
ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আজিজুল আকিল ডেভিডের হাতে যেন ছিল ‘আলাদিনের চেরাগ’। কেননা দলীয় পদ-পদবি আর আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় মাত্র কয়েক বছরেই তিনি কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তার মদদদাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও ওয়াসার সাবেক এমডি তাকসিম এ খান। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা ও লিয়াকত সিকদারসহ আরও অনেকে ছিলেন তার সহযোগী।
কৃষকের সন্তান ডেভিড চাচাতো ভাই ছাত্রলীগের দাপুটে সাবেক সভাপতি লিয়াকত সিকদারের এবং নিজের রাজনৈতিক অবস্থানের প্রভাব খাটিয়ে দেশে-বিদেশে বিপুল অর্থে গড়ে তুলেছেন এক ডজনেরও বেশি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার হাতিয়ে নেওয়াসহ সরকারি প্রকল্পে যুক্ত হয়ে শক্তিশালী বলয় তৈরি করেন। এমনকি প্রভাব খাটিয়ে তিনি বিপুল অর্থ দেশের বাইরে পাচার করেছেন। তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশে গড়েছেন আবাসন ব্যবসা ও একাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান। ছাত্রলীগের সেই ডেভিড এখন আবার বিএনপি নেতা পরিচয়ে ফায়দা লোটার চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে।
গত কয়েক দিনের অনুসন্ধানে বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। তাতে জানা গেছে, চাচাতো ভাই লিয়াকত সিকদারের পরিচয় এবং নিজের বুয়েট শাখার সাবেক ছাত্রলীগ নেতার পরিচয়ে ডেভিড আওয়ামী লীগের পুরো সময়ে দাপটের সঙ্গে একচেটিয়া ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, সরকারি প্রকল্পের কাজ বাগিয়ে নেওয়াসহ তার নানা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ-কারবার করেন। এসব প্রকল্পে নিম্নমানের সরঞ্জাম ব্যবহার করে এবং নামকাওয়াস্তে কাজ দেখিয়ে ডেভিড হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল অর্থ। এসব ক্ষেত্রে পেছন থেকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেন সালমান এফ রহমান, ওয়াসার সাবেক এমডি তাকসিম এ খান, লিয়াকত সিকদারসহ আরও অনেকে। তাদের মদদেই ডেভিড মূলত কাজের নামে লুট করেছেন হাজার কোটি টাকা। পাচার করা অর্থে তুরস্কে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা গড়েছেন বলেও জানা গেছে। তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে আজিজুল আকিল ডেভিড দাবি করেছেন, তিনি কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি করেননি। তার প্রতিষ্ঠান নিয়ম মেনেই সবকিছু করেছে। অর্থ পাচারের অভিযোগও মিথ্যা-ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন তিনি।
গত ২০ আগস্ট লিয়াকত সিকদারের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। একই সঙ্গে তার স্ত্রী মাহমুদা আলী সিকদার এবং তাদের মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কম্পিউটার ওয়ার্ল্ড বিডির ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করা হয়েছে। তবে বর্তমানে লিয়াকত সিকদারের সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ডেভিড চালাচ্ছেন বলে তথ্য রয়েছে। রাজনীতি করে অবৈধভাবে আয় করা হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে একাধিকবার লিয়াকত সিকদারের নাম এলেও ডেভিড বরাবরই থেকে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
ডেভিড যেভাবে মাফিয়া
ডেভিডের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের মধুখালীতে। বাবা গোলাম আকিল সিকদার ওরফে ফটু সিকদার পেশায় ছিলেন কৃষক। গ্রামে পড়াশোনা শেষ করে ১৯৮৯-৯০ ব্যাচে ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট)। বুয়েটে পড়াশোনাকালে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যোগ দেন। একপর্যায়ে বুয়েট ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তবে পড়াশোনা শেষ করার আগেই ধর্ষণের অভিযোগে ডেভিড বুয়েট থেকে বহিষ্কৃত হন। সেখানে থেকে প্রথমে চাচাতো ভাই লিয়াকত সিকদারের সঙ্গে ব্যবসা করলেও পরে ‘অ্যারিডড গ্রুপ’ নামে নিজেই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। স্বল্প সময়ে গড়ে তোলা এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে টেন্ডার বা ঠিকাদারি প্রকল্প বাগিয়ে নেন ডেভিড। সরকারের হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ পেয়ে যান তিনি। এরপর ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হতে আর সময় লাগেনি ডেভিডের। প্রথমে ভাই লিয়াকত ও পরে সালমান এফ রহমান এবং ওয়াসার সাবেক এমডি তাকসিমের ছত্রচ্ছয়ায় সচিবালয়কেন্দ্রিকও গড়ে ওঠে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি প্রকল্পের অর্থ লুট করে ডেভিড হয়ে ওঠেন বিপুল টাকার মালিক ও টেন্ডার জগতের ‘মাফিয়া’।
ডেভিডের সম্পদের পাহাড়
ডেভিড গুলশান-২ এলাকার ১০২ নম্বর রোডের ৩৮ নম্বর হাউসে বসবাস করছেন বলে জানা যায়। এখানে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের দুটি ফ্ল্যাট নিয়ে থাকছেন তিনি। এ ছাড়া বাড্ডা, রামপুরা ও উত্তরায় একাধিক ফ্ল্যাট, উত্তরা, সাভার, গাজীপুর, ভৈরব ও ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে তার একাধিক প্লট রয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া তার অ্যারিডড গ্রুপের অধীনে রয়েছে ১৭টি প্রতিষ্ঠান। ওয়াসার সাবেক এমডি তাকসিমকে ব্যবহার করে বাগিয়ে নিয়েছেন সেনা কর্মকর্তাদের জন্য আবাসন প্রকল্প জলসিঁড়ি পাইলট প্রকল্প ও মেট্রোরেলের বিভিন্ন অংশের কাজ। এ ছাড়া সন্তানদের নামে দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় ফ্ল্যাট ও বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন তিনি। বড় মেয়ের নামে আমেরিকায় ও ছোট মেয়ের নামে অস্ট্রেলিয়ায় বাড়ি কিনেছেন বলে তথ্য রয়েছে।
ডেভিডের ১৭ প্রতিষ্ঠান
ডেভিডের মালিকানাধীন অ্যারিডড গ্রুপের অধীনে রয়েছে অন্তত ১৭টি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। যেগুলো হচ্ছে- ইলেকট্রোমেকানিক ইঞ্জিনিয়ারিং, পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং, কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট, ফাউন্ডেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, আর্থওয়ার্কস ইঞ্জিনিয়ারিং, ড্রিলিং ইঞ্জিনিয়ারিং, রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং, ওয়াটার অ্যান্ড ওয়েস্ট ওয়াটার ইঞ্জিনিয়ারিং, টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইনফরমেশন টেকনোলজি, ফায়ার প্রটেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং, অপারেশন অব মেইনটেন্যান্স, কনস্ট্রাকশন এগ্রিগেটস, ইঞ্জিনিয়ার সার্ভেয়িং, মাস্টার্ড অয়েল এক্সট্রাকশন প্ল্যান্ট, ইম্পোর্ট অ্যান্ড এক্সম্পোর্টস এবং রিয়েল এস্টেটস। এর বাইরেও ঠিকাদারি কাজ পাওয়ার জন্য টেন্ডারের জন্য আরও একাধিক প্রতিষ্ঠান গড়েছেন বলেও তথ্য রয়েছে।
সরকারি প্রকল্পের কাজ নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি
আওয়ামী লীগের দাপটে এবং প্রভাবশালী নেতাদের মদদপুষ্ট হয়ে ডেভিড মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে পদ্মা (জশলদিয়া) ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট প্রকল্প ও দাশেরকান্দি পয়োশোধনাগার প্রকল্পের কাজ বাগিয়ে নেন। যেখানে ইতোমধ্যেই ব্যাপক দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্প দুটির কাজ করেছে ডেভিডের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
এ ছাড়া রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ২২০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ঢাকা ওয়াসার দুটি পাম্পিং স্টেশন নির্মাণেও হয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতি। নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহার ছাড়াও এই দুটি প্রকল্পে মোটা অঙ্কের অর্থ লোপাট করেছেন ডেভিড। অন্যদিকে ঘাটে ঘাটে লোকজন লাগিয়ে রেখে জলসিঁড়ি প্রকল্পের লেক ও পাইপলাইনসহ অন্যান্য কাজের ঠিকাদারি হাতিয়ে নেন তিনি। কাজ করেছেন মেট্রোরেলের মতো বৃহৎ প্রকল্পে। মেট্রোরেলের যন্ত্রাংশ, বগি, রেলওয়ে ইঞ্জিন ও পাইপলাইনের কাজ করেছেন। এ ছাড়া হাতিরঝিল প্রকল্প ও আফতাবনগর প্রকল্পে কাজ করার নামে তার বিরুদ্ধে নজিরবিহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য পাওয়া যায়। এর বাইরেও ৬০ কোটি লিটার বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে সক্ষম পদ্মা (জশলদিয়া) ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের (পর্যায়-১) পানি শোধনাগার প্রকল্পের লাইন নির্মাণে ৬০০ কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন বলে অভিযোগ আছে।
পাশাপাশি ডেভিড দাশেরকান্দি পয়োশোধনাগার প্রকল্পেও নিম্নমানের যন্ত্রাংশ ব্যবহারসহ নানাভাবে বিপুল টাকার দুর্নীতি করেছেন বলে তথ্য রয়েছে। তার নিম্নমানের কাজ ও যন্ত্রাংশের কারণে এই প্রকল্পে প্রতিবছর ওয়াসা গচ্চাও দিচ্ছে গড়ে ২০০ কোটি টাকা। কারণ রাজধানীবাসীর পয়োবর্জ্য পরিবেশবান্ধব উপায়ে শোধন করতে দাশেরকান্দি পয়োশোধনাগার প্রকল্প গ্রহণ করে ঢাকা ওয়াসা। এটি একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ হলেও বর্জ্য সংগ্রহের জন্য পাইপলাইন তৈরি না করায় উদ্বোধনের দুই বছরেও কোনো গ্রাহককে সেবার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তাদের হিসাবমতে, দাশেরকান্দি পয়োশোধনাগারে যন্ত্রপাতি কেনায় ৬০০ কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। তবে ওয়াসার কর্মকর্তাদের মতে, এই প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৪০০ কোটি টাকা।
এদিকে ২২০ কোটি টাকায় রামপুরা ও কমলাপুরে দুটি পাম্পের কাজ করে চীনের প্রতিষ্ঠান সিএএমসি ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। এ কোম্পানির বাংলাদেশি এজেন্ট ছিল ডেভিডের ঠিকাদারি কোম্পানি। আধুনিক প্রযুক্তির এই স্টেশনে নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের কারণে মাঝে মাঝেই একেকটি যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। যখনই নষ্ট হচ্ছে, তখনই মেরামতের জন্য লাগছে ২০-২৫ লাখ টাকা।
সম্প্রতি রামপুরা পাম্পিং স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, স্টেশনটি তৈরির জন্য রামপুরা ব্রিজের পাশে একটি স্লুইসগেট তৈরি করা হয়েছে। গেট দিয়ে সেই পানি পাম্পিং স্টেশনের সঙ্গে যুক্ত একটি ওয়াটার পন্ডে জমা হয়। সেই পানি নিষ্কাশনের জন্য মূল স্টেশনে রয়েছে তিনতলার একটি অবকাঠামো। মূল মেশিনারিজগুলো তৃতীয় তলায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে। আর নিচতলায় রয়েছে পাঁচটি পাম্পের সেটআপ। একেকটি পাম্পের প্রতি সেকেন্ডে পাঁচ হাজার লিটার পানি নিষ্কাশনের ক্ষমতা থাকার কথা, কিন্তু ইঞ্জিন চালু থাকা সত্ত্বেও সেগুলো থেকে সেই পরিমাণ পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। একই অবস্থায় রয়েছে কমলাপুর পাম্পিং স্টেশনও।
এ বিষয়ে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিগত সরকারের আমলে বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি করে অর্থ লুট করা হয়েছে। ওয়াসার গচ্চা গেছে হাজার হাজার কোটি টাকা।’ ডেভিডের প্রকল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শুধু ডেভিড না, যারা অনিয়ম-দুর্নীতি করে সরকারের টাকা লুট করেছেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পাশাপাশি আমরাও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’
ভোল পাল্টে বিএনপির নেতা পরিচয়ে ফায়দা লোটার চেষ্টা
বর্তমানে ওয়াসার কাজ করার জন্য এবং বহাল তবিয়তে থাকতে ফরিদপুরে ডেভিড নিজেকে বিএনপির নেতা পরিচয়ে নতুন করে ফায়দা লোটার চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে। বর্তমানে বিএনপির একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে সখ্য গড়ে দলের বড় পদ পাওয়ার জন্য বিপুল টাকা ব্যয় করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে ডেভিডের বক্তব্য
প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে ডেভিড খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকারি এসব প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি করার সুযোগ নেই। কোনো কোম্পানির যোগ্যতা না থাকলে তারা এসব কাজ বাগিয়ে নিতে পারে না। এ ছাড়া আমার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যা করেছে, তা নিয়ম মেনেই করেছে। এখানে অর্থ লুটের কোনো সুযোগ নেই।’