কক্সবাজারে দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলীর আইকনিক রেলওয়ে স্টেশনটি পঞ্চম তলা নির্মাণ করা হলেও পরিকল্পনায় গলদ রয়ে গেছে। দ্বিতীয় তলা থেকে একে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের কোনো পরিকল্পনা করা হয়নি। এ ছাড়া প্রতিবেশী দেশ মায়ানমারের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা না করেই রামু থেকে সীমান্তবর্তী ঘুমধুম পর্যন্ত প্রায় ২৯ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এখন শেষ পর্যায়ে সংশোধন করে বাদ দেওয়া হয়েছে এই অংশকে। এই হচ্ছে ‘দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ও রামু-ঘুমধুম রেলপথ নির্মাণ’ মেগা প্রকল্পের বাস্তব চিত্র।
প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। তার পরও ১৭টি অডিট আপত্তি অনিষ্পন্ন রয়েছে। বিভিন্ন স্টেশনের নির্মাণকাজ এখনো সম্পন্ন হয়নি। এসব স্টেশন ও সার্ভিস এরিয়া ভবনে নিম্নমানের টাইলস, কাঠ, গ্রিল, কমোড, বেসিন ব্যবহার করা হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদন সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
পরিকল্পনা ও রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, অন্য ফাস্টট্র্যাক প্রকল্পের মতো দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ও রামু-ঘুমধুম রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের কাজও দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। চতুর্থ বার সংশোধনের মাধ্যমে গত ৩০ জুন প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্য ধরা হলেও শেষ হয়নি। এ প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ডুয়েল গেজ সিঙ্গেল লাইন রেলপথ তৈরি হয়েছে। পরিকল্পনায় আরও ২৯ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করে রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত প্রসারিত করার কথা ছিল। কিন্তু মায়ানমারের সঙ্গে কোনো ধরনের এমওইউ করা হয়নি। নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে এই অংশের কাজ বাতিল করা হয়েছে।
আইএমইডির সচিব মো. আবুল কাশেম মহিউদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা প্রকল্প পরিদর্শন করার সময় সবকিছু তুলে ধরার চেষ্টা করি। এটা আমাদের কাজ। সতর্কতার সঙ্গে টাকা খরচ না করলে প্রকল্পে কিছু ত্রুটি থেকে যায়। এই প্রকল্পে তেমন কোনো ত্রুটি ধরা পড়েনি। তবে অনেক অডিট আপত্তি ধরা পড়েছে। প্রতিবেদনে তা আছে। রেলপথ মন্ত্রণালয় এসবের জবাব দেবে। লক্ষ্য থাকবে যাতে নিয়মের ব্যত্যয় না ঘটে।’
পরিদর্শনকারী (আইএমইডির) পরিচালক ও উপসচিব মো. মুমিতুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘দৃষ্টিনন্দন কক্সবাজার আইকনিক রেলওয়ে স্টেশন পঞ্চম তলা নির্মাণ করা হলেও পরিকল্পনায় গলদ রয়ে গেছে। কারণ দ্বিতীয় তলা থেকে একে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের কোনো পরিকল্পনা করা হয়নি। তাই ট্রেন চলাচল করলেও এই স্টেশনের ওপরের ফ্লোরগুলো খালি পড়ে আছে। এতে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, প্রতিবেশী দেশ মায়ানমারের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা না করেই রামু থেকে সীমান্তবর্তী ঘুমধুম পর্যন্ত প্রায় ২৯ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এখন শেষ পর্যায়ে এই অংশকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘যখন এই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল, তখনই প্রশ্ন উঠেছিল। কারণ সেখানে কোনো ব্যবসার উৎস ছিল না। তার পরও ঘুমধুম পর্যন্ত বাড়িয়ে বেশি টাকা খরচ করা হয়েছে। আমরা অর্থনীতির শ্বেতপত্রে এ ধরনের অর্থ তছরুপের কথা বলেছি। পাঁচতলা কক্সবাজার রেলস্টেশনটি কর্ণফুলী টানেলে বিলাসী হোটেলের মতো অবস্থা। রেলওয়ের কর্মকর্তারা বিলাসী ভ্রমণের জন্যই এটা করেছেন। এ ধরনের অপরিকল্পিত পরিকল্পনায় যারা জড়িত তাদের ধরা দরকার। কারণ জনগণের করের টাকা ও ঋণ করে এই প্রকল্প করা হয়েছে।’
প্রকল্প পরিচালক সুবক্তগীন বলেন, ‘গত ৩০ জুন প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু টুকটাক কিছু কাজ বাকি আছে। বড় কোনো কাজ বাকি নেই। নভেম্বর পর্যন্ত বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৯৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ। যে কাজ বাকি আছে, তা ডিফেক্ট ওয়ারেন্টি পিরিয়ডের মধ্যে শেষ হবে। এ জন্য এক বছর সময় বাড়ানো হয়েছে।’
দেশের অন্যতম পর্যটন শহর কক্সবাজারকে রেললাইনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার জন্য সাবেক সরকার উদ্যোগ নেয়। এরই অংশ হিসেবে ২০১০ সালের ৬ জুলাই দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ও রামু-ঘুমধুম রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটির অনুমোদন দেয় তৎকালীন সরকার। খরচ ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি কোষাগার থেকে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৩৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা এবং বিদেশি ঋণ হিসেবে ধরা হয়েছিল ৮১৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময় বেঁধে দেওয়া হয় ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
পরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ডুয়েল গেজ লাইন করার জন্য প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়। ২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ও রামু-ঘুমধুম রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা উন্নয়ন সহযোগী এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণ হিসেবে ধরা হয়। বাকি ৪ হাজার ৯১৯ কোটি টাকা সরকারি তহবিল থেকে ব্যয় করার সিদ্ধান্ত হয়। বাস্তবায়নকাল ধরা হয় ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত।
প্রকল্পের প্রধান কাজ ধরা হয় চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ডুয়েল গেজ সিঙ্গেল লাইন রেলপথ নির্মাণ। এ জন্য ৩৯টি মেজর ব্রিজ, ২৩০টি মাইনর ব্রিজ বা কালভার্ট নির্মাণ, হাতি চলাচলের জন্য আন্ডারপাস ও ওভারপাস নির্মাণ এবং দোহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, কক্সবাজারের চকরিয়ার হারবাং, ডুলাহাজারা, ঈদগাঁও উপজেলার ইসলামাবাদ, রামু উপজেলাসহ ৯টি স্থানে নতুন করে স্টেশন নির্মাণ এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। ১ হাজার ৩৯১ একর জমি অধিগ্রহণের কথাও উল্লেখ করা হয় প্রকল্পে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্য ফাস্টট্র্যাক প্রকল্পের মতো এটিকেও এর আওতাভুক্ত করেন এবং গভীরভাবে মনিটর করার নির্দেশ দেন। তার পরও ঠিকমতো কাজে গতি আসেনি। ২০২২ সালের ৬ জুন চতুর্থবারের মতো সংশোধন করে ২০২৪ সালের জুনে শেষ করার জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়। বিভিন্ন প্যাকেজে ভাগ করে ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। এরই মধ্যে প্রথম ধাপে দোহাজারী-কক্সবাজারের ১০০ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
গত ১১ ও ১২ অক্টোবর প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করার পর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রকল্পটি আসলে ৩০ জুনে শেষ হবে কি না তা দেখার জন্য আইএমইডির মহাপরিচালক গত ১৭ মে পর্যবেক্ষণ (মনিটরিং) করেন। তিনি অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করাসহ সার্বিক দিক পরিদর্শন করে এক বছর সময় অর্থাৎ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বাড়ানোর সুপারিশ করেন। সেটা আমলে নিয়ে পরিকল্পনা কমিশন গত ২৯ সেপ্টেম্বর এক বছর সময় বাড়ানোর সুপারিশ করে। ফলে প্রকল্পের মেয়াদ বেড়ে দাঁড়াল ১২ বছর। তবে বাতিল করা হয়েছে রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৯ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের কাজ। এতে ৩৫০ একর ভূমি অধিগ্রহণ এবং উখিয়া ও ঘুমধুম স্টেশন নির্মাণ, হাতি চলাচলের জন্য আন্ডারপাস-ওভারপাসসহ অন্যান্য কাজও বাতিল করা হয়েছে। এসব কাজের জন্য ৬ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকার বরাদ্দও বাদ গেছে। এসব বাদ দিয়ে প্রকল্পের মোট খরচ ধরা হয়েছে ১১ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঋণ হিসেবে ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা এবং সরকারি খরচ ধরা হয়েছে ২ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, লট-১-এর আওতায় নতুন করে বৃক্ষরোপণসহ আগে যেসব বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে সেসবের সুষ্ঠুভাবে পরিচর্যা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল যোগাযোগকে লাভজনক করতে চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত রেললাইনকে ব্রডগেজে রূপান্তরের উদ্যোগ নিতে হবে। এ ছাড়া আইকনিক রেলস্টেশনসহ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নির্মিত স্থাপনা প্রতিদিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দ্বিতীয় তলা থেকে একে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের কোনো পরিকল্পনা করা হয়নি।