
নান কারণে অনেকদিন ধরেই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প খাতের সংকট চলেছে। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন সরকার রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিলে আশায় বুক বাঁধেন ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তারা। কিন্তু তাদের সঙ্গে কোনোরকম আলোচনা ছাড়াই সরকারের উচ্চপর্যায়ের অনেকটা একক সিদ্ধান্তে হাজারের বেশি পণ্য ও সেবা খাতে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এতে কোনো রকমে টিকে থাকা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প খাত মহাসংকটে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আলোচনায় বসে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প খাতের জন্য অতি প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবা খাতের ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ী ও শিল্প খাতের সংশ্লিষ্টরা।
ইফাদ গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ও ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকিন আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, অনেকে রাজস্বজালের আওতায় নেই। এদের রাজস্বের আওতায় আনতে পারলে আদায় কয়েকগুণ বাড়বে। রাজস্ব আদায়ে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলেও রাজস্ব আদায় কয়েক গুণ বাড়বে। সে দিকে না গিয়ে সরকার আয় বাড়াতে সাধারণ ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের চেপে ধরল।
সরকারের রাজস্ব আদায়ের তিন খাতের মধ্যে অন্যতম ভ্যাট। বর্তমানে ভ্যাট নিবন্ধন নেওয়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫ লাখ ২৫ হাজার। এর মধ্যে গড়ে সাড়ে ৩ লাখ প্রতিষ্ঠান নিয়মিত ভ্যাট দিয়ে থাকে। এর বাইরে এখনো লাখ লাখ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাটের আওতায় আনতে ও ফাঁকি বন্ধ করতে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) বসানোর উদ্যোগ নিলেও এনবিআর তা পারেনি। সরকারেরর আয় বাড়াতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে শেষ পর্যন্ত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হলো।
গত বৃহস্পতিবার রাতে এ-সংক্রান্ত দুটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। অধ্যাদেশের পরিবর্তনগুলো সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হয়েছে।
অধ্যাদেশ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ফল, জুস, বেভারেজ, তামাকপণ্য, রেস্তোরাঁ, মোবাইলের টকটাইম, ইন্টারনেটসহ ৯০টিরও বেশি পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। পটেটো চিপস, বিস্কুট, আচার, চাটনি, বিভিন্ন ধরনের পেস্ট, এলপিজি, পাইকারিভাবে আমদানি করা পেট্রোলিয়াম বিটুমিন, ফেরো-ম্যাঙ্গানিজ, ফেরো-সিলিকো-ম্যাঙ্গানিজ অ্যালয়, ফেরো-সিলিকন অ্যালয়, এইচ আর কয়েল থেকে সি আর কয়েল শিট, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, চশমার প্লাস্টিক ফ্রেম এবং ইনডেন্টিং ব্যবসায় ভ্যাটের হার আগের ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। কিচেন টাওয়েল, হ্যান্ড টাওয়েল, নন-এসি হোটেল এবং স্থানীয় ব্র্যান্ডের পোশাক পণ্যে ভ্যাট ৭.৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। মোটরগাড়ির গ্যারেজ, ডকইয়ার্ড, চলচ্চিত্র স্টুডিও, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী (সিনেমা হল), মেরামত ও সার্ভিসিং, টেইলারিং শপ এবং টেইলার্স, ভবন রক্ষণাবেক্ষণকারী সংস্থা, সামাজিক ও খেলাধুলাবিষয়ক ক্লাবের ভ্যাট ১০ শতাংশের বদলে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। আমদানি করা ফল, জুস, পেইন্ট এবং বার্নিশ, চামড়া এবং জুতার কাঁচামাল, ডিটারজেন্ট পাউডার এবং নন-কার্বনেটেড কৃত্রিম স্বাদযুক্ত পানীয়সহ ৪১টি পণ্য ও পরিষেবার জন্য সম্পূরক শুল্ক ৫০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি করা হয়েছে। কার্বোনেটেড ও নন-কার্বোনেটেড পানীয়ের ওপর নতুন করে ৩০ এবং ১৫ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী বা আইএসপির ওপরও নতুন করে ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক কার্যকর হয়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ, ওষুধের ক্ষেত্রে স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ২ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে।
হোটেল, রেস্তোরাঁয় ভ্যাটের হার বাড়ানোর পরিকল্পনা থেকে সরে আসার দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে আলোচনায় বসে অধ্যাদেশ সংশোধন করে ভ্যাট কমাতে হবে। না হলে অনির্দিষ্টকালের জন্য রেস্তোরাঁ বন্ধ রাখতে বাধ্য হব। মূল্যস্ফীতি রেকর্ড করেছে। ডলারসংকটে আমরা কোনোরকমে টিকে আছি। এমন পরিস্থিতিতে সরকার খরচ বাড়িয়ে ব্যবসায়ীদের বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে।’
মহাসচিব ইমরান আরও বলেন, ‘৭০ শতাংশ রেস্তোরাঁ এখনো ভ্যাটের আওতার বাইরে। তাদের না ধরে আমরা যারা ভ্যাট দিয়ে থাকি তাদের ওপর আবারও চাপ বাড়িয়েছে। প্রশাসনের ব্যয় কমিয়ে ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিয়ে সরকার আয় বাড়াতে পারত। আইএমএফের শর্ত মানতে গিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো দেশের জনগণের ওপর ইচ্ছামতো করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া কোনো পূর্ণাঙ্গ সমাধান হতে পারে না।
বর্তমানে তৈরি পোশাকের আউটলেটের বিলের ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে ভ্যাট বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর প্রভাব নিয়ে জানতে চাইলে ফ্যাশন হাউস উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ ফ্যাশন উদ্যোক্তা সমিতির (এফইএবি) সভাপতি আজহারুল হক আজাদ খবরের কাগজকে বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে হলে ভ্যাটের হার বাড়ানোর সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে ভ্যাটের আওতা বাড়ানোর ওপর জোর দিতে পারে এনবিআর। করোনা, ডলারসংকটের পর ভ্যাট বাড়ানোয় আমরা নিঃস্ব হয়ে যাব।’
বাংলাদেশ মিষ্টি উৎপাদক সমিতির সাবেক সভাপতি মাধব চন্দ্র ঘোষ খবরের কাগজকে বলেন, ‘মিষ্টিতে ভ্যাট ৭ থেকে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলা উচিত ছিল।’
মোবাইল ফোন সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ফলে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারে খরচ বাড়বে।
গ্রামীণফোনের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার (সিসিএও) তানভীর মোহাম্মদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘মোবাইল পরিষেবার ওপর হঠাৎ করেই ৩ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ আমাদের বিস্মিত করেছে। সাত মাসের মধ্যে এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো সম্পূরক শুল্ক (এসডি) বাড়ানো হলো। মোবাইল পরিষেবার জন্য খরচ করা প্রতি ১০০ টাকার জন্য গ্রাহকদের এখন ১৪২.৪৫ টাকা (ভ্যাট, এসডি এবং সারচার্জসহ) দিতে হবে, যা গত বাজেটের আগে ছিল ১৩৩.২৫ টাকা।
তিনি বলেন, ‘কীভাবে এ খাত থেকে রাজস্ব আদায় বাড়ানো যায় তা নিয়ে আমাদের সঙ্গে সরকার আলোচনার বসতে পারত। তাহলে হয়তো রাজস্ব না বাড়িয়েও সমাধান করা যেত। সরকারের এই সিদ্ধান্ত উন্নয়নের গতিকে আরও ধীর করবে। এ সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করার পরামর্শ জানাচ্ছি।’
এদিকে রাজস্ব আদায়ে অর্থবছরের শুরু থেকে ঘাটতির মুখে পড়েছে সরকার। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। গত নভেম্বর পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার কোটি টাকা।
সম্প্রতি ঋণের শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ করার শর্ত দিয়েছে। বাংলাদেশকে দেওয়া ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারে চলমান ঋণ কর্মসূচির চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ঘুরে গেছে আইএমএফের প্রতিনিধিদল। তখন কর আদায় ও নীতি গ্রহণকারী সংস্থাকে আলাদা করাসহ রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর মতো কিছু কঠোর শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। সেই শর্ত পূরণেই ভ্যাট বাড়ানোর এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন ‘কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’-এর সভাপতি গোলাম রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোয় ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পে খরচ বাড়বে। এতে সাধারণ মানুষের ব্যয় বাড়বে। এভাবে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ঘটনা নজিরবিহীন। সরকার যদিও দাবি করছে অত্যাবশ্যক পণ্যের ওপর বাড়ানো হয়নি। কিন্তু শুধু সিগারেট বাদ দিলে বাকি সবই মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে যুক্ত। এতে করে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে এবং তা মূল্যস্ফীতিকে আরও বাড়িয়ে দেবে। সংশোধনের সুযোগ আছে, সরকারকে সে পথেই যেতে হবে।’