চালের দাম কমাতে সরকার আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করেছে। তার পরও আমদানি হচ্ছে না। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় চালের দাম বেশি পড়ছে। দেশেই এর চেয়ে কম দামে চাল পাওয়া যাচ্ছে। অপরদিকে নতুন ধান উঠলেও বাজারে চালের দাম কমেনি বরং কয়েক দিন আগে চিকন চাল কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা বেড়েছে।
পাইকারি চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিলমালিকরা বেশি করে ঋণ নিয়ে গোডাউনে ধান মজুত করে রেখে ইচ্ছামতো চালের দাম বাড়াচ্ছেন। তাই ব্যাংকঋণ বন্ধ করতে হবে, গোডাউনে অভিযান পরিচালনা করতে হবে। তা নাহলে কমবে না চালের দাম। মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) কৃষক, মিলমালিক এবং পাইকারি ও খুচরা চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এমনই তথ্য পাওয়া গেছে।
আগে চালের ওপর আমদানি শুল্ক, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক, অগ্রিম আয়কর এবং আগাম কর ছিল। সব মিলিয়ে দিতে হতো ৬২ দশমিক ৫০ শতাংশ শুল্ক। সরকার গত ২০ অক্টোবর চালের ওপর আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ এবং ৫ শতাংশ আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে। কিন্তু তাতেও আমদানিকারকরা সাড়া দেননি। তাই আমদানি পর্যায়ে সব শুল্ক প্রত্যাহারের সুপারিশ করে এনবিআরকে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)। তা আমলে নিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার ও সাধারণ মানুষের কাছে চালের দাম সহজলভ্য করতে গত ১ নভেম্বর চাল আমদানিতে শুল্ক ও নিয়ন্ত্রণ শুল্ক প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আমদানি শুল্ক ১৫ শতাংশ বাদ দিয়ে শুধু ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর রাখা হয়েছে। তাতে চালের আমদানি মূল্য কেজিপ্রতি প্রায় ৯ টাকা ৬০ পয়সা কমার কথা জানায় এনবিআর।
কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে উল্টো চিত্র। এ ব্যাপারে বেনাপোল বন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও রাতুল এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আবদুল লতিফ খবরের কাগজকে বলেন, ‘মোটা চাল গ্রামে বেশি চলে। সরকার ভারত থেকে আমদানির সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু ডলারের দাম বেশি। এ জন্য কুলিয়ে ওঠা যায় না। ভারতে চালের দামই বেশি পড়ছে। দেশে আনতে ৫১ থেকে ৫২ টাকা কেজি পড়ে যাচ্ছে। অথচ দেশেই মোটা চাল তার চেয়ে কম দামে পাওয়া যাচ্ছে। এ জন্য আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। কেউ কেউ আগে অর্ডার দিলেও লোকশান গুনতে হয়েছে। তাই ভারত থেকে আর আমদানি করা হচ্ছে না।’ অন্য আমদানিকারকরাও একই তথ্য জানান।
তাদের দাবির সত্যতা মিলেছে রাজধানীর কৃষিপণ্যের পাইকারি বাজার কারওয়ান বাজার ও কৃষিমার্কেটে। সেখানে সরেজমিনে গেলে পাইকারি ও খুচরা চাল বিক্রেতারা বলেন, ‘ভারতের চাল আসে না। কারণ দেশেই এর চেয়ে কম দামে চাল পাওয়া যাচ্ছে। এ ব্যাপারে কারওয়ান বাজারের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী মেসার্স হাজি রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী মো. মাইনুদ্দিন আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘ভারতের কোনো চাল নেই। চোখে দেখি না, গন্ধও পাই না। আমদানি হলে খবর পেতাম। তাদের লোক আসত। দেশেই তারচেয়ে কম দামে চাল বিক্রি হচ্ছে। এ জন্যই হয়তো আসছে না ভারতের চাল।’
একই বাজারের খুচরা চাল বিক্রেতা মান্নান রাইস এজেন্সির আবদুল মান্নান, বাহার ট্রেডার্সের বাহার মিয়াসহ অন্য চাল বিক্রেতারা বলেন, ‘সরকার যতই শুল্ক কমাক দাম কমবে না। কারণ ভারতে চালের দাম বেশি। আবার দেশে আমন ধান উঠলেও চিকন চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা। মিলাররা বলছেন, ধান নেই। সরবরাহ কমে যাওয়ায় দাম বাড়ছে। তাই আমাদেরও বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। লোকশান করে তো ব্যবসা করা যায় না। এ জন্য আমাদেরও বেশি দামে মিনিকেট ৭২-৭৬ টাকা, আটাশ চাল ৫৮-৬০ টাকা ও মোটা চাল ৫০-৫২ টাকা কেজি বিক্রি করতে হচ্ছে।’
এদিকে কৃষিমার্কেটের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী মেসার্স এম এম রাইস এজেন্সির ফিরোজ মাহমুদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘চালের বাজার চলে গেছে করপোরেট সিন্ডিকেটের পকেটে। তারা যা ইচ্ছা তাই করছে। ধান নেই অজুহাতে কয়েক দিন ধরে করপোরেট ব্যবসায়ীরা বস্তায় দাম বাড়িয়েছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। এক বস্তায় ৫০ কেজি চাল থাকে। কিন্তু বাস্তবে দেশে পর্যাপ্ত ধান রয়েছে। বোরো ধান ওঠার পর থেকেই মিলমালিকরা দাম বাড়াচ্ছেন। ব্যাংক থেকে বেশি করে ঋণ নিয়ে মিলাররা কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে মজুত করছেন। ইচ্ছামতো দাম বাড়াচ্ছেন। এর প্রভাব ভোক্তাদের ওপর পড়ছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যেহেতু ঋণের টাকায় মিলাররা বেশি করে ধান মজুত করছে তাই ব্যাংক ঋণ বন্ধ করতে হবে। তাহলে তারা সিন্ডিকেট করে ধান ও চাল মজুত করতে পারবে না। সপ্তাহের চাল সপ্তাহে সরবরাহ করতে হবে। সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে। তারা অভিযান চালালেই কমবে চালের দাম। সরকারকে এদিকে নজর বাড়াতে হবে।’
দেশের বিভিন্ন হাট-বাজারে আমন ধানের দাম কমছে। তবে চালের দামে এর প্রভাব নেই। এ ব্যাপারে নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর থানার চাল কেনাবেচার বড় বাজার খড়িবাড়ি হাটের অপু রহমান বলেন, ধানের দাম ১ হাজার ৩৭০ টাকা মণ। এক সপ্তাহ আগে এই দাম ছিল ১৪০০ টাকা। এক মণে ২৬ কেজি চাল হলে প্রতি কেজির দাম পড়ে ৫৩ টাকা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, দেশে চালের বার্ষিক চাহিদা ৩ কোটি ৭০ লাখ থেকে ৩ কোটি ৯০ লাখ টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩ কোটি ৯০ লাখ ৩৫ হাজার টন চাল উৎপাদন হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরেও ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৩৬ হাজার টন চাল উৎপাদন হয়েছে। চলতি বছরেও ভালো হবে। তার পরও বাড়ছে চালের দাম।