
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একপেশে সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রশাসনবহির্ভূত অন্য ২৫ ক্যাডার। কার্যত এখন সারা দেশের প্রশাসন দুই ভাগে বিভক্ত। ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন, একই অপরাধে তাদের ক্যাডারভুক্তদের সাজা হলেও প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা থাকছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত দুটি সুপারিশকে কেন্দ্র করে সারা দেশেই প্রশাসনে বিভক্তি স্পষ্ট হয়েছে। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, উপসচিব পদে পদোন্নতিতে পরীক্ষার মাধ্যমে আসতে হবে এবং প্রশাসন ক্যাডারের ৫০ শতাংশ ও বাকি অন্য ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ কোটা রাখার সুপারিশ করা হবে। সুপারিশে আরও বলা হয়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডার প্রশাসন থেকে আলাদা করা হবে। এই ঘোষণার পর থেকে সারা দেশে প্রশাসনের মাঝে একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। এই বিভক্তিতে সরকারের জনসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা এই দ্বন্দ্বের কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করছেন না। তবে এরই মধ্যে প্রশাসন ক্যাডার ও অন্য ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে এবং নিজেদের বঞ্চিত দাবি করে নানা কর্মসূচি পালন করেছেন। দাবি আদায় না হলে আরও কঠোর কর্মসূচি পালন করবেন- এমন ঘোষণাও আগেই দিয়ে রেখেছেন উভয় পক্ষের শীর্ষ নেতারা।
প্রশাসন ক্যাডার সার্ভিসের পক্ষে ‘বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড’ ও ‘বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন’ (বাসা)। অন্য পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত মোর্চা ‘আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’-এর সদস্যরা।
উভয় পক্ষ নিজের দাবির পক্ষে কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একে অপরের বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিচ্ছে। দুই পক্ষ সমানতালে এক অপরকে আপত্তিকর বক্তব্য দিয়ে ঘায়েল করতে চাইলেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এক পক্ষের বিরুদ্ধে ঢালাও ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে ‘আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’।
সম্প্রতি অন্য ২৫ ক্যাডার সার্ভিসের পক্ষে একটি বিবৃতি দিয়েছে ‘আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’। বিবৃতিতে উদ্বেগ জানিয়ে বলা হয়েছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত দপ্তর/সংস্থায় কর্মরত ২৫ বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় মতপ্রকাশের জন্য ঢালাওভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হচ্ছে। কোনো কারণ দর্শানোর নোটিশ ছাড়াই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এসব আদেশ জারি অত্যন্ত অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা মৌলিক অধিকার ও চাকরিবিধি পরিপন্থি। যাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তারা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে অত্যন্ত দক্ষ ও মেধাবী কর্মকর্তা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্তে (বরখাস্ত) ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে পরিষদ।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, পরিষদ মনে করে, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়া ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রত্যয় নিয়ে ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত হয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। এ সরকারের আমলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও অধিকার ক্ষুণ্ণ করায় পরিষদ তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে। জনবান্ধব সিভিল সার্ভিস গঠনসহ বর্তমান সরকার যেসব সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, তা যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে সরকারকে সহযোগিতা করছে পরিষদ। তাই এভাবে সাময়িক বরখাস্ত অব্যাহত থাকলে সিভিল সার্ভিসে অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। এতে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে পারে। এরূপ পরিস্থিতি এড়াতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ২৫ ক্যাডারভুক্ত যেসব কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে, সেসব আদেশ প্রত্যাহার করে কর্মকর্তাদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সমন্বয়ক ড. মুহাম্মদ মফিজুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘উভয় পক্ষ থেকেই পরস্পরবিরোধী কিছু মন্তব্য, বক্তব্য আসছে। এটা স্বাভাবিক। এসব বক্তব্য আপত্তিজনক হলে অভিযুক্তকে শোকজ করে, জবাব নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা চাকরিবিধিতে আছে। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকতে হবে, তাও বলা আছে বিধিতে। কিন্তু কোনো কিছুই না করে বিধি অনুসরণ না করে সরাসরি বরখাস্ত করার আদেশ জারি হলো, এটা কি ঠিক হয়েছে? কারণ চাকরিবিধিতে অপরাধের ধরন দেখে শাস্তির বিধান রয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ও জবাব চেয়ে সন্তুষ্ট না হলে বরখাস্ত বা ডিপার্টমেন্টাল প্রসিডিউর (ডিপি) করা যায়। এসব কোনো কিছুই না করে সোজা বরখাস্ত- এটা কিভাবে সম্ভব?’
ড. মুহাম্মদ মফিজুর রহমান আরও বলেন, ‘প্রশাসন ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তারা যেভাবে ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করছেন, তাদের বিরুদ্ধে তো কোনো ব্যবস্থা তো নিচ্ছে না জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তা ছাড়া অন্য ২৫ ক্যাডার সার্ভিসের যেসব কর্মকর্তা অভিযুক্ত হয়েছেন তারা সুবিচার কোথায় পাবেন? কার কাছে প্রতিকার চাইবেন? ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তাদের প্রশাসনের কাছেই যেতে হবে। তারাই ব্যবস্থা নেবে। কারণ ক্ষমতা তো প্রশাসন ক্যাডার সার্ভিসের কাছে। জনপ্রশাসনের সবকিছুই প্রশাসন ক্যাডারের কাছে দখল হয়ে গেছে। এত সবকিছু হয়েছে ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য। তাই প্রশাসনের কাছে সুবিচার না পেয়ে এখন আল্লাহর কাছে সুবিচার চাইছি।’