স্বপ্ন ছিল দুই মেয়েকে কষ্ট করে হলেও পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষ করার। কিন্তু সেই স্বপ্ন এখন ডুবতে বসেছে। পাশাপাশি পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়েও দুশ্চিন্তায় মোশাররফ হোসেন (৪০)। দুই পায়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে এভাবেই নিজের আর পরিবারের ভাগ্য নিয়ে হতাশায় ভুগছেন তিনি।
রাজধানীর জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছেন মোশাররফ হোসেন। সেখানে দেখা যায়, পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে বেডে শুয়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। দুই পায়ে গুলি লাগলেও তার ডান পায়ের অবস্থা বেশি খারাপ। চিকিৎসকরা সর্বশেষ ড্রেসিং করে ক্ষত স্থানে সেলাই করেছেন।
তিনি বলেন, ‘এখন আমার কোনো আয় নেই। বাবা মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে যা পান তা দিয়েই কোনোমতে সংসার চলছে। আমার পায়ের সঙ্গে যেন পুরো পরিবারও পঙ্গু হয়ে গেছে। সাতজন মানুষের সংসার কীভাবে চলবে? ঢাকা মেডিকেলে আসার আগে জমানো প্রায় এক লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। সরকার এক লাখ টাকা দিয়েছে, তাতে কিছুই হয়নি।’
মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমি চাই আমার পা ঠিক হোক। আমি যেন কাজ করে খেতে পারি। ১ লাখ, না ৫ লাখ টাকা দিলেও আমার তো চলবে না। আমার চাওয়া হলো, পা যাতে ঠিক হয়ে যায়। আমি যেন নিজে পরিশ্রম করে খেতে পারি। মেয়ে দুটিকে মানুষ করতে পারি। পুরো পরিবার নিয়ে যেন খেয়ে-পরে বাঁচতে পারি।’
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরে রাস্তায় মানুষের ঢল নামে। এ সময় বিজয় মিছিল বের করা হয়। মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসীরা। তারা নানাদিক থেকে মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের ওপর হামলা চালায়। মোশাররফও সেদিন বিজয় মিছিলে অংশ নিয়ে মাওনা চৌরাস্তার সামনে গেলে গুলিতে আহত হন।
মোশাররফ হোসেনের বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুরের শালীহর গ্রামে। তার বাবা মো. নাজিমউদ্দিন (৬৫) এবং মা নূরজাহান বেগম (৫৫)। সংসারে দুই মেয়ে ও স্ত্রী ছাড়াও রয়েছেন বাবা-মা ও এক বিধবা বোন। মোশাররফের বড় মেয়ে শারমিন আক্তার মিম (৮) মাওনায় একটি মাদরাসায় পড়ছিল। বাবা আহত হওয়ার পর যাতে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে না যায় সে জন্য তাকে গ্রামের স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। ছোট মেয়ে জিনিয়া আক্তার মিমের বয়স আড়াই বছর। পোশাককর্মী মোশাররফের আয়ের ওপরই চলত সাতজনের ভরণপোষণ।
শুরু থেকেই মোশাররফ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। সেদিনের ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সেদিন ছিল ৫ আগস্ট। আমি মাওনা চৌরাস্তার সামনে বিজয় মিছিলে ছিলাম। সৌখিন ও এনা পরিবহনের দুটির বাস ঢাকার দিকে যাচ্ছিল। পরে বাস দুটির গতিরোধ করে ছাত্র-জনতা। এ সময় বাসে থাকা অস্ত্রধারীরা গুলি চালানো শুরু করে। তাদের ছোড়া গুলি এসে আমার পায়ে লাগে বিকেল ৪টার দিকে। তার আগেই দুপুরে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গুলি লাগার পর ছাত্র ভাইয়েরা ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। ঢাকায় ঢোকার তখন সুযোগ ছিল না। শেখ হাসিনা যাওয়ার পরও ছাত্রলীগ তাণ্ডব চালাচ্ছিল। ময়মনসিংহ হাসপাতালে ঢোকার ১০ মিনিট পরই শুনতে পাই, গেটে ছাত্রলীগ ঝামেলা করেছে। কোনো লাশও ঢুকতে দিচ্ছে না। হাসপাতালে ঢোকার পর চোখের সামনেই একটা ছেলের মৃত্যু হয়। আধা ঘণ্টা পর দেখি আরও লাশ আসছে। জানতে পারি ছাত্রলীগ আন্দোলনকারী কাউকে পেলেই কুপিয়ে হত্যা করছে। আমার প্রচুর রক্ত বের হচ্ছিল, পাশাপাশি চলছিল স্যালাইন। পরে চিকিৎসকরা ড্রেসিং করে সেলাই করে দেন।’
মোশাররফ বলেন, ‘১৩ আগস্ট ময়মনসিংহ থেকে ঢাকার শেরেবাংলা নগরে ভাসকুলার ডিজিজ হাসপাতালে আমাকে রেফার করা হয়। গত ১৯ আগস্ট সেখান থেকে আবার পাঠানো করা হয় ঢামেকে। সেই থেকে আমি এখনো ঢামেকে চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে দুবার অপারেশন হয়েছে। রক্তনালি জোড়া দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুই দিন পর আবার ছুটে যায়। ভেতরে ইনফেকশনও হয়ে যায়। ডাক্তার জানিয়েছেন ড্রেসিং করে রাখতে হবে। শুনেছি চিকিৎসার জন্য আমাকে বিদেশ পাঠানোর সুপারিশ করা হয়েছে। আমি সুস্থ হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারি সবার কাছে এই দোয়া চাই।’
ঢামেকের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন বলেন, ‘মোশাররফের ডান পায়ের ঊরুতে গুলি লেগেছে। এতে পায়ের প্রধান রক্তনালি ছিঁড়ে গেছে। আমাদের এখানে তাকে কৃত্রিম রক্তনালি দিয়ে গ্রাফ করা হয়। গ্রাফ করে প্রাইমারি কাজ চালু করা হয়। পরবর্তী পর্যায়ে এই গ্রাফটা টেকেনি। রক্তনালি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটা কমিটি গঠন করা হয়। তারা তার বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দিয়েছে। এই রোগীর বিষয়ে অমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছি।’
সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশে পাঠানোর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে মোশাররফ বলেন, ‘আমার পাসপোর্ট তৈরির জন্য সব কাগজপত্র নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমার এনআইডিতে একটু সমস্যা আছে, তাই পাসপোর্ট হচ্ছে না। তারা চেষ্টা করছে বলে জানিয়েছে।’
সূত্র: বাসস