
গত ৫ আগস্ট আশুলিয়া থানার সামনে পুলিশের গুলিতে আহত হয় হাফিজুর রহমান হাবিব (১৭)। পিঠে গুলি লাগায় তার স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি হয়েছে। বাম পা অবশ হয়ে গেছে। হাঁটাচলা করতে পারে না। বিছানাতেই প্রস্রাব-পায়খানা হয়ে যায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে চলছে তার চিকিৎসা। গত ৫ মাসের চিকিৎসায়ও হাবিবের অবস্থার উন্নতি হয়নি।
এখন তাকে বিদেশ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এটি খুশির খবর হলেও দুশ্চিন্তায় ঘুম আসে না হাবিবের বাবার। ছেলের চিকিৎসার জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে এরই মধ্যে চাকরি হারিয়েছেন তিনি। হাতে কোনো টাকাই নেই। বিদেশ যাওয়ার জন্য হাতে রাখতে বলা হয়েছে ৫০ হাজার থাই মুদ্রা। এত অর্থ কোথায় পাবেন তিনি!
একদিকে চিন্তা ছেলের সুস্থতা নিয়ে, অন্যদিকে চিন্তা আর্থিক সংকটে পরিবার চলবে কীভাবে! উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় এখন দিন কাটছে তার। শুধু তিনিই নন, গণ-অভ্যুত্থানে আহতদের অনেকের মধ্যে এবং তাদের পরিবারে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। মানসিকভাবে তারা অনেকটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। চিকিৎসার দীর্ঘসূত্রতায় তারা হতাশ।
এরই মধ্যে দুই দফা সড়কও অবরোধ করেছেন দুটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতরা। সর্বশেষ গত ২ জানুয়ারি শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করেন আন্দোলনে আহত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীনরা। তারা চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. রেজাউর রহমানের পদত্যাগ দাবি করেন। এরপর রাত ৯টার দিকে তারা হাসপাতাল পরিচালকের কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেন।
এর আগে গত ১৪ নভেম্বর ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) বা পঙ্গু হাসপাতালের সামনের সড়ক অবরোধ করেন আন্দোলনে আহতরা। ওই দিন সকালে আহতদের দেখতে পঙ্গু হাসপাতালে গিয়েছিলেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। তিনি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসার সময় বিক্ষোভের মুখে পড়েন। আহতরা তার গাড়ি আটকে দেন। এ সময় প্রশাসনের সহায়তায় উপদেষ্টা ওই হাসপাতাল ত্যাগ করেন। পরে দুপুর ১টার দিকে হুইল চেয়ারে বসে সড়কে বিক্ষোভ শুরু করেন আহতরা। রাত ৩টার দিকে কয়েকজন উপদেষ্টার আশ্বাসে তারা সড়ক ছাড়েন।
এই ঘটনার পর আহতদের চিকিৎসায় আরও গুরুত্ব দেওয়া হয়। গুরুতর আহত কয়েকজনকে পরপর বিদেশে পাঠানো হয়। স্বাস্থ্য সেলের তথ্য অনুযায়ী এ পর্যন্ত ১২ জনকে বিদেশ পাঠানো হয়েছে। আরও কয়েকজনকে পাঠানোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
আহতদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন তাদের যে ধরনের সাপোর্ট দরকার তা তারা ঠিকমতো পাচ্ছেন না। না পাচ্ছেন মানসিক সাপোর্ট, না পাচ্ছেন পর্যাপ্ত আর্থিক সাপোর্ট, না তারা খুশি চিকিৎসায়। আহতদের মধ্যে অনেকেই আছেন, যার আয়ের ওপর তার পুরো পরিবার নির্ভরশীল ছিল। এখন তিনি হাসপাতালের বিছানায়। সরকারিভাবে তার চিকিৎসা হচ্ছে। কিন্তু তার পরিবার কীভাবে চলছে? সরকারিভাবে তারা যে টাকা পেয়েছেন তা পর্যাপ্ত নয় বলে দাবি করেছেন।
প্রথমদিকে সরকারিভাবে আহতদের আর্থিক সহায়তা ১ লাখ টাকা করে দেওয়া হলেও পরে তা বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। গত ১ জানুয়ারি জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয়, ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ২২৮ জনকে ৪৭ কোটি ৩২ লাখ টাকার মতো সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকে জমা ১০৯ কোটি ২০ লাখ ২৩ হাজার টাকার মধ্যে এখনো অ্যাকাউন্টে ৬১ কোটি টাকার মতো আছে।
ঢামেকের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে চিকিৎসাধীন হাবিবের বাবা বলেন, আগে ছাত্ররা খোঁজ নিতে আসত। গত দুই মাসে কেউ খোঁজও নিতে আসেনি। হাবিবকে সপ্তাহখানেকের মধ্যে থাইল্যান্ড পাঠানোর কথা বলেছে। সঙ্গে আমিও যাব। সেখানে আমার ব্যক্তিগত যদি কোনো খরচ লাগে, ছেলেকে সরকারিভাবে যা খেতে দেবে তার বাইরে যদি তার কিছু খেতে ইচ্ছে করে বা হঠাৎ একটা ওষুধ যদি কিনে দেওয়া লাগে- সে জন্য আমাকে ৫০ হাজার থাই মুদ্রা নিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ছেলে আহত হওয়ার পর আমি দিশেহারা। আমার সংসার চলছে না। গার্মেন্টে চাকরি করে সংসার চালাতাম। চাকরিও চলে গেছে। এক লাখ টাকার চেক পেয়েছি। তাতে কিছুই হয়নি। এখন এত টাকা আমি কোথায় পাব। আমি যখন ছেলেকে নিয়ে থাইল্যান্ডে থাকব, তখন আমার পরিবারইবা চলবে কীভাবে?
এখানে চিকিৎসাধীন মোশাররফ হোসেনকেও বিদেশে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। তিনিও পোশাককর্মী। তার আয়ের ওপর ৭ জন নির্ভরশীল। তিনি জানান, খুব কষ্টে দিন কাটছে তার পরিবারের। চরম হতাশার মধ্যে রয়েছেন তিনি।
মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমার পা শুকিয়ে যাচ্ছে। মাংস হাড্ডির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। এক মাস ধরে চিকিৎসা বন্ধ। ডাক্তাররাও ঠিকমতো আসেন না। দেখেন না। পায়ে খুব যন্ত্রণা হয়। কবে বিদেশ পাঠানো হবে ঠিক করে কিছু বলছেনও না। হাসপাতালে আছি, এখন দেখারও কেউ নেই। সরকার থেকে এক লাখ টাকা পেয়েছি। তা অনেক আগেই খরচ হয়ে গেছে।’
পরিবার নিয়ে সীমাহীন কষ্টে থাকার কথা জানিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে কেঁদে তিনি বলেন, ‘মেয়ের ভর্তির টাকা পর্যন্ত দিতে পারছি না। জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে সহায়তার জন্য আবেদন করেছি। এক লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলেছে, কিন্তু কবে দেবে তার ঠিক নেই। আমার স্ত্রী ৪ বার গিয়ে ঘুরে এসেছেন।’
বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীনরা চান, সপ্তাহে অন্তত একবার করে কেউ যেন তাদের কাছে যান, তাদের চিকিৎসা এবং পরিবারের খোঁজখবর নেন, চিকিৎসাসংক্রান্ত বিষয়ে সঠিক তথ্য জানান এবং পরিবার নিয়ে ভালো থাকার অন্তত ভরসাটুকু চান তারা।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের মানসিক অবস্থা নিরূপণে একটি জরিপ করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা। এ বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মুনতাসীর মারুফ বলেন, ভর্তি থাকা ৫৫ জন পুরুষ রোগীর ওপর জরিপ করা হয়। এতে দেখা যায়, প্রায় তিন-চতুর্থাংশেরই (৭৪.৫%) বিষণ্নতার উপসর্গ রয়েছে। এক-চতুর্থাংশের (২৭.৩%) বেশি রোগীর বিষণ্নতা খুবই তীব্র মাত্রার। প্রায় অর্ধেকের বেশী রোগীর মৃদু থেকে খুবই তীব্র মাত্রার উদ্বেগ (৫৪.৫%) এবং স্ট্রেস বা মানসিক চাপ (৫৮.২%)-এর উপসর্গ রয়েছে।
অধ্যাপক ডা. মুনতাসীর মারুফ বলেন, ‘আমরা নিটোরে এবং এনআইওতে প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসক টিম পাঠিয়ে সেবা দিচ্ছি। ঢাকার অন্য যেসব প্রতিষ্ঠানে আহতরা চিকিৎসাধীন আছেন, সেখানকার সাইকিয়াট্রিক বিভাগ থেকে তাদের মাঝে মাঝে কাউন্সেলিং করা যেতে পারে। এ ছাড়া আর আমাদের কাছেও যদি সহযোগিতা চাওয়া হয়- আমরাও চেষ্টা করব টিম করে মাঝে মাঝে তাদের সেবা দেওয়ার, কাউন্সেলিং করার।’
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য উপ-কমিটির সদস্য এবং মানসিক সেবাদানকারী সংগঠন হোপওয়েভের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক (যোগাযোগ) মুনিমাহ মাহরিন বলেন, ‘মানসিক সেবা দেওয়ার জন্য হোপওয়েভ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে আহতদের এবং শহিদ পরিবারের সদস্যদের মানসিক সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করছি। এখন বিভিন্ন হাসপাতালে যারা ভর্তি আছেন, তাদের কাছে গিয়ে সেবা দিচ্ছি। সবাইকে সেবা দেওয়া এখনো সম্ভব হয়নি। পর্যায়ক্রমে দেওয়া হবে।’
গত ২১ ডিসেম্বর গণ-অভ্যুত্থানসংক্রান্ত বিশেষ সেলের ওয়েবসাইটে নিহত ও আহত ব্যক্তিদের প্রথম ধাপের খসড়া তালিকা প্রকাশ করা হয়। ওই পর্যন্ত দেশে ৬০ জেলার ৮৫৮ জন শহিদের নাম তালিকাভুক্ত হয়। এরপর চিকিৎসাধীন আরও একজন শহিদ হন। এ ছাড়া ১১ হাজার ৫৫১ জন আহতের নাম তালিকাভুক্ত হয়।
এখন ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ২০০ জনের মতো চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে নিটোরে ১০০ জনের মতো, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ৬০ জনের মতো, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫ জনের মতো। এ ছাড়া বাকিরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনিস্টটিউটে চিকিৎসাধীন। এদের মধ্যে ২৫ জনকে গুরুতর হিসেবে বিদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ইতোমধ্যে ১২ জনকে পাঠানো হয়েছে। তবে একটি সূত্র জানিয়েছে, বিদেশে পাঠানোর যে তালিকা করা হয়েছে, তাতে আরও অনেকের নাম যোগ হতে পারে। ২৫ জনের সঙ্গে আরও অন্তত জনাবিশেক যোগ হতে পারে।
আহতরা বলছেন, যাদের বিদেশ পাঠানো দরকার তাদের যেন দ্রুত বিদেশে পাঠানো হয়। আর যারা দেশে চিকিৎসা নেবেন, তাদের ডেডিকেটেড হাসপাতালে নিয়ে যেন স্ব-স্ব বিষয়ে চিকিৎসক নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। যারা শুধু আহত এই কয়জন সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তাদেরই চিকিৎসা দেবেন। সব বিষয়ের সমন্বয়ে মেডিকেল টিম গঠন করতে হবে। তারাই আহতদের সেবা দেবেন। আহতরা বলেন, ‘আমরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে দেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আর আপনারা আমাদের জন্য এতটুকু করতে পারবেন না?’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন শুধু আহতদের চিকিৎসার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তাদের পুনর্বাসনসহ অন্য আর্থসামাজিক বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে দেখভাল করা হবে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘আহতদের দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আর যাদের বিদেশে পাঠানো প্রয়োজন আমরা তাদের বিদেশে পাঠিয়ে সেরা চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করছি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কিছুটা ধীরগতি লক্ষ করা গেছে। আমাদের অনেকের আন্তরিক ইচ্ছা সত্ত্বেও চিকিৎসা ধীরে হয়েছে। তবে যাদের বিদেশে চিকিৎসা প্রয়োজন, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে আমরা তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘আহতদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং উদ্বেগ অস্থিরতা দূর করার জন্য যে উদ্যোগগুলো নিয়েছি সেগুলো আরও সম্প্রসারিত করা প্রয়োজন বলে মনে করছি। মূলত শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিকভাবে তাদের পাশে থাকা, সামাজিকভাবে তাদের সম্মানিত করা- এই দুটি কাজ না হলে শুধু শারীরিক চিকিৎসা দিয়ে আসলে তাদের এই কষ্ট থেকে বা অস্থিরতা থেকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব নয়।’