
মামলার হুমকি দিয়ে চাঁদাবাজি, অভিযোগ থেকে রেহাই দেওয়ার কথা বলে টাকা আদায়, প্রতারণা ও ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগে গত ১৬ বছরে নিজ সংস্থার ২৩৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বহিষ্কারসহ বিভিন্ন ধরনের শাস্তি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এর মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অপসারণসহ বিভিন্ন ধরনের শাস্তি দেওয়া হয়েছে। বিভাগীয় মামলায় ১৩ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে এখনো তদন্ত চলছে। অন্তত ২৫ জনের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ যাচাই করছে দুদকের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি দমন কমিটি। এ ছাড়া ডলারে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে গত এপ্রিল মাসে উপপরিচালক (পিআরএল ভোগরত) আবু বকর সিদ্দিকের (জিনের বাদশা নামেও পরিচিত) বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদকের তিন সদস্যের ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি। কমিটির প্রতিবেদন পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে কমিশন।
এসব বিষয়ে দুদকের মুখপাত্র ও মহাপরিচালক আক্তার হোসেন খবরের কাগজকে জানান, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। দুদকের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে আসা অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি দমন কমিটি রয়েছে। কমিশনের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি অভিযোগ যাচাই করে ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় বিদ্যমান কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার পাশাপাশি ফৌজদারি মামলা করার নজিরও রয়েছে। তবে অবসরে যাওয়া বা সাবেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিষয়ে অভিযোগ এলে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ থাকে না। সে ক্ষেত্রে অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় শুধু ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে।
জানা গেছে, দুদকের বিদ্যমান জনবল ১ হাজার ১০০। দুদকের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। ১৬ বছরের বিভিন্ন সময়ে অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে। অনেক অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় শাস্তি হয়নি। সততার সঙ্গে চাকরি জীবন শেষ করে অনেকেই অবসরে গেছেন। দুর্নীতির অভিযোগে বহিষ্কারসহ বিভিন্ন ধরনের শাস্তি মাথায় নিয়ে কিছুসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। দুর্নীতি দমন ব্যুরো বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় দুদক।
সে সময় ব্যুরো আমলের কর্মকর্তাদের সততা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও প্রয়োজনীয় নিয়োগবিধি না থাকায় দুদক আইনেই ব্যুরোর অপেক্ষাকৃত সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুদকে বহাল করা হয়। তবে, ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের পর থেকেই কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রকাশ্যে আসে। ফলে ২০০৮ সালে দুদকের জন্য আলাদা চাকরিবিধি প্রণয়নের মধ্য দিয়ে এসব অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু হয়।
সেই থেকে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ২৩৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এতে চাকরিচ্যুতির পাশাপাশি ফৌজদারি মামলা দায়ের, বাধ্যতামূলক অবসর, পদ অবনমন, বেতন কমিয়ে দেওয়া এবং ইনক্রিমেন্ট স্থগিত করা হয়েছে। পিয়ন, ড্রাইভার, কনস্টেবল, কেরানি, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই), উপসহকারী পরিচালক, সহকারী পরিচালক, উপপরিচালক এবং পরিচালক পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরও শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৪ জনকে চাকরিচ্যুত এবং বাকিদের বাধ্যতামূলক অবসর ও অন্যান্য শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, দুদকের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দ্বারা হয়রানির শিকার মানুষের দেওয়া অভিযোগ খতিয়ে দেখছে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি দমন কমিটি। বর্তমানে ১৩টি বিভাগীয় মামলার তদন্ত ও ২টি ফৌজদারি অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। এ ছাড়া বিভিন্নভাবে আসা অভিযোগের মধ্যে আমলযোগ্য বিবেচনায় অন্তত ২৫টি নতুন অভিযোগ যাচাই করা হচ্ছে। যাচাই-বাছাইয়ের পর কমিটি সুপারিশ জানালে সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবে কমিশন। আরও কিছু সন্দেহভাজন কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন সংস্থাটির অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা ইউনিটের নজরদারিতে।
জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত শাস্তি পাওয়া ৯ জনের মধ্যে কনস্টেবল এমরান হোসেনকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়েছে। অসদাচরণ ও অদক্ষতার অভিযোগে সহকারী পরিচালক নীল কমল পালের ৩ বছরের ইনক্রিমেন্ট স্থগিত, সহকারী পরিচালক আল আমিন ও উচ্চমান সহকারী গাজী আব্দুল কাদেরের ১ বছরের ইনক্রিমেন্ট স্থগিত, প্রধান সহকারী মুহাম্মদ মাবুবুল হাসান আফ্রাদকে বাধ্যতামূলক অবসর ও ডেটা এন্ট্রি অপারেটর ওমর ফারুককে সাময়িক বরখাস্ত করার খবর পাওয়া গেছে।
এদিকে গত বছর চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী পরিমল ধরকে দুদকের ভুয়া অভিযোগ দেখিয়ে তা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা বলে ২০ লাখ টাকা দাবি করেন দুদকের কুমিল্লা কার্যালয়ের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) কামরুল হুদা। এ বিষয়ে পরিমল থানায় মামলা করেন। গত বছর ২৪ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামে ছুটে গিয়ে ঘুষ নিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন কামরুল হুদা। চাঁদাবাজির মামলায় কামরুলকে জেলহাজতে পাঠানো হলে দুদকও তাকে বরখাস্ত করে। দুদকের মহাপরিচালকের (মানি লন্ডারিং) পিএ গৌতম ভট্টাচার্য তার তিন সহযোগীসহ ঘুষের দেড় লাখ টাকা নেওয়ার সময় গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাতে ধরা পড়ে জেলহাজতে যান।
তারা ঢাকার উত্তরার ব্যবসায়ী আশিকুজ্জামানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ভুয়া অভিযোগের চিঠি তৈরি করে তা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা বলে ঘুষ দাবি করেছিলেন। এ ঘটনায় দুদক গৌতমকেও বরখাস্ত করেছে। বগুড়ায় পুলিশের এসআই আলমগীর হোসেনের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধান করতে গিয়ে অব্যাহতির আশ্বাস দিয়ে ঘুষ নেন দুদকের উপসহকারী পরিচালক সুদীপ কুমার চৌধুরী। এ অভিযোগে তাকেও বরখাস্ত করা হয়। একই ধরনের অভিযোগে উপপরিচালক শাওন মিয়া, সহকারী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান এবং কুড়িগ্রাম জেলা কার্যালয়ের গাড়িচালক সফিউল্লাহকেও বরখাস্ত করা হয়।
দুদকের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত ছিল দুর্নীতির মামলা থেকে রেহাই পাইয়ে দিতে পুলিশের ডিআইজি মিজানুর রহমানের কাছ থেকে দুদক পরিচালক এনামুল বাছিরের ২৫ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার ঘটনা। ২০১৯ সালের আলোচিত এ ঘটনায় এনামুল বাছির শুধু চাকরিচ্যুতই হননি, দুদকেরই দায়ের করা ফৌজদারি মামলায় তার ৮ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। এ রায়ের বিরুদ্ধে তিনি আপিল করেছেন। বর্তমানে তিনি জামিনে মুক্ত আছেন।
২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে ঘুষের ১০ লাখ টাকাসহ র্যাবের হাতে ধরা পড়েন দুদক চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের তৎকালীন উপপরিচালক সাব্বির আহমেদ। যে দুদক ফাঁদ পেতে বিভিন্ন দপ্তরের ঘুষখোর ধরতে সিদ্ধহস্ত। সেই দুদকের কর্মকর্তা ঘুষের টাকাসহ ধরা পড়েন র্যাবের হাতে। বিষয়টি ওই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ছিল। সাব্বিরকে তখনই চাকরিচ্যুত করা হয়। মামলাটির বিচার চলছে।
দেশের জেলা কার্যালয়গুলোর মধ্যে দুদক কর্মকর্তাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে চট্টগ্রামে। হালের সবচেয়ে আলোচিত ছিল দুদক উপপরিচালক শরীফ উদ্দিনকে অপসারণের ঘটনা। দুদকের চাকরিবিধির ক্ষমতাবলে কমিশন সরাসরি তাকে অপসারণ করে। এ ঘটনায় তার সহকর্মীরা দুদক সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের ব্যানারে সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেন। সহকর্মী অপসারণের ঘটনায় দুদকে প্রথমবারের মতো এ ধরনের মানববন্ধন হয়। এদিকে শরীফউদ্দিন অপসারণের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে মামলা করেও ফিরতে পারেননি। ২০০৮ থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৬ বছরের মধ্যে বরখাস্তের বিরুদ্ধে অনেকেই হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন। হাইকোর্টের আদেশে কয়েকজন স্বপদে ফিরেছিলেন। পরে তাদেরকে চাকরিবিধি অনুসারে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।
দুদকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮ সালে দুদক চাকরিবিধি প্রণয়ন হওয়ার পর অনিয়ম-দুর্নীতি ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ওই বছরেই ৩২ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে শাস্তির আওতায় আনা হয়। এর মধ্যে ৪ জন চাকরিচ্যুত হন। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে ৯৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে শাস্তি দেওয়া হয়। এর মধ্যে চাকরিচ্যুত হন ১৮ জন। ২০১৪ সালে ১২ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
২০১৫ সালে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ২০১৬ সালে ১৪ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, এর মধ্যে ২ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। ২০১৭ সালে ১৫ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এর মধ্যে ১ জনকে চাকরিচ্যুত, ২০১৮ সালে ৪ জনের মধ্যে ৩ জনকে চাকরিচ্যুত, ২০১৯ সালে ৩৬ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। এর মধ্যে ২ জন চাকরিচ্যুত হন। ২০২০ সালে তিনজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হলেও চাকরিচ্যুতি ঘটেনি। ২০২১-এ কোনো বিভাগীয় মামলা হয়নি। ২০২২ সালে একজনের চাকরিচ্যুতিসহ তিনজনকে শাস্তি দেওয়া হয়। গত বছর ১৫ এবং চলতি বছর ৯ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ১৩টি বিভাগীয় মামলার তদন্ত চলছে।
একটি সূত্র জানায়, নতুন করে আসা অভিযোগের মধ্যে অন্তত ২৫টির গ্রহণযোগ্যতা খতিয়ে দেখছে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি দমন কমিটি। কমিটির সুপারিশ পেলেই ব্যবস্থা নেবে কমিশন।