
দেশে গত দুই বছর ধরেই খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত সব ধরনের খরচ বেড়েছে। খরচের চাপে সাধারণ মানুষ দিশেহারা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ায় অনেকে আশায় বুক বেঁধেছিলেন, এবার হয়তো জিনিসপত্রের দাম কমবে। কিন্তু তা হয়নি, সরকার হাঁটল উল্টোপথে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে বহু খাতে খরচ বাড়িয়েছে।
হিসাব কষে দেখা যায়, গড়ে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে ১২ শতাংশ খরচ বাড়ানো হলো। চার সদস্যের একটি পরিবারের মাসিক আয় ৩৫ হাজার টাকা হলে সেই পরিবারের খরচ বাড়বে গড়ে ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা।
অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলেছেন, গরিব মানুষ খরচের চাপে আরও গরিব হবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘পণ্য ও সেবার ওপর গড়ে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। যেসব পণ্য ও সেবাখাতে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে তা যদি একজন সাধারণ আয়ের পরিবার ব্যবহার করে তবে ২ হাজার টাকায় খরচ বাড়বে প্রায় ২৫০ টাকা। এ বাড়তি খরচে সাধারণ মানুষের কষ্ট আরও বাড়বে।
তিনি আরও বলেন, সরকার এ কাজ না করলেও পারত। পরোক্ষ কর না বাড়িয়ে প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে পারত। এতে গরিব বা কম আয়ের মানুষের ওপর চাপ পড়ত না। আইএমএফের চাপে সরকার এটা করেছে।
মিরপুর ১০ নম্বরে ভাড়া বাসায় স্ত্রী, দুই সন্তান নিয়ে থাকেন বেসরকারি চাকরিজীবী রাহাত আলী। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ভ্যাট বাড়িয়ে সরবকার টুথপেস্ট থেকে পটেটো চিপস, বিস্কুট, আচার, চাটনি, টিস্যু, পাউরুটির মতো অতি প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে আগে ১০০ টাকায় ৫ টাকা ভ্যাট দিতে হতো। এখন দিতে হবে ১৫ টাকা। এই বাড়তি খরচ কীভাবে যোগাড় করব?
তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, মানুষের কষ্ট হবে- এটা কোনো সরকারই বোঝে না। অন্তর্বর্তী সরকারেরও একই অবস্থা। যে কর দেয় না, তার কাছ থেকে আদায় করার মুরোদ নেই। অর্থ পাচারকারীকে ধরবেন না। এদিকে অর্থবছরের মাঝপথে এসে শুল্ক-কর বাড়িয়ে দেবেন- এটা কি গ্রহণযোগ্য হবে?
ফার্মগেটের রেস্তোরাঁ কর্মচারী মো. মাহিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আজকে জুতা কিনতে গিয়েছিলাম। গত সপ্তাহেও যে জুতার দাম ৫২০ টাকা ছিল। এখন তার দাম ৬৭০ টাকা হয়েছে। দোকানি জানালেন, জুতা বানানোর উপাদানের ওপর সরকার ভ্যাট বাড়িয়েছে বলে জুতার দাম গড়ে ১৫০ টাকা বেড়েছে। আমার কাছে জুতা কিনতে এত টাকা ছিল না। তাই জুতা না কিনেই চলে এসেছি।’
অধ্যাদেশ বিশ্লেষণ করে, বাজারে খোঁজ নিয়ে এবং সাধারণ আয়ের অনেকের সঙ্গে কথা বলে হিসাব কষে দেখা যায়, খাবার কেনা, মোবাইল ফোনে কথা বলা, ইন্টারনেট ব্যবহার, ওষুধ ও যাতায়াতের ক্ষেত্রে খরচ বাড়বে ১০০ টাকায় গড়ে ১০ টাকা। সম্পূরক শুল্ক বাড়ায় স্কুলের ব্যাগ, বই, পেনসিল, কলমের দামও একই হারে বাড়বে। মোবাইলের টকটাইম, ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী বা আইএসপির ওপরও নতুন করে ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
গ্রামীণফোনের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার (সিসিএও) তানভীর মোহাম্মদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘মোবাইল পরিষেবার ওপর হঠাৎ করেই ৩ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করায় ভোক্তাকে এখন ৯.২ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক দিতে হবে। মোবাইল পরিষেবার জন্য গ্রাহকদের এখন ১৪২.৪৫ টাকা (ভ্যাট, এসডি এবং সারচার্জ সহ) দিতে হবে, যা গত বাজেটের আগে ছিল ১৩৩.২৫ টাকা।’
অন্যদিকে ওষুধের ক্ষেত্রে স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ২ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। কাঁচামালের ওপর সম্পূরক বাড়ায় অনেক ওষুধের দাম বাড়বে। মশা তাড়াতে কয়েল ব্যবহার করতেও এখন ১০০ টাকার প্যাকেট কিনতে খরচ বাড়বে ১০ টাকা।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন ‘কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’-এর সভাপতি গোলাম রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকার অধ্যদেশ জারি করে আইএমএফের চাপে প্রায় শত খাতে খরচ বাড়িয়ে সাধারণ আয়ের মানুষকে কষ্টে ফেলেছে। শুধু সিগারেট বাদ দিলে বাকি সবই মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে যুক্ত। এতে করে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে এবং তা মূল্যস্ফীতিকে আরও বাড়িয়ে দেবে। করোনার পর থেকেই জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। এর শেষ কোথায় এ প্রশ্ন আমার।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনেকে জীবন চালাতে শেষ সঞ্চয় ভেঙেছে, ভিটেমাটি বিক্রি করেছে। অনেকে ধারদেনাও করেছে। এসব মানুষ কীভাবে বাড়তি খরচ জোগাবে?
ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তে কী প্রভাব পড়বে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান খবরের কাগজকে বলেন, ‘সাধারণ মানুষকে রেস্তোরাঁতে খাবার খেতে হলে আগের চেয়ে ১০০ টাকায় ১০ টাকা বেশি দিতে হবে। এতে সাধারণ আয়ের মানুষ বিপদে পড়বে। তাদের খরচ বাড়বে।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, গেল বছর গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশ। তার আগের বছর ২০২৩ সালে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৪৮। গত বছর উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ছিল মানুষ। সে তুলনায় মানুষের আয় বাড়েনি। উল্টো বেড়েছে বেকারের সংখ্যা। বিবিএসের ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বেকারের সংখ্যা ছিল ২৬ লাখ ৬০ হাজার, যা এক বছর আগে ওই সময়ে ছিল ২৪ লাখ ৯০ হাজার। অর্থাৎ এক বছরে বেকার বেড়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘ব্যয় বাড়ানোয় জীবনযাত্রা চালিয়ে নিতে সাধারণ মানুষ সঞ্চয় ভেঙে ফেলবে। এতে তরুণ-তরুণীরা পুঁজির অভাবে ব্যবসায় আসতে পারবেন না। একদিকে চাকরি নেই। অন্যদিকে ব্যবসা করতে পারবেন না। ফলে বেকারের সংখ্যা বাড়বে। আয় না বাড়লে পরিবারে সচ্ছলতা আসবে না। আর্থিক সংকট কমবে না। বরং বাড়বে।’