
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকেন্দ্রিক এক হত্যা মামলার দ্বিতীয় আসামি করা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমকে। তবে ঘটনার সময় তিনি ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি। জ্যেষ্ঠতার তালিকায় তখন তার অবস্থান ছিল প্রধান বিচারপতির পরই।
সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে থাকা তথ্য বলছে, দিনাজপুর আদালতের সদর দরজার কাছে ওই হত্যাকাণ্ডের দিন গত ৪ আগস্ট এই বিচারপতি দেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগের একটি বেঞ্চের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। এই বেঞ্চ ওই দিন ৩২টি মামলায় আদেশ দিয়েছিলেন। এর মধ্যে একটি মামলার (সিভিল আপিল ২১২/২০১৭) রায়ও ঘোষণা করেছিলেন তার নেতৃত্বে বেঞ্চ।
আপিল বিভাগের তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত ওই বেঞ্চের অন্য দুই বিচারক ছিলেন বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী এবং মো. শাহিনুর ইসলাম।
প্রসঙ্গত, গত ১০ আগস্ট তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতি পদত্যাগ করেন। তাদের মধ্যে এই তিন বিচারপতিও আছেন। প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পদত্যাগ দাবিতে ওই দিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অ্যানেক্স ভবনের সামনে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা। ওই আন্দোলনের মধ্যে তারা পদত্যাগ করেন।
ঘটনার এক মাস পর গত ৪ সেপ্টেম্বর এই মামলা করেন দিনাজপুর জেলার কোতোয়ালি থানার পাক পাহাড়পুরের রেজাউল করিমের ছেলে মো. রিয়াদ। যিনি নিজেও ওই ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন বলে মামলায় উল্লেখ করেছেন।
বিষয়টি নজরে দিলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোতাহার হোসেন সাজু সম্প্রতি দৈনিক খবরের কাগজকে বলেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি, জ্যেষ্ঠতার ক্রমিকে প্রধান বিচারপতির পরেই যার অবস্থান ছিল, তাকে দিনাজপুরের একটি হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে, অথচ ঘটনার দিন তিনি রাজধানীতে অবস্থান করছিলেন, আপিল বিভাগের একটি বেঞ্চে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। এতেই বোঝা যায়, এই আন্দোলনকেন্দ্রিক যত মামলা হয়েছে, তার বেশির ভাগ আসামিই ভুয়া। অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে এভাবে আসামি করা হয়েছে। অথচ এসব ঘটনায় যে মায়ের সন্তান মারা গেছেন বা যিনি আহত হয়েছেন, তার ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলার জন্য এভাবে ঢালাও আসামি করায় মামলার ন্যায়বিচারই অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়।
সাবেক এই ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল (ডিএজি) বলেন, আশা করব, ভুয়া আসামি করার প্রমাণ পেলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তদন্তের মধ্যেই বাদীর ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে।
সাবেক বিচারপতি ইনায়েতুর রহিমের সহোদর ও জাতীয় সংসদে সাবেক হুইপ ইকবালুর রহিমকে প্রধান আসামি করা হয় এই মামলায়। তারা দুই ভাইসহ ১০৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ৫০০-৬০০ জনকে আসামি করে এই মামলা করা হয়।
মামলায় অভিযোগ করা হয়, এই আসামিরা ‘অত্যন্ত দুর্দান্ত প্রকৃতির ক্ষমতার অপব্যবহারকারী, মাস্তান, অস্ত্রধারী, হত্যাকারী ব্যক্তি।’ এতে উল্লেখ করা হয়, আন্দোলন চলাকালে গত ৪ আগস্ট দুপুর আনুমানিক ১২টা থেকে সাড়ে ১২টায় দিনাজপুর জিলা স্কুল থেকে পাকা রাস্তার ওপর দিয়ে কোর্টের সদর দরজার সামনে যাওয়ার সময় ইকবালুর রহিম ও তার সহোদর এম ইনায়েতুর রহিমের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উসকানিতে ও প্ররোচনায় এবং নির্দেশে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দমন করার জন্য আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, প্রেসক্লাবের নেতা-কর্মীসহ এই আসামিরা হাতে পিস্তল, রিভলবার, বন্দুক, হাঁসুয়া, সামুরাই, লোহার রড, লোহার পাইপ, প্লাস্টিকের পাইপ, প্লাস্টিকের পাইক, একনলা বন্দুক, দোনলা বন্দুক ও লাঠিসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্রে সস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি করে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থী রাহুলসহ আমি ও কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে যাই, বলে বাদী মামলায় উল্লেখ করেন।
এতে আরও উল্লেখ করা হয়, এই ঘটনা দেখে মামলার কয়েকজন সাক্ষী ও সাধারণ জনগণ তাদের হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। রাহুল চিকিৎসা নিয়ে বাসায় চলে যান। পরবর্তী সময় গুলিবিদ্ধ রাহুলের শারীরিক অবস্থার অবনতি দেখা দিলে গত ৭ আগস্ট রাত আনুমানিক সাড়ে ৮টার সময় তার আত্মীয়স্বজন তাকে পুনরায় এম. আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করান। পরে গত ৯ আগস্ট রাত ৬টা ৫৭ মিনিট রাহুল মৃত্যুবরণ করেন।
জানতে চাইলে দিনাজপুর জেলার কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমান গতকাল শুক্রবার রাতে দৈনিক খবরের কাগজকে বলেন, ‘ঘটনার সময় আমি এই থানায় কর্মরত ছিলাম না। পরে এখানে আমার পোস্টিং হয়েছে। তবে মামলাটি পুলিশ বাদী হয়ে করেনি। পাবলিক বাদী হয়ে এই মামলা করেছেন। কাউকে তো মামলা করতে মানা করা যাবে না। এখন মামলাটি তদন্তাধীন আছে। তদন্তে যা পাওয়া যাবে, সেভাবেই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
প্রসঙ্গত, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকেন্দ্রিক তিন মামলায় সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি খিজির হায়াতকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে ১টি হত্যা মামলা রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানায়, আর ২টি হত্যাচেষ্টা মামলা উত্তরা পশ্চিম থানায় করা হয়েছে।