ঢাকা ৩ মাঘ ১৪৩১, শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি ২০২৫

লক্ষ্মীপুরে দাবড়ে বেড়াচ্ছে অর্ধশত সন্ত্রাসী বাহিনী

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:১০ পিএম
আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:২৩ পিএম
লক্ষ্মীপুরে দাবড়ে বেড়াচ্ছে অর্ধশত সন্ত্রাসী বাহিনী
লক্ষ্মীপুর

সন্ত্রাসের জনপদখ্যাত লক্ষ্মীপুরে এখনো দাবড়ে বেড়াচ্ছে অর্ধশতাধিক বাহিনীর দুই হাজারের বেশি সন্ত্রাসী। চলছে দখল, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়সহ নানা অপরাধ। এই সন্ত্রাসীদের হাতে রয়েছে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে এরা নির্বিঘ্নে করছে এসব অপরাধ।

এসব বাহিনীর অনেকে বিভিন্ন মামলায় মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ নানা মেয়াদে দণ্ডপ্রাপ্ত ফেরারি আসামি হলেও পুলিশ তাদের গ্রেপ্তারে তেমন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। ফলে সাধারণ মানুষ তাদের হাতে প্রতিনিয়ত নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন এবং তারা কোনো আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সাহস পাচ্ছেন না। কোনো কোনো ভুক্তভোগী থানায় মামলা করতে গেলেও পুলিশ তাদের সহযোগিতা করছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। 

জানা যায়, গত ৫ আগস্ট দেশে সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর থেকে পুলিশ অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধীদের গ্রেপ্তার করার ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে আর এই সুযোগে সন্ত্রাসী বাহিনীগুলো এলাকায় ফিরে এসে বীরদর্পে তাদের অপরাধ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় একসময় শতাধিক সন্ত্রাসী বাহিনী রাজত্ব চালায়। সে সময় অনেকেই সন্ত্রাসী বাহিনীর হাতে হতাহত হন। আবার অনেকেই সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষা পেতে পরিবার-পরিজন নিয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান।

২০০৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কঠোর ভূমিকার কারণে এসব সন্ত্রাসী বাহিনী সাময়িকভাবে দমে ছিল। পুলিশ ও র‌্যাবের অভিযানে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার পূর্বাঞ্চলের কুখ্যাত সন্ত্রাসী জিসান বাহিনীর প্রধান সোলেমান উদ্দিন জিসান, দিদার বাহিনীর প্রধান দিদার, সোলেমান বাহিনীর প্রধান সোলেমান, নাছির বাহিনীর প্রধান নাছির, শামীম বাহিনীর প্রধান শামীম, সেলিম বাহিনীর প্রধান সেলিম, বাবুল বাহিনীর প্রধান আসাদুজ্জামান বাবুল, লাদেন বাহিনীর প্রধান মাসুম বিল্লাহ ওরফে লাদেন মাসুমসহ কয়েকজন বাহিনীপ্রধান নিহত হন। এ ছাড়া এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে নিহত হন মনির বাহিনীর প্রধান মনির, আনোয়ার বাহিনীর প্রধান আনোয়ার, মামুন বাহিনীর প্রধান মামুন, ভুলু বাহিনীর প্রধান ভুলু, গুল কামাল বাহিনীর প্রধান কামাল হোসেন, সাফু বাহিনীর প্রধান সাফু, নোমান বাহিনীর নোমান, আলাউদ্দিন বাহিনীর প্রধান আলাউদ্দিন, রতন বাহিনীর প্রধান রতন, মুন্না বাহিনীর প্রধান মোসলেহ উদ্দিন মুন্নাসহ আরও কয়েকজন বাহিনীপ্রধান নিহত হন। 

এসব বাহিনীর প্রধানরা নিহত হলেও তাদের হাতে থাকা বিপুল পরিমাণ অত্যাধুনিক অস্ত্র উদ্ধার করা হয়নি। পুলিশ প্রশাসনও অস্ত্রগুলো উদ্ধারে তৎপর হয়নি। প্রধানদের মৃত্যুর পর সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর তৎপরতা সাময়িকভাবে থেমে গেলেও পরবর্তী সময়ে অধিকাংশ বাহিনীর নেতৃত্ব দলের অন্য কেউ গ্রহণ করে তৎপরতা শুরু করে। তবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সক্রিয়তার কারণে দিপু বাহিনীর প্রধান মাহমুদুল করিম দিপু, তাজু বাহিনীর প্রধান তাজুল ইসলাম মেম্বার, টাইগার বাহিনীর প্রধান ওমর ফারুক, হিরো বাহিনীর প্রধান হিরো চৌধুরী, আমির বাহিনীর প্রধান হাজি আমির হোসেনসহ কয়েকটি বাহিনীর প্রধান তাদের বাহিনী বিলুপ্ত করে অপরাধ জগৎ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, বর্তমানে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় ৫০টির বেশি সন্ত্রাসী বাহিনী তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যদের কারও কারও মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন মামলা থাকলেও পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। 

জানা যায়, বর্তমানে লক্ষ্মীপুরের পূর্বাঞ্চলের ত্রাস জিসান বাহিনীর নেতৃত্বে রয়েছেন চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নের লতিপুর গ্রামের কাউসার ওরফে ছোট কাউসার। কাউসারকে মামুন বাহিনীর প্রধান মামুন হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন, জামাই ফারুক হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড এবং অন্য একটি মামলায় যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়েছে। হত্যাসহ বিচারাধীন আরও এক ডজনের বেশি মামলা। এ বাহিনীর হাতে রয়েছে বেশ কয়েকটি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর কাউসারের নেতৃত্বে জিসান বাহিনী এলাকায় অপহরণ, চাঁদাবাজি, জমি দখলসহ বিভিন্ন অপরাধ করে যাচ্ছে। 

একই এলাকায় কাজী বাবলু বাহিনী তৎপরতা চালিয়ে গেলেও সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর এ বাহিনীর সদস্যরা অনেকটা গা ঢাকা দিয়ে আছে। এ বাহিনীর হাতে রয়েছে দুই ডজনেরও বেশি আগ্নেয়াস্ত্র। ডাকাত নাছির বাহিনীর আগ্নেয়াস্ত্রগুলো কাজী বাবলুর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। এই এলাকায় আরেক সন্ত্রাসী বাহিনী হলো নিকু বাহিনী। এই বাহিনী এলাকায় ব্যাপক চাঁদাবাজি, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়সহ বিভিন্ন অপরাধকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। নিকু বাহিনীর নিকুর বিরুদ্ধে দুটি হত্যা, অস্ত্রসহ বেশ কয়েকটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। সদর উপজেলার হাজীরপাড়ায় তৎপর রয়েছে নিজাম উদ্দিন মুন্না বাহিনী। এই বাহিনীর প্রধান নিজাম উদ্দিন মুন্না একটি অত্যাধুনিক জি-থ্রি অস্ত্র ও ২০০ রাউন্ড বুলেটসহ পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি জামিনে মুক্তি পেয়ে এলাকায় ফিরে আসেন। গত ৪ আগস্ট লক্ষ্মীপুরে ছাত্র-জনতার সঙ্গে যুবলীগের সংঘর্ষ চলাকালে দুটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে এ বাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র নিয়ে এসে যুবলীগকে সহযোগিতা করে। এই সংঘর্ষে চারজন মেধাবী ছাত্র নিহত হন। 

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বশিকপুর ইউনিয়নে সক্রিয় রয়েছে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী বাহিনী। এর মধ্যে জিহাদি বাহিনী, নোমান বাহিনী, লাদেন বাহিনী এলাকায় বেশ সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে জিহাদি বাহিনীর হাতে নোমান বাহিনীর প্রধান নোমান ও তার সহযোগী রাকিব নিহত হওয়ার পর জিহাদি পালিয়ে যান। এখনো তার বাহিনীর অন্য সদস্যরা এলাকা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে এই বাহিনীর নেতৃত্বে রয়েছেন ফয়সাল দেওয়ান। লাদেন বাহিনীর প্রধান মাসুম বিল্লাহ লাদেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার পর এ বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন বালাইশপুর গ্রামের বারাকাত। আর নোমান বাহিনীর নেতৃত্বে রয়েছেন রাকিব হোসেন প্রকাশ ওরফে ভাগিনা রাকিব। এই এলাকার আরেক বাহিনীর নাম কিরণ বাহিনী। কিরণ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলেও বাহিনীর নেতৃত্বে রয়েছেন নন্দীগ্রামের সাতবাড়ির সিরাজউল্লার ছেলে মুরাদ। দত্তপাড়া ইউনিয়নে রয়েছে বেশ কয়েকটি বাহিনী। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য শামীম বাহিনী। এ বাহিনীর প্রধান শামীম বাবলু বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার পর বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন শ্রীরামপুর গ্রামের মো. কাউসার। এই এলাকায় বর্তমানে নোব্বা বাহিনীর নবীর নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা সক্রিয় রয়েছে। এই এলাকার আজিজ বাহিনী, ইসমাইল বাহিনী, হুমা বাহিনীর সদস্যদের হাতে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র থাকলেও তাদের এখন দৃশ্যমান তৎপরতা নেই।

সদর উপজেলার বাংগাখাঁ ইউনিয়নে রয়েছে মাওলা বাহিনী, লেংলা ফরহাদ বাহিনী, পিচ্চি আনোয়ার বাহিনী, শাহজাহান মেম্বার বাহিনী। গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে শাহজাহানের নেতৃত্বে তার বাহিনীর সদস্যরা ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালায়। এ ঘটনার পর থেকে শাহজাহান ও তার বাহিনীর সদস্যরা এলাকা ছেড়ে গা ঢাকা দিয়েছেন। এই বাহিনীগুলোর কাছে রয়েছে বেশ কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্র।

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার উত্তর জয়পুরে বর্তমানে তৎপর রয়েছে কদু আলমগীর বাহিনী ও জিহাদি বাহিনী। ৫ আগস্টের পর দুই বাহিনীর মধ্যে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। কদু আলমগীর নোমান হত্যা মামলায় দীর্ঘদিন কারাভোগ করার পর এলাকায় এসে আবার ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলছেন। গত মাসের শেষ দিকে কদু আলমগীর তার বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে ইউনিয়নের দক্ষিণ মাগুরী মতার হাটের নূরনবীর মুদি দোকানে গুলি চালিয়ে দোকানের মালামাল ও টাকা-পয়সা লুট করে নিয়ে যান। 

সদর উপজেলার দিঘলি ইউনিয়নে তৎপর রয়েছে আজগর ও সোহেল বাহিনী। মান্দারী ইউনিয়নে রয়েছে তালেব ও রুবেল বাহিনী। চরশাহী ইউনিয়নে বেশ কয়েকটি বাহিনী বিগত সময়ে তৎপর থাকলেও বর্তমানে রিয়াজ বাহিনী, মিঠু-মিল্লাত বাহিনী অপরাধ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। কুশাখালী ইউনিয়নে রয়েছে হেডম জাহাঙ্গীর বাহিনী, ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নে বিপ্লব বাহিনী, রাসেল বাহিনী, চররুহিতায় জহির বাহিনী, আবুল খায়ের বাহিনী, কালা বাচ্চু বাহিনী, চররমনী মোহনে কামরুল সরকার বাহিনী, ইউছুফ ছৈয়াল বাহিনী, মোল্যাহ বাহিনী, আলমগীর মেম্বার বাহিনী, দালাল বাজারে নুরনবী চেয়ারম্যান বাহিনী, দক্ষিণ হামছাদিতে ফরিদ বাহিনী, বাহার বাহিনী এবং লক্ষ্মীপুর পৌরসভা এলাকায় তাহের বাহিনী ও টিপু বাহিনীর তৎপর রয়েছে। 

এদিকে বশিকপুরে কয়েকটি বাহিনীর সমন্বয়ে একটি বাহিনী গড়ে উঠেছে। স্থানীয়দের কাছে এ বাহিনী মিশ্র বাহিনী হিসেবে পরিচিত। এ বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন আলামিন নামের এক সন্ত্রাসী। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এই বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ৫০-এর বেশি। তারা প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বশিকুর মাদ্রাসার পূর্ব পাশে অস্ত্র নিয়ে অবস্থান করে। বিভিন্ন ব্যক্তিকে এখানে ধরে এনে চাঁদা আদায় করে থাকে এবং এখান থেকে তারা ভাড়ায় সন্ত্রাসী কাজ করতে যায়। এই এলাকার পোদ্দার বাজারের পুলিশ ফাঁড়ি সব জেনেও অপরাধ দমনে সক্রিয় হয় না।

স্থানীয়রা জানান, সন্ত্রাসীরা এলাকায় চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি খুন, অপহরণসহ নানা অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সময় ও বিভিন্ন মামলায় বাহিনীর প্রধান ও সদস্যরা গ্রেপ্তার হলেও তাদের কাছ থেকেও অস্ত্রগুলো উদ্ধারের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো তৎপরতা নেই।

লক্ষ্মীপুরের কয়েকজন সচেতন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে খবর কাগজকে জানান, এসব সন্ত্রাসী বাহিনী আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দলীয় শেল্টারে থাকায় তাদের গ্রেপ্তারের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপরতা দেখায় না। দলীয় আশ্রয়ে থাকায় সাধারণ মানুষ তাদের হাতে নির্যাতিত হয়েও মুখ খুলতে সাহস পায় না। 

লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির সদস্যসচিব মো. শাহাবুদ্দিন সাবু খবরের কাগজকে বলেন, বিএনপি কখনো সন্ত্রাসী এবং সন্ত্রাসী বাহিনীকে প্রশ্রয় দেয় না। আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হাতে বিগত ১৭ বছরে বিএনপির শতাধিক নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন। শত শত নেতা-কর্মী আহত ও পঙ্গু হয়েছেন। তিনি অবিলম্বে সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার ও অস্ত্রগুলো উদ্ধারের দাবি জানান।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর লক্ষ্মীপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক নূরনবী ফারুক খবরের কাগজকে বলেন, জামায়াতে ইসলামী কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দেয় না। তাদের দলে কোনো সন্ত্রাসী, অস্ত্রধারী ও খারাপ লোক নেই। তিনি লক্ষ্মীপুরে সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার ও অস্ত্র উদ্ধারের জন্য দাবি জানান। 

লক্ষ্মীপুরের পুলিশ সুপার আখতার হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, সন্ত্রাসী বাহিনীর ব্যাপারে তার কাছে কোনো তথ্য নেই। বিভিন্ন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, এমন তথ্য পুলিশের কাছে নেই। 

তিনি জানান, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত-নিহতদের পরিবারের দায়ের করা মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পুলিশ তৎপর রয়েছে। লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর ও রামগঞ্জ থানার লুণ্ঠিত অস্ত্রের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। বাকি অস্ত্রগুলো উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। 

নৈতিকতা এখন মূল্যহীন

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:২৯ এএম
আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:২৪ পিএম
নৈতিকতা এখন মূল্যহীন
খবরের কাগজ ইনফোগ্রাফিকস

দেশে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা বা গুরুত্ব এখন নেই বললেই চলে। উপরন্তু যারা এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেন তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়। যে গুটিকয়েক মানুষের সৎভাবে চলার আগ্রহ রয়েছে, নৈতিকতাহীন লোকের আধিক্যের কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারাও ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন। বলা হচ্ছে, সমাজে সবচেয়ে বেশি আয় করা ছেলেকে মা-ও বেশি ভালোবাসেন। কিন্তু ওই মা কখনো আয়ের উৎস জানতে চান না। পাশাপাশি শিক্ষিত ও মূল্যবোধসম্পন্ন ছেলেটি অনেক সময়ই সমাজে ‘অযোগ্য’ হিসেবে বিবেচিত হন। একই উদাহরণ স্ত্রী ও ছেলেমেয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তারা বেশি আয় করা স্বামী ও বাবাকেই পছন্দ করেন।

এসব কারণে সমাজে এমন ধারণা বা ‘পারসেপশন’ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন পর্যায়ের লোকজনও নৈতিকতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে পারছেন না। রাজনীতিক থেকে শুরু করে আমলা, পুলিশ, শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, বিচারপতি, এমনকি নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যেও এখন নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা নেই। মধ্যবিত্তের কেউ কেউ আলোচনা করলেও এই বোধকে সমুন্নত রাখা তাদের পক্ষে হয়ে ওঠে না। সব মিলিয়ে সমাজে এমন একটি অবস্থা দাঁড়িয়েছে, মানুষের ভরসা করার আর কোনো জায়গা থাকছে না। পাশাপাশি অনুসরণযোগ্য সৎ, সজ্জন ও নৈতিকতাসম্পন্ন বিশিষ্ট নাগরিকের সংখ্যাও এখন খুব কম। বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে ‘সততা’র কারণে অনেকে নির্ভরযোগ্য হলেও রাজনীতিতে জড়িয়ে তারা আবার সর্বমহলে গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছেন। 

গত বছর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে জনমনে একধরনের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল- ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসায় নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ে সমাজে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে উত্তরণ ঘটবে। মানুষ কিছুটা হলেও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবেন। অন্তত সৎ থাকার তাগিদ তৈরি হবে জনমনে। কিন্তু এ প্রশ্নে কোনো উন্নতি বা দিকনির্দেনা এখনো দৃশ্যমান হয়নি। বরং ক্ষমতার নানামুখী টানাপোড়েন বা দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য হয়েছে। ব্যাপক প্রত্যাশার মধ্যেই বর্তমানে নানা প্রশ্ন সামনে আসছে। উন্নয়ন, সংস্কার, নৈতিকতা ও সততার চর্চায় প্রতিবন্ধক হয়ে উঠছে মূল্যবোধের অবক্ষয়। ফলে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ কি সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে?

গ্রিক শব্দ Ethos থেকে এসেছে নৈতিকতার ইংরেজি শব্দ ‘Ethics’; যা দিয়ে চরিত্র, রীতিনীতি, সংস্কৃতিসহ নানা বিষয় বোঝায়। অন্যভাবে বললে, নৈতিকতা দিয়ে নীতিসম্পর্কিত বোধ বা অনুভূতিকে বোঝানো হয়। যার মাধ্যমে মানুষের আচরণ বা চরিত্র প্রকাশিত হয়। ওয়েবস্টার অভিধানের সংজ্ঞা অনুযায়ী, নৈতিকতা হলো এমন বিষয়, যা জবাবদিহির সঙ্গে ভালো ও মন্দের মাত্রা নির্ণয় করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈতিক উন্নয়ন কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক ড. জসিম উদ্দীন খবরের কাগজকে বলেন, ‘নৈতিকতার অবক্ষয়ের পেছনে অনেকগুলো সেক্টর কাজ করে। একটা সেক্টরকে এটার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। আমার কী দায়িত্ব ছিল, আমি কী করছি। এটা যদি আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করি তাহলে কী উত্তর দেব? আমি কেমন? আমি যেটা করছি সেটা করার অধিকার আছে কি না। এ বিষয় নিয়ে নিজেকে ভাবতে হবে। উদাহরণস্বরূপ আমি শিক্ষক হিসেবে আমার কাজটা ঠিকমতো করছি কি না। আমরা তো নীতি-নৈতিকতার অনেক কিছুই জানি। কিন্তু জানার পরও তো শিক্ষকদের অনেকেই নৈতিকতাবিরোধী কাজ করছেন। আমি কি সমাজের উদ্দেশ্য পূরণ করতে পেরেছি। আমরা অন্যের সমালোচনা করি, কিন্তু নিজেরটা দেখি না।’

তিনি বলেন, নৈতিকতা চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। এটাকে আইন দিয়ে কোনো কিছু করা যাবে না। এটা উপলব্ধির বিষয়। নিজ থেকে অর্জন করতে হবে।

বিতর্কের শীর্ষে রাজনীতিবিদরা

দেশের নীতিনির্ধারক হিসেবে বিবেচিত হন রাজনীতিবিদরা। মহান সংসদে নির্বাচিতদের মতামতের ভিত্তিতেই পাস হয় গুরুত্বপূর্ণ সব আইন। কিন্তু এই রাজনীতিবিদরাই যখন ক্ষমতায় থাকেন, তখন তাদের অধিকাংশেরই সম্পদ বেড়ে যায়। কেউ কেউ বনে যান টাকার কুমির। ফলে তাদের নৈতিকতা, সততা নিয়ে প্রায়ই প্রশ্ন ওঠে। ক্ষমতার মেয়াদ শেষে তাদের অনেকেই আবার দুর্নীতির অভিযোগে আটক হন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ (টিআইবি) পরিচালিত একাধিক জরিপেও বিষয়টি উঠে আসে। সংস্থাটির ২০১৫ সালে করা ‘জাতীয় যুব-সততা জরিপ’-এ অংশগ্রহণকারী ৮৬ শতাংশ মনে করেন রাজনীতিতে সততার অভাব রয়েছে। একই প্রতিষ্ঠানের করা গ্লোবাল করাপশন ব্যারোমিটার-২০১২ অনুযায়ী, বাংলাদেশে সর্বোচ্চ দুর্নীতিপ্রবণ প্রতিষ্ঠান হলো রাজনৈতিক দল (৯৩ শতাংশ অংশগ্রহণকারীর মত)।

অন্যদিকে নির্বাচনি হলফনামা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রার্থীদের প্রথমবার জমা দেওয়া সম্পদের পরিমাণ পরবর্তী নির্বাচনের হলফনামায় শতগুণ বেড়েছে। ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সাবেক ২০ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর সম্পদ নজিরবিহীনভাবে বেড়ে যায়। সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সম্পদ বাড়ে ২ হাজার ১৩১ শতাংশের বেশি। 

বিগত সরকারের রাজনীতিবিদদের বড় ধরনের আর্থিক অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা এখন সামনে আসছে। নামে-বেনামে দেশের টাকা পাচার করেছেন তারা। নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পদ ছাড়তে হয় এক প্রতিমন্ত্রীকে। এ ছাড়া দলে নিজের অবস্থান সুসংহত রাখতে গ্রুপিংয়ের রাজনীতি করার চিত্র অনেকটা ওপেন সিক্রেট। তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চাও কম মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

নিজেদের সুপিরিয়র মনে করেন আমলারা

রাজনৈতিক সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন আমলারা। ফলে নিজেদের সুপিরিয়র বা সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান মনে করা, আমিত্ব-ভাব প্রবলভাবে পেয়ে বসেছে তাদের। সম্প্রতি আন্তক্যাডার বিরোধেও বিষয়টি সামনে এসেছে। সবাই বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সরকারি চাকরিতে যোগদান করলেও প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতিসহ সুযোগ-সুবিধা অন্যদের চেয়ে তুলনামূলক বেশি। বিষয়টি নিয়ে অন্যদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। অন্যদিকে এসব আমলার দুর্নীতির মধ্যে জড়িয়ে পড়ার হার অনেকটা বেড়েছে। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর শীর্ষ পর্যায়ের অনেক আমলাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আগে এ সংখ্যা অনেক কম ছিল।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠছেন অধিকাংশ আমলা। প্রশাসনে সৎ কর্মকর্তাদের উৎসাহ দিতে চালু করা হয় শুদ্ধাচার পুরস্কার। বিস্ময়কর হলেও সত্য, এই শুদ্ধাচার পুরস্কার পাওয়া অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের আরও ব্যাপক অভিযোগ পাওয়া গেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য মতিউর রহমানের ছেলের ছাগলকাণ্ডে অনেকের দুর্নীতির খবর বেরিয়ে আসে। অন্তর্বর্তী সরকারের করা শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনেও বিষয়টি দেখা যায়। তাদের মতে, চোরতন্ত্রের মূল স্তম্ভ হিসেবে কাজ করেছেন আমলারা। 

দুর্নীতির পাশাপাশি দলবাজিতেও আমলারা ছিলেন শীর্ষে। পেশাদার কর্মকর্তা হিসেবে নিরপেক্ষ ভূমিকার পরিবর্তে বিভিন্ন দলের স্বার্থ রক্ষায় তৎপর ছিলেন। ফলে সরকার পরিবর্তনের পর ওএসডি, পদত্যাগে বাধ্যকরণ, বদলির হিড়িক পড়ে যায়। আর এভাবেই আমলাতন্ত্রের নৈতিক অবক্ষয়ের বিষয়টি আজ জনমনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। 

পেশাদারত্ব ভুলে তেলবাজিতে সাংবাদিকরা

ষাট, সত্তর, আশি; এমনকি নব্বইয়ের দশকে বলা হতো যে সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা। কিন্তু সময়ের আবর্তে মহান সেই পেশার নৈতিকতা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ সাংবাদিকদের মধ্যে একটি শ্রেণি পেশাদারত্ব ভুলে এখন তেলবাজি ও চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়েছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে অনেক সম্পাদককে প্রশ্নের বাইরে অপ্রাসঙ্গিকভাবে প্রশংসা করতে দেখা গেছে; যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সমালোচিত হয়। অনেকে এসব প্রশংসাকে ‘তেলবাজি’ বলে অভিহিত করেন। এ ছাড়া অর্থের বিনিময়ে নিউজ করা, নিউজ বন্ধ করা, নানা ধরনের আর্থিক অনিয়মে জড়িত থাকার তথ্য সামনে আসায় পেশাদার সাংবাদিকরাও এখন বিব্রত ও লজ্জিত বোধ করেন। এ ছাড়া অনেকের নামে-বেনামে সম্পদশালী হওয়ার তথ্যও প্রকাশ পেয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নেতৃস্থানীয় সাংবাদিকদের পর্যন্ত আত্মগোপনে যেতে হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, অন্যান্য পেশার মতোই সাংবাদিকতা পেশাও আজ কলুষিত হয়েছে। তাদের সততা ও নৈতিকতা নিয়েও সমাজে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

চিকিৎসকদের প্রশ্নবিদ্ধ কর্মবিরতি
দেশে বিভিন্ন সময় চিকিৎসকদের কর্মবিরতি ঘোষণা দিতে দেখা যায়। পর্যবেক্ষকদের মতে, অনেক ক্ষেত্রে দাবি যৌক্তিক থাকলেও মানুষের জীবন-মরণের সঙ্গে যুক্ত এ মহান পেশাজীবীদের কর্মবিরতি নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরেও চিকিৎসকরা কর্মবিরতির ঘোষণা দেন। এ সময় অনেক রোগীকে ভয়ংকর রকম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। আবার অনেক সময় ভুল চিকিৎসার অভিযোগে রোগীর স্বজনরা চিকিৎসকদের সঙ্গে মারমুখী আচরণ করেন, যা চিকিৎসকদের জন্য আতঙ্কের। অনেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বেশি মুনাফার জন্য রোগীর কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নেয়। অনেক মানবিক চিকিৎসক আছেন যারা গরিব রোগীদের ক্ষেত্রে কম ফি নিয়ে থাকেন বা বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেন। আবার অনেক চিকিৎসক রোগীদের জিম্মি করে টাকা আদায় করেন। এসব ক্ষেত্রে নৈতিকভাবে চিকিৎসকদের আরও শক্তিশালী হওয়া দরকার বলে মনে করেন অনেকেই।

বিচারকরাও বিতর্কের মুখে
মহান পেশার মধ্যে বিচারকদের থাকার কথা মর্যাদার শীর্ষে। কারণ তাদের রায়ের ওপর সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়। কেউ কেউ মহান সৃষ্টিকর্তার পরেই বিচারকদের অবস্থান নির্ণয় করে থাকেন। কিন্তু সেই বিচারকদের নিয়ে সমাজে এখন বিতর্ক তৈরি হয়েছে। একটি দুর্নীতি মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে সাজা দেওয়ার ঘটনা নিয়ে সমাজে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। বলা হচ্ছে, বিচারকরাও বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে পারছেন না। তাদের মধ্যেও নৈতিকতার অভাব দেখা গেছে। আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক সরকার পতনের পর পালাতে গিয়ে সীমান্তে ধরা পড়েন। স্থানীয় জনগণ তাকে অপদস্ত করেন। অথচ তার থাকার কথা ছিল মর্যাদার আসনে। এ ছাড়া দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রায় দেওয়ায় এবং আর্থিক অপরাধে জড়িয়ে পড়ায় অনেককে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। 

পুলিশ সদস্যরাও দুর্নীতিতে
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হিসেবে জনগণের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হওয়ার কথা ছিল পুলিশের। কিন্তু নানা ধরনের অনিয়মের কারণে তাদের অনেকে এখন জনগণের শত্রুতে পরিণত হয়েছেন। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে পুলিশের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। এ কারণে ছাত্র-জনতাকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়। পুলিশের শীর্ষ থেকে নিম্নপর্যায়ের লোকজনের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের অঢেল সম্পদও দেশব্যাপী আলোচনার জন্ম দেয়। তার অবৈধ দখলদারি থেকে বাদ যায়নি সরকারি জমিও। এ ছাড়া ক্ষমতার পটপরিবর্তনে অনেক ঊর্ধ্বতন পুলিশ সদস্যকে দেশ ত্যাগ করতে হয়েছে। এসবের পেছনে নৈতিকতার অধঃপতনকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা।

নীতিহীন ব্যবসায়ীরাই গড়ে তুলছেন সিন্ডিকেট
ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কাছে সবাই জিম্মি। প্রতিনিয়ত জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। যখন যে পণ্যের মৌসুম, সেই পণ্যের দাম পরিকল্পিতভাবে বাড়ানো হচ্ছে। কিছুদিন আগেই বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় বোতলজাত সয়াবিন তেল। কিন্তু দাম বাড়ানোর ঘণ্টাখানেক পর অধিকাংশ দোকানে দেখা যায় শত শত তেলের বোতল। একইভাবে অধিকাংশ নিত্যপণ্যের দাম বাড়াতে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়েছে। ডিম নিয়ে কারসাজিও সিন্ডিকেটের। সরকারের একার পক্ষে এই সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া কঠিন বলে মনে করছেন অনেকে। যদি ব্যবসায়ীরা নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বজায় রাখেন, তাহলে এসব ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বর্তমানে দেশের নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফলে সমাজে একধরনের ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে, যা দেশের সামগ্রিক অগ্রগতিতে বাধা তৈরি করছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো, যা নৈতিকতা ও মূল্যবোধ তৈরির জন্য গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, সেগুলোও এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। দেশের অগ্রগতির জন্য নৈতিকতা ও মূল্যবোধসম্পন্ন প্রজন্ম দরকার। এসবের অবক্ষয়ের ফলে সৃষ্ট ক্ষত সরাতে না পারলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নসহ কোনো কিছুই টেকসই হবে না।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে-

>সমস্যা ব্যক্তিগত নয়, সমষ্টিগত
>বুদ্ধিজীবীরাও বিচার করেননি
>সমাজব্যবস্থার কারণে মূল্যবোধের ক্ষয়

চাকরির নামে কোটি টাকা আত্মাসাৎ করলেন চসিক কর্মকর্তা

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:২০ এএম
আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:৪০ এএম
চাকরির নামে কোটি টাকা আত্মাসাৎ করলেন চসিক কর্মকর্তা
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) বিভিন্ন পদে চাকরি দেওয়ার নাম করে অন্তত অর্ধশত ব্যক্তির কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে লাপাত্তা হয়েছেন সংস্থাটির এক উচ্চমান সহকারী। তার নাম কাঞ্চন কুমার চৌধুরী। দুই মাস ধরে তিনি কর্মস্থলেও আসছেন না। এদিকে চাকরি না পেয়ে এবং অর্থ হারিয়ে বিপাকে পড়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। কাঞ্চন ও তার স্ত্রীর মোবাইল ফোন বন্ধ। কেউ কেউ বলেছেন, কাঞ্চন চৌধুরী সাধুর বেশ ধরে ভারতে বাড়ি করেছেন। তিনি সেখানেও চলে যেতে পারেন।

চসিক সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর কাঞ্চন কুমার চৌধুরী কিছুদিন অফিস করলেও ধীরে ধীরে তিনি অনিয়মিত হয়ে পড়েন। নভেম্বর মাসে এসে তিনি চসিক কর্তৃপক্ষের কাছে অবসরে যাওয়ার আবেদন করেন। যদিও তার চাকরির মেয়াদ আরও চার বছর আছে। এই খবর জানাজানি হওয়ার পর পাওনাদাররা তাকে খুঁজতে থাকেন। একপর্যায়ে কেউ কেউ তার বাসায় যান। চাকরি কিংবা টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য চাপ দেন। ভুক্তভোগীদের কয়েকজন বাসায় যাওয়া শুরু করলে তিনি নগরীর ঘাটফরহাদবেগ এলাকার বাসা ছেড়ে অজ্ঞাত স্থানে চলে যান।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানকালে খবরের কাগজ বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলেছে। কাঞ্চন চৌধুরী মূলত অফিস সহকারী, কম্পিউটার অপারেটর, সচিবের ব্যক্তিগত সহকারী, কর আদায়কারী, চসিক পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয়া, মেকানিকের সহকারীসহ বিভিন্ন ধরনের শ্রমিক পদে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। ভুক্তভোগীদের কেউ কেউ বলছেন, কাঞ্চন চৌধুরী তার শ্বশুরবাড়ি কক্সবাজারে অবস্থান করতে পারেন। কেউ কেউ ভারতে চলে যাওয়ার আশঙ্কাও করছেন।

চট্টগ্রাম শহরের পাথরঘাটা সেবক কলোনির বাসিন্দা ভুক্তভোগী উত্তম ভৌমিক খবরের কাগজকে জানান, তার স্ত্রী, শ্যালিকাসহ পরিবারের চারজনের চাকরি দেওয়ার জন্য ৫ লাখ টাকা দিয়েছেন। একইভাবে পাথরঘাটা ব্রিকফিল্ড এলাকার বাসিন্দা মো. সোহেল নিজের পরিবার এবং আত্মীয়স্বজনের আটজনের চাকরির জন্য দিয়েছেন ১০ লাখ টাকা। কাঞ্চন টাকা নেওয়ার পর বার বার সময় নিয়েছেন। কিন্তু টাকাও ফেরত দেননি, চাকরিও দেননি। কাঞ্চন চৌধুরী এখন আত্মগোপনে চলে গেছেন। শোনা গেছে, কাঞ্চন এখন কর্পোরেশনের চাকরি ছাড়ারও আবেদন করেছেন।

একসময় সেবক হিসেবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কাজ করতেন প্রতিবন্ধী মো. মজিবর। সেই কারণে বিভিন্ন সময়ে তাকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে যেতে হতো। আসা-যাওয়ার সুবাদে সংস্থাটির উচ্চমান সহকারী কাঞ্চন কুমার চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় হয়। পরিচয় সূত্রে মজিবুরের ভাইপো মো. ইমনকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরি দেওয়ার জন্য দুই দফায় ৫ লাখ টাকা নিয়েছেন কাঞ্চন। এর মধ্যে দুই লাখ ৪৫ হাজার টাকার ডকুমেন্ট হিসেবে ১০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প দিয়েছে। তিনি জমি বিক্রি করে টাকাটা দিয়েছেন। এখন জমিও গেছে, ভাইপোর চাকরিও হয়নি।

আরেক ভুক্তভোগী লিটন দাশ খবরের কাগজকে জানান, তিনি ৯ জনের চাকরির জন্য ১৫ লাখ টাকা দিয়েছেন। তিনিসহ বেশ কয়েকজন পাওনাদার টাকা ফেরত চাইতে কাঞ্চন চৌধুরীর বাসায় গেলে দুই মাস আগে তিনি সবাইকে নিয়ে স্থানীয় সাধু তারাচরণ সেবাশ্রম মন্দিরে ভুক্তভোগীদের ডাকেন। সেই বৈঠকে অন্তত ৩০ জন ভুক্তভোগী উপস্থিত ছিলেন। পরের সপ্তাহে সবাইকে টাকার ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তারপরের সপ্তাহে বাসায় তালা ঝুলিয়ে আত্মগোপনে চলে যান। এরপর বোয়ালখালির তার গ্রামের বাড়ি এবং কাট্টলী এলাকায় তার আত্মীয়ের বাড়িসহ সম্ভাব্য এলাকায় খোঁজ খবর নিয়ে তার হদিস মিলেনি। একজন উচ্চমান সহকারীকে এত টাকা কেন তুলে দিলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কাঞ্চন চৌধুরী তখন সাধুর মতো চলাফেরা করতেন। বাইরে কিছু খেতেন না। ধর্মপালন করতেন। এ কারণে তারা সবাই তাকে বিশ্বাস করেছেন। তিনি যে সাধুর বেশে চুরি করবেন, তা তারা কল্পনাও করতে পারেননি।

ভুক্তভোগী মোহাম্মদ সানিকে মেকানিক্যাল বিভাগে মেকানিকের সহকারী হিসেবে চাকরি দেওয়ার কথা ছিল। তার বিনিময়ে কাঞ্চন চৌধুরী নিয়েছেন দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা। ডকুমেন্ট হিসেবে ১০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করে দিয়েছেন। টাকা নেওয়ার পর থেকে মোবাইল বন্ধ। তার সঙ্গে আরো একজন ভুক্তভোগীর সচিবের পিএস পদে চাকরির জন্য সাড়ে তিন লাখ টাকার মৌখিক চুক্তি হয়। তবে তিনি দেড় লাখ টাকা দিয়েছেন। তাদের দুইজনের কারো চাকরি হয়নি। তারা টাকাও ফেরত পাননি।

এদিকে চসিকের সবিচ মোহাম্মদ আশরাফুল আমিন স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, সিটি কর্পোরেশনে সচিবালয় বিভাগের সাধারণ শাখার উচ্চমান সহকারী কাঞ্চন কুমার চৌধুরী বিভিন্নজনের কাছ থেকে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা নিয়েছেন। টাকা নেওয়ার দীর্ঘদিন পার হলেও চাকরি এবং টাকা ফেরত না দেওয়ার বিষয়ে পাওয়া অভিযোগগুলো তদন্ত করে দাখিলের জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গত ৬ জানুয়ারি গঠিত কমিটির আহ্বায়ক হলেন চসিকের স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট মনীষা মহাজন, সদস্য শিক্ষা কর্মকর্তা মোছাম্মদ রাশেদ আক্তার এবং সদস্য সচিব আজিজ আহমদ। কমিটিকে ৭ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম খবরের কাগজে বলেন, ‘কাঞ্চনের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ তারা পেয়েছেন। এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। যারা অভিযোগ করেছেন, তারা যদি তথ্য-প্রমাণ দিয়ে তার কাছে টাকা পাওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে কাঞ্চন কুমার চৌধুরীর অবসরের পর এককালীন পাওনা থেকে কেটে তাদের টাকা  পরিশোধ করা হবে। এছাড়া কাঞ্চনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করারও প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।’

ভ‍্যাট ইস‍্যুতে চাপে এনবিআর

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০৫:১৫ এএম
আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০১ এএম
ভ‍্যাট ইস‍্যুতে চাপে এনবিআর

বিভিন্ন পণ্য ও সেবায় ভ্যাট-শুল্ক বৃদ্ধি এবং গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরকার সরে না এলে কারখানা বন্ধ করে দিয়ে রাজপথে নামার হুমকি দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের এমন ঘোষণায় বেকায়দায় পড়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে করণীয় জানতে চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে এনবিআর। এদিকে ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) কয়েকটি পণ্য ও সেবা খাতের ওপর থেকে বর্ধিত ভ্যাট ও শুল্ক হ্রাসের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। হজযাত্রীদের টিকিটের ওপর আরোপিত বর্ধিত আবগারি শুল্ক কমানোর ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে

বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী সংগঠন ও শ্রেণি-পেশার মানুষের পক্ষ থেকে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর দাবি জানিয়ে বৃহস্পতিবার এনবিআরে আবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। আবেদনে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, করোনার আঘাতে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হতে বসেছিল। করোনা কমার পর অর্থনীতি কিছুটা ঘরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। ঠিক তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ডলারের মূল্য বেড়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় এলসি খোলা। অতীব প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করা হচ্ছে কয়েক গুণ বেশি দাম দিয়ে। 

এসআরও জারি না করেই কিছু পণ্যের ভ্যাট কমানোর ঘোষণা

পোশাক ও মিষ্টির ওপর ভ্যাট হার ১৫ থেকে ১০ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নন-এসি হোটেলের ওপর ভ্যাট হার ১৫ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হচ্ছে। এটি আগে ছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। অন্যদিকে মোটরগাড়ির গ্যারেজ ও ওয়ার্কশপের ভ্যাটেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে ভ্যাট হবে ১০ শতাংশ। অন্যদিকে হজযাত্রীদের হজ পালনের ব্যয় কমাতে হজযাত্রীদের বিমান টিকিটের ওপর আবগারি শুল্ক পুরোপুরি প্রত্যাহার করেছে এনবিআর। ইন্টারনেট-মোবাইল ও ওষুধের কাঁচামালের ওপর বাড়তি ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্কও কমানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

এনবিআর সদস্য (ভ্যাট নীতি) বেলাল হোসেন চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে অধ্যাদেশ জারি করে ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানোর ফলে ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখছি। তারা ভ্যাট ও শুল্ক কমানোর দাবি জানিয়েছেন। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কোন খাতে কতটা কমানো সম্ভব, সে বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ নিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। তবে এটাও ঠিক যে একসময় সব খাতে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ করতে হবে। তিনি বলেন, ‘কিছু বিষয়ে ভ্যাট কমানোর প্রতিশ্রুতি আমরা তাদের দিয়েছি। পরে এসআরও জারি করা হবে।’ 

অর্থ মন্ত্রণালয়ে এনবিআরের পাঠানো চিঠি নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। তিনি জানান, কিছু পণ্য ও সেবার ভ্যাট ও শুল্ক কমানোর কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। 

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ফলে কে কী বলছেন বা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, তা আমরা পর্যবেক্ষণ করছি।’

ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর দাবিতে ব্যবসায়ীরা অনড়

ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকতে পারেনি এনবিআর। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে রাজস্ব ভবনের সামনে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে হোটেল, রেস্তোরাঁ ও মিষ্টান্ন খাতের কয়েক শ ব্যবসায়ী ভ্যাট কমানোর দাবিতে অবস্থান গ্রহণ করেন। তারা জানিয়ে দেন, ভ্যাট কমানো না হলে ঘরে ফিরবেন না। ব্যবসায়ীদের এমন অবস্থানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে এনবিআর এসআরও জারি না করেই সংশ্লিষ্ট খাতের ভ্যাট কমানোর ঘোষণা দেয়।

বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান খবরের কাগজকে বলেন, ‘ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এমনিতেই হোটেল, রেস্তোরাঁর ব্যবসা চাপে আছে। এর মধ্যে রেস্তোরাঁর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করে আরও বিপদে ফেলা হয়েছিল। ভ্যাট কমানোর দাবিতে আমরা রাজপথে নেমেছিলাম। ভ্যাট না কমালে আমরা ঘরে ফিরে যেতাম না। এনবিআর আমাদের দাবি মেনে ভ্যাট কমানোর কথা জানিয়েছে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘৭০ শতাংশ রেস্তোরাঁ এখনো ভ্যাটের আওতার বাইরে। তাদের না ধরে আমরা যারা ভ্যাট দিয়ে থাকি তাদের ওপর আরও চাপ বাড়ানো হয়েছিল। এসব না করে প্রশাসনের ব্যয় কমিয়ে ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিয়ে সরকার আয় বাড়াতে পারে। আইএমএফের শর্ত মানতে গিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো দেশের জনগণের ওপর ইচ্ছামতো করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া কোনো পূর্ণাঙ্গ সমাধান হতে পারে না।’

নতুন করে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি ও ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোর সমালোচনা করে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকার যে নীতি নিচ্ছে তা বাস্তবায়িত হলে আমরা কোথায় যাব? গ্যাসের দাম ও ভ্যাট বাড়ার আগে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এ নিয়ে কোনো আলোচনাও করা হয়নি। বিনিয়োগ কমেছে। অর্থনীতির এই পরিস্থিতিতে গ্যাসের দাম ও ভ্যাট বৃদ্ধির প্রভাব কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে তা চিন্তা করা উচিত। ব্যবসায়ী মানেই যেন অপরাধী। সবাই চুষে খেতে চায়।’ 

তিনি বলেন, ‘আসলে সব সরকারের চরিত্রই এক। গত সরকার বলেছিল গ্যাসের দাম বাড়িয়ে সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন করবে। কিন্তু তারা সেই প্রতিশ্রুতি রাখেনি।’

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী আহসান খান চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘আজকে আমরা সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছি যে প্রান্তিক কৃষকের আম, টমেটো, আনারস, কলা, পেয়ারা ও কলার পাল্প পণ্যগুলোর ওপর মূসক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন প্রান্তিক চাষিরা। এখন যদি ভ্যাট ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এসব পণ্যের দাম বেড়ে যায়, তবে অনেকেই এসব পণ্য কেনা থেকে বিরত থাকবেন। সরকারকে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যে বর্ধিত ভ্যাট ও শুল্ক প্রত্যাহার এবং গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার দাবি জানাচ্ছি।’

বাংলাদেশে অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সভাপতি এম এ হাশেম খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিস্কুট ও কেকের ওপর ভ্যাট বাড়ানোর সঙ্গে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। ৫ টাকার একটি বিস্কুট আর তৈরি করা সম্ভব হবে না। বিস্কুটের দাম বেড়ে যাবে। তাহলে ব্যবসা করব কীভাবে? ভ্যাট আর সম্পূরক শুল্ক না কমালে ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া আর উপায় নেই।’ 

অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য

ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকারের আয় বাড়ানোর অনেক পথ আছে। সরকারকে সেসব পথ খুঁজে নিতে হবে। তা না করে ইচ্ছামতো ভ্যাট আর সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে খরচ বাড়িয়ে দেওয়া হলো, যা ব্যবসায়ে খরচ বাড়িয়ে দিল। এতে শিল্পে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে।’

আরেক রাজস্ব খাতের বিশ্লেষক এনবিআর সদস্য ফরিদ উদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শিল্পের খরচ বাড়ানো হলো। এসব খাতে খরচ বাড়লে বাজারে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাকেও দাম বেশি দিয়ে জিনিসপত্র কিনতে হবে। এ ছাড়া ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে না পারলে রাজস্ব পরিশোধ করবেন কীভাবে?’

গৌরনদীতে টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট টাকা নয়ছয় করে প্রকল্প, পড়ে আছে ফাঁকা ভবন

প্রকাশ: ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:০৯ এএম
আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:১৮ এএম
টাকা নয়ছয় করে প্রকল্প, পড়ে আছে ফাঁকা ভবন
শহিদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট

প্রকৃত বাজারমূল্যের চেয়ে অস্বাভাবিকভাবে বেশি মূল্যে মেশিনারিজ কেনা হয়েছে। এতে অতিরিক্ত ১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। দ্বিতীয় শিফটের ক্লাসের সম্মানীর নামে প্রায় ১৯ লাখ টাকা ওঠানো হয়েছে। প্রকল্পবহির্ভূত কাজে গাড়ি ব্যবহার করে জ্বালানি কেনা ও মেরামতের জন্যও বেশি খরচ করা হয়েছে। এভাবেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে নয়ছয় করেই বরিশালের গৌরনদীতে শহিদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে ছাত্র হোস্টেল, ছাত্রী হোস্টেল, প্রিন্সিপাল কোয়ার্টার, অফিসার্স কোয়ার্টার নির্মাণ করা হলেও এখনো সেগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। ফিজিবিলিটি স্টাডি (সম্ভাব্যতা সমীক্ষা) ছাড়াই অনিয়ম করে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে। 

আইএমইডি থেকে গত ১০ ডিসেম্বর প্রকল্পটি সরেজমিনে মনিটরিং করা হয়। তার ভিত্তিতেই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।  প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে বস্ত্র অধিদপ্তর। সার্বিক ব্যাপারে জানতে সর্বশেষ প্রকল্প পরিচালক মো. ইফতেখার আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি হওয়ায় কোনো মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে বস্ত্র অধিদপ্তরের উপপরিচালক ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলম রেজা খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রকল্পটি সাড়ে তিন বছর আগে শেষ হয়েছে। কোনো অনিয়ম হলে ওই সময়ের প্রকল্প পরিচালক জানেন, তিনি বলতে পারবেন। আমি কিছু বলতে পারব না। বিল্ডিং নির্মাণে কোনো ত্রুটি থাকলে তা সারানো হবে।’ 

বস্ত্র অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. শহিদুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘আইএমইডির প্রতিবেদন আমি হাতে পাইনি। কাজেই কোথায় কী সমস্যা, তা জানি না। ডকুমেন্ট ছাড়া কোনো মন্তব্য করতে পারছি না। তবে সব বিল্ডিং ফাঁকা পড়ে নেই। অধ্যক্ষ তার পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন, এটা বলতে পারি।’    

প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, চুক্তিপত্র অনুযায়ী ঠিকাদার মেশিনারিজ সরবরাহ করতে ব্যর্থ হলেও প্রায় ৬৯ লাখ টাকা জরিমানা আরোপ করা হয়নি। উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান না করে পিপিআর-২০০৮-এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে প্রায় ২০ লাখ টাকার কম্পিউটার ও অফিস যন্ত্রপাতি কেনা হয়। শুধু তাই নয়, নকল (ফেক) ক্যাশমেমো তৈরি করে বিভিন্ন দোকানে প্রায় ৬ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সম্মানীর ওপর আয়কর কর্তন না করায় ৫ লাখ টাকার বেশি রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। ১ হাজার ৭৩৮টি আসবাবপত্র কেনা হয়েছে। তাতে খরচ হয়েছে ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। ৩ কোটি ৪২ লাখ টাকায় ৫ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। 

দেশে দক্ষ লোকবল তৈরি এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়। কিন্তু কোনো ফিজিবিলিটি স্টাডি ছাড়াই প্রকল্পটির খরচ ধরা হয় ৬২ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এরপর বাড়তে থাকে টাকা। ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত অর্থাৎ তিন বছরে সম্পূর্ণ সরকারি অর্থে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু ওই সময়ে তো দূরের কথা, মাঝপথে তিনবার সংশোধন করে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়ে। শুধু তাই নয়, শেষবারের মতো ২০২১ সালের ২৬ এপ্রিল আন্তখাত সমন্বয়ও করা হয়েছে। সময় বাড়ানো হয়েছে ১৬৭ শতাংশ। খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ৯৯ কোটি টাকা বা ৫৯ শতাংশ। তবে প্রকৃত খরচ হয়েছে ৯০ কোটি ১১ লাখ টাকা বা আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৯০ শতাংশ এবং বাস্তব অগ্রগতি ১০০ শতাংশ। এভাবে খরচ বেড়েছে ৫৯ শতাংশ এবং সময় ১৬৮ শতাংশ। 

প্রকল্পের প্রধান কাজ হচ্ছে ৪ তলা একাডেমিক ভবন নির্মাণ। তাতে খরচ হয়েছে ৯ কোটি ২ লাখ টাকা। ৬ তলার ছাত্র হোস্টেল নির্মাণে খরচ হয়েছে ৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। ৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা খরচ করে ছাত্রী হোস্টেল, ৯ কোটি ২২ লাখ খরচে দোতলা প্রিন্সিপাল কোয়ার্টার এবং ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা খরচে ৬ তলা স্টাফ কোয়ার্টার নির্মাণ করা হয়েছে। ২ কোটি ২২ লাখ টাকায় বাউন্ডারি ওয়াল ও ছাত্রীনিবাসের নিরাপত্তা দেওয়ালও করা হয়েছে। এভাবে আরও কিছু কাজ করা হয়েছে। তাতে লাখ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। 

২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি- একনেক সভায় এ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। তখন খরচ ধরা হয়েছিল ৬২ কোটি ১৩ লাখ টাকা। বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছিল ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত তিন বছর। সে সময়ে বাস্তবায়ন হয়নি। তাই সংশোধন করা হয়। এতে এক লাফে খরচ বাড়িয়ে ধরা হয় ৯৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। সময় বাড়ানো হয় তিন বছর, অর্থাৎ ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত। তাতেও হয়নি কাজ। দ্বিতীয়বারের মতো ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর সংশোধন করা হয়। এতে খরচ বাড়িয়ে ধরা হয় ৯৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। সময়ও বাড়ানো হয় এক বছর। পরে আবার খরচ না বাড়িয়ে এক বছর সময় বাড়িয়ে ২০২০ সালের ৩০ জুন করা হয়। কিন্তু তারপরও কাজ অসমাপ্ত থাকায় শেষ সময়ে ২০২১ সালের ২৬ এপ্রিল বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় প্রকল্পটির আন্তখাত সমন্বয় করে ২০২১ সালের জুনে নিয়ে যায়। 

প্রথমে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর থেকে ২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন মো. আব্দুস সাত্তার শিকদার। দ্বিতীয় প্রকল্প পরিচালক হিসেবে মো. এনামুল হক ২০১৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। সর্বশেষ পিডি ছিলেন মো. ইফতেখার আহমেদ ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। এভাবে পিডিরা দায়িত্ব পালন করলেও বরাদ্দ টাকার নয়ছয় করেছেন। 

আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটির আওতায় একাডেমিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু তিন বছরের মধ্যেই দ্বিতীয় তলায় প্রশাসনিক শাখার রুমের দরজার ওপরের দেওয়ালে ফাটল ধরে। এই তলায় অন্য একটি রুমের বাথরুমের দরজা ভেঙে পড়েছে। এ ছাড়া কলাপসিবল গেট  মরিচা পড়ে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। ভবনের ছাদেও পানি জমে থাকছে। একাডেমিক ভবন ও ছাত্র হোস্টেলের ডাইনিং রুমের এক পাশের দেওয়াল স্যাঁতসেঁতে অবস্থা। ১০০ জন ছাত্রী থাকার জন্য প্রায় ৬ কোটি টাকা খরচ করে হোস্টেল নির্মাণ করা হলেও মাত্র ১৮ জন ছাত্রী থাকেন। এত বড় ভবন ফাঁকা পড়ে আছে। 

একইভাবে অধ্যক্ষের ভবন নির্মাণ করা হলেও তিনি থাকেন না। অতিথিদের বিশ্রামাগার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ১২টি পরিবারের বসবাসের জন্য ৬ তলা স্টাফ কোয়ার্টার নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু মাত্র একটি পরিবার বসবাস করে। এখন পর্যন্ত কোনো শিক্ষক বা কর্মকর্তা কোয়ার্টারে ওঠেননি। প্রকল্পটি গ্রহণের আগে কোনো ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয়নি। এতে অর্থের অপচয় হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ: নীতি সুদহার বৃদ্ধি, না বিনিয়োগ

প্রকাশ: ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৪৫ এএম
আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৪৮ এএম
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ: নীতি সুদহার বৃদ্ধি, না বিনিয়োগ
প্রতীকী ছবি

দেশে এখনো উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে সার্বিকভাবে গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। অন্যদিকে বিনিয়োগের অন্যতম নিয়ামক বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে সর্বনিম্ন অবস্থায় রয়েছে। গত অক্টোবর শেষে এই হার দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ। নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গত পাঁচ মাসে ৫০ বেসিস পয়েন্ট করে তিন দফা নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে, যা বর্তমানে ১০ শতাংশ রয়েছে। তবে নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হচ্ছে না। বরং এর প্রভাবে বাজারে সব ধরনের ঋণের সুদহার বেড়ে গেছে। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদাও তলানিতে নেমে এসেছে, যা দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এই অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী মুদ্রানীতিতে কী পদক্ষেপ নেবে, সেটাই দেখার বিষয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আবার নীতি সুদহার বাড়াবে, নাকি বিনিয়োগ বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেবে- সেটাই দেখার বিষয়।

জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি চলতি জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে ঘোষণা করা হবে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনাও শুরু করেছে। এ বিষয়ে গত রবিবার থেকে আলোচনা শুরু করেছেন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। এটা হবে বর্তমান গভর্নরের প্রথম মুদ্রানীতি ঘোষণা। এর আগে প্রথা অনুযায়ী গত রবিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন গভর্নর। এ সময় তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি না কমলে নীতি সুদহার আরও বাড়ানো হবে। গত মঙ্গলবার ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের সঙ্গেও বৈঠকে বসেন গভর্নর। সেখানেও একই মতামত তুলে ধরেন তিনি। যদিও অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘উন্নত দেশে কার্যকর হলেও আমাদের দেশের বাস্তবতায় নীতি সুদহার বাড়িয়ে মুদ্রানীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। তাই নীতি সুদহার না বাড়িয়ে বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব দিতে হবে। সেই সঙ্গে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করতে হবে এবং বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।’

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মঈনুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে খুব একটা সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। আগামীতেও কোনো সুফল আসবে বলে মনে হচ্ছে না। বরং বাংলাদেশ ব্যাংককে বাজার তদারকি বাড়ানোর মাধ্যমে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেট ভাঙার বিকল্প নেই।’ এই অবস্থায় নীতি সুদহার না বাড়িয়ে বিনিয়োগ বাড়ানোর দিকে বেশি নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। 

একই বিষয়ে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘উন্নত বিশ্বে সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হলেও আমাদের দেশে সেটা সম্ভব নয়। কারণ সেসব দেশে ৯০ শতাংশ ঋণই ভোক্তাঋণ। তারা বাড়ি, গাড়িসহ নানা কাজে ঋণ নেন। ফলে সেসব দেশে সুদহার বাড়িয়ে ভোগব্যয় কমানো যায়। আর আমাদের দেশে ৮৫ শতাংশ ঋণই ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য নেওয়া হয়। ফলে এখানে সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়, সরকারি তথ্যেই যার প্রমাণ পাওয়া যায়। বর্তমানে সুদহার সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। বরং বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধিও তলানিতে ঠেকেছে। অর্থাৎ দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে না। ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধিও কমে সর্বনিম্ন অবস্থায় নেমেছে। কারণ ১৫ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে আমাদের পক্ষে ব্যবসা করা প্রায় অসম্ভব। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে এলডিজি গ্র্যাজুয়েশনও সম্ভব হবে না।’

জানা গেছে, আগামী ২০ জানুয়ারি মুদ্রানীতি প্রণয়নসংক্রান্ত কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সেখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আর ২২ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে মুদ্রানীতি অনুমোদন করা হবে।

নীতি সুদহার বাড়িয়ে কেন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না- এই বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়। কেননা সর্বশেষ গত অক্টোবরে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে বলেই ডিসেম্বরে সামান্য মূল্যস্ফীতি কমেছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশ এমনিতেই দুর্বল, তার ওপর আবার নানা ধরনের চাপ আছে। নীতি সুদহার বাড়ানোর ফলে এমনিতেই ঋণের সুদহার বাড়ছে। এখন বলা হচ্ছে গ্যাসের দাম আবার বাড়ানো হবে। নীতি সুদহার বাড়ানোর পাশাপাশি যদি গ্যাস ও বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয়, তাহলে তো আর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।’ 

এ বিষয়ে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নূরুল আমিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরবরাহ ঠিক রেখে আমাদের মতো দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন। এ জন্য সব সময়ই যে নীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হবে তা নয়, মানুষের আচার-আচরণ, লোভ-লালসা এগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। বড় ৮-১০টা কোম্পানি নিত্যপণ্য আমদানির কাজ করে। এর বাইরে আমাদের দেশে উৎপাদন হয় এমন পণ্যের দাম হঠাৎ করেই বেড়ে যায়। ওই জায়গার কারসাজিগুলো চিহ্নিত করা এবং সেগুলো দূর করতে পারলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে বলে মনে করি।’ তিনি বলেন, ‘গত অক্টোবরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও অনেক কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ। যদিও একটা সময় এই লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৫ বা ১৬ শতাংশ। সেখানে ১৩ বা ১৪ শতাংশ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কম হওয়া আমাদের জন্য মোটেও ভালো না। কারণ আমাদের অর্থনীতির ৮০ শতাংশই বেসরকারি খাতনির্ভর। ফলে তাদের চাহিদা যদি পূরণ করতে না পারি, তাদের যদি বিনিয়োগের পরিবেশ দিতে না পারি, রাজনৈতিক পরিস্থিতি যদি ব্যবসার অনুকূলে না আসে, তাহলে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা আরও কমবে; যা দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আগামী মুদ্রানীতিতে এই বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া দরকার বলেই আমি বলে করি।’