
২০২৪ সালজুড়েই অর্থনীতিতে ছিল নানা সংকট। মূল্যস্ফীতির চাপ ছিল অসহনীয়। সত্যিকার অর্থে এ বছর সীমিত আয়ের মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে প্রায় সব ধরনের পণ্যে, বিশেষ করে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে। বছরজুড়ে ছিল মূল্যস্ফীতির দাপট। গত এক দশকে মূল্যস্ফীতির এত চাপ মানুষকে সহ্য করতে হয়নি। মূলত দুই বছর ধরে মূল্যস্ফীতির চাপ পরিলক্ষিত হয়।
সরকারের প্রত্যাশা ছিল এই চাপ ধীরে ধীরে কমে আসবে। গত আগস্ট মাসে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে মূল্যস্ফীতি কমাতে নীতি সুদহার বৃদ্ধিসহ নানা পদক্ষেপ নিলেও তা কমেনি। বরং বেড়েই চলছে। অবশ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেছেন, যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এর ফলে আশা করা যাচ্ছে আগামী বছরের জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে।
মূল্যস্ফীতির এই চোখ রাঙানি কেবল বাংলাদেশ দেখেছে, এমন নয়। কোভিড মহামারি থেকে উত্তরণ হতে না হতেই ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। এতে সারা বিশ্বেই পণ্যমূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। অন্য দেশগুলো এরই মধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো পারেনি।
২০২৪ সালে অর্থনীতিতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ডলারসংকট। ডলারের এতটা সংকট বাংলাদেশ সম্প্রতি আর দেখেনি। ২০২২ সালে ১ মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৫ টাকা। বর্তমানে ১ ডলার কিনতে ব্যয় করা হচ্ছে ১২০ থেকে ১২২ টাকা। অর্থাৎ ৩০ শতাংশ কমেছে টাকার মান। ডলার দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় আমদানি সংকুচিত করতে হয়। ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল, তারা আমদানির জন্য ডলার পাননি। একদিকে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, অন্যদিকে সংকটের কারণে স্থানীয়ভাবে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি- এই দুইয়ে মিলে দেশে পণ্যমূল্য বেড়েছে।
ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য কমে যাওয়ার কারণে সরকারের লেনদেনে রেকর্ড ঘাটতি দেখা দেয়। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে ঋণ পরিশোধের খরচ বাড়ে। ডলারসংকটের কারণে বাড়ে জ্বালানিসংকটও। ফলে শিল্পকারখানাগুলো ভুগেছে সেদিক থেকেও।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এরপর ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে একটি ভঙ্গুর অর্থনীতি পায়। জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলনে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। তবে অক্টোবরের পর থেকে কিছুটা গতি ফিরে পায়। কৃষি ও শিল্প খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সংকোচনমূলক থেকে বর্তমানে সম্প্রসারণ ধারায় ফিরেছে অর্থনীতি। গতি ফিরলেও এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে অর্থনীতিতে।
২০২৪ সালজুড়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে মজুত নিয়ে ছিল অস্বস্তি। কোভিডকালীন বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। রিজার্ভ কমে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১০০ কোটি ডলার। তবে ব্যবহারযোগ্য বা নিট রিজার্ভ ১৮ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার জন্য যে শর্ত দিয়েছে তার মধ্যে একটি হলো নির্দিষ্ট মাত্রায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখা। তবে আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, রিজার্ভ ধরে রাখতে বারবার ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে একটা স্থিতিশীল অবস্থায় দাঁড়িয়েছে রিজার্ভ। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার ছিল অস্থিতিশীল। ইতিবাচক দিক হচ্ছে বিনিময় হার এখন স্থিতিশীল।
দেশের অর্থনীতি যে একটা স্থবিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এ কথা অকপটে স্বীকার করেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। সম্প্রতি রাজধানীতে ঢাকা চেম্বার আয়োজিত এক সেমিনারে তিনি বলেছেন, অর্থনীতিতে অস্থিরতা রয়েছে। তবে এটি সাময়িক। কয়েক মাসের মধ্যে অর্থনীতি তার গতি ফিরে পাবে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যে সন্তোষজনক নয় তা বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এরই মধ্যে আভাস দিয়েছে।
আইএমএফ গত ১৮ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে বলেছে, চলতি বছরে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। এর আগে বিশ্বব্যাংক বলেছে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সাম্প্রতিক বন্যার কারণে এ বছরের শেষে দেশের প্রবৃদ্ধি কমে হবে ৪ শতাংশ। এ ছাড়া এডিবি গত সেপ্টেম্বরে ৫ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে। সম্প্রতি সরকারি গবেষণা সংস্থা বিআইডিএসের বার্ষিক সম্মেলন হয়ে গেল। সেখানে এক অধিবেশনে চলতি বছর জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের বেশি হবে না বলে অর্থনীতিবিদ-গবেষকরা অভিমত দেন।
উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, সরকারি আয়ের বড় উৎস রাজস্ব আদায়ে নাজুক অবস্থা। চলতি বছরের শুরু থেকে রাজস্ব আহরণ কম হয়েছে এবং বছর শেষে এ ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। উদ্বেগ এই কারণে যে রাজস্ব আদায়ে শুধু বিশাল ঘাটতিই হয়নি, বরং ডিসেম্বরে প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়েছে। স্বাধীনতার পর, করোনাকালে প্রথমবারে রাজস্ব আয়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। তারপর এ বছরে প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক বা নেগেটিভ প্রবৃদ্ধি হলো। রাজস্ব আদায়ের বিশাল ঘাটতি সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজস্ব আদায় বাড়াতে সরকারের ওপর আইএমএফের চাপ রয়েছে। অন্যদিকে নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে শুল্কছাড় দিতে হচ্ছে। কিন্তু আইএমএফ তা চায় না। বিষয়টি নিয়ে বেকায়দায় রয়েছে সরকার।
২০২৪ সালে বিনিয়োগ পরিস্থিতি যে খারাপ ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই সময়ে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ উভয়ই কমে গেছে। স্থানীয় বিনিয়োগ কমার কারণ হলো বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ অনেক কমে গেছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিদেশিরা এ দেশে আসতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।
সরকারি আয়ের আরেকটি উৎস হচ্ছে বিদেশি ঋণ। ২০২৪ সালের প্রথম দিক থেকে বিদেশি ঋণপ্রবাহের শ্লথগতি লক্ষ করা গেছে। বছরের শেষে এসেও একই ধারা বজায় রয়েছে। খারাপ খবর হলো, সম্প্রতি বিদেশি ঋণ পরিশোধে চাপ বেড়েছে। যে পরিমাণ ঋণ এসেছে, তারচেয়ে বেশি পরিশোধ করা হচ্ছে। ফলে নিট বিদেশি ঋণ কমে গেছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মা রেল লিংকসহ মেগা প্রকল্পের ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় শুরু হয়ে যাওয়ায় বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়েছে।
সঞ্চয়পত্র বিক্রি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ১৪ হাজার ৯৯২ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে বিক্রি হয়েছিল ২১ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র। সেই হিসাবে এক বছরে নতুন করে সঞ্চয়পত্র বিক্রি সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা বা ৩১ শতাংশ কমেছে।
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিগত সরকারের সুবিধাভোগী ধনী গোষ্ঠীর অনেকে আত্মগোপনে চলে গেছেন। এ সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতিও শ্লথ হয়েছে। আবার উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়েছে। এ ছাড়া বিল-বন্ডের সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিপর্যায়ের বিনিয়োগের একটি বড় অংশ বিল-বন্ডে স্থানান্তর হয়েছে। এসব কারণে সঞ্চয়পত্রের প্রতি মানুষের আগ্রহে কিছুটা ভাটা পড়েছে।
অর্থনীতিতে সুখবর হচ্ছে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি। রাজনৈতিক অস্থিরতা, একের পর এক শ্রমিক বিক্ষোভ, তৈরি পোশাক খাতে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার মধ্যেও দেশের রপ্তানি আয় বেড়ে চলেছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী নভেম্বরেও রপ্তানি আয়ে ১৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বরাবরের মতোই সবচেয়ে বেশি রপ্তানি আয় এনেছে তৈরি পোশাক খাত। এ খাত থেকেও প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশ।
আরেকটি ভালো খবর হচ্ছে, প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সের উচ্চ প্রবৃদ্ধি। নভেম্বরে ২২০ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। গত বছরের নভেম্বরে দেশে এসেছিল ১৯৩ কোটি ডলারের প্রবাসী আয়, অর্থাৎ গত বছরের নভেম্বরের চেয়ে এবার একই সময়ে প্রবাসী আয় বেড়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ। ২০২৪ সালে সর্বোচ্চ ২৫৪ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় আসে জুনে। সেটিই একক মাস হিসেবে গত তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রবাসী আয়। এর আগে সর্বোচ্চ আয় এসেছিল ২০২০ সালের জুলাইয়ে, ২৫৯ কোটি ডলার। প্রবাসী আয় হলো দেশের ডলার জোগানের একমাত্র দায়বিহীন উৎস। কারণ এই আয়ের বিপরীতে কোনো বিদেশি মুদ্রা খরচ করতে হয় না অথবা কোনো দায় পরিশোধ করতে হয় না। ফলে প্রবাসী আয় যত বেশি আসবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তত বেশি শক্তিশালী হবে।
অর্থনীতিতে যে কিছুটা গতি ফিরেছে তার প্রমাণ মিলেছে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের সংগঠন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) ত্রৈমাসিক হালনাগাদ প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, দেশের অর্থনীতি সাময়িক উন্নতি করেছে। অস্থিতিশীলতা কাটিয়ে, বিশেষ করে আমদানি-রপ্তানি বৃদ্ধি এবং রিজার্ভের পতন ঠেকানোর মাধ্যমে পরিবর্তিত সময়ে প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখছে। তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি, সরকারি ব্যয় হ্রাস, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের গতি কমে যাওয়ার মতো চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে জানিয়েছে শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনটি।
২০২৪ সালের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন সম্পর্কে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, যে বছরটি শেষ হতে চলছে তার অর্থনীতিতে অনেক সমস্যা রয়েছে। রিজার্ভে সমস্যা। আমদানির সমস্যা। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। আরও সমস্যা আছে, যেমন ব্যাংক খাত। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সুফল মেলেনি।
তিনি বলেন, কিছু খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। রপ্তানির প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। রেমিট্যান্সের শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে ব্যাংক খাত, রিজার্ভের সমস্যা কাটেনি এখনো। অর্থনীতিতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য সরকার চেষ্টা করছে। তবে এর সুফল আসবে কি না, তা বলা মুশকিল।