ঢাকা ৩০ পৌষ ১৪৩১, মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫

লণ্ডভণ্ড কমিউনিটি পুলিশিং

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:০৯ এএম
আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৫২ এএম
লণ্ডভণ্ড কমিউনিটি পুলিশিং
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

‘আগে রাত হলেই পাড়া-মহল্লায় পুলিশের টহল ও আনাগোনা দেখা যেত। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে পুলিশ সদস্যরা আড্ডা দিতেন, তারা গল্প করার পাশাপাশি মহল্লার নানা খোঁজখবর নিতেন। এতে করে মনে একটা সাহস বা স্বস্তি কাজ করত। এখন আর কাউকেই দেখা যায় না। রাত হলে এলাকায় চুরি-ছিনতাইয়ের আতঙ্ক বাড়ে।’

কথাগুলো বলেছেন রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজার এলাকার জেরিন নিবাসের তত্ত্বাবধায়ক মো. ইয়ানুস আলী। কেবল তিনি নন, একই বিষয়ে আলাপকালে প্রায় অভিন্ন মন্তব্য পাওয়া গেছে আরও কয়েকজনের কাছ থেকেও। আলাপকালে তারা বলেছেন, পুলিশের সামাজিক নেটওয়ার্ক হিসেবে পরিচিত ‘কমিউনিটি পুলিশিংয়ের’ মাধ্যমে আগে পাড়া-মহল্লার স্থানীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ ও সুসম্পর্ক রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কাজ করত থানা পুলিশ। কিন্তু জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশ বাহিনীর আগের কাঠামোর পাশাপাশি ‘কমিউনিটি পুলিশিং’ লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর মতে, বিগত সরকারের সময়ে কমিউনিটি পুলিশের সঙ্গে কাজ করতেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের অনেক নেতা-কর্মী। কিন্তু সরকার পতনের পরই তাদের বেশির ভাগ এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। অনেকেই এখন আত্মগোপনে। তবে বিএনপি বা অন্য কোনো সংগঠনের নেতা-কর্মীদের এখনো এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়নি। ফলে কমিউনিটি পুলিশে লোকবল বলতে এখন আর কিছুই নেই। 

জানা গেছে, মূলত লোকবল সংকটের কারণেই কমিউনিটি পুলিশের ধারণা তৈরি হয়েছিল। বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে আনুপাতিক হিসেবে পুলিশ সদস্যের সংখ্যা অত্যন্ত অপ্রতুল। সংশ্লিষ্টদের হিসাবমতে, গড়ে ৮১২ নাগরিকের জন্য দায়িত্বে রয়েছেন একজন মাত্র পুলিশ সদস্য। অথচ ভারতে এবং উন্নত বিশ্বে পুলিশ সদস্যের এই আনুপাতিক হার চার থেকে পাঁচগুণেরও বেশি। 

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, “কমিউনিটি পুলিশিং এখন প্রায় পুরোপুরি বন্ধ আছে। কমিউনিটি পুলিশের আগে যেসব কমিটি ছিল, সেগুলোর আর অস্তিত্ব নেই। এ ছাড়া ওই সব কমিটির প্রধান বা মূল ব্যক্তিদের নিয়েও আগে স্বেচ্ছাচারিতা বা পক্ষপাতের অনেক অভিযোগও ছিল। সবমিলে কমিউনিটি পুলিশিং নতুন করে আর সচল করা হয়নি। তবে বর্তমানে পুলিশের উদ্যোগে ‘নাগরিক কমিটি’ বা সিটিজেন ফোরাম নামে নতুন কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।” 

নাগরিক কমিটি সম্পর্কে ডিসি তালেবুর রহমান বলেন, ‘এটি কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মতো নয়, নাগরিক কমিটির কাজ মূলত পুলিশকে পরামর্শ ও মতামত দিয়ে সহায়তা করা। সবেমাত্র কাজটি শুরু হয়েছে। নাগরিক কমিটি সংশ্লিষ্ট থানার আওতাধীন সমাজের গণমান্যদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে। থানা পুলিশ তাদের নিয়ে মাঝেমধ্যে মতবিনিময়সহ নানা কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।’

এ বিষয়ে মাঠপর্যায়ের পরিস্থিতি জানতে গত শনিবার (৭ ডিসেম্বর) কথা হয় ডিএমপির একাধিক থানার অফিসার ইনচার্জের (ওসি) সঙ্গে। তাদের মধ্যে তেজগাঁও থানার ওসি মো. মোবারক হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমার থানার আওতায় বর্তমানে নাগরিক কমিটি বা সিটিজেন ফোরামের কার্যক্রম চলছে। এটি পুলিশের নতুন উদ্যোগ। যে উদ্যোগের মধ্যে আমরা নাগরিকদের কাছ থেকে প্রত্যাশাগুলো জানতে চাচ্ছি। পুলিশের দৈনন্দিন কাজের বিষয়েও পরামর্শ নিচ্ছি। গত ৫ ডিসেম্বর তেজগাঁও থানার হলরুমে দলমত নির্বিশেষে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ নিয়ে আমরা মতবিনিময় করেছি। যেখানে সাংস্কৃতিক কর্মী, খেলোয়াড়, চিকিৎসক, শিক্ষক, একাধিক ধর্মীয় নেতাও অংশ নেন।’ তিনি বলেন, ‘আগে কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমে পুলিশ জনগণের কাছে গিয়ে পাড়া-মহল্লার নানা তথ্য সংগ্রহসহ অভিযানিক সহায়তা নিত। বর্তমানে এ কাজগুলো পুরোপুরি বন্ধ আছে। তবে শিগগিরই এ-জাতীয় পুলিশিং আবারও শুরু হবে বলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।’

একই বিষয়ে আলাপকালে রামপুরা থানার ওসি আতাউর রহমান আকন খবরের কাগজকে বলেন, ‘সমাজের সম্মানিত নাগরিকদের সম্পৃক্ত করে আমরা ইতোমধ্যেই নানা বিষয়ে কাজ শুরু করেছি। জনগণ আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করলে আমরাও সহজেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও উন্নয়ন ঘটাতে পারব।’ 

এ বিষয়ে সামাজিক অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের দেশে অপরাধের যে ধরন ও বাস্তবতা, সে অনুসারে সমাজের সহযোগিতা বা ভূমিকা ছাড়া পুলিশের একার পক্ষে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা সম্ভব নয়। এ জন্য কমিউনিটি পুলিশিং খুবই কার্যকরী ও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিগত সময়ে অনেক ক্ষেত্রে এই কমিউনিটি পুলিশিং রাজনৈতিক প্রভাবে পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা পালন করেছে বলে আমরা জানতে পারি। ফলে রাজনৈতিক  গুরুত্ব না দিয়ে দলমত নির্বিশেষে সর্বজনগ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের কমিটিতে রেখে কমিউনিটি পুলিশিং করা গেলে খুব ভালো ফল পাওয়া যাবে।’ 

ঢাবির সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক আরও বলেন, ‘গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে বর্তমানে জমিজমা দখল বা মালিকানা বিরোধ, কিশোর অপরাধ, চুরি, ছিনতাই, মাদকসহ নানা সামাজিক অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ পরিস্থিতিতে দ্রুত কমিউনিটি পুলিশিং অথবা এই বৈশিষ্ট্যের কোনো ব্যবস্থা চালু করতে হবে। জনগণকে সম্পৃক্ত করে পুলিশিং করা গেলে সমাজের অপরাধ অনেকাংশে কমে আসবে।’

এ প্রসঙ্গে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মুহাম্মদ নুরুল হুদা খবরের কাগজকে বলেন, ‘কমিউনিটি পুলিশিং অবশ্যই প্রয়োজন। এর মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- পুলিশের কর্মকাণ্ডে জনগণকে সম্পৃক্ত করা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এটা আছে। সেটা যেকোনো নামে বা ‘ফরম্যাটে’ হতে পারে। কারণ একটি দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য বিরাটসংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা সম্ভব হয় না। তখন পুলিশ ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধ গড়ে সমাজ তথা রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে হয়। তাছাড়া জনগণকে সম্পৃক্ত করে পুলিশিং করলে বড়সংখ্যক পুলিশের প্রয়োজনও হবে না।’ 
নুরুল হুদা আরও বলেন, ‘কমিউনিটি পুলিশিং হচ্ছে অপরাধ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। জনগণের সঙ্গে পুলিশের সুসম্পর্ক থাকলে অপরাধসংক্রান্ত আগাম তথ্য পাওয়া যায়, তাতে করে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। আবার কোনো অপরাধ ঘটে গেলেও তদন্তে ভালো সহযোগিতা পাওয়া যাবে। ফলে কমিউনিটি পুলিশিং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ।’

৮১২ নাগরিকের জন্য পুলিশ সদস্য মাত্র ১ জন: পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, সর্বশেষ আদম শুমারি অনুসারে বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি ৩৫ লাখ ২০ হাজার (১৭৩.৫২ মিলিয়ন)। অপরদিকে পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যমতে, বাংলাদেশ পুলিশে বর্তমানে মোট জনবলের সংখ্যা ২ লাখ ১৩ হাজার ৬৪৪। সে হিসাবে দেখা যাচ্ছে, প্রতি ৮১২ জন নাগরিকের জন্য পুলিশ সদস্য মাত্র ১ জন।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, বৃহৎ জনসংখ্যার আনুপাতিক হিসেবে পুলিশ সদস্য অপ্রতুল। তাই কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মতো যেকোনো ব্যবস্থায় জনগণকে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করতে না পারলে পুলিশের একার পক্ষে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

কমিউনিটি পুলিশিং কী: বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইট ও উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রতিষ্ঠাতা রবার্ট পিলের গণমুখী পুলিশিং এর মূলনীতি থেকেই মূলত কমিউনিটি পুলিশিংয়ের ধারণা আসে। কমিউনিটি পুলিশিং হচ্ছে অপরাধ সমস্যা সমাধানে পুলিশ ও জনগণের যৌথ অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠার একটি পুলিশিং দর্শন। বাংলাদেশ পুলিশের কর্মকাণ্ডে জনগণের অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে র্কাযকরভাবে অপরাধ প্রতিরোধের জন্য কমিউনিটি পুলিশিং ধারণা গ্রহণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশে কমিউনিটি পুলিশিং যেভাবে শুরু: ১৯৯৪ সালে দেশে প্রথম কমিউনিটি পুলিশিংয়ের ধারণা থেকে মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু হয়। তৎকালীন ময়মনসিংহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ কে এম‍ শহীদুল হক, যিনি পরবর্তী সময়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ছিলেন। তিনিই মূলত এই ব্যবস্থার বিকাশ ঘটান। সে সময় ময়মনসিংহে হঠাৎ করেই বেড়ে যায় চুরি, ছিনতাই। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তৎকালীন এসপি আহমাদুল হক গঠন করেন ‘টাউন ডিফেন্স পার্টি’। এটি মূলত কমিউনিটি পুলিশিংয়ের একটি অংশ। ঠিক সে সময়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ কে এম শহীদুল হক কমিউনিটি পুলিশিং নিয়ে কাজ শুরু করেন, যা পরবর্তী সময় ডিএমপিসহ সারা দেশে ছড়িয়ে দেন। কমিউনিটি পুলিশিংয়ের যাবতীয় কর্মকাণ্ড অপরাধ প্রতিরোধ তথা অপরাধ যাতে ঘটতে না পারে সেই লক্ষ্যে পরিচালিত হয়ে থাকে।

গতি পায়নি অর্থনীতি

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৩০ পিএম
গতি পায়নি অর্থনীতি
খবরের কাগজ ইনফোগ্রাফ

উচ্চ মূল্যস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বিশাল রাজস্ব ঘাটতিসহ নানামুখী চাপে রয়েছে দেশের অর্থনীতি। এই চাপ সামলাতে অন্তর্বর্তী সরকার কিছু পদক্ষেপ নিলেও গতি পায়নি অর্থনীতি।

সরকারের আয় কমেছে। বেড়েছে ব্যয়। বাজেটে অর্থায়নে বিকল্প পথ খোঁজা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির তুলনায় কর আহরণ খুবই কম। কর আদায় আরও বাড়াতে হবে। চলমান ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ কর্মসূচির পাশাপাশি আইএমএফের কাছে নতুন করে আরও ৭৫ কোটি ডলার চেয়েছে সরকার। বাড়তি ঋণ পেতে নতুন শর্ত আরোপ করেছে সংস্থাটি। সেটি হলো, কর আহরণ আরও বাড়তে হবে। মূলত আইএমএফের শর্ত পালন করতে গিয়েই অর্থবছরের মাঝপথে এসে শতাধিক পণ্য ও সেবায় মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে এমনিতেই সাধারণ মানুষের জীবন নাভিশ্বাস। উপরন্তু পণ্য ও সেবায় সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে তাদের জীবন আরও দুবির্ষহ হয়ে পড়েছে। এখনো উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে সাধারণ মানুষ পিষ্ট হচ্ছেন। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ডিসেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৩ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এটি সর্বোচ্চ। ডলারের দাম ১২৩ টাকার বেশি। কিছুটা ইতিবাচক আছে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। তবে সামষ্টিক অর্থনীতির বাকি প্রায় সব সূচকই তলানিতে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় বিনিয়োগ স্থবির হয়ে রয়েছে। জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। ফলে শিল্প খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে অস্থিরতা কাটছে না। 

অর্থনীতি যে সংকটে আছে তাতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১ দশমিক ৮১ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ৬ শতাংশের বেশি। সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা কৃষিতে। এ খাতে চলতি প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ। শিল্প ও সেবা খাতের অবস্থাও শোচনীয়। অবশ্য অর্থনীতির এই নাজুক অবস্থা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। 

গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর অর্থনৈতিক নেতৃত্বেও বড় পরিবর্তন হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা, পরিকল্পনা উপদেষ্টা, বাণিজ্য উপদেষ্টার পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, এনবিআর চেয়ারম্যানসহ বড় বড় পদে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা চেষ্টা করছেন অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার। কিন্তু নেতৃত্বের পরিবর্তন হলেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। 

ধুঁকে ধুঁকে চলছে রাজস্ব খাত। এনবিআরের সাময়িক হালনাগাদ হিসাবে চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। প্রতি মাসেই আদায়ের লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে আছে এনবিআর।

বৈদেশিক ঋণপ্রবাহ কমে গেছে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ আসছে, তার চেয়ে বেশি সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হওয়ায় অর্থনীতিতে চাপ বেড়েছে।  

উন্নয়ন প্রকল্পের খরচ কমেছে। আওয়ামী লীগ-ঘনিষ্ঠ অনেক ঠিকাদার পালিয়ে থাকার কারণে এডিপির বাস্তবায়ন পরিস্থিতি খুবই খারাপ। আগের বছরের তুলনায় জুলাই-নভেম্বর সময়ে সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা কম খরচ হয়েছে। 

খেলাপি ঋণ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে অনিয়ম-দুর্নীতি করে নামে-বেনামে যেসব ঋণ নেওয়া হয়েছে, তা এখন খেলাপি হতে শুরু করেছে। তা ছাড়া বর্তমান সরকার খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করছে। ফলে উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে খেলাপি ঋণ। 

আর এই ঋণের বোঝা বাড়ছে দেশের জনগণের ঘাড়ে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের ঘাড়ে দেশি-বিদেশি ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা। এ অঙ্ক বাংলাদেশের তিনটি জাতীয় বাজেটের সমান।  এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ১০ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অপর দিকে বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। বিশাল অঙ্কের এই ঋণের বিপরীতে সরকারকে প্রতিবছর ১ লাখ কোটি টাকার বেশি সুদ গুনতে হচ্ছে। এতে করে সরকারের আর্থিক চাপ আরও বেড়েছে। 

যোগাযোগ করা হলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, অর্থনীতিতে অনেক সমস্যা রয়েছে। রিজার্ভে সমস্যা। আমদানির সমস্যা। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। আরও সমস্যা আছে, যেমন ব্যাংক খাত। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সুফল মেলেনি। 

তিনি আরও বলেন, কিছু খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। রপ্তানির প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। রেমিট্যান্সের শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে ব্যাংক খাত, রিজার্ভের সমস্যা কাটেনি এখনো। অর্থনীতিতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য সরকার চেষ্টা করছে। তবে এর সুফল আসবে কি না, তা বলা মুশকিল।

স্থিতিশীল হয়নি রাজনীতি

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৪৫ পিএম
আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:১৯ পিএম
স্থিতিশীল হয়নি রাজনীতি
খবরের কাগজ ইনফোগ্রাফ

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলেও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিপূর্ণভাবে স্থিতিশীল হয়নি। বরং নির্বাচনের দিনক্ষণ, সংস্কার ও কোন নির্বাচন আগে, নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রচেষ্টা, রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ মতবিরোধসহ বিভিন্ন কারণে রাজনীতিতে কিছুটা অস্থিরতা আছে। এদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গেই অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সর্বোপরি প্রশাসন ও পুলিশে এখনো স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। প্রশাসন বনাম বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে বিভক্তি অবসানের কোনো লক্ষণ নেই। অন্যদিকে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্পূর্ণভাবে গতিশীল হয়নি। ফলে জনমনে এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, এত সব সরকার সামাল দেবে কীভাবে? 

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, সংস্কার কমিশনগুলোর রিপোর্ট আগামী কয়েকদিনের মধ্যে জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। আমি মনে করি, আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারের রোডম্যাপ দেওয়া উচিত হবে। না হলে রাজনৈতিক দলগুলো আবার রাস্তায় নামবে। এতে নতুন সমস্যার মুখে পড়তে হবে সরকারকে। 

তিনি বলেন, আজ হোক বা কাল হোক নির্বাচন তো দিতেই হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেরিতে নির্বাচন হওয়ার সুযোগ অনেকটাই কমে গেছে। দেশের বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং আন্তর্জাতিক মহলও নির্বাচন চাইছে। কারণ দেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে গেছে। বিদেশি কোনো বিনিয়োগ নেই, সমঝোতাও হবে না। এ জন্য নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে দেরি হলে দেশে অস্থিরতা বাড়বে। ফলে দ্রুত নির্বাচন হলে দেশে সংকটও কমে আসবে। 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলো যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন দেওয়া। নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যেসব সংস্কার প্রয়োজন সেগুলো চিহ্নিত করে শুধু অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে হবে। একই সঙ্গে ভোটের জন্য প্রস্তুতি, ভোটার তালিকা তৈরিসহ নির্বাচনের একটা রোডম্যাপ দেওয়াই বর্তমান সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য খুবই জরুরি। 

তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠন হয়েছে, ভোটার তালিকা প্রণয়নের কাজ চলছে, অন্যান্য আইনের সংস্কারকাজও চলমান। সংস্কার কমিশনে বিএনপি তাদের মতামত দিয়েছে। এই মতামতের ওপর ভিত্তি করে প্রধান উপদেষ্টা সব রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে কী কী সংস্কার করা যায় সে ব্যাপারে ঐকমত্য সৃষ্টি করতে পারেন। কিছু বিষয়ে দ্বিমত থাকবে, এটা স্বাভাবিক। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে সেগুলো সংস্কার হবে। এখানে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার চিহ্নিত করে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

তার মতে, ‘নির্বাচনের জন্য মাঠের ও প্রাতিষ্ঠানিক কিছু সংস্কার দুই-তিন মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন সম্ভব। আর নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার এলে সংবিধান সংশোধনীসহ অন্য দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করবে। এর আগে জাতির কাছে তারা অঙ্গীকার এবং নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি দেবে যে, আমরা আগামী দিনে ঐকমত্যের ভিত্তিতে এগুলো বাস্তবায়ন করব।’ যেমন আদালতের রায়ের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ও গণভোটের বিধান পুনর্বহাল হয়েছে। ফলে অন্য সমস্যাগুলোও সমাধানে পরবর্তী সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। 

জানা গেছে, সরকার ও বিএনপিসহ তার মিত্র দলগুলোর মধ্যে দূরত্বের মূল কারণ হলো নির্বাচনের সুস্পষ্ট দিনক্ষণ ঘোষণা না করা। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে রাষ্ট্র বিনির্মাণে ঠিক কতটা সংস্কার হবে এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা- এসব ইস্যু নিয়ে সরকারের সঙ্গে তাদের সন্দেহ-অবিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গেলে অনেকে ‘মাইনাস টু’ এর বিষয়টি সামনে নিয়ে আসছে। যদিও বিএনপি বলছে, মাইনাস টু-এর আশা জীবনেও পূরণ হবে না। 

ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে চলতি বছরেই নির্বাচন চায় বিএনপি। তবে এ ক্ষেত্রে অনেকটাই কৌশলী অবস্থান নিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটি ‘আগে ব্যাপকভিত্তিক সংস্কার ও পরে নির্বাচনে’র কথা বলছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা, রাষ্ট্রপতির অপসারণ নিয়ে দ্বিমত, ভোটার হওয়ার সর্বনিম্ন বয়সসীমা ১৭ বছর করার উদ্যোগ নিয়েও বিএনপির আপত্তি রয়েছে। পাশাপাশি গণ-অভ্যুত্থানের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে উপদেষ্টা মাহফুজ আলমকে বিশ্বে পরিচয় করিয়ে দেওয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নীরব মনোমালিন্য তৈরি হয়েছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন জায়গায় দখল ও চাঁদাবাজিসহ নানা ইস্যুতে সরকারের একাধিক উপদেষ্টা ও বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য এখনো অব্যাহত আছে। সব মিলিয়ে সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

সর্বশেষ ‘প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভল্যুশন’ (ঘোষণাপত্র) তৈরি এবং সংবিধান বাতিলসংক্রান্ত বক্তব্য নিয়েও দ্বিমত স্পষ্ট হয়েছে। এখন ঘোষণাপত্র তৈরির দায়িত্ব নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে শুধু জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নয়, গত ১৬ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের স্বীকৃতি চায় বিএনপি। ফলে গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরিতেও জটিলতা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া ছাত্র নেতৃত্বের নতুন দলকে স্বাগত জানালেও এ ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলেও মনে করে বিএনপিসহ তার মিত্ররা। সব মিলিয়ে সরকারের সঙ্গে বিএনপির কিছুটা সন্দেহ-অবিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তবে সংস্কার হোক আর যাই হোক বিএনপির সমর্থন ছাড়া বা দলটির সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া সরকারের কোনো কাজই সহজ হবে না বলে দেশের রাজনীতিতে আলোচনা আছে। 

পর্যবেক্ষকদের মতে, সব দলের সঙ্গে সমন্বয় করে নির্বিঘ্নে একটি নির্বাচন তথা নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নতুন রাজনৈতিক দল গঠনকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে জনগণ আশা করে অতীতের মতো কিংস পার্টি হবে না। সরকারের সহযোগিতায় কোনো রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করবে না। কোনো গোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার জন্য নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা জনগণ প্রত্যাখ্যান করবে। 

এদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও নানা ইস্যুতে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে বিএনপি ও জামায়াতের অবস্থান নিয়ে প্রকাশ্যে বাহাসে লিপ্ত রয়েছে দল দুটির একাধিক নেতা। এ ছাড়া সংবিধান সংস্কার প্রশ্নে গণতন্ত্র মঞ্চেও অনৈক্যের সুর। এই ইস্যুতে জোট থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছে গণসংহতি আন্দোলন ও রাষ্ট্র-সংস্কার আন্দোলন। দল দুটির প্রস্তাব- নির্বাচনের মাধ্যমে গণপরিষদ গঠন করতে হবে এবং সংবিধান পুনর্লিখন করতে হবে। একই প্রস্তাব দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। সংবিধান সংস্কার নিয়েও দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ স্পষ্ট হয়েছে। 

জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার খবরের কাগজকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারকে সবাই শুরু থেকেই সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি। আগামী দিনেও অন্তর্বর্তী সরকার সহযোগিতা চাইলে আমরা সহযোগিতা করব।’ তিনি বলেন, ‘দেশে দলও অনেক এবং মত ভিন্ন। তবে গণ-অভ্যুত্থানের চেতনায় দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য থাকলেই হবে। রাজনৈতিক আদর্শের ভিন্নতা কোনো ব্যাপার নয়।’

জনপ্রশাসন-পুলিশে অস্থিরতা কাটেনি

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:১০ পিএম
আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:২০ পিএম
জনপ্রশাসন-পুলিশে অস্থিরতা কাটেনি
খবরের কাগজ ইনফোগ্রাফ

প্রায় সাড়ে পাঁচ মাসেও জনপ্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর ভেতরের অস্থিরতা পুরোপুরি কাটেনি। দূর হয়নি সংকটও। কিছুটা গতিশীল হলেও নিয়োগ, পদায়ন-বদলি, পদোন্নতি বা চাকরিচ্যুতি, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-বিভক্তিসহ নানা ধরনের জটিলতা এখনো বিরাজ করছে রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই দুটি বিভাগে। এতে করে সারা দেশে নাগরিকসেবা, সামাজিক শৃঙ্খলা ও আইনি সুরক্ষার কাজটিও যথাযথভাবে হচ্ছে না। বরং কোথাও কোথাও পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকেও যাচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সরকারকে সম্পূর্ণভাবে গতিশীল করতে হলে রাষ্ট্রের এই দুই প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত সক্রিয় করতে হবে। 

বিসিএসের ক্যাডারে বৈষম্য, জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ নিয়ে হট্টগোল, ৪৩তম বিসিএসে বহু প্রার্থী বাদ পড়াসহ নানা ইস্যুতে অভ্যন্তরীণ সংকট দেখা দেয় প্রশাসনে, যা এখনো পুরোপুরি দূর হয়নি। একইভাবে ভঙ্গুর এক পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়ানো পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরেও চলছে অস্থিরতা। নতুন পরিস্থিতিতে বদলি, চাকরিচ্যুতি, মামলা-গ্রেপ্তার, হামলার আশঙ্কায় পুলিশে এখনো কিছুটা আতঙ্ক রয়ে গেছে। 

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক সচিব ও বিপিএটিসির সাবেক রেক্টর এ কে এম আব্দুল আউয়াল মজুমদার খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রশাসনের মধ্যে অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা ও বিভাজন সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। এখন প্রশাসন বনাম ২৫ ক্যাডারে একটি জটিলতা বিদ্যমান। দুই পক্ষেরই কিছু নেতিবাচক দিকও আছে। যেমন: প্রশাসন ক্যাডার অন্য ক্যাডারদের ঠিকমতো মূল্যায়ন করে না, তাদের দাবিগুলো গুরুত্বের সঙ্গে নেয় না। দেখা যায়, প্রশাসন ক্যাডারে পদ না থাকলেও পদোন্নতি নিচ্ছে, বিপরীতে অন্য ক্যাডার সার্ভিসে শূন্য পদ আছে, যোগ্য কর্মকর্তাও আছেন অথচ তাদের পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে না। জনপ্রশাসন হবে সেবার ফেরিওয়ালা। প্রশাসনের লক্ষ্য এটাই হওয়া উচিত। কিন্তু এই চর্চা জনপ্রশাসনে হয় না। সবার প্রতি সুবিচার করতে হবে। কেউ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, বঞ্চিত না হন তা নিশ্চিত করা গেলেই এ ধরনের সংকট বা অস্থিরতা কেটে যাবে।’ 

এসব বিশৃঙ্খলার মাঝে প্রশাসন কোন পথে চলছে এমন প্রশ্নের জবাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে খবরের কাগজকে বলেন, “প্রশাসনে গতি ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। এটা কার্যক্রমের অংশ। তবে সবকিছু যে ‘স্মুথলি’ চলছে তা এখনই বলা যাবে না। কারণ আগের সরকার বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের কর্মকর্তাদের পদায়ন করে গেছে। এখন সব যদি বাদ দেওয়া হয় বা বদলি করে দেওয়া হয়, তবে তো প্রশাসন চলবে না। এ ছাড়া গত সরকারের আমলের অনেক কর্মকর্তাই কোনো না কোনো লাইনে বা পন্থায় উপদেষ্টাদের কাছে যাচ্ছেন। তারা তাদের দিয়ে পদায়ন বা পদোন্নতি বা অন্য কোনো তদবির করাচ্ছেন। এ ধরনের কিছু সমস্যাও এখন মোকাবিলা করতে হয়।” 

অস্থির জনপ্রশাসন
গত ৮ আগস্ট বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তারা দাবি-দাওয়া নিয়ে সচিবালয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। এ সময় জনপ্রশাসন মন্ত্রণলয়ে ঘেরাওয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা। তাদের পথ ধরেই এ সময় আন্দোলনে নামে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ। পাশাপাশি আনসার বাহিনী, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্ররাও দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সচিবালয় ঘিরে আন্দোলন শুরু করেন। গতকাল সোমবারও সচিবালয়ের সামনে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বাদ পড়া পুলিশের এসআই ক্যাডেটরা।

এসব ঘটনাকে পাশ কাটিয়ে সারা দেশেই আলোচনায় গুরুত্ব পায় প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়সহ সারা দেশের প্রশাসনে বিশৃঙ্খলার বিষয়টি। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরেই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সুবিধাভোগী, দুর্নীতিতে অভিযুক্ত, অদক্ষ, দলবাজ কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করে। তাদের মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কিছু কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর, বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) নিয়োগ দিয়ে জনপ্রশাসনে সংযুক্ত করা, সচিবালয়ের বাইরে কর্মকর্তাদের দপ্তর বদল করা, মাঠ প্রশাসনের জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং অন্য কর্মকর্তাদের উঠিয়ে এনে কম গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করে সরকার। ফলে এমনও হয়েছে দীর্ঘদিন কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকেছে সচিবশূন্য। আবার মাঠ প্রশাসনে বেশ কয়েক দিন ডিসিশূন্য ছিল কয়েকটি জেলা। সরকারের এসব সিদ্ধান্তে অস্থিরতা শুরু হয় প্রশাসনে। এতে স্থবির হয়ে পড়ে সরকারের দিকনির্দেশনার বাস্তবায়ন।

তবে এই মূহূর্তে সারা দেশে আলোচনা হচ্ছে প্রশাসন ক্যাডার ও অন্য ২৫ ক্যাডার সার্ভিস কর্মকর্তাদের মাঝে বিভক্তি নিয়ে। এই বিভক্তির কারণে প্রশাসন ক্যাডার ও অন্য ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তারা নিয়েছেন পাল্টাপাল্টি অবস্থান। আরও রয়েছে ৪৩ বিসিএস ক্যাডারে যারা বাদ পড়েছেন তাদের আন্দোলন, যা নিয়ে ইতোমধ্যে সুরাহা করার কথা জানিয়েছে সরকার।

পুরোপুরি শক্ত হয়নি পুলিশের মনোবল
পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা পর্যায়ক্রমে অনেকটা উন্নতি হলেও সার্বিক নিরাপত্তাব্যবস্থা ও নাগরিকদের আইনি সুরক্ষার প্রশ্নে এখনো অস্থিরতা বিরাজ করছে। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রায় প্রতিদিনই পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের নানা পদে রদবদল হয়েছে। অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো ও ওএসডি করা হয়েছে। গত প্রায় পাঁচ মাসে পুলিশে বদলি বা পদায়নের সংখ্যাও অর্ধলাখের বেশি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হতাহত বা গুলি চালানোর ঘটনায় অনেক পুলিশ সদস্য ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন। অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। যারা চাকরি করছেন তাদেরও একটা অংশ নানা আতঙ্কে সময় পার করছেন। তার মাঝে আবার রাজনৈতিক প্রভাবও শুরু হয়েছে বলে আলোচনা হচ্ছে। 

এদিকে পুলিশ বাহিনী বিগত আওয়ামী লীগের আমলে যেভাবে দলীয় নির্দেশনা বাস্তবায়ন করত এখনো আবার পুলিশের অনেকেই অন্য দল বা ক্ষমতার কেন্দ্রের মন জয় করার চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। দু-এক জায়গায় এখনো পুলিশের ওপর হামলার খবর আসছে। থানায় হামলা চালিয়ে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। গত ৬ জানুয়ারি চট্টগ্রামে পুলিশ পরিদর্শক নেজাম উদ্দিনকে প্রকাশ্যে মারধর করেন স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা-কর্মীরা। গত ২০ ডিসেম্বর সিলেটের আদালত চত্বরে এক পুলিশ কর্মকর্তাকে কিলঘুষি মারা হয়। এ রকম বিভিন্ন স্থানে পুলিশ আক্রান্ত হয়েছে। এর ফলে নিজের নিরাপত্তা শঙ্কায় দায়িত্ব পালনেও উদ্বিগ্ন থাকছেন পুলিশ সদস্যরা। ফলে মাঠপর্যায়ে নাগরিকের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দিতে গিয়ে পুলিশের দুর্বলতা প্রকাশ পাচ্ছে বারবার।

এ প্রসঙ্গে পুলিশের সাবেক আইজিপি মুহাম্মদ নুরুল হুদা খবরের কাগজকে বলেন, ‘৫ আগস্টের প্রেক্ষাপটে চরম অবনতি ঘটা দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি পুলিশ বাহিনী। তবে তারা চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে তা যায়নি। নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে এখানে সব শ্রেণির মানুষের সহযোগিতার বিষয় আছে। জনগণকে সহযোগিতা করতে হবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা জরুরি। এ ছাড়া এসব বিষয়ে সরকারের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও কঠোর পদক্ষেপ থাকতে হবে।’ 

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ৫ আগস্টের প্রেক্ষাপটে বর্তমানে পুলিশ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও তাদের কর্মকাণ্ডে নানা অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনাও ফুটে উঠছে। পদায়ন, বদলিসংক্রান্ত বিষয়গুলো এখন জটিল আকার ধারণ করছে। কাকে কোথায় দায়িত্ব দিলে ভালো কাজ হবে সেটার দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। তার মাঝে কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ বেশ ভালো উন্নতি করলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এখনো পুরোপুরি শৃঙ্খলা আনতে পারেনি। তিনি বলেন, এ পরিস্থিতি থেকে বের হতে আগের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে। জনগণের জন্যই প্রকৃতপক্ষে পুলিশকে কাজ করতে হবে। রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করলে ভবিষ্যতে আবারও নাজেহাল হওয়ার শঙ্কা থাকবে।

এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর খবরের কাগজকে বলেন, বর্তমানে পুলিশ সর্বোচ্চ পেশাদারত্ব ও আন্তরিকতার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। পুলিশ নাগরিকের সুরক্ষার জন্য কাজ করছে। পুলিশকে দায়িত্ব পালনে সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে। 

গার্মেন্টে বাড়ছে শ্রমিক অসন্তোষ

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৩১ এএম
আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৩৭ এএম
গার্মেন্টে বাড়ছে শ্রমিক অসন্তোষ
চট্টগ্রামের ইপিজেডের ক্যাপস অ্যান্ড টেক্সাইল লিমিটেডের শ্রমিকরা আন্দোলন করছেন। ছবি: খবরের কাগজ

তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে আন্দোলন ও ছোটখাটো অবান্তর দাবি নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িছে পড়ছে চট্টগ্রামের পোশাক কারখানায়। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হলেও দিন দিন যেন ‘আবদার’ বাড়ছে। ফলে শ্রমিকদের নানা অজুহাতে কর্মবিরতি সড়ক অবরোধ, কাজে যোগ না দেওয়ায় চরম বিপাকে পড়তে হচ্ছে মালিকদের। এসব সংকটের কারণে কারখানা বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হচ্ছেন কর্তৃপক্ষ। 

পোশাক কারখানার মালিকরা জানান, ম্যানেজারকে ছাঁটায়ের দাবি, দুপুরের ভাত, হিট অ্যালাউন্স (ভাতা), ওভার টাইমের অতিরিক্ত বিল, নাস্তার বিল এসবের জন্যও আন্দোলন করছেন শ্রমিকরা। কথায় কথায় কাজ বন্ধ করে দিচ্ছেন তারা। বর্তমানে শ্রমিকদের কাছে অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়ছেন মালিকরা। এক কারখানা অন্য কারখানার শ্রমিকদের মধ্যেও লাগছে সংঘর্ষ।

রবিবার (১২ জানুয়ারি) দুপুরে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) অ্যাডামস ক্যাপস অ্যান্ড টেক্সটাইলস লিমিটেডের শ্রমিকরা আন্দোলনে নামেন। দুপুরের বের হয়ে শ্রমিকরা আর কাজে যোগ দেননি। 

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কাজ না করে সড়কের অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন দাবি আদায়ের মিছিলে অংশ নেন নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা। এ সময় তারা ১৩ দফা দাবি দিয়ে দাবি আদায়ের জন্য কারখানার ম্যানেজার ও মালিকদের সঙ্গে একটি পক্ষ বৈঠকে বসেন। কারখানার বাইরের সড়ক দিয়ে দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিকে যাওয়া চেষ্টা করা হলে শ্রমিকরা বাধা দেন। খবর নিয়ে জানা গেছে, বৈঠকের দাবি না মানায় বিকেলে শ্রমিকরা ওই কারখানা ভাঙচুর করেন। 

এর আগের দিন শনিবার জেএমএস ও মেরিমো কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষে ৬০ জন শ্রমিক আহত হন। খবর পেয়ে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, সিএমপি ও শিল্প-পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। চীন-বাংলাদেশ যৌথ বিনিয়োগে পরিচালিত জেএমএস কারখানায় শ্রমিক আছে আড়াই হাজার। কোরিয়ান মালিকানাধীন মেরিমো কারখানায় শ্রমিক আছে ৪ হাজার ২০০। এ ঘটনায় মালিক কর্তৃপক্ষ তিনটি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হন। 

সিইপিজেডের আরও আগে প্যাসিফিক জিন্সের কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলনে যান দুপুরের ভাতের জন্য। এশিয়া গ্রুপের পরিচালনাধীন সিস টেক্সের দুপুরের খাবারের মান ভালো না সেই জন্য শ্রমিকরা আন্দোলন করেছে। কোরিয়ান একটি কারখানায় বহিরাগত পুরুষ শ্রমিকরা আন্দোলন ও ভাঙচুর চালান চাকরির জন্য। এভাবে চট্টগ্রামের পোশাক কারখানায় আন্দোলন সংগ্রাম ও ভাঙচুর লেগেই আছে। 

জানা যায়, ঢাকার গাজীপুর, আশুলিয়া ও নারায়ণগঞ্জের মতো চট্টগ্রামেও পোশাক শ্রমিকদের আবদার দিন দিন বাড়ছে। চট্টগ্রামের বড় শিল্প গ্রুপের কারখানাও শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতে না পারে কারখানা বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। সেখানে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে আন্দোলন ও কর্মবিরতি দুঃখজনক বলে দাবি করেছেন মালিক কর্তৃপক্ষ। 

চট্টগ্রামের ৬০৬টি গার্মেন্ট কারখানা রয়েছে। জুলাই-আগস্ট ছাত্র আন্দোলন ও দেশে বন্যার কারণে ১২ দিন বন্ধ ছিল। এতে এ খাতের ব্যবসায়ীরা ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়ে। এখন গার্মেন্ট মালিকরা শ্রমিকদের বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছেন।

চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) নির্বাহী পরিচালক মো. আবদুস সোবহান খবরের কাগজকে বলেন, ‘তুচ্ছ ঘটনায় মারামারিতে জড়িয়ে যাচ্ছেন শ্রমিকরা। কাল্পনিক দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনে নামছে। দেশের মধ্যে খুবেই নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে চলে ইপিডেজের বা বেপজার কারখানাগুলো। সেখানে শ্রমিকরা বারবার কাজ বন্ধ করে আন্দোলনে নামছে। কারখানা ভাঙচুর করছে, এটা খুবই দুঃখজনক। এখানে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন আছে বলে মনে হচ্ছে। এগুলো করে কেউ লাভবান হবে না, বরং দেশের জন্য ক্ষতি হবে। তাই আমি শ্রমিকদের শান্ত থাকার জন্য অনুরোধ করব। বেশি গরম পড়ছে এমন অজুহাতে গরমের জন্য ভাতা ‘হিট অ্যালাউন্স’ চায় শ্রমিকরা। এগুলো অবান্তর দাবি, দেশের কোথাও নেই, বিদেশে আছে কি না সন্দেহ।’ 

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক নেতা ও চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক এস এম আবু তৈয়ব খবরের কাগজকে বলেন, ‘চট্টগ্রামের গার্মেন্ট কারখানাগুলো খুব সুন্দরভাবে চলছিল। শ্রমিকরা মাস শেষে ঠিক সময়ে বেতন-ভাতা পেলে খুশি থাকে। তবে কোনো কোনো কারখানায় মালিক শ্রমিকদের চাহিদামতো বেতন-ভাতা পরিশোধ করে না। এতে সমস্যা দেখা দেয়। আমি মনে করি, ঢাকার আন্দোলনের কোনো প্রভাব চট্টগ্রামে নেই। চট্টগ্রামে যা আন্দোলন হচ্ছে, তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা।’ 

বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বায়ারদের কাছে টাকা আটকে যাচ্ছে। ব্যাংক থেকে টাকা তোলা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে চট্টগ্রামসহ দেশের সব পোশাক কারখানাতেই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপ ও আমেরিকার মতো দেশে সময়মতো পণ্য পাঠানো যায়নি। সব মিলিয়ে নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে পোশাক কারখানাকে। এর মধ্যে শ্রমিক অসন্তোষ তো আছেই।’

বাজারে উত্তাপ, নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের চলাই দায়

প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৫৬ পিএম
আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:১৯ পিএম
বাজারে উত্তাপ, নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের চলাই দায়
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের টাউন হল মার্কেটে বুধবার আপেলের কেজি ৩২০ টাকায় বিক্রি হলেও এক দিন পর শুক্রবার সকাল থেকে বিক্রি হয়েছে ৩৫০ টাকায়। 

রবিবারও (১২ জানুয়ারি) তা একই ছিল।

শুধু আপেল নয়, মিষ্টি, বেকারিতে বিক্রি হওয়া সব খাবারের দামই ১০০ টাকায় গড়ে ১০ থেকে ১২ টাকা বেড়েছে। একইভাবে বেশির ভাগ রেস্তোরাঁয় খাবারের দাম গড়ে ১০ টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে ক্রেতাকে। 

সাধারণ আয়ের মানুষদের বেশির ভাগই বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর আশায় ছিলাম যে দাম কমবে। কিন্তু দাম কমার পরিবর্তে অধ্যাদেশ জারি করে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যা আমাদের জন্য কষ্ট বয়ে আনবে।

মোহাম্মদপুরের টাউন হল বাজারের ফল বিক্রেতা মো. নাঈম খান ক্ষোভ প্রকাশ করে খবরের কাগজকে বলেন, ‘কয়দিন আগে আপেলের কেজি ছিল ৩২০ টাকা। সরকার ভ্যাট বাড়ানোর পর তা এখন ৩৫০ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি। আগে নাশপাতির কেজি ৩০০ টাকায় বিক্রি হলেও আজকে (রবিবার) ৩২০ টাকার বেশি বিক্রি হচ্ছে। বেদানার দামও কেজিতে ১০০ টাকা বেড়ে ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরকার ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানোর কারণেই হঠাৎ করে এভাবে দাম বেড়ে গেছে। দাম বাড়ায় আগের চেয়ে বিক্রি কমেছে। সরকার সাধারণ মানুষকে কষ্টে ফেলেছে। একই সঙ্গে ব্যবসারও ক্ষতি করেছে।’ 

এ সময় জাহিদুর রহমান নামে এক ক্রেতা বলেন, ‘আগে থেকেই বাজারে সবকিছুর দাম চড়া ছিল। হঠাৎ করে এই সরকার যেভাবে ইচ্ছামতো শুল্ক ও ভ্যাট আরোপ করেছে। তাতে সব জিনিসের দাম আরও বেড়ে গেছে। জ্বলন্ত আগুন আরও উসকে দেওয়া হয়েছে।’

জুস, মিষ্টি, বেকারি আইটেম, রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা বাড়তি ভ্যাট ও শুল্ক আরোপের কড়া সমালোচনা করে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর আদেশ সংশোধন করে কমানো না হলে অনেকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। 

আইএমএফের শর্ত পূরণ করতে গিয়ে চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) মাঝপথে বিশেষ অধ্যাদেশ জারি করে প্রায় ১০০ পণ্য ও সেবায় ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এসব পণ্যের মধ্যে ফল, জুস, মিষ্টি, বেকারি ফুড রয়েছে। আবার রেস্তোরাঁর খাবারের দামে ভ্যাট বাড়ানোয় খাবারের দামও বাড়বে। এতে সবার মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আগে বিভিন্ন পণ্যের ওপর ভ্যাট ৫ থেকে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ আরোপ করা ছিল। নতুন করে বাড়িয়ে তা ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। আম, কমলালেবু, লেবুজাতীয় ফল, আঙুর, লেবু, পেঁপে, তরমুজ, আপেল ও নাশপাতি, ফলের রস, সবজির রস, তামাক, বাদাম, ফ্রুট ড্রিংকস, আর্টিফিশিয়াল বা ফ্লেভার ড্রিংকস ও ইলেকট্রোলাইট ড্রিংকস (কার্বোনেটেড ও নন-কার্বোনেটেড), তামাকযুক্ত সিগারেট মানুষকে আকৃষ্ট করে। কিন্তু এসব পণ্যে সম্পূরক শুল্ক ৫ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। 

সার্বিক ব্যাপারে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সাবেক সহসভাপতি ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক হাফেজ হারুন-অর-রশিদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা ভ্যাট দিয়ে ব্যবসা করতে চাই। কিন্তু হঠাৎ করে অর্থবছরের মাঝপথে যেভাবে বাড়তি শুল্ক ও ভ্যাটের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে তা ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। কারণ এমনিতেই তো অধিকাংশ পণ্যের দাম বেশি। কিন্তু মানুষের আয় বাড়েনি। ব্যবসায়ীদেরও বিক্রি বাড়েনি। লোকসান করে আমাদের ব্যবসা করতে হচ্ছে। সরকারের এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হবে। তা না হলে আমাদের অনেকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে।’ 

দামের ব্যাপারে টাউন হল বাজারের আফজাল ফল ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী মো. রাজু খবরের কাগজকে বলেন, ‘ডলারের কারণে আগে থেকে বিভিন্ন ফলের দাম বেশি। আগের মতো কাস্টমার আসে না। তারপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এটা খুবই কষ্টকর। আগে কম দামে বিক্রি করা হলেও এখন নাশপাতি, আপেল, আঙুর, বেদানার কেজিতে ২০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। শুধু এই বাজারেই নয়, কারওয়ান বাজার, হাতিরপুলসহ বিভিন্ন বাজারের খুচরা ফল বিক্রেতারা বলছেন, সরকার হঠাৎ করে এসব পণ্যের দাম বাড়ানোয় বাজারে খারাপ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। অনেকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ লোকসান করে ব্যবসা করা যাবে না।

জুসের ওপরও বাড়তি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। সম্পূরক শুল্ক ৫ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। মানুষকে গরমকালে তো বটে, শীত মৌসুমেও জুস একটু স্বস্তি ও তৃপ্তি দেয়। গতকাল টাউন হল বাজারের সিঙ্গাপুর জুসের বিক্রয়কর্মী রুহুল আমিন বলেন, ‘শুনেছি সরকার ফলের ওপর শুল্ক বেশি বসিয়েছে। এ জন্য ফলের দামও বেড়ে গেছে। কিন্তু জুসেও শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। তবে দাম বাড়ানো হয়নি। লোকসান করে আগের মতোই আমের জুস ১২০ টাকা গ্লাস, মাল্টার জুস ১৫০ টাকা গ্লাস বিক্রি করা হচ্ছে। এভাবে লোকসান করে ব্যবসা করা যাবে না। মালিক হয়তো রাতেই দাম বাড়াতে পারে। তখন আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হবে।’ ধানমন্ডির প্রধান সড়কসহ বিভিন্ন বাজারের জুস বিক্রেতারাও বলেন, ফলে ও জুসে শুল্ক বাড়তি আরোপ করা হয়েছে। এ জন্য দাম বেড়ে গেছে। 

মিষ্টান্ন ভান্ডার, তৈরি পোশাকের শোরুম বা বিপণিবিতানে পণ্য ও সেবা বিক্রিতে থাকা বিদ্যমান ভ্যাট বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতদিন তা সাড়ে ৭ শতাংশ ছিল। ফলে বাজারে মিষ্টির দাম বাড়তির দিকে। এ ব্যাপারে কলাবাগানের মুসলিম সুইটসের ম্যানেজার নন্দন ঘোষ বলেন, ‘শুনেছি সরকার হুট করে বছরের মাঝপথে ভ্যাট বাড়িয়েছে। এটা ঠিক করেনি। কারণ এমনিই সবকিছুর দাম বাড়তি। ক্ষীর, স্পেশাল চমচম ৫০০ টাকা কেজি, কালোজাম ও রসগোল্লা ৩০০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে।’ টাউন হল বাজার, মিরপুর, মালিবাগসহ বিভিন্ন বাজারের মিষ্টান্ন ভান্ডারের বিক্রয়কর্মীরা বলেন, এভাবে দাম বাড়ানোর ফলে বিক্রি কমে যাবে। কারণ সব জিনিসের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। 

মানুষ কর্মব্যস্ততার কারণে বাসাবাড়ির বাইরে যান। প্রয়োজন হলে রেস্তোরাঁ বা হোটেলে খাবার খেয়ে নেন। কিন্তু এই খাতেও ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। এ ব্যাপারে গ্রিন রোডের বৈশাখী বাংলা রেস্তোরাঁর ম্যানেজার গোলাম হোসেন গোলাপ ও টাউন হল বাজারের জান্নাত হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার মো. রিপন বলেন, বিভিন্ন কারণে মানুষ খুব কষ্টে আছেন। তার পরও ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। এতে বিক্রি করে যাবে। ব্যবসা করা কঠিন হয়ে যাবে। তাই প্রত্যাহার করা উচিত। 

বিভিন্ন সুপারশপেও ফল, সবজি থেকে শুরু করে নিত্যপণ্য বিক্রি হয়। গতকাল গ্রিন রোডের স্বপ্ন আউটলেটে ওই এলাকার সাইদুর রহমান নামে এক অবসরপ্রাপ্ত শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘সবকিছুর দাম এমনিতেই বেশি। অন্তর্বর্তী সরকার দাম না কমিয়ে শুল্ক, ভ্যাট বাড়িয়ে বাজারে উত্তাপ ছড়িয়ে দিয়েছে। কোনো মন্তব্য করতে চাই না। কারণ আমাদের কথা কেউ শুনবে না।’

জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলিম আখতার খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকার রাজস্ব বাড়াতে বেশি করে শুল্ক ও ভ্যাট আরোপ করেছে। এটা সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত। বিধিগত বিষয়। এখানে ভোক্তা অধিদপ্তরের বলার কিছু নেই। কিন্তু কেউ যদি তারচেয়ে অতিরিক্ত দাম আদায় করে সেটা অনৈতিক ব্যাপার। আমরা তা দেখার জন্য বাজার মনিটরিং করি, জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা হয়, জরিমানা করা হয়।’