দেশে মূল্যস্ফীতি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে তিনবেলা পুষ্টিকর খাবার জোটাতেই হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। চিকিৎসা, শিক্ষা, যাতায়াত- সবকিছুতেই খরচ বাড়ছে। এর সঙ্গে ‘বোঝার ওপর শাকের আঁটি’র মতো যোগ হয়েছে বাড়ি ভাড়া। নতুন বছর আসতে না আসতেই ভাড়া বাড়ানোর হিড়িক পড়েছে।
রাজধানীসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, অল্প আয়ের মানুষের ৪-৫ হাজার টাকার আধা-পাকা বাড়িরও ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা। ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার সাধারণ মানের বাসার ভাড়া ১ থেকে ২ হাজার টাকা বাড়ানো হয়েছে। একটু ভালো মানের ২৫ থেকে ৩৫ হাজার টাকার বাড়ির ভাড়া এক ধাক্কায় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়ানোর কথা জানা গেছে।
ফ্ল্যাট ভাড়া, বিক্রি বা লিজের ব্যাপারে অন্যতম সন্ধানদাতা প্রতিষ্ঠান বিপ্রপার্টির তথ্য অনুসারে, ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক, ধানমন্ডি, বনশ্রী ও রামপুরায় বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ১৪ থেকে ২০ শতাংশ। বাড্ডা, মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকায় বেড়েছে ৭ থেকে ৮ শতাংশ।
সাধারণ মানুষের গলা চেপে ধরে এভাবে ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত অমানবিক জানিয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান খবরের কাগজকে বলেন, এ দেশে যারা বাড়ি বানিয়ে ভাড়া দিচ্ছেন তাদের বেশির ভাগই বর্তমান ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ, ব্যবসায়ী। এদের বেশির ভাগই ঘুষ বা অনৈতিক উপায়ে আয় করে একাধিক বাড়ি বানিয়ে ভাড়া তুলছেন। নিজের পকেট ভারী করাই অন্যতম উদ্দেশ্য। ভাড়া বাড়ানোয় ভাড়াটিয়ারা কতটা ভোগান্তিতে পড়ছেন, তা নিয়ে চিন্তা করেন না। এসব বাড়ির মালিক বেশির ভাগ কর ফাঁকি দেন। এদের আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। সাধারণ মানুষ আইনি জটিলতা ও ঝামেলা হবে এমন আশঙ্কায় এসব প্রভাবশালী বাড়িওয়ালার বিরুদ্ধে যান না বললেই চলে।
তিনি বলেন, ‘এর বাইরেও কিছু মানুষ অল্প অল্প করে সঞ্চয় করে বাড়ি বা ফ্ল্যাট বানিয়ে ভাড়া দেন। এদের সংখ্যা অনেক কম। খোঁজ নিয়ে দেখবেন এসব ব্যক্তি সাধারণ ভাড়াটিয়ার ওপর তুলনামূলক কম চাপ দেন।’
মিরপুর-১৩ নম্বরের বিজয় রাকিন সিটিতে ২৪ হাজার টাকার ভাড়া বাসায় স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন চাকারিজীবী রিয়াজ রহমান। ২৫ নভেম্বর তার ফ্ল্যাটের মালিক ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ভাড়া ১০ হাজার টাকা বাড়িয়ে ৩৪ হাজার টাকা করার কথা জানিয়েছেন।
রিয়াজ রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘এই বছরের শুরুতে আমার বেতন ২ হাজার টাকা বেড়ে ৫৫ হাজার টাকা হয়েছে। এই বেতনে খাবার, ডাক্তার-ওষুধ, যাতায়াত, ছেলেমেয়ের পড়াসহ সংসারের খরচ করে ২৪ হাজার টাকার বাসা ভাড়া দিতেই কষ্ট হয়ে যায়। অনেক সময় ধারদেনা করি। এর মধ্যে ১০ হাজার টাকা ভাড়া বাড়ানো অমানবিক।’
রিয়াজ রহমান বলেন, ‘বাড়ির মালিক জানিয়ে দিয়েছেন বাড়তি ভাড়া দিতে না পারলে বাসা ছাড়তে হবে। বিভিন্ন মোবাইল নম্বরের নগদ বা বিকাশে ভাড়া নেন। ভাড়া পরিশোধের কোনো রসিদ দেন না।’
সরেজমিন রাকিন সিটিতে গিয়ে দেখা যায়, একই আকার ও মানের বাসার ভাড়া বিভিন্ন রকম। কোনোটির ২৫ হাজার, কোনোটির ৩৫ হাজার বা ৪০ হাজার টাকাও চাওয়া হচ্ছে। কোনো নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে এ এলাকার বেশির ভাগ ফ্ল্যাটের মালিক ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়িয়ে থাকেন। শুধু এ এলাকা নয়, রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে কোনো ভাড়াটিয়া বাড়তি ভাড়া দিতে সক্ষম না হলে নানা অজুহাতে নামিয়ে দেওয়া হয়। অনেক সময় হুমকি-ধমকি দিয়েও বাসা ছাড়তে বাধ্য করা হয়।
রাজধানীর বাড্ডায় অসুস্থ শাশুড়ি ও এক মেয়ে নিয়ে ১৫ হাজার টাকার ভাড়া বাসায় থাকেন শামসুর নাহার। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘স্বামী মারা গেছেন। আমি রঙের কারখানায় কাজ করি। কারখানা আর মেয়ের স্কুল কাছেই বলে এখানে থাকি। গত বছর ভাড়া বাড়িয়েছে ১ হাজার টাকা। দুই বছর পর ভাড়া বাড়ানোর কথা থাকলেও এই বছর আবারও ১ হাজার টাকা বাড়ানোর কথা বলেছেন। এই এলাকায় বাড়িওয়ালার ছয়তলার দুটি বাড়ি। তার সব ফ্ল্যাটেই গড়ে ১/২ হাজার টাকা করে ভাড়া বাড়িয়েছেন। তার ভাই লোকজন নিয়ে এসে বলে গেছেন, বাড়তি ভাড়া দিতে না পারলে বাসা ছেড়ে দিতে হবে।’
এ খবরে দিশেহারা ভাড়াটিয়ারা। ভাড়া কিছুটা কম বাড়ানোর জন্য অনুরোধ করলেও তা কাজে আসছে না। উল্টো বাড়তি ভাড়া দিতে না পারায় বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিচ্ছেন। এলাকার প্রভাবশালীদের দিয়ে বাসা ছাড়তে চাপ দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বাড়ি ভাড়া সূচকে পাকা, আধা-পাকা এবং কাঁচা ও ঝুপড়ি ঘর- তিন ধরনের বাড়ির ভাড়া বেড়েছে বলে জানানো হয়েছে। কাঁচাঘরের ভাড়া সবচেয়ে বেশি বেড়েছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন খবরের কাগজকে বলেন, ক্রমবর্ধমান বাড়ি ভাড়া নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। চলমান মূল্যস্ফীতির সঙ্গে এটি বাড়তি চাপ তৈরি করছে। এই বাড়তি খরচ কম আয়ের পরিবারগুলোর বোঝা দ্বিগুণ করে দেয়।
খুলনার বাগমারা এলাকায় আধা-পাকা ঘরে ভাড়া থাকেন কাঠমিস্ত্রি সুখেন সাহা। খবরের কাগজকে বলেন, ‘ওপরে টিন, মেঝে পাকা, দুই রুমের ভাড়া ৪ হাজার টাকা। এবার ৮০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। পরিবার নিয়ে এখন খোলা আকাশের নিচে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তিনবেলা খাবার জোগাড় করতেই কষ্ট হয়ে যায়। ভাড়া বাড়ালে কেমনে কী করব!’
বাড়িওয়ালাদের বেশির ভাগই ভাড়া পরিশোধের রসিদ দেন না। অনেকে রসিদ দিলেও তাতে প্রকৃত ভাড়ার চেয়ে কম দেখানো হয়। এখন অনেক বাড়িওয়ালা বিকাশ বা নগদে ভাড়া নিচ্ছেন। ঠিক কত ভাড়া দিচ্ছেন তার প্রমাণ হিসেবে রসিদ না থাকায় অনেক ভাড়াটিয়া আইনের আশ্রয় নিতে পারছেন না।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানজীম আল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, বছরের শুরুতেই বিবেকহীনভাবে ভাড়া বাড়ানোর ঘটনা বেশি ঘটে। অনেক ভাড়াটিয়া আইনি জটিলতায় বাড়িওয়ালার স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেন না। অথচ বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী বাড়িওয়ালা যখন-তখন ভাড়া বাড়াতে পারবেন না। মালিক ও ভাড়াটিয়ার মধ্যে আপসে ভাড়া ঠিক করতে হবে। দুই বছরের আগে বাড়ি ভাড়া বাড়ানো যাবে না।
আইন অনুযায়ী, ‘বাড়িওয়ালা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য অতিরিক্ত আদায়কৃত টাকার দ্বিগুণ পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং পরবর্তী সময়ে প্রতিবার অপরাধের জন্য ওই অতিরিক্ত টাকার তিন গুণ দণ্ডিত হবেন। বাড়িওয়ালা এক মাসের বেশি ভাড়া অগ্রিম হিসেবে নিতে পারবেন না। বাড়ি ভাড়া নিতে গেলে লিখিত চুক্তি করে নিতে হবে। বাড়ির মালিক ভাড়াটিয়াকে ভাড়া গ্রহণের লিখিত রসিদ প্রদানে বাধ্য থাকবেন। চুক্তি অনুযায়ী ভাড়া পরিশোধ করে থাকলে ভাড়াটিয়াকে হঠাৎ করে উচ্ছেদ করা যায় না। ভাড়াটিয়া প্রয়োজন মনে করলে আদালতের আশ্রয় নিতে পারবেন। আইনের ৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, একটি নির্দিষ্ট এলাকায় একজন নিয়ন্ত্রক ও উপনিয়ন্ত্রক থাকবেন। তাদের ভাড়া নির্ধারণের ক্ষমতা দেওয়া আছে।’