স্বাধীনতা-পূর্ব ও পরবর্তী রাজনীতিতে ছাত্রলীগের চারজন নেতাকে ‘চার খলিফা’ নামে অভিহিত করা হতো। তাদের এই নামে ডাকা হতো মূলত ইসলামের চার খলিফার সঙ্গে তুলনা করে। তারা হলেন নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আ স ম আব্দুর রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখন। কিন্তু হালে মাগুরা-১ আসনে নতুন পাঁচ খলিফার কর্মকাণ্ড বেশ চাউর হয়েছে। অবশ্য এদের খলিফার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে নেতিবাচক অর্থে।
এই আসনের সাবেক এমপি সাইফুজ্জামান শিখর এলাকায় চাঁদাবাজি ও প্রভাব বিস্তারের জন্য এই পাঁচজন দলীয় নেতাকে নিযুক্ত করেছিলেন বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন। এরাই পাঁচ খলিফা নামে পরিচিতি লাভ করেছেন। শ্রীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রবীণ একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে খবরের কাগজকে জানান, আলোচিত এই পাঁচ নেতা হলেন শ্রীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন রশিদ মুহিত, জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক শেখ রেজাউল ইসলাম, জেলা আওয়ামী লীগ নেতা মীর সুমন, অ্যাডভোকেট শাখারুল ইসলাম শাকিল ও জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক ফজলুর রহমান।
জানা গেছে, এই পাঁচ নেতার প্রভাব বিস্তারের কারণে বিগত সরকারের সময়ে সাইফুজ্জামান শিখরকে নিয়ে বেশ আলোচনা ও সমালোচনা হয়।
এলাকার একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা জানিয়েছেন, আলোচিত ওই পাঁচ নেতাকে দিয়ে গোটা মাগুরা জেলা নিয়ন্ত্রণ করতেন শিখর। তাদের নিয়ে সিন্ডিকেট করে স্থানীয় পর্যায়ে সব রকমের ঠিকাদারি কাজসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বণ্টন করতেন। কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ের অধিকাংশ নেতা-কর্মী এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতেন। অথচ এখন দলের বিপদের দিনে সেই সব বঞ্চিত নেতা-কর্মীই বিপদে আছেন। অন্যদিকে সিন্ডিকেট তৈরি করে টাকা কামানো নেতারা আরামে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বঞ্চিত নেতারা একদিকে অর্থনৈতিক সমস্যায় আছেন, অন্যদিকে নানা রাজনৈতিক মামলা ও হামলায় তারা অবর্ণনীয় কষ্টে দিন পার করছেন।
সাইফুজ্জামান শিখরের বাবা মোহাম্মদ আছাদুজ্জামান ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ। সেই সুবাদে দুই দফায় শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী ও একবার এমপি হয়েছেন শিখর। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তার। নিজে সংসদ সদস্য হওয়ার পাশাপাশি বোনকেও বানিয়েছেন সংসদ সদস্য। সমান তালে করেছেন তদবির-বাণিজ্য। টেন্ডারবাজি-দখলদারত্বসহ ব্যাংকের টাকা লুট করে গড়ে তুলেছেন বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। নিজ জেলা মাগুরায় একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নিতে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতাদের বাদ দিয়ে হাইব্রিডদের দিয়ে গড়েছেন ‘শিখর বাহিনী’, যা নিয়ন্ত্রণ করতেন তারই দুই ভাই।
একসময়ের ছাত্রনেতা প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী পদে যাওয়ায় সারা দেশে শিখরের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি হয়। শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারীদের মধ্যে শিখরকে প্রভাবশালী ধরা হতো। আওয়ামী লীগের শেষ দুটি মন্ত্রিসভার নেতারা প্রায় সবাই তার ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এমনকি অনেকেই মন্ত্রী হওয়ার জন্য শিখরের কাছে ধরনা দিয়েছেন বলেও আওয়ামী লীগের মধ্যে আলোচনা আছে। ওই সময় তার নামে প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে বড় দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এসব অর্থ দিয়ে রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে বাড়ি, ফ্ল্যাট ও প্লটের মালিক হয়েছেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাবেক সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী হওয়ার সুবাদে শিখরের সঙ্গে সখ্য তৈরি হয় তার (শেখ হাসিনার) বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের বিতর্কিত সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরেরও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন তিনি। এ ছাড়া তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দুর্নীতিবাজ কয়েকজন কর্মকর্তা ও খুলনা বিভাগের প্রভাবশালী এক আওয়ামী লীগ নেতার সমন্বয়ে তৈরি হয় একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। গত দেড় দশকে ব্যাংক ও শেয়ারবাজারে জালিয়াতি, কারসাজি এবং প্রতারণার মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে এই সিন্ডিকেট। এভাবেই মোটা দাগে শিখরের নাম জড়ায় শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারিতে। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের আমলে সরকারি মেগা প্রকল্পে মেগা দুর্নীতিও করেন শিখর। বিশেষ করে সরকারি বড় প্রকল্পের কোন টেন্ডার কোন প্রতিষ্ঠান পাবে তাও নির্ধারণ করতেন তার সিন্ডিকেট সদস্যরা। বিনিময়ে মোটা অঙ্কের লভ্যাংশ নিয়েছেন শিখর।
শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী থাকাকালীন সরকারি একটি ব্যাংক থেকে কয়েক শ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফরিদপুরে ‘এজিএস’ নামে একটি কোম্পানি খোলেন শিখর এবং তার সহযোগী আরিফ ও গালিব। পরে সেই ঋণ আর শোধ করা হয়নি। নিজের প্রভাব খাটিয়ে ২০২২ সালের দিকে হাসানুজ্জামান টিটো নামে এক ব্যক্তির জুট মিল দখলে নেন শিখর। নিজে দখল করে টিটোকে মাসে লভ্যাংশ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। দখল হয়ে যাওয়ার পর মূল মালিক টিটোকেই কোণঠাসা করে রাখেন শিখর। টিটো তার ন্যায্যমূল্য বুঝে নিতে চাইলে হত্যা ও নাশকতার মামলা দেওয়ার হুমকিও দেন। ওই জুট মিল দেখিয়ে সরকারি ব্যাংক থেকে শতকোটি টাকা ঋণ নিলেও কোনো টাকাই পরিশোধ করেননি তিনি। দেশের উত্তরবঙ্গের একাধিক জেলায় নামে-বেনামে কোম্পানির কথা বলে একাধিক সরকারি ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ তুলে নিয়ে পকেটে ঢুকিয়েছেন শিখর। এ ছাড়া তার ব্যক্তিগত গাড়িতে করে বিভিন্ন অবৈধ পণ্যর পাশাপাশি সোনা চোরাচালান হতো বলে অভিযোগ আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিশেষ সহকারী থাকা অবস্থায় ক্যাসিনোকাণ্ডেও নাম জড়িয়েছে শিখরের। পদের প্রভাব খাটিয়ে ক্যাসিনোকাণ্ডে জড়িত ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, খালিদ ভূঁইয়া, জি কে শামীমসহ কয়েকজন নেতাকে সুবিধা দিয়েছেন। বিনিময়ে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা তার পকেটে যেত বলেও অভিযোগ রয়েছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, এসব ঘটনা শেখ হাসিনার কান পর্যন্ত চলে যায় এবং এভাবেই অসংখ্য অভিযোগ জমা হয় গণভবনে। একপর্যায়ে শিখরকে গণভবন ও বিশেষ সহকারীর পদ থেকে সরানোর দাবি আসে নানা জায়গা থেকে। এমন অবস্থায় নৌকার মনোনয়ন দিয়ে ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় তাকে গণভবন থেকে বাদ দেওয়া হয়।
অবশ্য এ ঘটনায়ও প্রভাব কমে যায়নি শিখরের। এমপি হয়ে নিজ জেলা মাগুরায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন তিনি। স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাগুরায় একক নিয়ন্ত্রণ নিতে জেলার প্রবীণ আওয়ামী লীগের নেতাদের কোণঠাসা করেন শিখর। তার পরিবারের সদস্যরাও ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। তার মেজো ভাই আনিসুজ্জামান সাচ্চু জেলার টেন্ডারগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেন। ছোট ভাই হিসামের নামেও চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। নিজের প্রভাব ধরে রাখতে বোন কামরুল লায়লা জলিকে বানিয়েছেন সংরক্ষিত আসনের এমপি।
দলীয় নেতা-কর্মীদের কয়েকজনকে অর্থনৈতিক সুবিধা দিলেও অধিকাংশ নেতা-কর্মী কোনো সুবিধা পাননি তাদের কাছ থেকে। হাইব্রিড ও অনুপ্রবেশকারীদের দলীয় কমিটিতে পদায়ন করে ‘শেখর বাহিনী’ তৈরি করেন তিনি। আর এই বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই দলেরও অনেক নেতা-কর্মীকে মামলা-হামলার শিকার হতে হতো। তাদের অত্যাচারে অনেককেই এলাকাছাড়া হতে হয়েছে।
মাগুরার স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের মধ্যে আলোচনা আছে, পছন্দমতো প্রশাসনিক কর্মকর্তা মাগুরায় নিয়ে এসে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটের ফল বদলে দিতেন শিখর। এভাবে উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকার মনোনীত প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও শিখর তার নিজের অনুসারীদের জয় নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখতেন। জেলা পরিষদে আওয়ামী লীগ নেতা রানা ওসমানকে জোর করে পরাজিত করে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ কুমার কুণ্ডুকে জয়ী ঘোষণা করেন বলে অভিযোগ আছে। একইভাবে সদর উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদে জাতীয় পার্টির প্রার্থী জয়লাভ করলেও তাকে পরাজিত ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ নেতা আবু নাছির বাবলুকে জয়ী ঘোষণা করা হয়।
মাগুরায় নামে-বেনামে কয়েক শ একর জমি আছে শিখর ও তার পরিবারের সদস্যদের। অধিকাংশই প্রভাব খাটিয়ে হয় দখল, নয়তো নামমাত্র মূল্যে কিনে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সেখানে আম বাগান, মাল্টা বাগান, লেবু বাগান ও গরুর খামার করেছেন শিখর। তার অন্য ভাইয়েরাও নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। জাগলা এলাকায় তার ভাইয়ের নামে একটি ইটভাটা করে অনেক জায়গা দখল করা হয়েছে। আঠারখাদা ইউনিয়ন ও হাজীপুর এলাকায় শত শত বিঘা জমি নিজের করে নিয়েছেন। শিবরামপুর পৌরসভার মধ্যে ২০ বিঘা জমির ওপরে বাগানবাড়ি তৈরি, আলিধানীতে ২০ বিঘা ধানি জমি, কাটাখালী, নড়িহাটি, বাঁশকোটা, টেংগাখালী, মালন্দ, মৃগীডাংগা, বাগডাংগা মৌজায় শত বিঘা ফসলি জমি রয়েছে তার।
জানা গেছে, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর শিখরের আধিপত্যে ভাটা পড়ে। ভারতে পালিয়ে যান তিনি। গত ৭ জানুয়ারি শিখর ও তার স্ত্রী সিমা রহমানের বিরুদ্ধে পৃথক দুই মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২ কোটি ৯৫ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ ও ব্যাংক হিসাবে প্রায় ১১ কোটি টাকার সন্দেহভাজন লেনদেনের অভিযোগ আনা হয় তাদের বিরুদ্ধে।
প্রথম মামলায় সাইফুজ্জামান শিখরের বিরুদ্ধে সরকারের দায়িত্বশীল পদে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ উপায়ে ১ কোটি ৭৯ লাখ ৬২ হাজার ৫২১ টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। একই সঙ্গে এ সম্পদ ভোগদখলে রাখা এবং নিজ নামীয় ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক সাতটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে মোট ১০ কোটি ৯৮ লাখ ৮২ হাজার ৩১৫ টাকার সন্দেহজনক ও অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য মিলেছে।
দ্বিতীয় মামলায় শিখরের স্ত্রী সিমা রহমানের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ উপায়ে ১ কোটি ১৬ লাখ ১ হাজার ৩৩২ টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। এ মামলায় সাইফুজ্জামান শিখরকেও আসামি করা হয়েছে।