ঢাকা ৩০ পৌষ ১৪৩১, মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫

আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে মংডু শহর বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনা শুরুর পক্ষে মত

প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:৩০ এএম
আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:০৫ এএম
বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনা শুরুর পক্ষে মত
ছবি: সংগৃহীত

গৃহযুদ্ধে টালমাটাল প্রতিবেশী মায়ানমারের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশে উদ্বেগ বাড়ছে। সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের নিয়ন্ত্রণ এখন বিদ্রোহী আরাকান আর্মির হাতে। সামরিক জান্তাদের হটিয়ে প্রায় ২৭১ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকায় টহল দিচ্ছে তারা। দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে নতুন করে যেন জটিলতায় পড়তে না হয় সেজন্য সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপের কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। আরাকান আর্মির নেতৃত্বের গতিবিধি লক্ষ্য রাখা এবং তাদের পরিকল্পনা জানার জন্য অতি দ্রুতই বড় ধরনের আলোচনা শুরু করার পক্ষে মত তাদের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকার হয়তো এতদিন তাদের (আরাকান আর্মি) সঙ্গে ভিন্ন মাধ্যমে আলোচনা করেছে। এখন যেহেতু আরাকান তাদের দখলে চলে এসেছে, সরাসরি আলোচনা দরকার আছে। আরাকান নিয়ে তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? অর্থনৈতিক কাঠামো কী হবে? এসব জানতে হবে। এখন মায়ানমারের সার্বভৌমত্ব বড় আকারে আরাকান আর্মির হাতে। যদি বাংলাদেশে সম্ভব না হয়, তৃতীয় কোনো দেশে তাদের সঙ্গে তাড়াতাড়ি বসা দরকার।

সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, গত রবিবার সকালে বিদ্রোহীরা মংডু শহর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার কথা জানায়। গত মে মাস থেকে এই শহরটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য তারা আক্রমণ শুরু করে। এখানে জান্তা সরকারের সীমন্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) শক্তিশালী ৫ নম্বর ব্যাটালিয়ন ছিল। হামলার পর বিজিপি সদস্যদের পাশাপাশি তাদের মিত্র অন্য সশস্ত্র সংগঠনগুলোর সদস্যরাও ঘাটিঁ ছেড়ে পালান। মিলিটারি অপারেশন কমান্ড ১৫ এর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থুরেইন তুনসহ প্রায় ৮০ জন বিদ্রোহীদের হাতে আটক হন। মংডু শহর দখল নেওয়ার আগেই বুথিডং ও পালেতাও শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়াতে এখন দেশের সীমান্তবর্তী মায়ানমারের এলাকা বিদ্রোহীদের করায়ত্তে।

বিদ্রোহীদের হাতে সীমান্তবর্তী এলাকার নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়ায় দুই দেশের স্বাভাবিক ব্যবসা-বাণিজ্যও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম আমদানি-রপ্তানি হচ্ছে। আবার জান্তা সরকারও রাখাইনে অবরোধ আরোপ করে রেখেছে। ফলে সেখানে মানুষের মধ্যে নানা সংকট তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখলে মায়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দুর্দশা কমে আসবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। অপরদিকে যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে আরও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে প্রবেশের শঙ্কা তৈরি হয়। এ কারণে এই ইস্যু সমাধানের জন্য বিদ্রোহীদের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার আলোচনা করতে পারে বলে মায়ানমারের সংবাদমাধ্যম ইরাবতীতে একজন সামরিক বিশ্লেষক মন্তব্য করেছেন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, গত এক দুই বছর ধরে আরাকান আর্মির সামরিক বিজয় ঘটছে। বাংলাদেশকে সতর্ক থাকা দরকার। তাদের শক্তি ও প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। জান্তারা হয়তো এখনো অফিশিয়ালি রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। গৃহযুদ্ধের কারণে একক ক্ষমতা তাদের হাতে নেই। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের বাইরে অনানুষ্ঠানিকভাবে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারে। এই যোগাযোগ ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টের মাধ্যমেও করা যায়।

তিনি বলেন, ‘বিদ্রোহীরা সামরিক বিজয়কে ধরে রাখতে পারে কি না সেটাও দেখতে হবে। মায়ানমারের পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে সেটা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। রোহিঙ্গা প্রবেশের একটা আশঙ্কা সবসময় আছে। সেই দিক থেকেও খেয়াল রাখতে হবে, যেন নতুন করে আর না আসতে পারে। একই সঙ্গে আরাকান আর্মির নেতৃত্বের গতিবিধি নজর রাখা জরুরি।

গতি পায়নি অর্থনীতি

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৩০ পিএম
গতি পায়নি অর্থনীতি
খবরের কাগজ ইনফোগ্রাফ

উচ্চ মূল্যস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বিশাল রাজস্ব ঘাটতিসহ নানামুখী চাপে রয়েছে দেশের অর্থনীতি। এই চাপ সামলাতে অন্তর্বর্তী সরকার কিছু পদক্ষেপ নিলেও গতি পায়নি অর্থনীতি।

সরকারের আয় কমেছে। বেড়েছে ব্যয়। বাজেটে অর্থায়নে বিকল্প পথ খোঁজা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির তুলনায় কর আহরণ খুবই কম। কর আদায় আরও বাড়াতে হবে। চলমান ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ কর্মসূচির পাশাপাশি আইএমএফের কাছে নতুন করে আরও ৭৫ কোটি ডলার চেয়েছে সরকার। বাড়তি ঋণ পেতে নতুন শর্ত আরোপ করেছে সংস্থাটি। সেটি হলো, কর আহরণ আরও বাড়তে হবে। মূলত আইএমএফের শর্ত পালন করতে গিয়েই অর্থবছরের মাঝপথে এসে শতাধিক পণ্য ও সেবায় মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে এমনিতেই সাধারণ মানুষের জীবন নাভিশ্বাস। উপরন্তু পণ্য ও সেবায় সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে তাদের জীবন আরও দুবির্ষহ হয়ে পড়েছে। এখনো উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে সাধারণ মানুষ পিষ্ট হচ্ছেন। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ডিসেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৩ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এটি সর্বোচ্চ। ডলারের দাম ১২৩ টাকার বেশি। কিছুটা ইতিবাচক আছে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। তবে সামষ্টিক অর্থনীতির বাকি প্রায় সব সূচকই তলানিতে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় বিনিয়োগ স্থবির হয়ে রয়েছে। জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। ফলে শিল্প খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে অস্থিরতা কাটছে না। 

অর্থনীতি যে সংকটে আছে তাতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১ দশমিক ৮১ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ৬ শতাংশের বেশি। সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা কৃষিতে। এ খাতে চলতি প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ। শিল্প ও সেবা খাতের অবস্থাও শোচনীয়। অবশ্য অর্থনীতির এই নাজুক অবস্থা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। 

গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর অর্থনৈতিক নেতৃত্বেও বড় পরিবর্তন হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা, পরিকল্পনা উপদেষ্টা, বাণিজ্য উপদেষ্টার পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, এনবিআর চেয়ারম্যানসহ বড় বড় পদে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা চেষ্টা করছেন অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার। কিন্তু নেতৃত্বের পরিবর্তন হলেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। 

ধুঁকে ধুঁকে চলছে রাজস্ব খাত। এনবিআরের সাময়িক হালনাগাদ হিসাবে চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। প্রতি মাসেই আদায়ের লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে আছে এনবিআর।

বৈদেশিক ঋণপ্রবাহ কমে গেছে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ আসছে, তার চেয়ে বেশি সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হওয়ায় অর্থনীতিতে চাপ বেড়েছে।  

উন্নয়ন প্রকল্পের খরচ কমেছে। আওয়ামী লীগ-ঘনিষ্ঠ অনেক ঠিকাদার পালিয়ে থাকার কারণে এডিপির বাস্তবায়ন পরিস্থিতি খুবই খারাপ। আগের বছরের তুলনায় জুলাই-নভেম্বর সময়ে সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা কম খরচ হয়েছে। 

খেলাপি ঋণ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে অনিয়ম-দুর্নীতি করে নামে-বেনামে যেসব ঋণ নেওয়া হয়েছে, তা এখন খেলাপি হতে শুরু করেছে। তা ছাড়া বর্তমান সরকার খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করছে। ফলে উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে খেলাপি ঋণ। 

আর এই ঋণের বোঝা বাড়ছে দেশের জনগণের ঘাড়ে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের ঘাড়ে দেশি-বিদেশি ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা। এ অঙ্ক বাংলাদেশের তিনটি জাতীয় বাজেটের সমান।  এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ১০ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অপর দিকে বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। বিশাল অঙ্কের এই ঋণের বিপরীতে সরকারকে প্রতিবছর ১ লাখ কোটি টাকার বেশি সুদ গুনতে হচ্ছে। এতে করে সরকারের আর্থিক চাপ আরও বেড়েছে। 

যোগাযোগ করা হলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, অর্থনীতিতে অনেক সমস্যা রয়েছে। রিজার্ভে সমস্যা। আমদানির সমস্যা। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। আরও সমস্যা আছে, যেমন ব্যাংক খাত। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সুফল মেলেনি। 

তিনি আরও বলেন, কিছু খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। রপ্তানির প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। রেমিট্যান্সের শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে ব্যাংক খাত, রিজার্ভের সমস্যা কাটেনি এখনো। অর্থনীতিতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য সরকার চেষ্টা করছে। তবে এর সুফল আসবে কি না, তা বলা মুশকিল।

স্থিতিশীল হয়নি রাজনীতি

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৪৫ পিএম
আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:১৯ পিএম
স্থিতিশীল হয়নি রাজনীতি
খবরের কাগজ ইনফোগ্রাফ

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলেও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিপূর্ণভাবে স্থিতিশীল হয়নি। বরং নির্বাচনের দিনক্ষণ, সংস্কার ও কোন নির্বাচন আগে, নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রচেষ্টা, রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ মতবিরোধসহ বিভিন্ন কারণে রাজনীতিতে কিছুটা অস্থিরতা আছে। এদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গেই অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সর্বোপরি প্রশাসন ও পুলিশে এখনো স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। প্রশাসন বনাম বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে বিভক্তি অবসানের কোনো লক্ষণ নেই। অন্যদিকে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্পূর্ণভাবে গতিশীল হয়নি। ফলে জনমনে এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, এত সব সরকার সামাল দেবে কীভাবে? 

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, সংস্কার কমিশনগুলোর রিপোর্ট আগামী কয়েকদিনের মধ্যে জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। আমি মনে করি, আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারের রোডম্যাপ দেওয়া উচিত হবে। না হলে রাজনৈতিক দলগুলো আবার রাস্তায় নামবে। এতে নতুন সমস্যার মুখে পড়তে হবে সরকারকে। 

তিনি বলেন, আজ হোক বা কাল হোক নির্বাচন তো দিতেই হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেরিতে নির্বাচন হওয়ার সুযোগ অনেকটাই কমে গেছে। দেশের বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং আন্তর্জাতিক মহলও নির্বাচন চাইছে। কারণ দেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে গেছে। বিদেশি কোনো বিনিয়োগ নেই, সমঝোতাও হবে না। এ জন্য নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে দেরি হলে দেশে অস্থিরতা বাড়বে। ফলে দ্রুত নির্বাচন হলে দেশে সংকটও কমে আসবে। 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলো যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন দেওয়া। নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যেসব সংস্কার প্রয়োজন সেগুলো চিহ্নিত করে শুধু অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে হবে। একই সঙ্গে ভোটের জন্য প্রস্তুতি, ভোটার তালিকা তৈরিসহ নির্বাচনের একটা রোডম্যাপ দেওয়াই বর্তমান সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য খুবই জরুরি। 

তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠন হয়েছে, ভোটার তালিকা প্রণয়নের কাজ চলছে, অন্যান্য আইনের সংস্কারকাজও চলমান। সংস্কার কমিশনে বিএনপি তাদের মতামত দিয়েছে। এই মতামতের ওপর ভিত্তি করে প্রধান উপদেষ্টা সব রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে কী কী সংস্কার করা যায় সে ব্যাপারে ঐকমত্য সৃষ্টি করতে পারেন। কিছু বিষয়ে দ্বিমত থাকবে, এটা স্বাভাবিক। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে সেগুলো সংস্কার হবে। এখানে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার চিহ্নিত করে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

তার মতে, ‘নির্বাচনের জন্য মাঠের ও প্রাতিষ্ঠানিক কিছু সংস্কার দুই-তিন মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন সম্ভব। আর নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার এলে সংবিধান সংশোধনীসহ অন্য দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করবে। এর আগে জাতির কাছে তারা অঙ্গীকার এবং নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি দেবে যে, আমরা আগামী দিনে ঐকমত্যের ভিত্তিতে এগুলো বাস্তবায়ন করব।’ যেমন আদালতের রায়ের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ও গণভোটের বিধান পুনর্বহাল হয়েছে। ফলে অন্য সমস্যাগুলোও সমাধানে পরবর্তী সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। 

জানা গেছে, সরকার ও বিএনপিসহ তার মিত্র দলগুলোর মধ্যে দূরত্বের মূল কারণ হলো নির্বাচনের সুস্পষ্ট দিনক্ষণ ঘোষণা না করা। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে রাষ্ট্র বিনির্মাণে ঠিক কতটা সংস্কার হবে এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা- এসব ইস্যু নিয়ে সরকারের সঙ্গে তাদের সন্দেহ-অবিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গেলে অনেকে ‘মাইনাস টু’ এর বিষয়টি সামনে নিয়ে আসছে। যদিও বিএনপি বলছে, মাইনাস টু-এর আশা জীবনেও পূরণ হবে না। 

ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে চলতি বছরেই নির্বাচন চায় বিএনপি। তবে এ ক্ষেত্রে অনেকটাই কৌশলী অবস্থান নিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটি ‘আগে ব্যাপকভিত্তিক সংস্কার ও পরে নির্বাচনে’র কথা বলছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা, রাষ্ট্রপতির অপসারণ নিয়ে দ্বিমত, ভোটার হওয়ার সর্বনিম্ন বয়সসীমা ১৭ বছর করার উদ্যোগ নিয়েও বিএনপির আপত্তি রয়েছে। পাশাপাশি গণ-অভ্যুত্থানের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে উপদেষ্টা মাহফুজ আলমকে বিশ্বে পরিচয় করিয়ে দেওয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নীরব মনোমালিন্য তৈরি হয়েছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন জায়গায় দখল ও চাঁদাবাজিসহ নানা ইস্যুতে সরকারের একাধিক উপদেষ্টা ও বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য এখনো অব্যাহত আছে। সব মিলিয়ে সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

সর্বশেষ ‘প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভল্যুশন’ (ঘোষণাপত্র) তৈরি এবং সংবিধান বাতিলসংক্রান্ত বক্তব্য নিয়েও দ্বিমত স্পষ্ট হয়েছে। এখন ঘোষণাপত্র তৈরির দায়িত্ব নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে শুধু জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নয়, গত ১৬ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের স্বীকৃতি চায় বিএনপি। ফলে গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরিতেও জটিলতা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া ছাত্র নেতৃত্বের নতুন দলকে স্বাগত জানালেও এ ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলেও মনে করে বিএনপিসহ তার মিত্ররা। সব মিলিয়ে সরকারের সঙ্গে বিএনপির কিছুটা সন্দেহ-অবিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তবে সংস্কার হোক আর যাই হোক বিএনপির সমর্থন ছাড়া বা দলটির সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া সরকারের কোনো কাজই সহজ হবে না বলে দেশের রাজনীতিতে আলোচনা আছে। 

পর্যবেক্ষকদের মতে, সব দলের সঙ্গে সমন্বয় করে নির্বিঘ্নে একটি নির্বাচন তথা নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নতুন রাজনৈতিক দল গঠনকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে জনগণ আশা করে অতীতের মতো কিংস পার্টি হবে না। সরকারের সহযোগিতায় কোনো রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করবে না। কোনো গোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার জন্য নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা জনগণ প্রত্যাখ্যান করবে। 

এদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও নানা ইস্যুতে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে বিএনপি ও জামায়াতের অবস্থান নিয়ে প্রকাশ্যে বাহাসে লিপ্ত রয়েছে দল দুটির একাধিক নেতা। এ ছাড়া সংবিধান সংস্কার প্রশ্নে গণতন্ত্র মঞ্চেও অনৈক্যের সুর। এই ইস্যুতে জোট থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছে গণসংহতি আন্দোলন ও রাষ্ট্র-সংস্কার আন্দোলন। দল দুটির প্রস্তাব- নির্বাচনের মাধ্যমে গণপরিষদ গঠন করতে হবে এবং সংবিধান পুনর্লিখন করতে হবে। একই প্রস্তাব দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। সংবিধান সংস্কার নিয়েও দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ স্পষ্ট হয়েছে। 

জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার খবরের কাগজকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারকে সবাই শুরু থেকেই সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি। আগামী দিনেও অন্তর্বর্তী সরকার সহযোগিতা চাইলে আমরা সহযোগিতা করব।’ তিনি বলেন, ‘দেশে দলও অনেক এবং মত ভিন্ন। তবে গণ-অভ্যুত্থানের চেতনায় দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য থাকলেই হবে। রাজনৈতিক আদর্শের ভিন্নতা কোনো ব্যাপার নয়।’

জনপ্রশাসন-পুলিশে অস্থিরতা কাটেনি

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:১০ পিএম
আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:২০ পিএম
জনপ্রশাসন-পুলিশে অস্থিরতা কাটেনি
খবরের কাগজ ইনফোগ্রাফ

প্রায় সাড়ে পাঁচ মাসেও জনপ্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর ভেতরের অস্থিরতা পুরোপুরি কাটেনি। দূর হয়নি সংকটও। কিছুটা গতিশীল হলেও নিয়োগ, পদায়ন-বদলি, পদোন্নতি বা চাকরিচ্যুতি, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-বিভক্তিসহ নানা ধরনের জটিলতা এখনো বিরাজ করছে রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই দুটি বিভাগে। এতে করে সারা দেশে নাগরিকসেবা, সামাজিক শৃঙ্খলা ও আইনি সুরক্ষার কাজটিও যথাযথভাবে হচ্ছে না। বরং কোথাও কোথাও পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকেও যাচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সরকারকে সম্পূর্ণভাবে গতিশীল করতে হলে রাষ্ট্রের এই দুই প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত সক্রিয় করতে হবে। 

বিসিএসের ক্যাডারে বৈষম্য, জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ নিয়ে হট্টগোল, ৪৩তম বিসিএসে বহু প্রার্থী বাদ পড়াসহ নানা ইস্যুতে অভ্যন্তরীণ সংকট দেখা দেয় প্রশাসনে, যা এখনো পুরোপুরি দূর হয়নি। একইভাবে ভঙ্গুর এক পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়ানো পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরেও চলছে অস্থিরতা। নতুন পরিস্থিতিতে বদলি, চাকরিচ্যুতি, মামলা-গ্রেপ্তার, হামলার আশঙ্কায় পুলিশে এখনো কিছুটা আতঙ্ক রয়ে গেছে। 

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক সচিব ও বিপিএটিসির সাবেক রেক্টর এ কে এম আব্দুল আউয়াল মজুমদার খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রশাসনের মধ্যে অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা ও বিভাজন সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। এখন প্রশাসন বনাম ২৫ ক্যাডারে একটি জটিলতা বিদ্যমান। দুই পক্ষেরই কিছু নেতিবাচক দিকও আছে। যেমন: প্রশাসন ক্যাডার অন্য ক্যাডারদের ঠিকমতো মূল্যায়ন করে না, তাদের দাবিগুলো গুরুত্বের সঙ্গে নেয় না। দেখা যায়, প্রশাসন ক্যাডারে পদ না থাকলেও পদোন্নতি নিচ্ছে, বিপরীতে অন্য ক্যাডার সার্ভিসে শূন্য পদ আছে, যোগ্য কর্মকর্তাও আছেন অথচ তাদের পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে না। জনপ্রশাসন হবে সেবার ফেরিওয়ালা। প্রশাসনের লক্ষ্য এটাই হওয়া উচিত। কিন্তু এই চর্চা জনপ্রশাসনে হয় না। সবার প্রতি সুবিচার করতে হবে। কেউ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, বঞ্চিত না হন তা নিশ্চিত করা গেলেই এ ধরনের সংকট বা অস্থিরতা কেটে যাবে।’ 

এসব বিশৃঙ্খলার মাঝে প্রশাসন কোন পথে চলছে এমন প্রশ্নের জবাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে খবরের কাগজকে বলেন, “প্রশাসনে গতি ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। এটা কার্যক্রমের অংশ। তবে সবকিছু যে ‘স্মুথলি’ চলছে তা এখনই বলা যাবে না। কারণ আগের সরকার বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের কর্মকর্তাদের পদায়ন করে গেছে। এখন সব যদি বাদ দেওয়া হয় বা বদলি করে দেওয়া হয়, তবে তো প্রশাসন চলবে না। এ ছাড়া গত সরকারের আমলের অনেক কর্মকর্তাই কোনো না কোনো লাইনে বা পন্থায় উপদেষ্টাদের কাছে যাচ্ছেন। তারা তাদের দিয়ে পদায়ন বা পদোন্নতি বা অন্য কোনো তদবির করাচ্ছেন। এ ধরনের কিছু সমস্যাও এখন মোকাবিলা করতে হয়।” 

অস্থির জনপ্রশাসন
গত ৮ আগস্ট বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তারা দাবি-দাওয়া নিয়ে সচিবালয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। এ সময় জনপ্রশাসন মন্ত্রণলয়ে ঘেরাওয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা। তাদের পথ ধরেই এ সময় আন্দোলনে নামে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ। পাশাপাশি আনসার বাহিনী, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্ররাও দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সচিবালয় ঘিরে আন্দোলন শুরু করেন। গতকাল সোমবারও সচিবালয়ের সামনে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বাদ পড়া পুলিশের এসআই ক্যাডেটরা।

এসব ঘটনাকে পাশ কাটিয়ে সারা দেশেই আলোচনায় গুরুত্ব পায় প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়সহ সারা দেশের প্রশাসনে বিশৃঙ্খলার বিষয়টি। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরেই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সুবিধাভোগী, দুর্নীতিতে অভিযুক্ত, অদক্ষ, দলবাজ কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করে। তাদের মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কিছু কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর, বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) নিয়োগ দিয়ে জনপ্রশাসনে সংযুক্ত করা, সচিবালয়ের বাইরে কর্মকর্তাদের দপ্তর বদল করা, মাঠ প্রশাসনের জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং অন্য কর্মকর্তাদের উঠিয়ে এনে কম গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করে সরকার। ফলে এমনও হয়েছে দীর্ঘদিন কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকেছে সচিবশূন্য। আবার মাঠ প্রশাসনে বেশ কয়েক দিন ডিসিশূন্য ছিল কয়েকটি জেলা। সরকারের এসব সিদ্ধান্তে অস্থিরতা শুরু হয় প্রশাসনে। এতে স্থবির হয়ে পড়ে সরকারের দিকনির্দেশনার বাস্তবায়ন।

তবে এই মূহূর্তে সারা দেশে আলোচনা হচ্ছে প্রশাসন ক্যাডার ও অন্য ২৫ ক্যাডার সার্ভিস কর্মকর্তাদের মাঝে বিভক্তি নিয়ে। এই বিভক্তির কারণে প্রশাসন ক্যাডার ও অন্য ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তারা নিয়েছেন পাল্টাপাল্টি অবস্থান। আরও রয়েছে ৪৩ বিসিএস ক্যাডারে যারা বাদ পড়েছেন তাদের আন্দোলন, যা নিয়ে ইতোমধ্যে সুরাহা করার কথা জানিয়েছে সরকার।

পুরোপুরি শক্ত হয়নি পুলিশের মনোবল
পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা পর্যায়ক্রমে অনেকটা উন্নতি হলেও সার্বিক নিরাপত্তাব্যবস্থা ও নাগরিকদের আইনি সুরক্ষার প্রশ্নে এখনো অস্থিরতা বিরাজ করছে। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রায় প্রতিদিনই পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের নানা পদে রদবদল হয়েছে। অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো ও ওএসডি করা হয়েছে। গত প্রায় পাঁচ মাসে পুলিশে বদলি বা পদায়নের সংখ্যাও অর্ধলাখের বেশি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হতাহত বা গুলি চালানোর ঘটনায় অনেক পুলিশ সদস্য ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন। অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। যারা চাকরি করছেন তাদেরও একটা অংশ নানা আতঙ্কে সময় পার করছেন। তার মাঝে আবার রাজনৈতিক প্রভাবও শুরু হয়েছে বলে আলোচনা হচ্ছে। 

এদিকে পুলিশ বাহিনী বিগত আওয়ামী লীগের আমলে যেভাবে দলীয় নির্দেশনা বাস্তবায়ন করত এখনো আবার পুলিশের অনেকেই অন্য দল বা ক্ষমতার কেন্দ্রের মন জয় করার চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। দু-এক জায়গায় এখনো পুলিশের ওপর হামলার খবর আসছে। থানায় হামলা চালিয়ে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। গত ৬ জানুয়ারি চট্টগ্রামে পুলিশ পরিদর্শক নেজাম উদ্দিনকে প্রকাশ্যে মারধর করেন স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা-কর্মীরা। গত ২০ ডিসেম্বর সিলেটের আদালত চত্বরে এক পুলিশ কর্মকর্তাকে কিলঘুষি মারা হয়। এ রকম বিভিন্ন স্থানে পুলিশ আক্রান্ত হয়েছে। এর ফলে নিজের নিরাপত্তা শঙ্কায় দায়িত্ব পালনেও উদ্বিগ্ন থাকছেন পুলিশ সদস্যরা। ফলে মাঠপর্যায়ে নাগরিকের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দিতে গিয়ে পুলিশের দুর্বলতা প্রকাশ পাচ্ছে বারবার।

এ প্রসঙ্গে পুলিশের সাবেক আইজিপি মুহাম্মদ নুরুল হুদা খবরের কাগজকে বলেন, ‘৫ আগস্টের প্রেক্ষাপটে চরম অবনতি ঘটা দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি পুলিশ বাহিনী। তবে তারা চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে তা যায়নি। নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে এখানে সব শ্রেণির মানুষের সহযোগিতার বিষয় আছে। জনগণকে সহযোগিতা করতে হবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা জরুরি। এ ছাড়া এসব বিষয়ে সরকারের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও কঠোর পদক্ষেপ থাকতে হবে।’ 

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ৫ আগস্টের প্রেক্ষাপটে বর্তমানে পুলিশ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও তাদের কর্মকাণ্ডে নানা অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনাও ফুটে উঠছে। পদায়ন, বদলিসংক্রান্ত বিষয়গুলো এখন জটিল আকার ধারণ করছে। কাকে কোথায় দায়িত্ব দিলে ভালো কাজ হবে সেটার দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। তার মাঝে কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ বেশ ভালো উন্নতি করলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এখনো পুরোপুরি শৃঙ্খলা আনতে পারেনি। তিনি বলেন, এ পরিস্থিতি থেকে বের হতে আগের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে। জনগণের জন্যই প্রকৃতপক্ষে পুলিশকে কাজ করতে হবে। রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করলে ভবিষ্যতে আবারও নাজেহাল হওয়ার শঙ্কা থাকবে।

এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর খবরের কাগজকে বলেন, বর্তমানে পুলিশ সর্বোচ্চ পেশাদারত্ব ও আন্তরিকতার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। পুলিশ নাগরিকের সুরক্ষার জন্য কাজ করছে। পুলিশকে দায়িত্ব পালনে সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে। 

পাঁচ খলিফার সিন্ডিকেটে ‘শিখর’ বাহিনী

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৩ পিএম
আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৪১ পিএম
পাঁচ খলিফার সিন্ডিকেটে ‘শিখর’ বাহিনী
সাবেক এমপি সাইফুজ্জামান শিখর। অলংকরণ : নিয়াজ চৌধুরী তুলি

স্বাধীনতা-পূর্ব ও পরবর্তী রাজনীতিতে ছাত্রলীগের চারজন নেতাকে ‘চার খলিফা’ নামে অভিহিত করা হতো। তাদের এই নামে ডাকা হতো মূলত ইসলামের চার খলিফার সঙ্গে তুলনা করে। তারা হলেন নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আ স ম আব্দুর রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখন। কিন্তু হালে মাগুরা-১ আসনে নতুন পাঁচ খলিফার কর্মকাণ্ড বেশ চাউর হয়েছে। অবশ্য এদের খলিফার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে নেতিবাচক অর্থে।

এই আসনের সাবেক এমপি সাইফুজ্জামান শিখর এলাকায় চাঁদাবাজি ও প্রভাব বিস্তারের জন্য এই পাঁচজন দলীয় নেতাকে নিযুক্ত করেছিলেন বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন। এরাই পাঁচ খলিফা নামে পরিচিতি লাভ করেছেন। শ্রীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রবীণ একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে খবরের কাগজকে জানান, আলোচিত এই পাঁচ নেতা হলেন শ্রীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন রশিদ মুহিত, জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক শেখ রেজাউল ইসলাম, জেলা আওয়ামী লীগ নেতা মীর সুমন, অ্যাডভোকেট শাখারুল ইসলাম শাকিল ও জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক ফজলুর রহমান।
 
জানা গেছে, এই পাঁচ নেতার প্রভাব বিস্তারের কারণে বিগত সরকারের সময়ে সাইফুজ্জামান শিখরকে নিয়ে বেশ আলোচনা ও সমালোচনা হয়।

এলাকার একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা জানিয়েছেন, আলোচিত ওই পাঁচ নেতাকে দিয়ে গোটা মাগুরা জেলা নিয়ন্ত্রণ করতেন শিখর। তাদের নিয়ে সিন্ডিকেট করে স্থানীয় পর্যায়ে সব রকমের ঠিকাদারি কাজসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বণ্টন করতেন। কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ের অধিকাংশ নেতা-কর্মী এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতেন। অথচ এখন দলের বিপদের দিনে সেই সব বঞ্চিত নেতা-কর্মীই বিপদে আছেন। অন্যদিকে সিন্ডিকেট তৈরি করে টাকা কামানো নেতারা আরামে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বঞ্চিত নেতারা একদিকে অর্থনৈতিক সমস্যায় আছেন, অন্যদিকে নানা রাজনৈতিক মামলা ও হামলায় তারা অবর্ণনীয় কষ্টে দিন পার করছেন।
 
সাইফুজ্জামান শিখরের বাবা মোহাম্মদ আছাদুজ্জামান ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ। সেই সুবাদে দুই দফায় শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী ও একবার এমপি হয়েছেন শিখর। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তার। নিজে সংসদ সদস্য হওয়ার পাশাপাশি বোনকেও বানিয়েছেন সংসদ সদস্য। সমান তালে করেছেন তদবির-বাণিজ্য। টেন্ডারবাজি-দখলদারত্বসহ ব্যাংকের টাকা লুট করে গড়ে তুলেছেন বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। নিজ জেলা মাগুরায় একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নিতে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতাদের বাদ দিয়ে হাইব্রিডদের দিয়ে গড়েছেন ‘শিখর বাহিনী’, যা নিয়ন্ত্রণ করতেন তারই দুই ভাই। 

একসময়ের ছাত্রনেতা প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী পদে যাওয়ায় সারা দেশে শিখরের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি হয়। শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারীদের মধ্যে শিখরকে প্রভাবশালী ধরা হতো। আওয়ামী লীগের শেষ দুটি মন্ত্রিসভার নেতারা প্রায় সবাই তার ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এমনকি অনেকেই মন্ত্রী হওয়ার জন্য শিখরের কাছে ধরনা দিয়েছেন বলেও আওয়ামী লীগের মধ্যে আলোচনা আছে। ওই সময় তার নামে প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে বড় দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এসব অর্থ দিয়ে রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে বাড়ি, ফ্ল্যাট ও প্লটের মালিক হয়েছেন তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাবেক সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী হওয়ার সুবাদে শিখরের সঙ্গে সখ্য তৈরি হয় তার (শেখ হাসিনার) বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের বিতর্কিত সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরেরও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন তিনি। এ ছাড়া তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দুর্নীতিবাজ কয়েকজন কর্মকর্তা ও খুলনা বিভাগের প্রভাবশালী এক আওয়ামী লীগ নেতার সমন্বয়ে তৈরি হয় একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। গত দেড় দশকে ব্যাংক ও শেয়ারবাজারে জালিয়াতি, কারসাজি এবং প্রতারণার মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে এই সিন্ডিকেট। এভাবেই মোটা দাগে শিখরের নাম জড়ায় শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারিতে। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের আমলে সরকারি মেগা প্রকল্পে মেগা দুর্নীতিও করেন শিখর। বিশেষ করে সরকারি বড় প্রকল্পের কোন টেন্ডার কোন প্রতিষ্ঠান পাবে তাও নির্ধারণ করতেন তার সিন্ডিকেট সদস্যরা। বিনিময়ে মোটা অঙ্কের লভ্যাংশ নিয়েছেন শিখর। 

শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী থাকাকালীন সরকারি একটি ব্যাংক থেকে কয়েক শ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফরিদপুরে ‘এজিএস’ নামে একটি কোম্পানি খোলেন শিখর এবং তার সহযোগী আরিফ ও গালিব। পরে সেই ঋণ আর শোধ করা হয়নি। নিজের প্রভাব খাটিয়ে ২০২২ সালের দিকে হাসানুজ্জামান টিটো নামে এক ব্যক্তির জুট মিল দখলে নেন শিখর। নিজে দখল করে টিটোকে মাসে লভ্যাংশ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। দখল হয়ে যাওয়ার পর মূল মালিক টিটোকেই কোণঠাসা করে রাখেন শিখর। টিটো তার ন্যায্যমূল্য বুঝে নিতে চাইলে হত্যা ও নাশকতার মামলা দেওয়ার হুমকিও দেন। ওই জুট মিল দেখিয়ে সরকারি ব্যাংক থেকে শতকোটি টাকা ঋণ নিলেও কোনো টাকাই পরিশোধ করেননি তিনি। দেশের উত্তরবঙ্গের একাধিক জেলায় নামে-বেনামে কোম্পানির কথা বলে একাধিক সরকারি ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ তুলে নিয়ে পকেটে ঢুকিয়েছেন শিখর। এ ছাড়া তার ব্যক্তিগত গাড়িতে করে বিভিন্ন অবৈধ পণ্যর পাশাপাশি সোনা চোরাচালান হতো বলে অভিযোগ আছে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিশেষ সহকারী থাকা অবস্থায় ক্যাসিনোকাণ্ডেও নাম জড়িয়েছে শিখরের। পদের প্রভাব খাটিয়ে ক্যাসিনোকাণ্ডে জড়িত ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, খালিদ ভূঁইয়া, জি কে শামীমসহ কয়েকজন নেতাকে সুবিধা দিয়েছেন। বিনিময়ে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা তার পকেটে যেত বলেও অভিযোগ রয়েছে।

নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, এসব ঘটনা শেখ হাসিনার কান পর্যন্ত চলে যায় এবং এভাবেই অসংখ্য অভিযোগ জমা হয় গণভবনে। একপর্যায়ে শিখরকে গণভবন ও বিশেষ সহকারীর পদ থেকে সরানোর দাবি আসে নানা জায়গা থেকে। এমন অবস্থায় নৌকার মনোনয়ন দিয়ে ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় তাকে গণভবন থেকে বাদ দেওয়া হয়। 

অবশ্য এ ঘটনায়ও প্রভাব কমে যায়নি শিখরের। এমপি হয়ে নিজ জেলা মাগুরায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন তিনি। স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাগুরায় একক নিয়ন্ত্রণ নিতে জেলার প্রবীণ আওয়ামী লীগের নেতাদের কোণঠাসা করেন শিখর। তার পরিবারের সদস্যরাও ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। তার মেজো ভাই আনিসুজ্জামান সাচ্চু জেলার টেন্ডারগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেন। ছোট ভাই হিসামের নামেও চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। নিজের প্রভাব ধরে রাখতে বোন কামরুল লায়লা জলিকে বানিয়েছেন সংরক্ষিত আসনের এমপি।

দলীয় নেতা-কর্মীদের কয়েকজনকে অর্থনৈতিক সুবিধা দিলেও অধিকাংশ নেতা-কর্মী কোনো সুবিধা পাননি তাদের কাছ থেকে। হাইব্রিড ও অনুপ্রবেশকারীদের দলীয় কমিটিতে পদায়ন করে ‘শেখর বাহিনী’ তৈরি করেন তিনি। আর এই বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই দলেরও অনেক নেতা-কর্মীকে মামলা-হামলার শিকার হতে হতো। তাদের অত্যাচারে অনেককেই এলাকাছাড়া হতে হয়েছে। 

মাগুরার স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের মধ্যে আলোচনা আছে, পছন্দমতো প্রশাসনিক কর্মকর্তা মাগুরায় নিয়ে এসে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটের ফল বদলে দিতেন শিখর। এভাবে উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকার মনোনীত প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও শিখর তার নিজের অনুসারীদের জয় নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখতেন। জেলা পরিষদে আওয়ামী লীগ নেতা রানা ওসমানকে জোর করে পরাজিত করে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ কুমার কুণ্ডুকে জয়ী ঘোষণা করেন বলে অভিযোগ আছে। একইভাবে সদর উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদে জাতীয় পার্টির প্রার্থী জয়লাভ করলেও তাকে পরাজিত ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ নেতা আবু নাছির বাবলুকে জয়ী ঘোষণা করা হয়। 

মাগুরায় নামে-বেনামে কয়েক শ একর জমি আছে শিখর ও তার পরিবারের সদস্যদের। অধিকাংশই প্রভাব খাটিয়ে হয় দখল, নয়তো নামমাত্র মূল্যে কিনে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সেখানে আম বাগান, মাল্টা বাগান, লেবু বাগান ও গরুর খামার করেছেন শিখর। তার অন্য ভাইয়েরাও নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। জাগলা এলাকায় তার ভাইয়ের নামে একটি ইটভাটা করে অনেক জায়গা দখল করা হয়েছে। আঠারখাদা ইউনিয়ন ও হাজীপুর এলাকায় শত শত বিঘা জমি নিজের করে নিয়েছেন। শিবরামপুর পৌরসভার মধ্যে ২০ বিঘা জমির ওপরে বাগানবাড়ি তৈরি, আলিধানীতে ২০ বিঘা ধানি জমি, কাটাখালী, নড়িহাটি, বাঁশকোটা, টেংগাখালী, মালন্দ, মৃগীডাংগা, বাগডাংগা মৌজায় শত বিঘা ফসলি জমি রয়েছে তার। 

জানা গেছে, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর শিখরের আধিপত্যে ভাটা পড়ে। ভারতে পালিয়ে যান তিনি। গত ৭ জানুয়ারি শিখর ও তার স্ত্রী সিমা রহমানের বিরুদ্ধে পৃথক দুই মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২ কোটি ৯৫ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ ও ব্যাংক হিসাবে প্রায় ১১ কোটি টাকার সন্দেহভাজন লেনদেনের অভিযোগ আনা হয় তাদের বিরুদ্ধে।

প্রথম মামলায় সাইফুজ্জামান শিখরের বিরুদ্ধে সরকারের দায়িত্বশীল পদে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ উপায়ে ১ কোটি ৭৯ লাখ ৬২ হাজার ৫২১ টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। একই সঙ্গে এ সম্পদ ভোগদখলে রাখা এবং নিজ নামীয় ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক সাতটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে মোট ১০ কোটি ৯৮ লাখ ৮২ হাজার ৩১৫ টাকার সন্দেহজনক ও অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য মিলেছে।

দ্বিতীয় মামলায় শিখরের স্ত্রী সিমা রহমানের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ উপায়ে ১ কোটি ১৬ লাখ ১ হাজার ৩৩২ টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। এ মামলায় সাইফুজ্জামান শিখরকেও আসামি করা হয়েছে।

গার্মেন্টে বাড়ছে শ্রমিক অসন্তোষ

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৩১ এএম
আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৩৭ এএম
গার্মেন্টে বাড়ছে শ্রমিক অসন্তোষ
চট্টগ্রামের ইপিজেডের ক্যাপস অ্যান্ড টেক্সাইল লিমিটেডের শ্রমিকরা আন্দোলন করছেন। ছবি: খবরের কাগজ

তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে আন্দোলন ও ছোটখাটো অবান্তর দাবি নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িছে পড়ছে চট্টগ্রামের পোশাক কারখানায়। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হলেও দিন দিন যেন ‘আবদার’ বাড়ছে। ফলে শ্রমিকদের নানা অজুহাতে কর্মবিরতি সড়ক অবরোধ, কাজে যোগ না দেওয়ায় চরম বিপাকে পড়তে হচ্ছে মালিকদের। এসব সংকটের কারণে কারখানা বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হচ্ছেন কর্তৃপক্ষ। 

পোশাক কারখানার মালিকরা জানান, ম্যানেজারকে ছাঁটায়ের দাবি, দুপুরের ভাত, হিট অ্যালাউন্স (ভাতা), ওভার টাইমের অতিরিক্ত বিল, নাস্তার বিল এসবের জন্যও আন্দোলন করছেন শ্রমিকরা। কথায় কথায় কাজ বন্ধ করে দিচ্ছেন তারা। বর্তমানে শ্রমিকদের কাছে অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়ছেন মালিকরা। এক কারখানা অন্য কারখানার শ্রমিকদের মধ্যেও লাগছে সংঘর্ষ।

রবিবার (১২ জানুয়ারি) দুপুরে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) অ্যাডামস ক্যাপস অ্যান্ড টেক্সটাইলস লিমিটেডের শ্রমিকরা আন্দোলনে নামেন। দুপুরের বের হয়ে শ্রমিকরা আর কাজে যোগ দেননি। 

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কাজ না করে সড়কের অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন দাবি আদায়ের মিছিলে অংশ নেন নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা। এ সময় তারা ১৩ দফা দাবি দিয়ে দাবি আদায়ের জন্য কারখানার ম্যানেজার ও মালিকদের সঙ্গে একটি পক্ষ বৈঠকে বসেন। কারখানার বাইরের সড়ক দিয়ে দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিকে যাওয়া চেষ্টা করা হলে শ্রমিকরা বাধা দেন। খবর নিয়ে জানা গেছে, বৈঠকের দাবি না মানায় বিকেলে শ্রমিকরা ওই কারখানা ভাঙচুর করেন। 

এর আগের দিন শনিবার জেএমএস ও মেরিমো কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষে ৬০ জন শ্রমিক আহত হন। খবর পেয়ে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, সিএমপি ও শিল্প-পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। চীন-বাংলাদেশ যৌথ বিনিয়োগে পরিচালিত জেএমএস কারখানায় শ্রমিক আছে আড়াই হাজার। কোরিয়ান মালিকানাধীন মেরিমো কারখানায় শ্রমিক আছে ৪ হাজার ২০০। এ ঘটনায় মালিক কর্তৃপক্ষ তিনটি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হন। 

সিইপিজেডের আরও আগে প্যাসিফিক জিন্সের কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলনে যান দুপুরের ভাতের জন্য। এশিয়া গ্রুপের পরিচালনাধীন সিস টেক্সের দুপুরের খাবারের মান ভালো না সেই জন্য শ্রমিকরা আন্দোলন করেছে। কোরিয়ান একটি কারখানায় বহিরাগত পুরুষ শ্রমিকরা আন্দোলন ও ভাঙচুর চালান চাকরির জন্য। এভাবে চট্টগ্রামের পোশাক কারখানায় আন্দোলন সংগ্রাম ও ভাঙচুর লেগেই আছে। 

জানা যায়, ঢাকার গাজীপুর, আশুলিয়া ও নারায়ণগঞ্জের মতো চট্টগ্রামেও পোশাক শ্রমিকদের আবদার দিন দিন বাড়ছে। চট্টগ্রামের বড় শিল্প গ্রুপের কারখানাও শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতে না পারে কারখানা বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। সেখানে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে আন্দোলন ও কর্মবিরতি দুঃখজনক বলে দাবি করেছেন মালিক কর্তৃপক্ষ। 

চট্টগ্রামের ৬০৬টি গার্মেন্ট কারখানা রয়েছে। জুলাই-আগস্ট ছাত্র আন্দোলন ও দেশে বন্যার কারণে ১২ দিন বন্ধ ছিল। এতে এ খাতের ব্যবসায়ীরা ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়ে। এখন গার্মেন্ট মালিকরা শ্রমিকদের বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছেন।

চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) নির্বাহী পরিচালক মো. আবদুস সোবহান খবরের কাগজকে বলেন, ‘তুচ্ছ ঘটনায় মারামারিতে জড়িয়ে যাচ্ছেন শ্রমিকরা। কাল্পনিক দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনে নামছে। দেশের মধ্যে খুবেই নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে চলে ইপিডেজের বা বেপজার কারখানাগুলো। সেখানে শ্রমিকরা বারবার কাজ বন্ধ করে আন্দোলনে নামছে। কারখানা ভাঙচুর করছে, এটা খুবই দুঃখজনক। এখানে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন আছে বলে মনে হচ্ছে। এগুলো করে কেউ লাভবান হবে না, বরং দেশের জন্য ক্ষতি হবে। তাই আমি শ্রমিকদের শান্ত থাকার জন্য অনুরোধ করব। বেশি গরম পড়ছে এমন অজুহাতে গরমের জন্য ভাতা ‘হিট অ্যালাউন্স’ চায় শ্রমিকরা। এগুলো অবান্তর দাবি, দেশের কোথাও নেই, বিদেশে আছে কি না সন্দেহ।’ 

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক নেতা ও চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক এস এম আবু তৈয়ব খবরের কাগজকে বলেন, ‘চট্টগ্রামের গার্মেন্ট কারখানাগুলো খুব সুন্দরভাবে চলছিল। শ্রমিকরা মাস শেষে ঠিক সময়ে বেতন-ভাতা পেলে খুশি থাকে। তবে কোনো কোনো কারখানায় মালিক শ্রমিকদের চাহিদামতো বেতন-ভাতা পরিশোধ করে না। এতে সমস্যা দেখা দেয়। আমি মনে করি, ঢাকার আন্দোলনের কোনো প্রভাব চট্টগ্রামে নেই। চট্টগ্রামে যা আন্দোলন হচ্ছে, তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা।’ 

বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বায়ারদের কাছে টাকা আটকে যাচ্ছে। ব্যাংক থেকে টাকা তোলা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে চট্টগ্রামসহ দেশের সব পোশাক কারখানাতেই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপ ও আমেরিকার মতো দেশে সময়মতো পণ্য পাঠানো যায়নি। সব মিলিয়ে নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে পোশাক কারখানাকে। এর মধ্যে শ্রমিক অসন্তোষ তো আছেই।’