ঢাকা ৯ চৈত্র ১৪৩১, রোববার, ২৩ মার্চ ২০২৫
English

সালমান-তাকসিমের মদদে ডেভিড যেভাবে মাফিয়া

প্রকাশ: ০৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:০৭ এএম
আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:১৬ এএম
সালমান-তাকসিমের মদদে ডেভিড যেভাবে মাফিয়া
খবরের কাগজ ইনফোগ্রাফিকস

ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আজিজুল আকিল ডেভিডের হাতে যেন ছিল ‘আলাদিনের চেরাগ’। কেননা দলীয় পদ-পদবি আর আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় মাত্র কয়েক বছরেই তিনি কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তার মদদদাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও ওয়াসার সাবেক এমডি তাকসিম এ খান। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা ও লিয়াকত সিকদারসহ আরও অনেকে ছিলেন তার সহযোগী। 

কৃষকের সন্তান ডেভিড চাচাতো ভাই ছাত্রলীগের দাপুটে সাবেক সভাপতি লিয়াকত সিকদারের এবং নিজের রাজনৈতিক অবস্থানের প্রভাব খাটিয়ে দেশে-বিদেশে বিপুল অর্থে গড়ে তুলেছেন এক ডজনেরও বেশি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার হাতিয়ে নেওয়াসহ সরকারি প্রকল্পে যুক্ত হয়ে শক্তিশালী বলয় তৈরি করেন। এমনকি প্রভাব খাটিয়ে তিনি বিপুল অর্থ দেশের বাইরে পাচার করেছেন। তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশে গড়েছেন আবাসন ব্যবসা ও একাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান। ছাত্রলীগের সেই ডেভিড এখন আবার বিএনপি নেতা পরিচয়ে ফায়দা লোটার চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে।

গত কয়েক দিনের অনুসন্ধানে বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। তাতে জানা গেছে, চাচাতো ভাই লিয়াকত সিকদারের পরিচয় এবং নিজের বুয়েট শাখার সাবেক ছাত্রলীগ নেতার পরিচয়ে ডেভিড আওয়ামী লীগের পুরো সময়ে দাপটের সঙ্গে একচেটিয়া ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, সরকারি প্রকল্পের কাজ বাগিয়ে নেওয়াসহ তার নানা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ-কারবার করেন। এসব প্রকল্পে নিম্নমানের সরঞ্জাম ব্যবহার  করে এবং নামকাওয়াস্তে কাজ দেখিয়ে ডেভিড হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল অর্থ। এসব ক্ষেত্রে পেছন থেকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেন সালমান এফ রহমান, ওয়াসার সাবেক এমডি তাকসিম এ খান, লিয়াকত সিকদারসহ আরও অনেকে। তাদের মদদেই ডেভিড মূলত কাজের নামে লুট করেছেন হাজার কোটি টাকা। পাচার করা অর্থে তুরস্কে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা গড়েছেন বলেও জানা গেছে। তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে আজিজুল আকিল ডেভিড দাবি করেছেন, তিনি কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি করেননি। তার প্রতিষ্ঠান নিয়ম মেনেই সবকিছু করেছে। অর্থ পাচারের অভিযোগও মিথ্যা-ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন তিনি। 

গত ২০ আগস্ট লিয়াকত সিকদারের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। একই সঙ্গে তার স্ত্রী মাহমুদা আলী সিকদার এবং তাদের মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কম্পিউটার ওয়ার্ল্ড বিডির ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করা হয়েছে। তবে বর্তমানে লিয়াকত সিকদারের সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ডেভিড চালাচ্ছেন বলে তথ্য রয়েছে। রাজনীতি করে অবৈধভাবে আয় করা হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে একাধিকবার লিয়াকত সিকদারের নাম এলেও ডেভিড বরাবরই থেকে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

ডেভিড যেভাবে মাফিয়া

ডেভিডের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের মধুখালীতে। বাবা গোলাম আকিল সিকদার ওরফে ফটু সিকদার পেশায় ছিলেন কৃষক। গ্রামে পড়াশোনা শেষ করে ১৯৮৯-৯০ ব্যাচে ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট)। বুয়েটে পড়াশোনাকালে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যোগ দেন। একপর্যায়ে বুয়েট ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তবে পড়াশোনা শেষ করার আগেই ধর্ষণের অভিযোগে ডেভিড বুয়েট থেকে বহিষ্কৃত হন। সেখানে থেকে প্রথমে চাচাতো ভাই লিয়াকত সিকদারের সঙ্গে ব্যবসা করলেও পরে ‘অ্যারিডড গ্রুপ’ নামে নিজেই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। স্বল্প সময়ে গড়ে তোলা এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে টেন্ডার বা ঠিকাদারি প্রকল্প বাগিয়ে নেন ডেভিড। সরকারের হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ পেয়ে যান তিনি। এরপর ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হতে আর সময় লাগেনি ডেভিডের। প্রথমে ভাই লিয়াকত ও পরে সালমান এফ রহমান এবং ওয়াসার সাবেক এমডি তাকসিমের ছত্রচ্ছয়ায় সচিবালয়কেন্দ্রিকও গড়ে ওঠে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি প্রকল্পের অর্থ লুট করে ডেভিড হয়ে ওঠেন বিপুল টাকার মালিক ও টেন্ডার জগতের ‘মাফিয়া’। 

ডেভিডের সম্পদের পাহাড়

ডেভিড গুলশান-২ এলাকার ১০২ নম্বর রোডের ৩৮ নম্বর হাউসে বসবাস করছেন বলে জানা যায়। এখানে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের দুটি ফ্ল্যাট নিয়ে থাকছেন তিনি। এ ছাড়া বাড্ডা, রামপুরা ও উত্তরায় একাধিক ফ্ল্যাট, উত্তরা, সাভার, গাজীপুর, ভৈরব ও ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে তার একাধিক প্লট রয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া তার অ্যারিডড গ্রুপের অধীনে রয়েছে ১৭টি প্রতিষ্ঠান। ওয়াসার সাবেক এমডি তাকসিমকে ব্যবহার করে বাগিয়ে নিয়েছেন সেনা কর্মকর্তাদের জন্য আবাসন প্রকল্প জলসিঁড়ি পাইলট প্রকল্প ও মেট্রোরেলের বিভিন্ন অংশের কাজ। এ ছাড়া সন্তানদের নামে দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় ফ্ল্যাট ও বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন তিনি। বড় মেয়ের নামে আমেরিকায় ও ছোট মেয়ের নামে অস্ট্রেলিয়ায় বাড়ি কিনেছেন বলে তথ্য রয়েছে। 

ডেভিডের ১৭ প্রতিষ্ঠান

ডেভিডের মালিকানাধীন অ্যারিডড গ্রুপের অধীনে রয়েছে অন্তত ১৭টি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। যেগুলো হচ্ছে- ইলেকট্রোমেকানিক ইঞ্জিনিয়ারিং, পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং, কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট, ফাউন্ডেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, আর্থওয়ার্কস ইঞ্জিনিয়ারিং, ড্রিলিং ইঞ্জিনিয়ারিং, রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং, ওয়াটার অ্যান্ড ওয়েস্ট ওয়াটার ইঞ্জিনিয়ারিং, টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইনফরমেশন টেকনোলজি, ফায়ার প্রটেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং, অপারেশন অব মেইনটেন্যান্স, কনস্ট্রাকশন এগ্রিগেটস, ইঞ্জিনিয়ার সার্ভেয়িং, মাস্টার্ড অয়েল এক্সট্রাকশন প্ল্যান্ট, ইম্পোর্ট অ্যান্ড এক্সম্পোর্টস এবং রিয়েল এস্টেটস। এর বাইরেও ঠিকাদারি কাজ পাওয়ার জন্য টেন্ডারের জন্য আরও একাধিক প্রতিষ্ঠান গড়েছেন বলেও তথ্য রয়েছে।

সরকারি প্রকল্পের কাজ নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি

আওয়ামী লীগের দাপটে এবং প্রভাবশালী নেতাদের মদদপুষ্ট হয়ে ডেভিড মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে পদ্মা (জশলদিয়া) ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট প্রকল্প ও দাশেরকান্দি পয়োশোধনাগার প্রকল্পের কাজ বাগিয়ে নেন। যেখানে ইতোমধ্যেই ব্যাপক দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্প দুটির কাজ করেছে ডেভিডের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। 

এ ছাড়া রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ২২০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ঢাকা ওয়াসার দুটি পাম্পিং স্টেশন নির্মাণেও হয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতি। নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহার ছাড়াও এই দুটি প্রকল্পে মোটা অঙ্কের অর্থ লোপাট করেছেন ডেভিড। অন্যদিকে ঘাটে ঘাটে লোকজন লাগিয়ে রেখে জলসিঁড়ি প্রকল্পের লেক ও পাইপলাইনসহ অন্যান্য কাজের ঠিকাদারি হাতিয়ে নেন তিনি। কাজ করেছেন মেট্রোরেলের মতো বৃহৎ প্রকল্পে। মেট্রোরেলের যন্ত্রাংশ, বগি, রেলওয়ে ইঞ্জিন ও পাইপলাইনের কাজ করেছেন। এ ছাড়া হাতিরঝিল প্রকল্প ও আফতাবনগর প্রকল্পে কাজ করার নামে তার বিরুদ্ধে নজিরবিহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য পাওয়া যায়। এর বাইরেও ৬০ কোটি লিটার বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে সক্ষম পদ্মা (জশলদিয়া) ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের (পর্যায়-১) পানি শোধনাগার প্রকল্পের লাইন নির্মাণে ৬০০ কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন বলে অভিযোগ আছে।

পাশাপাশি ডেভিড দাশেরকান্দি পয়োশোধনাগার প্রকল্পেও নিম্নমানের যন্ত্রাংশ ব্যবহারসহ নানাভাবে বিপুল টাকার দুর্নীতি করেছেন বলে তথ্য রয়েছে। তার নিম্নমানের কাজ ও যন্ত্রাংশের কারণে এই প্রকল্পে প্রতিবছর ওয়াসা গচ্চাও দিচ্ছে গড়ে ২০০ কোটি টাকা। কারণ রাজধানীবাসীর পয়োবর্জ্য পরিবেশবান্ধব উপায়ে শোধন করতে দাশেরকান্দি পয়োশোধনাগার প্রকল্প গ্রহণ করে ঢাকা ওয়াসা। এটি একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ হলেও বর্জ্য সংগ্রহের জন্য পাইপলাইন তৈরি না করায় উদ্বোধনের দুই বছরেও কোনো গ্রাহককে সেবার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তাদের হিসাবমতে, দাশেরকান্দি পয়োশোধনাগারে যন্ত্রপাতি কেনায় ৬০০ কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। তবে ওয়াসার কর্মকর্তাদের মতে, এই প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৪০০ কোটি টাকা। 

এদিকে ২২০ কোটি টাকায় রামপুরা ও কমলাপুরে দুটি পাম্পের কাজ করে চীনের প্রতিষ্ঠান সিএএমসি ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। এ কোম্পানির বাংলাদেশি এজেন্ট ছিল ডেভিডের ঠিকাদারি কোম্পানি। আধুনিক প্রযুক্তির এই স্টেশনে নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের কারণে মাঝে মাঝেই একেকটি যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। যখনই নষ্ট হচ্ছে, তখনই মেরামতের জন্য লাগছে ২০-২৫ লাখ টাকা। 

সম্প্রতি রামপুরা পাম্পিং স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, স্টেশনটি তৈরির জন্য রামপুরা ব্রিজের পাশে একটি স্লুইসগেট তৈরি করা হয়েছে। গেট দিয়ে সেই পানি পাম্পিং স্টেশনের সঙ্গে যুক্ত একটি ওয়াটার পন্ডে জমা হয়। সেই পানি নিষ্কাশনের জন্য মূল স্টেশনে রয়েছে তিনতলার একটি অবকাঠামো। মূল মেশিনারিজগুলো তৃতীয় তলায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে। আর নিচতলায় রয়েছে পাঁচটি পাম্পের সেটআপ। একেকটি পাম্পের প্রতি সেকেন্ডে পাঁচ হাজার লিটার পানি নিষ্কাশনের ক্ষমতা থাকার কথা, কিন্তু ইঞ্জিন চালু থাকা সত্ত্বেও সেগুলো থেকে সেই পরিমাণ পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। একই অবস্থায় রয়েছে কমলাপুর পাম্পিং স্টেশনও। 

এ বিষয়ে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিগত সরকারের আমলে বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি করে অর্থ লুট করা হয়েছে। ওয়াসার গচ্চা গেছে হাজার হাজার কোটি টাকা।’ ডেভিডের প্রকল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শুধু ডেভিড না, যারা অনিয়ম-দুর্নীতি করে সরকারের টাকা লুট করেছেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পাশাপাশি আমরাও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’ 

ভোল পাল্টে বিএনপির নেতা পরিচয়ে ফায়দা লোটার চেষ্টা

বর্তমানে ওয়াসার কাজ করার জন্য এবং বহাল তবিয়তে থাকতে ফরিদপুরে ডেভিড নিজেকে বিএনপির নেতা পরিচয়ে নতুন করে ফায়দা লোটার চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে। বর্তমানে বিএনপির একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে সখ্য গড়ে দলের বড় পদ পাওয়ার জন্য বিপুল টাকা ব্যয় করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে ডেভিডের বক্তব্য

প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে ডেভিড খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকারি এসব প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি করার সুযোগ নেই। কোনো কোম্পানির যোগ্যতা না থাকলে তারা এসব কাজ বাগিয়ে নিতে পারে না। এ ছাড়া আমার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যা করেছে, তা নিয়ম মেনেই করেছে। এখানে অর্থ লুটের কোনো সুযোগ নেই।’

আওয়ামী লীগ ইস্যুতে অনৈক্যে উদ্বেগ অস্থিরতা

প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২৫, ০১:৫৩ পিএম
আওয়ামী লীগ ইস্যুতে অনৈক্যে উদ্বেগ অস্থিরতা
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর সম্ভবত রাজনীতিতে এতটা উত্তাপ আর কখনো দেখা যায়নি। সংস্কার নাকি নির্বাচন, কোনটি আগে- এ নিয়ে রাজনীতিতে তর্ক-বিতর্ক থাকলেও আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন ইস্যুতে দেশে এই প্রথম প্রচণ্ড রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়িয়েছে। বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) আওয়ামী লীগবিরোধী বলে পরিচিত দলগুলোর মধ্যে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি অস্থিরতা দৃশ্যমান।

বস্তুত, আওয়ামী লীগ ইস্যুতে রাজনীতিকদের বক্তব্য এক জায়গায় স্থির থাকছে না, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিপরীতমুখী অবস্থান দৃশ্যমান হচ্ছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো; এই ইস্যুতে আবার সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, খোদ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধেও বক্তব্য উঠে আসছে। ফলে জনমনে প্রচণ্ড উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ছে। রাজনৈতিক অঙ্গনেও ছড়িয়ে পড়ছে একধরনের অস্থিরতা। অফিস-আদালত থেকে শুরু করে সচেতন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবর্ত্র একটাই আলোচনা, কী হচ্ছে, কী হবে? 

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেনাবাহিনীর সঙ্গে আলোচনা-সংশ্লিষ্ট দুটি পোস্ট গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় গত শুক্রবার সন্ধ্যায় নানা গুঞ্জন তৈরি হয়। গত দুই দিন কিছু কিছু জায়গায় সেনাবাহিনীর টহল জোরদার করায় এই গুঞ্জন কিছুটা বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়ে আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করে। গতকাল শনিবার সুশীল সমাজের দু-একজন নাগরিকও সিনিয়র সাংবাদিকদের কাছে ফোন করে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। তবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ সেনাবাহিনী সম্পর্কে ইতিবাচক বক্তব্য দেওয়ায় পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। 

বিদ্যমান পরিস্থিতি বিচেনায় নিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গতকাল বলেছেন, ‘রাজনীতিতে মতভিন্নতা থাকলেও ফ্যাসিবাদ পুনর্বাসন প্রশ্নে কোনো আপোস হবে না।’ তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত থাকতে পারে, তবে সমস্যা সৃষ্টি হলে আলোচনায় বসব। যেকোনো মূল্যে ঐক্য ধরে রাখতে হবে, যাতে করে পতিত স্বৈরাচার শক্তি আমাদের কাঁধে চেপে বসতে না পারে।’

পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ খবরের কাগজকে বলেন, ‘কোনো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন চায়, এটা আমার কাছে মনে হয় না। সবাই ফ্যাসিবাদী রাজনীতির কবর কামনা করে। এখানে মতপার্থক্যটা হলো, আওয়ামী লীগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত কীভাবে হবে।’ 

তিনি বলেন, ‘বিএনপি বলেছে জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে। আমার মনে হয় এটাই বিএনপির অবস্থান। আওয়ামী লীগ জনগণের ওপর যে অত্যাচার-নির্যাতন করেছে, দেশের ক্ষতি করে বিদেশে অর্থ পাচার করেছে, এসব কারণেই তাদের আর গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে রাখবে না। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে পরিত্যাগ করেছে, ছুড়ে ফেলে দিয়েছে জনগণ। সেই অবস্থা এখনো অব্যাহত রয়েছে।’ 

‘সবাই আওয়ামী লীগের অপরাধের বিচার চায়। এখানে কারও দ্বিমত নেই। কাজেই যত দ্রুত বিচার হবে, ততই দেশের জন্য ভালো। কারণ একটা সমস্যার কিছুটা ফয়সালা হয় এবং সেটা হওয়া উচিত’ যোগ করেন দেশের বিশিষ্ট এই নাগরিক। তিনি বলেন, ‘যারা বিচারের দায়িত্বে আছেন, তাদের আরও তৎপরতার সঙ্গে কাজ করে এর সমাধান করা উচিত। আমি মনে করি, বিচার-প্রক্রিয়া নিষ্পত্তি হলে এ-সংক্রান্ত যে মতপার্থক্য আছে তা অনেকটাই কেটে যাবে।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। তারা নির্বাচনে অংশ নিতে চায়, তারা তাদের অধিকার চায়। কিন্তু তারা তো দায়িত্ব পালন করেনি। কোনো দায়ও নেয়নি। তাই সহিংসতা, খুন ও বহু মানুষকে আহত করার ঘটনায় বহু লোক ক্ষুব্ধ। মানুষের মধ্যে এখনো ক্ষোভ আছে।’ তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ বাড়লে জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়বে, এটাই স্বভাবিক। তাই জনমনে যাতে উদ্বেগ না দেখা যায়, সে জন্য সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।’ 

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ছাত্রদের অনৈক্য অনেক দিন ধরেই চলছে। এটা অস্বাভাবিক নয়। বাংলাদেশের এলিট শ্রেণি- বিএনপি, আওয়ামী লীগ, সেনাবাহিনী বা সিভিল সার্ভিসের বিরুদ্ধেই ছিল ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান। কারণ তারা একটা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত চায়। যেখানে এলিট শ্রেণির কোনো রুল থাকবে না। এ জন্য এই এলিট শ্রেণিরা এখন এক হয়ে যাচ্ছে। ফলে আমার কাছে মনে হচ্ছে, এটা এখন শ্রেণি বিভাজন। শ্রেণিগত অনৈক্য দেখা দিলে একটা ভয় বা শঙ্কা থাকে।’

তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোকে এখন সবচেয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। গণ-অভ্যুত্থানের ছাত্রদের চাওয়া-পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে দলগুলোকে ধারণ করতে হবে। সেটাকে ধারণ না করতে পারলে আগামী দিনে হয়তো ভয়াবহ সংঘর্ষময় পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। আমি মনে করি, ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত মেনে নিলে সংঘাতের আশঙ্কা থাকবে না। 

রাজনীতিতে অনৈক্য
গত বৃহস্পতিবার রাতে প্রথম জাতীয় নাগরিক পার্টির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহর একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে তোলপাড় শুরু হয়। এতে তিনি লিখেছেন, “রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ নামে নতুন একটি ষড়যন্ত্র নিয়ে আসার পরিকল্পনা চলছে। এই পরিকল্পনা পুরোপুরি ভারতের। আমিসহ আরও দুইজনের কাছে ক্যান্টনমেন্ট থেকে এই পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয় ১১ই মার্চ দুপুর ২:৩০-এ।”

হাসনাত আবদুল্লাহর এই পোস্টকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। এ রকম পরিস্থিতির মধ্যেই বৃহস্পতিবার রাতেই ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিনিধিদের প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই।

প্রধান উপদেষ্টার এমন বক্তব্যের পর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে এনসিপি। দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ কর্তৃক সংঘটিত পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা হত্যাকাণ্ড, আগ্রাসনবিরোধী আন্দোলনে হত্যাকাণ্ড, গুম-ক্রসফায়ার, ভোট ডাকাতিসহ জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রশ্নে কার্যকর অগ্রগতি দৃশ্যমান হওয়ার আগে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল পদ থেকে এ ধরনের বক্তব্য অনাকাঙ্ক্ষিত। এরপর গতকাল নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের চেষ্টা কঠোর হস্তে দমন করা হবে।’ আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল করে বিচার-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দলটিকে নিষিদ্ধ করারও দাবি জানান তিনি। 

এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘গণহত্যার বছর না ঘুরতেই আওয়ামী লীগকে ফেরানোর খায়েশ বিপজ্জনক।’

এরই মধ্যে আগুনে ঘি ঢালে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বক্তব্য। তিনি বলেন, হত্যা ও লুটপাটে জড়িত নয়, এমন কারও নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বাধা নেই। পরবর্তী সময়ে তার এই বক্তব্য নিয়ে বিএনপির মধ্যে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। পাশাপাশি ফেসবুকেও এই বক্তব্যের পক্ষে-বিপক্ষে নানা মতও তুলে ধরেন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা। যদিও রিজভীর এই বক্তব্য ব্যক্তিগত, দলের নয় বলে জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য মির্জা আব্বাস। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘রিজভীর বক্তব্য তার একান্ত ব্যক্তিগত। বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে কোনো আলোচনা হয়নি।’ তবে গণমাধ্যম রিজভীর বক্তব্য আংশিক তুলে ধরেছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

তারেক রহমানের বক্তব্য উদ্ধৃত করে মির্জা আব্বাস বলেন, ‘পলাতক স্বৈরাচারের দোসরদের পুনর্বাসনের সুযোগ দেওয়া যাবে না। এটাই দলীয় অবস্থান। গণহত্যার দায়ে অভিযুক্তদের রাজনীতি করার কোনো সুযোগ নেই।’ 

অন্যদিকে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘জনগণ আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন কোনোভাবেই মেনে নেবে না। তার মতে, জনগণের প্রধান চাওয়া গণহত্যার বিচারের নিশ্চয়তা। 

গতকাল চলমান সাম্প্রতিক আলোচনা প্রসঙ্গে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, ‘রাজনীতিতে আবার ফেরার জন্য আওয়ামী লীগ নিজে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। আমরা কেউ কেউ, যারা খুব গুরুত্বপূর্ণ লোকজন, ঝগড়া করে ফোকাস করে তাদের সবার সামনে নিয়ে আসছি।’ 

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গুলশানে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে আমি এখনই কোনো কমেন্ট করব না। দয়া করে ওদিকে ডাইভার্ট করবেন না।’

আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু খবরের কাগজকে বলেন, “আমরাও ‘ইনক্লুসিভ’ ইলেকশন চাই। আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আনতে আমাদের আপত্তি নেই। তবে তার আগে তারা আমাদের ভাইবোনদের জীবনগুলো ফেরত দিতে হবে। বিদেশে পাচার করা অর্থের হিসাব দিতে হবে। ইনক্লুসিভ ইলেকশনের নামে আবার ফ্যাসিবাদকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করলে আমাদের লাশ ও রক্তের ওপর দিয়ে করতে হবে।’ 

গতকাল এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেছেন, ‘দেশের মানুষ জীবন দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, আওয়ামী লীগ এ দেশে আর রাজনীতি করতে পারবে না। যে ভাইয়েরা রাজপথে জীবন দিয়েছেন, তাদের রক্তের শপথ আমাদের শরীরে একবিন্দু রক্ত থাকতে আওয়ামী লীগকে রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না।’

গত দুই দিনে নেতাদের এই নানামুখী প্রতিক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্যের চিত্র ফুটে উঠছে। আর এ কারণেই জনমনে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। বলা হচ্ছে, যারা একসঙ্গে শেখ হাসিনার পতন ঘটিয়েছে, তাদের মধ্যে এই অনৈক্যের শেষ কোথায়? তাহলে কি নির্বাচন পিছিয়ে যাবে, সংস্কার কি বাধাগ্রস্ত হবে- এমন প্রশ্ন উঠছে জনমনে। 

এ প্রসঙ্গে ড. মাহবুব উল্লাহ আরও বলেন, ‘হাসনাত আবদুল্লাহর ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে একটা ঘটনা বেরিয়ে আসছে। এটার ভালো-মন্দ দুই দিকই আছে। আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের যে উপায়ের কথা বলা হয়েছে তা বন্ধ হয়ে যাবে; এবং যারা চিন্তাভাবনা করছে তাদের নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হবে। সামগ্রিকভাবে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কারও কোনো অভিযোগ থাকা উচিত নয়। ছাত্রদের আবেগ ও অনুভূতিকে মূল্য দিতে হবে। তাহলে বিষয়টা সহজ হবে। দেশের জন্য তারুণ্যর এই শক্তির প্রয়োজন আছে।’ 

সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে বিতর্ক 
৫ আগস্টের ঘটনায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা সবদিক থেকেই ইতিবাচক ছিল। বলা হয়, সেনাবাহিনী ছাত্রদের পক্ষে না দাঁড়ালে ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থান সফল নাও হতে পারত। তবে হঠাৎ করেই হাসনাত আবদুল্লাহর পোস্টকে কেন্দ্র করে কিছুটা বিতর্ক তৈরি হয়।

তবে গতকাল হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘সেনাবাহিনীর ওপর পূর্ণ আস্থা ও সমর্থন আছে। তবে কেউ তাদের ব্যবহার করে চক্রান্ত করতে চাইলে মানা হবে না। ক্যান্টনমেন্ট থেকে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে হস্তক্ষেপ ২৪-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি মেনে নেব না।’ 

তবে এই বিতর্কে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী সরাসরি কোনো কথা বলেনি। বরং গতকাল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সরকার এবং সেনাবাহিনীর ভূমিকার প্রতি বিএনপির আস্থা আছে। সেনাবাহিনী আগেও সহযোগিতা করেছে, আগামীতেও করবে।

ফাউন্ডেশন ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (এফএসডিএস) চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবর খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা একটা কঠিন সময় পার করছি, এটা কারোরই কাম্য নয়। ছাত্র-জনতা ও সেনাবাহিনীর একে অপরের প্রতিপক্ষ হওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয় এবং এখানে আমাদের আরও সতর্ক ও সংযত থাকতে হবে। জনসমর্থন কিন্তু ম্যাচুরিটি প্রমাণ করে না। দেশের বহুমাত্রিকতাকে রক্ষা ও গতিশীলতা রক্ষার জন্য সব থেকে দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়।’ 

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত দেশের বর্তমান বাস্তবতা দেখে করতে হবে। দেশের ১৮ কোটি সাধারণ জনগণ কী চায়? নির্বাচনে অংশ নিলে তারা ক্যাম্পেইন করতে পারবে কি না? তাই সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। দেশের অস্থিরতা রুখতে বাস্তবতার নিরিখে অন্তর্বর্তী সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বিদ্যানন্দের উদ্যোগ সাহরির আয়োজনে সবার কদর সমান

প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২৫, ০৮:৫২ এএম
সাহরির আয়োজনে সবার কদর সমান
চট্টগ্রাম নগরের ষোলশহর বিপ্লব উদ্যানের প্যান্ডেলে সাহরি খাচ্ছেন সুবিধাবঞ্চিত কিছু মানুষ। ছবি: খবরের কাগজ

২০ মার্চ রাত পৌনে ৩টা। চট্টগ্রাম নগরের ষোলশহর বিপ্লব উদ্যানের প্যান্ডেলের ভেতর কিছু মানুষকে লাইন ধরে প্রবেশ করতে দেখা যায়। একটু ভেতরে উঁকি দিতেই চোখে পড়ে সেখানে সাহরি খাওয়ার আয়োজন চলছে। ভেতরে গেলে জানা যায়, শুধু ভাসমান মানুষ নয়, স্থানীয়দের পাশাপাশি দূর-দূরান্ত থেকেও অনেকে এসেছেন। আশপাশের অনেক শিক্ষার্থীও এখানে নিয়মিত সাহরি খান। তবে তারা খাওয়ার পাশাপাশি যতক্ষণ থাকেন স্বেচ্ছাসেবীদের কাজে সহযোগিতা করেন। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন বিনামূল্যে এখানে সাহরি ও ইফতারের আয়োজন করে।
 
ষোলশহর স্টেশনসংলগ্ন বস্তি থেকে সাহরি খেতে আসা নূর মিয়া খবরের কাগজকে জানান, তিনি যেদিন শুনেছেন, এখানে সাহরি খাওয়ানো হচ্ছে সেদিন থেকেই আসতে শুরু করেন। প্রথম দিন তিনি একা এলেও এখন স্ত্রী ও বড় ছেলেকেও নিয়ে আসেন। পরিবারের যেসব সদস্য রোজা রাখেন না তাদের আনেন না বলে জানান তিনি।

ঢাকা থেকে নাইটকোচে আসা রাঙ্গুনীয়ার বাসিন্দা বেলাল উদ্দিন জানান, সাহরির সময় হয়ে গেছে। তাই নিরুপায় হয়ে তিনি খেতে এসেছেন। এ ধরনের আয়োজনের জন্য তিনি আয়োজকদের ধন্যবাদ জানান।

আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাহরি খাওয়া রোজাদারের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। প্রথম দিন তারা দেড় শ মানুষের সাহরি খাওয়ার আয়োজন করেছিলেন। এখন ৩০০-এর কাছাকাছি মানুষ খাচ্ছেন।

বিদ্যানন্দের স্বেচ্ছাসেবী ওমর ফারুক খবরের কাগজকে জানান, তারা প্রথম সাহরি খাওয়ার আয়োজন নিউ মার্কেট এলাকায় করেছিলেন। সেদিন দেড় শতাধিক রোজাদার সাহরি খান। পরদিন সাহরি খাওয়ানোর স্থান সরিয়ে ষোলশহর বিপ্লব উদ্যানে নিয়ে আসেন। দ্বিতীয় রোজায়ও প্রায় একই পরিমাণ লোক সাহরি খান। এরপর খবরটি আশপাশে ছড়িয়ে পড়লে দিন দিন লোক বাড়তে থাকে। এখানে যারা খান তাদের মধ্যে ভাসমান মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। কিছু কিছু শিক্ষার্থীও আসেন, তারা সাহরি খাওয়ার পাশাপাশি কাজেও হাত লাগান। আশপাশের অনেক পরিবারও এখানে খেতে চলে আসে। সবাইকে চেয়ার-টেবিলে বসিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। এখানে সবার কদর সমান। 

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইফতারের পরপর তারা সাহরির রান্নার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। সাগরিকা এলাকা থেকে প্রতিদিন রান্না করে খাবার নিয়ে আসা হয়। রাত ৩টার দিকে খাওয়া শুরু হয়। এখন ৩০০-এর কাছাকাছি রোজাদার প্রতি রাতে সাহরি খাচ্ছেন। এই সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে।
 
খাবারের মেন্যু প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিদিন গরু কিংবা মুরগির মাংসের সঙ্গে ডিম এবং ডাল থাকে। যেদিন শুধু ডিম থাকে সেদিন ডাল-ভাতের সঙ্গে দুটি ডিম দেওয়া হয়। কখনো মানুষ বেশি চলে এলে শেষের দিকে হয়তো কাউকে ডিম ডাল দিয়ে ভাত খাওয়ানো হয়। এই সংখ্যাটি খুবই নগণ্য। তবে খাবারের সংকট সেভাবে এখনো হয়নি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শেষ রমজান পর্যন্ত তাদের এই কর্মসূচি চলবে। ঈদের দিন এবং ঈদের পরদিন ঈদ আয়োজনের মাধ্যমে কর্মসূচি সম্পন্ন হবে।

পেট্রল পাম্পে ‘লাল’ হেলাল

প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২৫, ০৭:৩০ এএম
পেট্রল পাম্পে ‘লাল’ হেলাল
সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের তেমুখীতে সরকারি জায়গা দখল করে পরিচালিত একটি পেট্রল পাম্প। ইনসেটে পাম্পের মালিক মো. হেলাল উদ্দিন      খবরের কাগজ

সিলেটে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের মেগা প্রকল্প ‘কুমারগাঁও-বাদাঘাট-এয়ারপোর্ট সড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্প’। প্রায় ৭২৭ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের তেমুখীতে একটি গোলচত্বর করার মধ্য দিয়ে গত বছরের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা ছিল। গোলচত্বর করতে গিয়ে যেন গোলকধাঁধায় পড়ে সওজ। তখন সরকারি জায়গায় একটি পেট্রল পাম্পের কথিত বন্দোবস্তের চুক্তিনামার তথ্য প্রকাশ পায়। প্রকল্পের গোলচত্বর অংশের কাজ তখন থেকে বন্ধ রাখা হয়।

গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সওজ এ বিষয়টি অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখে জায়গা বন্দোবস্তের চুক্তিনামাটিই জাল। তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড কাউন্সিলর হিসেবে পেট্রল পাম্প মালিক মো. হেলাল উদ্দিন ক্ষমতার দাপটে জাল চুক্তিনামা দেখিয়ে ফোর লেন প্রকল্পের শেষ অংশের কাজ থামিয়ে দিয়েছিলেন। এ নিয়ে ২০২৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি খবরের কাগজে ‘পেট্রল পাম্পে আটকা ফোর লেন’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছিল। প্রতিবেদন সূত্রে সওজের সংশ্লিষ্ট দপ্তর অনুসন্ধান করে চুক্তি জাল করার সত্যতা পায়।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, একটানা প্রায় ৩০ বছর সরকারি জমি দখল করে পেট্রল পাম্পের ব্যবসায় অন্তত শতকোটি টাকা অবৈধভাবে রোজগার করেছেন হেলাল। তৎকালীন সরকারদলীয় কাউন্সিলর হওয়ার দাপটে জমি দখলমুক্ত করতে সওজের পক্ষ থেকে সব রকমের পদক্ষেপ নেওয়া ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন।

হেলাল সিলেট সিটি করপোরেশনের ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন। ওই সময় খবরের কাগজের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করলে হেলালের দাবি ছিল, মোট ১৪ ডেসিমেল জায়গা পেট্রল পাম্পের। এটা তার ব্যক্তিগত মালিকানার জায়গা। পেট্রল পাম্পের সামনে প্রায় সমপরিমাণ সরকারি জায়গা তিনি বন্দোবস্ত নিয়ে ব্যবহার করছেন।

পেট্রল পাম্পটির নাম ‘সফাত উল্লাহ সিএনজি ফিলিং স্টেশন’। সওজ পেট্রল পাম্পসহ সেখানকার অবৈধভাবে গড়ে ওঠা দোকানপাট অভিযান করতে গেলে তা স্থগিত চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন করেন। ওই রিট পিটিশনে তিনি সওজ এবং সিলেট জেলা পরিষদের সঙ্গে করা একটি চুক্তিনামা দাখিল করেন। এতে করে বন্ধ রাখা হয় ফোর লেন প্রকল্পের গোলচত্বরের কাজ। এরপর সওজ চুক্তিপত্র বের করে জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়ায় উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেছে।

কাগজপত্র ঘেঁটে জানা গেছে, পেট্রল পাম্পের জায়গাটি জেলা পরিষদের মালিকানাধীন। আগে খাল ছিল। হেলাল সেখানে মাছ চাষ করতে এক বছরের জন্য লিজ নিয়েছিলেন ১৯৯৫ সালে। কিন্তু মাছ চাষ না করে তিনি সেখানে মাটি ভরাট করে পেট্রল পাম্পের সঙ্গে যুক্ত করেন। জেলা পরিষদের সঙ্গে কথিত চুক্তিনামায় হেলাল উল্লেখ করেন ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তাকে সাইল শ্রেণির ভূমি লিজ দিয়েছে সিলেট জেলা পরিষদ। কিন্তু সাইল শ্রেণির ভূমি জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে লিজ দেওয়ার কোনো নিয়মই নেই। এমনকি ওই চুক্তিনামায় সাক্ষী হিসেবে তৎকালীন সিলেট জেলা পরিষদের সহকারী এম এ সাত্তারের যে স্বাক্ষর রয়েছে, তা জাল করা হয়েছে বলে নিশ্চিত হয় সওজ।

যোগাযোগ করলে সিলেট জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সন্দ্বীপ কুমার সিংহ খবরের কাগজকে বলেন, ‘পেট্রল পাম্পের লিজ নেওয়া জায়গা ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত নবায়ন করা। এরপর লিজগ্রহীতা চাইলেও আর নবায়নের অনুমতি দেওয়া হয়নি। সেই জায়গায় এখন যা হবে বা হচ্ছে, তা এক কথায় অবৈধ।’

সওজের ভূমি শাখা সূত্র জানায়, সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় সড়ক নির্মাণ ও প্রশস্তকরণের জন্য সওজ সড়কের পাশের জমি অধিগ্রহণ করে। অধিগ্রহণ করা ভূমির দাগে হেলাল পেট্রল পাম্পের চলাচলের কারণে পাকা কালভার্টসহ সংযোগ রাস্তা নির্মাণের অনুমতির জন্য সওজ থেকে ভূমি লিজ অনুমতিপ্রাপ্ত হন। অনুমতিপ্রাপ্ত লিজ অনুযায়ী গ্রহীতা পাঁচ বছর খাজনা প্রদান করেন। পরবর্তী সময়ে লিজের খাজনার রাজস্ব প্রদান না করার কারণে লিজের অনুমতিপত্রের শর্ত সাপেক্ষে লিজটি ১৯৯৫ সাল থেকে বাতিল হয়ে যায়।

এরপর হেলাল পেট্রল পাম্পসহ ওই ভূমিতে অবৈধভাবে দোকানপাট নির্মাণ করেন। তখন সওজ উচ্ছেদ অভিযান করতে গেলে তিনি তা স্থগিত চেয়ে প্রথম দফা ২০০৭ সালে উচ্চ আদালতে রিট করেন। ওই রিটের কোনোরূপ প্রতিকার না পেয়ে পুনরায় ২০১৫ সালে দ্বিতীয় দফা রিট করেন। এতে নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে যে চুক্তিপত্র উল্লেখ করা হয়েছিল, জেলা পরিষদ বা সওজ দপ্তর থেকে এ ধরনের কোনো চুক্তি সম্পাদন হয়নি। তখন চুক্তিপত্রটি জাল ও প্রতারণামূলক বলে প্রতীয়মান হয়।

২০২৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি খবরের কাগজে সংবাদ প্রকাশের পর ১২ মার্চ হেলাল ওই কাগজপত্রের মাধ্যমে আরেকটি স্থগিতাদেশের কপি সওজে হস্তান্তর করেন। এর বিরুদ্ধে সওজ গত ১৯ ফেব্রুয়ারি আবার আপিল করে।

গত বুধবার সওজের সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আমির হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘এই পাম্পের জায়গা আমাদের। কিন্তু হেলাল জাল চুক্তিনামা দেখিয়ে উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ এনেছেন। তার দায়ের করা রিট মামলায় দেওয়া চুক্তিনামাটি ভুয়া ও মিথ্যা। ৩০ বছরের খাজনা প্রদান করা হয়েছে মর্মে সকল তথ্যও ভুয়া। সেটা সম্পূর্ণ জালিয়াতির মাধ্যমে আদালতকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে।’

১৯৯১ সালে ৩০ বছরের জন্য সওজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনো চুক্তিই হয়নি জানিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী আরও বলেন, ‘তিনি (হেলাল) তৎকালীন চুক্তিনামা দেখিয়েছেন, যা কম্পিউটারে টাইপ করা। কিন্তু ১৯৯১ সালে আমাদের দপ্তরে কোনো কম্পিউটার ছিল না। তখন সব কাজ হাতে লিখে হতো। জালিয়াতির বড় প্রমাণ এটিই।’

এলাকাবাসী জানিয়েছেন, প্রায় ৩০ বছর ধরে মহাসড়কের পাশে মহামূল্যবান সরকারি জায়গায় পেট্রল পাম্প ব্যবসাই তার আর্থিক ভিত্তি। এই দখলযজ্ঞে ৭২৭ কোটি টাকার প্রকল্পকাজ আটকে থাকার পাশাপাশি পেট্রল পাম্প ব্যবসায় হেলাল গত ৩০ বছরে অন্তত শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। স্থানীয় লোকজন এ জন্য তাকে অধিক লাভবান অর্থে ‘লাল’ হেলাল বলে অভিহিত করছেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে হেলাল সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সিলেট সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আশফাক আহমদের দাপটে চলাচল করতেন। এরপর ক্ষমতার রাজনীতির পালাবদলে সিলেট-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের স্ত্রী সেলিনা মোমেনের প্রভাবকে পুঁজি করে চলেন।

পেট্রল পাম্পে সরকারি জায়গা ব্যবহারে ভুয়া চুক্তিনামার বিষয়ে হেলালের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তেমুখীর বাসিন্দা তার কয়েক ঘনিষ্ঠজন জানিয়েছেন, জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে তেমুখীর পাশে অবস্থিত সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন ঠেকাতে মাঠে তৎপর ছিলেন হেলাল। ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে শাবিপ্রবির শিক্ষার্থী রুদ্র সেন হত্যা মামলায় আসামি হওয়ায় হেলাল প্রকাশ্যে চলাচল এড়িয়ে চলছেন। মামলার এজাহারে তিনি ৬৩ নম্বর আসামি।

গত বৃহস্পতিবার বিকেলে পেট্রল পাম্পে গিয়ে হেলালের দেখা মেলেনি। পেট্রল পাম্প থেকে জানানো হয়, তিনি (হেলাল) বাইরে আছেন। তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে কল করে বন্ধ পাওয়া গেছে। ফেসবুকে সক্রিয় দেখা গেলেও মেসেঞ্জারে কল করে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

২০২৫-২০২৬ বাজেট রাজস্ব অব্যাহতি থাকবে না, চাপে পড়বে শিল্প বিনিয়োগ

প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২৫, ০৩:৩০ এএম
রাজস্ব অব্যাহতি থাকবে না, চাপে পড়বে শিল্প বিনিয়োগ
খবরের কাগজ ইনফোগ্রাফিকস

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে আগামী অর্থ বছরের বাজেটে নতুন করে আর কোনো খাতে রাজস্ব অব্যাহতি দেওয়া হবে না। এখনো রাজস্ব অব্যাহতি আছে এমন বেশির ভাগ খাত থেকেও তা প্রত্যাহার করা হবে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, ঢালাওভাবে রাজস্ব অব্যাহতি প্রত্যাহার হলে শিল্প বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু খবরের কাগজকে বলেন, ‘রাজস্ব অব্যাহতি বেশির ভাগ কমিয়ে ফেলা বা প্রত্যাহার করা হলে দেশের শিল্প ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। এতে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আয় বাড়াতে হলে রাজস্বের আওতাও বাড়াতে হবে।’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘বছর দুয়েক থেকে ডলারসংকটের কারণে শিল্প খাতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না অনেকে। এমন পরিস্থিতিতে ঢালাওভাবে রাজস্ব অব্যাহতি প্রত্যাহার বা কমানো হলে শিল্প বিনিয়োগে খরচ আরও বেড়ে যাবে। রাজস্ব অব্যাহতি প্রত্যাহার বা কমানো হলে মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেওয়া হবে।’

চলতি অর্থবছরের গত আট মাসে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ৫৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ঘাটতির হিসাব থাকলেও আইএমএফ থেকে অর্থমন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠিয়ে আগামী তিন অর্থবছরে ২০ লাখ ২০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে বলা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু এনবিআর থেকে আদায় করতে হবে ১৮ লাখ ৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। আগামী ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরে রাজস্ব খাত থেকে ৫ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হবে। এর মধ্যে এনবিআরকে আদায় করতে হবে ৫ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা। এ বড় অঙ্কের লক্ষ্যমাত্রা আদায় করতে আইএমএফ থেকে রাজস্ব অব্যাহতি প্রত্যাহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

এনবিআরের রাজস্ব আদায়বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইএমএফ থেকে ২০২৬-২০২৭ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৫৯ হাজার ৮০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে বলা হয়েছে। এর মধ্যে এনবিআরকে আদায় করতে হবে ৫ লাখ ৯৯ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৫৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআর থেকে আদায়ের পরিকল্পনা ৬ লাখ ৮৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। রাজস্ব অব্যাহতির সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে এনবিআরকে ঘাটতির বৃত্তে ঘুরপাক খেতে হবে। তাই রাজস্ব আদায় বাড়াতে আগামী অর্থবছরে নতুন করে আর একটি খাতেও রাজস্ব অব্যাহতি দেওয়া হবে না। এখনো বহাল আছে এমন বেশির ভাগ খাত থেকেই রাজস্ব অব্যাহতি কমানো বা প্রত্যাহার করতে হবে।

এনবিআর চেয়ারম্যান ড. আবদুর রহমান খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রভাবশালীদের খুশি করতে অপ্রয়োজনে অনেক খাতে রাজস্ব অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। রাজস্ব অব্যাহতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি। নতুন করে আর কোনো খাতে এসব দেওয়া হবে না। এনবিআর যে অঙ্কের রাজস্ব আদায় করে থাকে, অব্যাহতি দিয়ে তার প্রায় সমপরিমাণ রাজস্ব হারায়। এতে এনবিআরের প্রকৃত আদায় কমে যায়। অব্যাহতির সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছি। বিভিন্ন কৌশলে কেন এসব সুবিধা নিতে হবে?’

আগামী অর্থবছরের বাজেটবিষয়ক এনবিআরের কর্মকৌশলে বলা হয়েছে, চলতি ও তার আগের বাজেটে কিছু খাতে রাজস্ব অব্যাহতি দেওয়া হলেও বেশির ভাগই এখনো বহাল আছে। ৪৩ শতাংশ কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক অব্যাহতি আছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে এসব অব্যাহতি কমিয়ে অর্ধেক করা হবে। নতুনভাবে একটি কাঁচামাল আমদানিতেও রাজস্ব অব্যাহতি দেওয়া হবে না। বিশেষভাবে স্থানীয়ভাবে পাওয়া যায় এমন সব কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানিতে সম্পূর্ণ রাজস্ব অব্যাহতি প্রত্যাহার করা হবে। এতে নির্ধারিত শুল্ক দিয়েই আমদানি করতে হবে। ফলে সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়বে।

চলতি বাজেটে আইটি বা সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান, পোশাক খাত, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, মাইক্রো ফাইন্যান্স ও ইকোনমিক জোনে রাজস্ব অব্যাহতি কমানো বা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে ব্যবসায়ী নেতাদের চাপে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। কর্মকৌশলে বলা হয়েছে, আগামী বাজেটে এসব খাতের অব্যাহতি কমানো হবে। শিল্প খাতের পণ্য পরিবহন ও সরবরাহ, জ্বালানি, যোগাযোগ এবং অন্য অত্যাবশ্যকীয় ৩০ ধরনের খাতে বিভিন্ন হারের কর অব্যাহতি সুবিধা নতুন করে দেওয়া হবে না। এ ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের আয়, বিদেশি ঋণের সুদ, শেয়ার হস্তান্তরের ফলে মূলধনি মুনাফার ওপর অর্জিত আয়, রয়্যালটি, কারিগরি সহায়তার ফি এবং বিদেশি কর্মীদের আয়ের ওপর নির্দিষ্টহারে রাজস্ব অব্যাহতি কমানো হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় কর্মরত বিদেশিদের প্রথম তিন বছরের বেতনের ওপর ৫০ শতাংশ আয়কর আগামী বাজেটে নবায়ন করা হবে না।

কর্মকৌশলে বলা হয়েছে কৃষি, পশুসম্পদ, মৎস্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনপ্রশাসন, প্রতিরক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষাসহ জিডিপিতে অবদান আছে, এমন ৫০ শতাংশ পণ্য ও সেবায় ভ্যাট নেই। আসছে বাজেটে এ হিসাবে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এসব খাতের ওপর ঢালাওভাবে ভ্যাট অব্যাহতি আর দেওয়া হবে না। ওষুধের কাঁচামাল, সাবান-শ্যাম্পুর কাঁচামাল, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, সার্ভার, মাদারবোর্ড উৎপাদনে ভ্যাট বাড়ানো নিয়ে এনবিআর হিসাব করছে।

এনবিআরের কর্মকৌশলে আরও বলা হয়েছে, রাজস্ব অব্যাহতি দিয়ে সরকার এক অর্থবছরে গড়ে ২ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা থেকে ৩ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব কম আদায় করে থাকে। আয়কর খাতে রাজস্ব অব্যাহতি আদায়ের চেয়ে বেশি। ভ্যাট ও শুল্ক খাতে রাজস্ব অব্যাহতি ও আদায় প্রায় সমান। রাজস্ব অব্যাহতি প্রত্যাহার করা হলে এবং নতুন করে আর না দেওয়া হলে এনবিআরের প্রকৃত আদায় বেড়ে যাবে, যা লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সহায়ক হবে।

সম্প্রতি এনবিআরের এক অনুষ্ঠানে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ কর ছাড়ের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, ‘গত ৫০ বছর আমরা রাজস্ব অব্যাহতি দিয়ে শিশু লালন-পালন করছি; আর কতকাল লালন করব?’

তিনি আরও বলেন, “যে শিশুদের এত দিন ধরে লালন-পালন করা হয়েছে, তারা এখন শারীরিকভাবে বড় হয়ে গেছে। তারা এখনো বলে, ‘আমাদের সুরক্ষা দিন’, কিন্তু সুরক্ষার দিন তো চলে গেছে।”

২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি আইএমএফের সঙ্গে বাংলাদেশের ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ কর্মসূচি শুরু হয়। রাজস্ব সংস্কারসহ একগুচ্ছ শর্ত ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা হলে সাত কিস্তিতে ঋণ প্রদান করা হবে। না হলে কিস্তি আটকে দেওয়া হবে। আইএমএফ থেকে রাজস্ব অব্যাহতি প্রত্যাহার করার কথা বললেও বেশির ভাগই এখনো বহাল আছে। এতে অসন্তোষ প্রকাশ করে আগামী অর্থবছরে রাজস্ব অব্যাহতি প্রত্যাহারে চাপ দিয়েছে সংস্থাটি।

মাঠ প্রশাসনে মব ভায়োলেন্স আতঙ্ক

প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২৫, ১১:৩৯ এএম
আপডেট: ২২ মার্চ ২০২৫, ১১:৪১ এএম
মাঠ প্রশাসনে মব ভায়োলেন্স আতঙ্ক
খবরের কাগজ ইনফোগ্রাফিকস

একের পর এক মব ভায়োলেন্সের ঘটনায় একধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে মাঠ প্রশাসনে। সিভিল প্রশাসনের সর্বস্তরের পাশাপাশি পুলিশ প্রশাসনও ভায়োলেন্স ঘটার আশঙ্কায় স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। ফলে কঠোর হওয়ার পরিবর্তে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা স্থানীয় জনগণের সঙ্গে কোথাও মিলেমিশে, আবার কোথাওবা বুঝিয়ে-শুনিয়ে আপাতত দৈনন্দিন কার্যক্রম সামাল দিচ্ছেন। 

অন্তর্বর্তী সরকার সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে ইতোমধ্যেই নানা উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নিয়েছে। মব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে কঠোর বার্তা দেওয়া হয়েছে। তবে মাঠ প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, ফুটপাতের সামান্য একটি দোকানও তারা উচ্ছেদ করার সাহস পাচ্ছেন না। কারণ এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলেই সংশ্লিষ্টরা লোকজন জড়ো করে মব তৈরির চেষ্টা করেন।
প্রশাসনের উচ্চপর্যায় থেকে কঠোর নির্দেশনা থাকলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকর ভূমিকা এখনো অনুপস্থিত। পুলিশের মনোবলও এখনো পুরোপুরি ফিরে আসেনি বলে পুলিশের কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও একাধিকার স্বীকার করেছেন। 

আওয়ামী লীগের বিরোধী বলে পরিচিত (যারা সরকারবিরোধী আন্দোলনে জড়িত ছিলেন) দলগুলোর বেশির ভাগ নেতাই এখন বেশ বেপরোয়া। তাদের কথাবার্তা ও আচরণে এমন একটা ভাব স্পষ্ট যে প্রশাসন তাদের কথার বাইরে কিছুই করতে পারবে না। অনেক ক্ষেত্রেই তারা স্থানীয় প্রশাসনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন বলে আলোচনা আছে। এদের অনেকেই সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনের কথা শুনতে চাইছেন না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাঠপর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা উল্টো প্রশাসনের লোকদের শাসাচ্ছেন। পুলিশ বা প্রশাসনের তরফ থেকে বলতে গেলে তাদের ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ অভিহিত করে ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এমন পরিস্থিতির মধ্যেই তাদের চলতে হচ্ছে।

তা ছাড়া দেশের পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, সেটিও বিবেচনায় নিতে হচ্ছে প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের। কারণ আওয়ামী লীগ সরকার আমলে সুবিধাভোগী সিনিয়র কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে মাঠ প্রশাসনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) ওএসডি করাসহ বেশ কিছু কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। উল্লিখিত সময়ে দায়িত্ব পালন করা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া বর্তমানে চলমান রয়েছে। এতে মাঠ প্রশাসন এবং সচিবালয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মাঝে অনিশ্চয়তা ও আশঙ্কা বিরাজ করছে। যেকোনো ঘটনার সূত্র ধরে বা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে যে কারও ভাগ্য ঝুলে যেতে পারে, এমন পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে তাদের। 

মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের গত সাত মাসে সারা দেশে মব ভায়োলেন্সসহ অন্যান্য গণপিটুনিতে অন্তত ১১৪টি ঘটনায় ১১৯ জন নিহত ও ৭৪ জন আহত হয়েছেন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রশাসনে সব মিলিয়ে ওএসডি কর্মকর্তার সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। প্রশাসনে মোট ওএসডি আছেন ৫১৬ জন। এ ছাড়া দুজন গ্রেড-১ কর্মকর্তা, ৩৩ জন অতিরিক্ত সচিব, ৭৬ জন যুগ্ম সচিব, ১৩৬ জন উপসচিব, ১৫৫ জন সিনিয়র সহকারী সচিব, ৯৪ জন সহকারী সচিব এবং ৮ জন সিনিয়র সহকারী প্রধানকে ওএসডি করা হয়েছে।

এ ছাড়া আওয়ামী লীগের সময়ে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারদের (এসপি) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। প্রাথমিকভাবে ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী এমন ৩৩ জন কর্মকর্তাকে গত ১৯ জানুয়ারি ওএসডি করা হয়েছে। একই কারণে এর আগে ১২ জন কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়। 

মাঠ প্রশাসনে কর্মরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করাই বড় চ্যালেঞ্জ। বর্তমানে পুলিশের সক্ষমতা মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। তা ছাড়া মব জাস্টিস প্রতিরোধে সরকারের ব্যর্থতা এবং ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসরদের তাড়ানোর নামে অরাজনৈতিক নিরপেক্ষ, দক্ষ ও যোগ্য কর্মকর্তাদেরও হয়রানিসহ কথায় কথায় মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানববন্ধন, ঝাড়ু মিছিল, ঘেরাও, এমনকি প্রশাসনের ওপর হামলার ঘটনাও ইতোমধ্যে ঘটেছে। 

এমন পরিস্থিতিতে দেশের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি জেলার ডিসির সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাদের মধ্যে অধিকাংশই কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। একজন ডিসি খবরের কাগজের সঙ্গে ফোনে কথা বললেও দাবি করেন ‘কোনো কথা হয়নি’। কথার মধ্যেই আতঙ্ক ও ভয় নিয়ে কথা বলেন ওই কর্মকর্তা। তবে শতভাগ গোপনীয়তার নিশ্চয়তা দেওয়ার পর কথা বলেন তিনজন জেলা প্রশাসক (ডিসি)। 

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মাঠ প্রশাসনের চ্যালেঞ্জগুলো কীভাবে মোকাবিলা করছেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে গুরুত্বপূর্ণ জেলার একজন ডিসি নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেন, ‘মাঠ প্রশাসনে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা। সমঝোতা করেই প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে। সকালে অফিসে আসি একটা আতঙ্ক নিয়ে। সারাক্ষণ মনের মধ্যে ভয় কাজ করে, এই বুঝি কোথাও মব তৈরি হয়ে গেল। আবার কোনো না কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেল। সব সময় এই আতঙ্ক থাকে মনে।’

তিনি বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে কোনো সমস্যা আমরা দেখছি না। সমস্যা মাঠপর্যায়ে। মাঠপর্যায়ে এক নম্বর সমস্যা হচ্ছে জনগণের মধ্যে আইনকে নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা। প্রত্যেকেই মনে করে স্বাধীন। তার ওপর খবরদারি করার কেউ নেই। তাকে নিয়ন্ত্রণ করার কেউ নেই। তারা নিজেদের মতো আইনশৃঙ্খলা বিচার-বিশ্লেষণ করে আইনকে হাতে নিয়ে নেয়। মনমতো না হলেই সে নিজের মতো করে প্রতিরোধ করতে চায়। এমন বিষয়গুলো আমরা এখন লক্ষ করছি। আরেকটা বিষয়, তা হলো আগে পুলিশ বা অন্য বাহিনী কিন্তু এখনো নিজেদের সক্ষমতা বা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। এর ফলে ইউনিয়ন পর্যায়ে একজন নেতাকেও কোনো অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার বা নিয়ন্ত্রণ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাও ভয় পাচ্ছেন। এখন সামনে নির্বাচনের মতো একটা বড় বিষয় আছে। এমন পরিস্থিতিতে এমন জটিল অথচ বৃহৎ একটি কর্মযজ্ঞ কীভাবে হবে, তা বোধগম্য না।’

তিনি বলেন, ‘তৃতীয়ত; কথায় কথায় একটা মব তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এসব ঘটনায় সময়মতো পদক্ষেপ নিতে না পারলে বড় কোনো দুর্ঘটনা যে ঘটে যেতে পারে। এটা যে কেউ যখন-তখন তৈরি করতে পারে। ছাত্ররা পারে, শ্রমিকরা পারে অথবা যেকোনো পেশার যেকোনো গোষ্ঠী, যখন-তখন একটা মব তৈরি করে ফেলতে পারে। আমি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে একটা আদেশ দিলেও এর বিরুদ্ধে জড় হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে একটা অবস্থান নিয়ে ফেলে তারা।’ উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘একটা পার্কে অবৈধ দোকান বসতে দেব না বা সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে যত্রতত্র গাড়ি পার্ক করতে দেব না বা বাজারে অথবা ফুটপাতে অনুমোদনহীন দোকানপাট বসতে দেব না। এমন পদক্ষেপ নিতে গেলে দেখা যাবে দোকানিরা বা পরিবহন শ্রমিকরা জোট বেঁধে একটা মব তৈরি করে ফেলল। এভাবেই তারা আইনটাকে নিজের হাতে তুলে নেওয়া বা আইন না মানার প্রবণতা, মব তৈরি করার প্রবণতা- এই বিষয়গুলো আমরা সাংঘাতিকভাবে দেখছি। তা ছাড়া রাজনৈতিক দলের যেসব নেতা-কর্মী আছেন (নির্দিষ্ট কোনো দলের কথা নয়), তারা অনেকটা বল্গাহীন হয়ে গেছেন। তাদের ওপরে কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। না প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ আছে, না তাদের নিজ দলের শীর্ষ নেতাদের আছে। এই নিয়ন্ত্রণ না থাকায় যে কেউ যেমন তেমন করে তাদের ইচ্ছামতো কার্যক্রম করছে। আসলে তারা এখন আর প্রশাসনকে একবারেই ভয় পাচ্ছে না। আগে ডিসিরা একটু উচ্চস্বরে কথা বলতে পারতেন। এখন তেমন হলেই ডিসির সঙ্গেই উদ্ধত ব্যবহার করা হয়। ডিসি জোরে কথা বললেও মানুষ এখন নেগেটিভলি দেখছে। এই বিষয়গুলো বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে নরম হয়ে বাবা-সোনা বলে গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে আমাদের ম্যানেজ করতে হচ্ছে। আসলে এই মুহূর্তে ফোর্স ব্যবহার করে কোনো কিছু নিয়ন্ত্রণের কোনো সুযোগই আমরা দেখছি না। যতটুকু সম্ভব ভালো সম্পর্ক রেখে যেভাবে ম্যানেজ করা যায়, এখন সেটাই আমরা করছি। অন্যথায় যেকোনো সময় জটিল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এমন একটা বিশ্বাস-আস্থা দিয়ে এখন আমরা প্রশাসনকে চালিয়ে নিচ্ছি। কারণ ফোর্স অ্যাপ্লাই করার এক শতাংশও সুয়োগ নেই মাঠ প্রশাসনের।’

অপর এক জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খবরের কাগজকে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি না হলেও পরে বলেন, ‘আমাদের এখন আইনের ভেতরে কাজ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ বাহিনীসহ অন্যান্য ফোর্স সহযোগিতা করছে। প্রশাসন মানুষকে বোঝোচ্ছে। 
দীর্ঘদিনের একটা অপচেষ্টা, অপসংস্কৃতির যে প্র্যাকটিস তা তো আর রাতারাতি সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এর জন্য সময় প্রয়োজন। আমরা আইনের ভেতরেই সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। জুলাই-আগস্টের পর যে পরিবর্তিত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এই পরিস্থিতিতে সবাইকে নিয়ে সুষ্ঠুভাবে চলাটাই একটা চ্যালেঞ্জ। তবে আমরা চেষ্টা করছি, এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সুষ্ঠু একটা পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে। যাতে জনগণ শান্তিপূর্ণভাবে একসঙ্গে থাকতে পারে।’

সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাক আহমেদ জানান, একজন জেলা প্রশাসক কী কাজ করবেন তার একটা সীমা-পরিসীমা আছে। একটি জেলার যেকোনো বিশৃঙ্খল বা উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করাই জেলা প্রশাসকের কাজ। যেকোনো পরিস্থিতি হোক। এটা ৫ আগস্টের আগের বা পরের কোনো বিষয় না। বরং ৫ আগস্টের পর পরিস্থিতি অনেকটা ভালো। কারণ এখন রাজনৈতিক শক্তিমত্তার জায়গাটা অনুপস্থিত। কাজেই অন্য সময় যেসব চ্যালেঞ্জ থাকে, এখন বরং সেসব কম। তাই মাঠ প্রশাসনসহ সব সরকারি দপ্তরই কোনো চাপ ছাড়াই দায়িত্ব পালন করতে পারছে। তাই আমার কাছে কোনো চাপ মনে হয়নি, ভালোভাবেই কাজ করতে পারছি। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার মতো কোনো কিছুই প্রশাসন বরদাশত করছে না।’ তিনি বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে আইনের শাসন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। সেটাই আমাদের বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য। এখন কেউ যদি নিজের হাতে আইন তুলে নিতে চায়, সে ক্ষেত্রে কঠোর ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন- এমন নির্দেশনা এই জেলায় দেওয়া হয়েছে। এই জেলার পরিবেশ বেশ শান্ত। এখানে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। সবাই মিলেমিশে আছে। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার মতো কোনো সংকট এখানে হয়নি।’