খুলনা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি করপোরেশনের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর জেড এ মাহমুদ ডন। শহরের দোলখোলা মোড়-বানিয়াখামার-ইসলামপুর-রায়পাড়া এলাকায় তার কথাই শেষ কথা!
অপরাধজগতের কথিত গডফাদার ডনের সব অপকর্মের দোসর ছিল দোলখোলা এলাকার দুই ভাই দেলোয়ার হোসেন দেলো ও মোজাহার হোসেন মোজো। একাধিক সন্ত্রাসী বাহিনী ও কিশোর গ্যাং রয়েছে দুই ভাইয়ের নিয়ন্ত্রণে। এসব সন্ত্রাসীর কাছে রয়েছে অবৈধ অস্ত্র। বিগত ওয়ান ইলেভেনের সময় সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ীরা আত্মগোপনে চলে গেলে দেলো-মোজোর নেতৃত্বে চলত মাদক ব্যবসা। ডনের সব অপকর্মের দোসর হিসেবে ‘ছায়া শাসক’ হয়ে ওঠেন তারা।
খুলনার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময় দুই ভাই ভাঙারির ব্যবসা করতেন। কখনো বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ভারতীয় শাড়ি বিক্রি করেছেন। তাদের বাবা আবুল হাসেম নৈশপ্রহরী ছিলেন ও বোনেরা পরের বাড়িতে কাজ করতেন। ডনের সঙ্গে সখ্য গড়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন দুই ভাই। এর পরই মাদক ব্যবসা, সন্ত্রাসীদের সিন্ডিকেট গড়ে তোলা, ভূমি দখল, মাছ ফ্যাক্টরি দখল, বিভিন্ন খাতে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। এর মাধ্যমেই গড়ে তোলেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সঙ্গে ডন শাসনের অবসান হয়। ওই দিন খুলনার নিরালা আবাসিক এলাকা থেকে ডনকে নিয়ে পালিয়ে যান দেলো। বর্তমানে তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা বাড়িগুলোতে রয়েছে দিনরাত সতর্ক প্রহরা। ক্যাডার বাহিনীর সদস্যরা ধরা না পড়ায় এখনো মানুষ দেলো-মোজোর অপকর্মের বিষয়ে মুখ খুলতে ভয় পান। গত ১২ নভেম্বর এই অপরাধীদের গ্রেপ্তারের জন্য পূর্ব বানিয়াখামারে একটি বাড়িতে অভিযান চালায় যৌথ বাহিনী। কিন্তু সেখানে তাদের পাওয়া যায়নি।
মেট্রোপলিটন পুলিশে প্রায় দুই বছর কর্মরত ছিলেন, এমন একজন কর্মকর্তা বলেন, খুলনার মাদক ব্যবসা, সন্ত্রাসী বাহিনী, জমি দখল, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করত দেলো-মোজো চক্র। আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে নিজ দলের নেতা-কর্মীকেও খুনের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। ২০২২ সালে মহানগর যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান সাগরের মৃত্যুর সঙ্গেও দেলো জড়িত বলে প্রচার আছে। গত ৮ জুলাই ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আলামিনকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় দেলোকে আসামি করা হয়েছে।
এ ছাড়া ৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মিছিলে প্রকাশ্যে শটগান দিয়ে গুলি করেছেন দেলো। নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুবলীগের একজন সিনিয়র নেতা জানান, এলাকায় ভয়ে আতঙ্কে তাদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলত না। দোলখোলা মোড়ে দেলো রাত হলেই বাড়িতে সন্ত্রাসী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ নেতাদের নিয়ে মদের আসর বসাতেন। এই বাড়িটি সন্ত্রাসীদের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। অনেক পুলিশ কর্মকর্তাও এখানে মদ্যপানে বিভোর থাকতেন। ৫ আগস্টের পর বিক্ষুব্ধ লোকজন দেলোর বাড়ি ভাঙচুর করেন। এরপরই বিএনপি নেতাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন সুকৌশলী দেলো।
বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়িসহ অঢেল সম্পত্তি: ডনের মাধ্যমেই দেলোয়ারের পরিচয় হয় শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই সাবেক এমপি শেখ জুয়েল ও শেখ সোহেলের সঙ্গে। তাদের আশীর্বাদে মাছ বিক্রি থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন দেলোয়ার। তার রয়েছে মাছের কোম্পানি, পণ্যবাহী জাহাজ, একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়িসহ অঢেল সম্পত্তি। জানা যায়, খুলনা শহরে দেলোর বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে ১০-১২টি। রায়পাড়া রোডের ইসলামপুর মসজিদের পাশে একটি ৫ তলা, নবারূণ সংসদের কাছে একটি ৬ তলা, রাজ্জাকের গলির মধ্যে একটি ৬ তলা, একটি ৪ তলা, ২টি দোতলা ও ৩টি জমি, রায়পাড়া মেইন রোডের মেট্রো ক্লিনিকের সামনে এক বিঘার ওপরে সিদ্দিক মঞ্জিলের জমি, মুসলমান পাড়া মেইন রোডের খোকা মোল্লা লেনে ৩ কাঠার একটি জমি ও আব্দুল গনি বিদ্যালয় লেনে ৫ কাঠার একটি জমি রয়েছে।
এ ছাড়া ডুমুরিয়া মৌজায় নামে-বেনামে ৪০ থেকে ৫০ বিঘা জমি রয়েছে। যেখানে গড়ে তোলা হয়েছে বাগানবাড়ি। সেখানে মাঝেমধ্যে আয়োজন করা হয় পিকনিকের নামে মাদক সেবন ও জলসা। দেলোর ভাই মোজোর বাড়ি, হ্যানিমেন ফার্মেসি ভবনে দোকান রয়েছে। তাদের ৭-৮টি গাড়ি রয়েছে, যা দিয়ে মাঝেমধ্যে শহরে মহড়া দিত।
দেলো-মোজোর ‘অবিশ্বাস্য’ উত্থান: ১৯৭৪ সালে কাজের সন্ধানে গোপালগঞ্জ থেকে খুলনায় চলে আসেন দেলো-মোজোর বাবা আবুল হাসেম। দিনে রিকশা চালাতেন ও রাতে নৈশপ্রহরীর কাজ করতেন। ছেলেমেয়েসহ ৯ জনের সংসারে অভাব-অনটনের মধ্যে তার দুই বোন পরের বাড়িতে কাজ নেন। একসময় বড়বাজারে কাপড়ের দোকানে সামান্য বেতনে কাজ শুরু করেন দেলো। পরে তিনি ভাঙারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। সেখান থেকে নতুন বাজারে মাছ বিক্রি করতেন। পরবর্তী সময়ে মাছ কোম্পানির গ্রেডারের কাজ পান। গ্রেডার থেকে তিনি সাতক্ষীরা কালীগঞ্জ এলাকায় রোজেলা ফিশের মালিক বনে যান। জানা যায়, ২০১০ সালে চার বন্ধুর যৌথ মালিকানায় মাছ কোম্পানিটি চালু করেন। পরবর্তী সময়ে শেখ পরিবারের দাপটে তিন বন্ধুকে হটিয়ে নিজেই মালিক বনে যান। অভিযোগ রয়েছে, মাছ ব্যবসার অন্তরালে চলত তার মাদকের ব্যবসা। কক্সবাজার থেকে মাছের আড়ালে আসত ইয়াবা। আর সেই ইয়াবা নগরীতে বিক্রি করতেন তার ভাই মোজাহার হোসেন মোজো। এ কাজে তাকে সহযোগিতা করতেন প্রভাবশালী নেতারা। অবৈধ আয়ের একটি অংশ পেতেন প্রশাসন থেকে শুরু করে দলের শীর্ষ নেতারা।
অনুগত ক্যাডার বাহিনী, মূর্তিমান আতঙ্ক: খুলনার একাধিক সন্ত্রাসী বাহিনী ও কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করতেন দেলোয়ার হোসেন দেলো। অল্প সময়ে শেখ বাড়ির ছত্রচ্ছায়ায় তারা হয়ে ওঠেন খুলনায় মূর্তিমান আতঙ্ক। তাদের কাছে মজুত ছিল বিপুল পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র। জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুর পর তাকে খুলনা বসুপাড়ায় মাদ্রাসায় দাফন না দিতে প্রকাশ্যে শটগান ও সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে মাদ্রাসার মূল ফটকে অবস্থান নেন দেলো।
এ ছাড়া ২০২২ সালে মহানগর যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান সাগরের মৃত্যুর সঙ্গেও দেলো জড়িত আছে জানাজানি হলেও ভয়ে সাগরের পরিবার এ ব্যাপারে মুখ খুলতে রাজি হয়নি। তবে সাগরকে ওই রাতে ডনের অফিসে ডেকে এনে দেলোর নেতৃত্বে মারধর করার পর একটি রিকশায় তুলে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন অনেকে। অপরদিকে আরেক যুবলীগ নেতা আমিন শেখ হত্যা মামলার বাদী শেখ মো. জাহাঙ্গীর জানান, ৮ জুলাই রাত ৯টার দিকে সাবেক কাউন্সিলর ডনের নির্দেশে দেলোসহ কয়েকজন পরিকল্পিতভাবে আল আমিনকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করে। তিনি বলেন, আল আমিনের ভাই তৌহিদ থানায় মামলা করতে গেলে ডন তার মুখে পিস্তল ঠেকিয়ে হত্যায় জড়িত নয়, এমন লোকদের নামে মামলা দিতে নির্দেশ দেন। পরবর্তী সময় তারা ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ডন ও তার দোসর দেলোসহ ৯ জনের নাম আসামি হিসেবে এজাহারে যুক্ত করার জন্য আদালতে আবেদন করেন। ৫ আগস্টের পর আত্মগোপনে থাকায় এসব অভিযোগের বিষয়ে দোলোয়ার হোসেন দেলো ও তার ভাই মোজাহার হোসেন মোজোর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।