
সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি ব্যাংকঋণে নির্ভরতা কমাতে এবার সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার। তাই এবার বাড়ছে সঞ্চয়পত্রের সুদহার। শুধু তা-ই নয়, প্রথমবারের মতো সঞ্চয়পত্রের সুদহার অনেকটাই বাজারভিত্তিক করা হচ্ছে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সঞ্চয়পত্রের সুদহার অন্তত এক শতাংশ বাড়ানো হচ্ছে। সঞ্চয়পত্রের ধরন অনুযায়ী এ হার বেড়ে হতে যাচ্ছে ১২ দশমিক ২৫ থেকে ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত। ফলে এখন থেকে ১ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগে সর্বোচ্চ সুদহার হবে ১ হাজার ২৫৫ আর সর্বনিম্ন ১ হাজার ২২৫। এর ওপর আবার সরকার ৫ শতাংশ হারে কর কাটবে।
অর্থনীতিবিদরা এ বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তাদের কেউ বলছেন, রাজস্ব আয় কম হওয়ায় সরকারের ব্যয় নির্বাহের জন্য সঞ্চয়পত্র থেকে বেশি ঋণ নিতে সুদহার বাড়িয়ে এটিকে আকর্ষণীয় করা হচ্ছে। এতে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরাও লাভবান হবেন। আবার অনেকে বলছেন, এমনিতেই আমাদের সুদ পরিশোধের চাপ বেশি। নতুন করে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাড়লে এই খাতে বিনিয়োগ বাড়বে। ফলে সরকারের সুদ পরিশোধের চাপও বাড়বে।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাড়ার দুটি দিক আছে। একদিকে, এতে বাজেটে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধের চাপ বাড়বে। এমনিতেই আমাদের সুদ পরিশোধের ব্যয় অনেক বেশি। প্রতি ৭ টাকায় ১ টাকা সুদ পরিশোধ করতে হয়। অন্যদিকে এর একটা ইতিবাচক দিকও আছে। এবার যেটা করা হচ্ছে সেটা একটু ভিন্ন। অর্থাৎ সরকারি বন্ডের সুদহারের সঙ্গে এটা সমন্বয় করা হয়েছে। এতে সঞ্চয়পত্রের সুদহারও অনেকটা বাজারভিত্তিক করা হয়েছে, যা আগে বাজারের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না। কেবল প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ছিল। তবে এখানে সরকারকে একটু সতর্ক হতে হবে। কারণ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী, অভ্যন্তরীণ ঋণের ২৫ শতাংশের বেশি সঞ্চয়পত্র থেকে নেওয়া যাবে না। ফলে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাড়ায় এর বিনিয়োগ স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে।’
একই বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মঈনুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, যেহেতু সরকার কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আদায় করতে পারছে না, ফলে সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য বেশি পরিমাণে ঋণ নিতে হবে। ব্যাংক খাত থেকে যেন বেশি ঋণ নিতে না হয়, সে জন্যই সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাড়ানো হচ্ছে। এতে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরাও লাভবান হবেন। এ ছাড়া ট্রেজারি বন্ডের সুদের হারের পাশাপাশি ব্যাংকে আমানতের সুদের হারও এখন বেশি। সরকার তাই সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার বৃদ্ধির বিষয়ে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জানা গেছে, এরই মধ্যে জাতীয় সঞ্চয় স্কিমগুলোর সুদের হার পুনর্নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রস্তাবে প্রধান উপদেষ্টা অনুমোদন দিয়েছেন। শিগগিরই এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করবে মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ।
অনুমোদিত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সরকারের নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা কমিটি (সিডিএমসি) বছরে দুবার (জুন ও ডিসেম্বরে) সঞ্চয়পত্রের সুদহার নির্ধারণ করবে। নতুন সুদহার পাঁচ ও দুই বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের গড় সুদের হার (সর্বশেষ ৬ মাসের নিলামের ভিত্তিতে) অনুযায়ী নির্ধারণ করা হবে। তবে ওয়েজ আর্নার বন্ড, ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড এবং ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড এ সংস্কারের আওতাবহির্ভূত থাকবে।
নতুন নিয়ম অনুযায়ী, তিন বছর মেয়াদি তিন মাস অন্তর মুনাফা সঞ্চয়পত্রে সাড়ে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য সম্ভাব্য সুদহার হবে ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ। আর এর বেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সুদহার ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ। বর্তমানে এ স্কিমে সুদহার ১১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ রয়েছে।
পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্রে সাড়ে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য সুদহার হবে ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। আর এর বেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ সুদ হবে। বর্তমানে এ স্কিমে সুদহার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। অন্যদিকে একই মেয়াদের পারিবারিক সঞ্চয়পত্রে সাড়ে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য সুদহার ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ হবে। আর এর বেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ সুদ নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমানে এ স্কিমে সুদহার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ রয়েছে। এ ছাড়া তিন বছর মেয়াদি ডাকঘর স্থায়ী আমানতে সাড়ে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য সুদহার হবে ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ। আর এর বেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ।
এদিকে বর্তমানে ব্যাংকগুলো সাধারণত স্থায়ী আমানতে ৯ থেকে ১১ শতাংশ সুদ দেয়। তবে তারল্যসংকটে থাকা কিছু ব্যাংক ১৩ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রে বর্তমানে ১১ থেকে সাড়ে ১১ শতাংশ সুদ পান গ্রাহক। অর্থাৎ আগে ব্যাংকের আমানত এবং ট্রেজারি বিল ও বন্ডের তুলনায় সঞ্চয়পত্রের সুদহার অনেক বেশি থাকলেও বর্তমানে সেটা অনেক কমে গেছে।
এদিকে বর্তমানে ব্যাংক খাতে চলছে কিছুটা নাজুক পরিস্থিতি। সেই সঙ্গে অনেক ব্যাংক গ্রাহকের টাকা সঠিক সময়ে ফেরত না দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। ফলে ব্যাংকের সুদহার বাড়ানোর পর অনেকে সঞ্চয়পত্রকেই নিরাপদ মনে করছেন। তাই সঞ্চয়কারীরা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন। পাশাপাশি আগের কেনা সঞ্চয়পত্রে মেয়াদ শেষে আবারও নতুন করে বিনিয়োগ করছেন। আর সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাড়লে এই খাতে বিনিয়োগ আরও বাড়বে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরুতেই সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এ সময় সঞ্চয়পত্র বিক্রির সঙ্গে বেড়েছে নিট বিনিয়োগের পরিমাণও। অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ঋণ নেওয়া হয়েছে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। মানে সরকারই এ অর্থ ঋণ নিয়েছে। এ সময়েই সরকার এই খাত থেকে পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার ৪৬ শতাংশ ঋণ নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে।
চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, মূলত তিনটি কারণে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ বাড়ছে। প্রথমত, বর্তমানে ব্যাংক খাতে একধরনের অস্থিরতা চলছে। অনেক ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। যার ফলে গ্রাহকের আস্থাহীনতাও বাড়ছে। ফলে আমানতের সুদের হার আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেলেও মানুষ এখন আর কোনো ব্যাংকেই টাকা রাখছে না। দ্বিতীয়ত, দীর্ঘদিন ধরে পুঁজিবাজারে মন্দা চলছে। ভালো হওয়ার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। তাই সবাই এখন নিরাপদ সঞ্চয়পত্রেই বেশি বিনিয়োগ করছেন। সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ বাড়ার আরও একটি কারণ হচ্ছে, বর্তমানে প্রবাসীরা অনেক বেশি পরিমাণে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। তবে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ বাড়লে সরকারের সুদ পরিশোধের চাপ বাড়ে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাড়লে চাপে পড়বে দেশের ব্যাংক খাত। কারণ এমনিতেই ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের আস্থা কমে গেছে। ফলে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাড়লে অধিকাংশ গ্রাহক সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করবেন। তখন ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহে কিছুটা চাপে পড়বে। এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাড়লে ব্যাংকের আমানত সংগ্রহে কিছুটা চাপ তৈরি হবে- এটা স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকেও আকর্ষণীয় সুদহারে আমানত সংগ্রহ করতে হবে।