘কোম্পানি থেকে আগের মতো বোতলের তেল দিচ্ছে না। দিনের চাহিদা হয়তো ২০০ কার্টন। সর্বশেষ গত সোমবার ৮০ কার্টন তেল পেয়েছি। এভাবে ব্যবসা করা যায় না।’
বাজার স্থিতিশীল করার জন্য জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর প্রতিদিন বাজারে অভিযান চালাচ্ছে। তারপরও বোতলজাত তেলের সংকট কাটছে না।
এর কারণ জানতে চাইলে সরকারি প্রতিষ্ঠানটির ঢাকা বিভাগের সহকারী পরিচালক বিকাশ চন্দ্র দাস খবরের কাগজকে বলেন, ‘গতকাল সিটি গ্রুপের ভোজ্যতেলের মিল ভিজিট করা হয়েছে। আমরাও তেল সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণ জানতে চেয়েছি। মিল থেকে বলা হয়েছে, গ্যাসের সংকট, ব্যাংক থেকে এলসি খুলতে না পারার কারণে রিফাইনারি মিল থেকে আগের মতো তেল উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এ জন্য এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে সরবরাহও কমে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পরির্দশনে দেখা গেছে, গত ১ ডিসেম্বর ১০ হাজার ৯০৪ কার্টন ও ২ ডিসেম্বর ১০ হাজার ৪১৪ কার্টন তেল সরবরাহ করা হলেও গত শনিবার মাত্র ৪৬৫ কার্টন ও গতকাল ৫০৩ কার্টন বোতলজাত তেল ডিলারের কাছে সরবরাহ করা হয়েছে। এর কারণ হিসেবে মিল কর্তপক্ষ বলেছে, গ্যাসের সংকট ও ব্যাংকে এলসি খোলা যাচ্ছে না। সে জন্য উৎপাদনও করা যাচ্ছে না। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রুড অয়েলের দামও বেশি। এ জন্য উৎপাদনও কমে গেছে। ফলে মিল থেকে বাজারে আগের মতো তেল সরবরাহ করা যাচ্ছে না।’
আসলে সংকট কোথায়? কেন বাজার তেলশূন্য? এসব জানতে ভোজ্যতেল উৎপাদনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনে যোগাযোগ করা হলে কেউ কথা বলতে রাজি হননি। তবে মেঘনা গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক তসলিম শাহরিয়ার বলেন, ‘আমরা ডিলারদের তেল দিচ্ছি। কিন্তু চাহিদার তো শেষ নেই। তাই হয়তো কারও কারও কাছে মনে হচ্ছে কম পাওয়া যাচ্ছে।’
দাম বাড়ানোর জন্যই কি এভাবে সংকট তৈরি করা হয়েছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ট্যারিফ কমিশনের সঙ্গে বৃহস্পতিবার মিটিং হয়েছে। তারা মূল্য সংশোধনের ব্যাপারে প্রক্রিয়া যাচাই করছে। চূড়ান্ত হলে সেটা আমাদের জানানো হবে।’ সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিতের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
দামের ব্যাপারে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের উপ-প্রধান মো. মাহমুদুল হাসান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেশি। সপ্তাহের ব্যবধানে ব্যারেলে ৫০ থেকে ৬০ ডলার দাম বেড়েছে। দামের ব্যাপারে মিলমালিকদের সঙ্গে চার দিন আগে পর্যালোচনা সভা হয়েছে। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। দাম বাড়াবে কিনা এটা সরকারের সিদ্ধান্ত।’
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই বলছে, বাংলাদেশে বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদা ২০ লাখ টন। প্রতি মাসে লাগে দেড় লাখ টন। তবে রমজান মাসে চাহিদা দ্বিগুণ হয়ে যায়। এ জন্য ৩ লাখ টন তেল লাগে। গত অক্টোবর-নভেম্বরে অপরিশোধিত ও পাম অয়েল আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ৬৮ হাজার টন। গত বছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছে ৪ লাখ ৬০ হাজার টন। বছরের ব্যবধানে আমদানি কমেছে ২০ শতাংশ। তার পরও বাজারে তেলসংকট দেখা দিয়েছে। এ দোকান-সে দোকান ঘুরে সহজে মিলছে না বোতলজাত তেল।