অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশি নাগরিকদের খোঁজে মাঠে নেমেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এনবিআরের দুই গোয়েন্দা শাখা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি) এবং ভ্যাট গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে একাধিক টাস্কফোর্স কমিটি। চলতি মাসের শুরু থেকে এসব কমিটি বিনা নোটিশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হাজির হয়ে দেখছে ঠিক কতজন বিদেশি নাগরিক কাজ করছেন, তাদের তথ্য সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে জানানো হয়েছে কি না, কী পরিমাণ বেতন দেওয়া হয়, বেতনের অর্থ কীভাবে পরিশোধ করা হয়, তা থেকে সঠিক হিসাবে কর পরিশোধ করা হয়েছে কি না।
এনবিআরের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিকদের কাজের বিষয়ে এনবিআর আন্তরিক। তবে তা অবশ্যই বৈধভাবে করতে হবে। অবৈধভাবে কাজ করলে তা মেনে নেওয়া হবে না। অবৈধভাবে কাজ করায় সরকারের অনেক টাকার রাজস্ব ক্ষতি ও অর্থ পাচার হচ্ছে। অবৈধভাবে কর্মরতদের খুঁজে বের করা হবে।’
অভিযান নিয়ে তৈরি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সারা দেশেই এ অভিযান চালানো হবে। রাজধানী ও চট্টগ্রামে প্রথম ধাপে অভিযানে নেমেছে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গোয়েন্দা শাখার সংশ্লিষ্টরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হাজির হচ্ছেন। প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের কাগজপত্র ও কম্পিউটারের তথ্য দেখে এবং সরেজমিন প্রতিষ্ঠান ঘুরে বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা ও অন্যান্য তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হচ্ছেন।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানের মালিকের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে বিদেশি নাগরিকরা তথ্য গোপন করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে বিদেশি নাগরিকদের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের মালিককেও অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। অনেক বিদেশি নাগরিককে দেশে ব্যাংকের মাধ্যমে মূল বেতনের অল্প কিছু দিয়ে বাকিটা বিদেশে লেনদেন করা হয়। অনেকের বেতনের বেশির ভাগ আবার হুন্ডিতে পাঠানো হয়। এভাবে অর্থ পাচার করা হয় ও কর ফাঁকি দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্রে বিদেশি নাগরিকের তথ্য থাকলেও তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে গোপন করা হচ্ছে। হিসাবপত্র জব্দ করে তা খতিয়ে দেখে প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত সপ্তাহে গুলশান এলাকার একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানে গোয়েন্দা শাখার কর্মকর্তারা উপস্থিত হয়ে তথ্য-প্রমাণ খতিয়ে দেখে নিশ্চিত হয়েছেন যে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুজন বিদেশি নাগরিককে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার কথা জানানো হলেও এখানে কাজ করছেন পাঁচজন। প্রতি মাসে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা হিসেবে দুজনকে, ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা হিসেবে দুজনকে এবং একজনকে ৫ লাখ টাকা বেতন দেওয়া হয়। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে জানানো হয়েছে দুজন বিদেশি কাজ করেন। প্রতিজনের বেতন ৮০ হাজার টাকা করে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এক করবর্ষে বিদেশি নাগরিক খাতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ৯৭ হাজার টাকার কর ফাঁকি দিয়েছে। চট্টগ্রামের তৈরি পোশাকশিল্পের একটি কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, বিশেষজ্ঞ হিসেবে গত জানুয়ারি থেকে চারজন বিদেশি ব্যক্তি কাজ করলেও তাদের বিষয়ে সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানকে জানানো হয়নি। এসব ব্যক্তির বেতন-ভাতা হিসেবে নগদ লেনদেনের মাধ্যমে মোট ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা দেওয়া হয়।
১ থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত এনবিআর পরিচালিত অভিযানে ১১৯টির বেশি প্রতিষ্ঠানে ৮৭ জন বিদেশি নাগরিকের খোঁজ পাওয়া গেছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে কর্মরত অনেক বিদেশি নাগরিকের ওয়ার্ক পারমিট নেই। তারা সঠিক বেতনের তথ্য গোপন করেন।
সরকারি হিসাবে এ দেশে ৮৫ হাজার ৪৮৬ বিদেশি নাগরিক কাজ করেন, তাদের অর্ধেকই ভারতীয়। ভারতীয়দের সংখ্যা ৩৫ হাজার ৩৮৬ এবং চীনা ১৩ হাজার ২৬৮ জন।
গত কয়েক করবর্ষে এনবিআরে আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন গড়ে প্রায় ১৫ হাজার বিদেশি। এদের বার্ষিক আয় গড়ে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। এতে মোট কর পাওয়া গেছে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা।
এর আগের সরকারের সময় কয়েক দফা দেশের মধ্যে কর্মরত প্রকৃত বিদেশি নাগরিকের তথ্য হালনাগাদ নিয়ে ডেটা ব্যাংক করার উদ্যোগ নিলেও শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি। এবারে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের মধ্যে অবৈধভাবে কর্মরত ও বসবাস করছেন, এমন নাগরিকদের তথ্য হালনাগাদ করতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। সরকারি সিদ্ধান্ত হলো, বিদেশিদের বাংলাদেশে নিয়ম মেনে বসবাস করতে হবে।
এর আগে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ‘বাংলাদেশে বিদেশিদের কর্মসংস্থান’ শীর্ষক গবেষণায় পাওয়া তথ্যানুসারে, অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করা বিদেশি কর্মীদের উপার্জিত ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা এক বছরে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এতে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি ন্যূনতম ১২ হাজার কোটি টাকা।
গবেষণায় বৈধ বিদেশি কর্মী প্রায় ৯০ হাজার এবং অবৈধ বিদেশি কর্মী কমপক্ষে ১ লাখ ৪০ হাজার পাওয়া গেছে।
গবেষণায় বিদেশি কর্মীর প্রতিজনের ন্যূনতম গড় মাসিক বেতন দেড় হাজার মার্কিন ডলার ধরে মোট বার্ষিক আয় ৪৫০ কোটি ডলার হিসাব পাওয়া গেছে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিদেশি কর্মী এবং তাদের নিয়োগদানকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে অবৈধভাবে কাজ করানো হচ্ছে। এভাবে অর্থ পাচার ও কর ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে।
এনবিআরের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রায় ৪৪টি দেশ থেকে আসা বিদেশিরা বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে কর্মরত। সবচেয়ে বেশি ভারতের, এরপর চীন, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, তুরস্ক, নরওয়ে ও নাইজেরিয়ার নাগরিক। অন্যদিকে পর্যটক ভিসায় কাজ করা নিষিদ্ধ হলেও এই ভিসায় বিদেশিরা অবৈধভাবে দেশের বিভিন্ন খাতে কাজ করছেন।
পর্যটন করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, বছরে গড়ে ৮ থেকে ১০ লাখ পর্যটক ভিসা নিয়েছেন। এসব ভিসা নিয়ে সর্বোচ্চ মেয়াদ তিন মাস পর ফেরত যাওয়ার কথা থাকলেও বছরে গড়ে ১ লাখ ৬০ হাজার বিদেশি পর্যটক দেশের মধ্যে অবৈধভাবে কাজ করছেন। ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের হিসাবে কর্মোপযোগী বিদেশি ভিসার সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। আর বিডা, বেপজা ও এনজিও ব্যুরো- তিন সংস্থার কর্মানুমতির দেওয়া বিদেশির সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার।