
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের টাউন হল মার্কেটে বুধবার আপেলের কেজি ৩২০ টাকায় বিক্রি হলেও এক দিন পর শুক্রবার সকাল থেকে বিক্রি হয়েছে ৩৫০ টাকায়।
রবিবারও (১২ জানুয়ারি) তা একই ছিল।
শুধু আপেল নয়, মিষ্টি, বেকারিতে বিক্রি হওয়া সব খাবারের দামই ১০০ টাকায় গড়ে ১০ থেকে ১২ টাকা বেড়েছে। একইভাবে বেশির ভাগ রেস্তোরাঁয় খাবারের দাম গড়ে ১০ টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে ক্রেতাকে।
সাধারণ আয়ের মানুষদের বেশির ভাগই বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর আশায় ছিলাম যে দাম কমবে। কিন্তু দাম কমার পরিবর্তে অধ্যাদেশ জারি করে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যা আমাদের জন্য কষ্ট বয়ে আনবে।
মোহাম্মদপুরের টাউন হল বাজারের ফল বিক্রেতা মো. নাঈম খান ক্ষোভ প্রকাশ করে খবরের কাগজকে বলেন, ‘কয়দিন আগে আপেলের কেজি ছিল ৩২০ টাকা। সরকার ভ্যাট বাড়ানোর পর তা এখন ৩৫০ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি। আগে নাশপাতির কেজি ৩০০ টাকায় বিক্রি হলেও আজকে (রবিবার) ৩২০ টাকার বেশি বিক্রি হচ্ছে। বেদানার দামও কেজিতে ১০০ টাকা বেড়ে ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরকার ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানোর কারণেই হঠাৎ করে এভাবে দাম বেড়ে গেছে। দাম বাড়ায় আগের চেয়ে বিক্রি কমেছে। সরকার সাধারণ মানুষকে কষ্টে ফেলেছে। একই সঙ্গে ব্যবসারও ক্ষতি করেছে।’
এ সময় জাহিদুর রহমান নামে এক ক্রেতা বলেন, ‘আগে থেকেই বাজারে সবকিছুর দাম চড়া ছিল। হঠাৎ করে এই সরকার যেভাবে ইচ্ছামতো শুল্ক ও ভ্যাট আরোপ করেছে। তাতে সব জিনিসের দাম আরও বেড়ে গেছে। জ্বলন্ত আগুন আরও উসকে দেওয়া হয়েছে।’
জুস, মিষ্টি, বেকারি আইটেম, রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা বাড়তি ভ্যাট ও শুল্ক আরোপের কড়া সমালোচনা করে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর আদেশ সংশোধন করে কমানো না হলে অনেকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে।
আইএমএফের শর্ত পূরণ করতে গিয়ে চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) মাঝপথে বিশেষ অধ্যাদেশ জারি করে প্রায় ১০০ পণ্য ও সেবায় ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এসব পণ্যের মধ্যে ফল, জুস, মিষ্টি, বেকারি ফুড রয়েছে। আবার রেস্তোরাঁর খাবারের দামে ভ্যাট বাড়ানোয় খাবারের দামও বাড়বে। এতে সবার মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আগে বিভিন্ন পণ্যের ওপর ভ্যাট ৫ থেকে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ আরোপ করা ছিল। নতুন করে বাড়িয়ে তা ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। আম, কমলালেবু, লেবুজাতীয় ফল, আঙুর, লেবু, পেঁপে, তরমুজ, আপেল ও নাশপাতি, ফলের রস, সবজির রস, তামাক, বাদাম, ফ্রুট ড্রিংকস, আর্টিফিশিয়াল বা ফ্লেভার ড্রিংকস ও ইলেকট্রোলাইট ড্রিংকস (কার্বোনেটেড ও নন-কার্বোনেটেড), তামাকযুক্ত সিগারেট মানুষকে আকৃষ্ট করে। কিন্তু এসব পণ্যে সম্পূরক শুল্ক ৫ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
সার্বিক ব্যাপারে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সাবেক সহসভাপতি ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক হাফেজ হারুন-অর-রশিদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা ভ্যাট দিয়ে ব্যবসা করতে চাই। কিন্তু হঠাৎ করে অর্থবছরের মাঝপথে যেভাবে বাড়তি শুল্ক ও ভ্যাটের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে তা ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। কারণ এমনিতেই তো অধিকাংশ পণ্যের দাম বেশি। কিন্তু মানুষের আয় বাড়েনি। ব্যবসায়ীদেরও বিক্রি বাড়েনি। লোকসান করে আমাদের ব্যবসা করতে হচ্ছে। সরকারের এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হবে। তা না হলে আমাদের অনেকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে।’
দামের ব্যাপারে টাউন হল বাজারের আফজাল ফল ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী মো. রাজু খবরের কাগজকে বলেন, ‘ডলারের কারণে আগে থেকে বিভিন্ন ফলের দাম বেশি। আগের মতো কাস্টমার আসে না। তারপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এটা খুবই কষ্টকর। আগে কম দামে বিক্রি করা হলেও এখন নাশপাতি, আপেল, আঙুর, বেদানার কেজিতে ২০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। শুধু এই বাজারেই নয়, কারওয়ান বাজার, হাতিরপুলসহ বিভিন্ন বাজারের খুচরা ফল বিক্রেতারা বলছেন, সরকার হঠাৎ করে এসব পণ্যের দাম বাড়ানোয় বাজারে খারাপ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। অনেকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ লোকসান করে ব্যবসা করা যাবে না।
জুসের ওপরও বাড়তি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। সম্পূরক শুল্ক ৫ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। মানুষকে গরমকালে তো বটে, শীত মৌসুমেও জুস একটু স্বস্তি ও তৃপ্তি দেয়। গতকাল টাউন হল বাজারের সিঙ্গাপুর জুসের বিক্রয়কর্মী রুহুল আমিন বলেন, ‘শুনেছি সরকার ফলের ওপর শুল্ক বেশি বসিয়েছে। এ জন্য ফলের দামও বেড়ে গেছে। কিন্তু জুসেও শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। তবে দাম বাড়ানো হয়নি। লোকসান করে আগের মতোই আমের জুস ১২০ টাকা গ্লাস, মাল্টার জুস ১৫০ টাকা গ্লাস বিক্রি করা হচ্ছে। এভাবে লোকসান করে ব্যবসা করা যাবে না। মালিক হয়তো রাতেই দাম বাড়াতে পারে। তখন আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হবে।’ ধানমন্ডির প্রধান সড়কসহ বিভিন্ন বাজারের জুস বিক্রেতারাও বলেন, ফলে ও জুসে শুল্ক বাড়তি আরোপ করা হয়েছে। এ জন্য দাম বেড়ে গেছে।
মিষ্টান্ন ভান্ডার, তৈরি পোশাকের শোরুম বা বিপণিবিতানে পণ্য ও সেবা বিক্রিতে থাকা বিদ্যমান ভ্যাট বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতদিন তা সাড়ে ৭ শতাংশ ছিল। ফলে বাজারে মিষ্টির দাম বাড়তির দিকে। এ ব্যাপারে কলাবাগানের মুসলিম সুইটসের ম্যানেজার নন্দন ঘোষ বলেন, ‘শুনেছি সরকার হুট করে বছরের মাঝপথে ভ্যাট বাড়িয়েছে। এটা ঠিক করেনি। কারণ এমনিই সবকিছুর দাম বাড়তি। ক্ষীর, স্পেশাল চমচম ৫০০ টাকা কেজি, কালোজাম ও রসগোল্লা ৩০০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে।’ টাউন হল বাজার, মিরপুর, মালিবাগসহ বিভিন্ন বাজারের মিষ্টান্ন ভান্ডারের বিক্রয়কর্মীরা বলেন, এভাবে দাম বাড়ানোর ফলে বিক্রি কমে যাবে। কারণ সব জিনিসের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে।
মানুষ কর্মব্যস্ততার কারণে বাসাবাড়ির বাইরে যান। প্রয়োজন হলে রেস্তোরাঁ বা হোটেলে খাবার খেয়ে নেন। কিন্তু এই খাতেও ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। এ ব্যাপারে গ্রিন রোডের বৈশাখী বাংলা রেস্তোরাঁর ম্যানেজার গোলাম হোসেন গোলাপ ও টাউন হল বাজারের জান্নাত হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার মো. রিপন বলেন, বিভিন্ন কারণে মানুষ খুব কষ্টে আছেন। তার পরও ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। এতে বিক্রি করে যাবে। ব্যবসা করা কঠিন হয়ে যাবে। তাই প্রত্যাহার করা উচিত।
বিভিন্ন সুপারশপেও ফল, সবজি থেকে শুরু করে নিত্যপণ্য বিক্রি হয়। গতকাল গ্রিন রোডের স্বপ্ন আউটলেটে ওই এলাকার সাইদুর রহমান নামে এক অবসরপ্রাপ্ত শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘সবকিছুর দাম এমনিতেই বেশি। অন্তর্বর্তী সরকার দাম না কমিয়ে শুল্ক, ভ্যাট বাড়িয়ে বাজারে উত্তাপ ছড়িয়ে দিয়েছে। কোনো মন্তব্য করতে চাই না। কারণ আমাদের কথা কেউ শুনবে না।’
জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলিম আখতার খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকার রাজস্ব বাড়াতে বেশি করে শুল্ক ও ভ্যাট আরোপ করেছে। এটা সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত। বিধিগত বিষয়। এখানে ভোক্তা অধিদপ্তরের বলার কিছু নেই। কিন্তু কেউ যদি তারচেয়ে অতিরিক্ত দাম আদায় করে সেটা অনৈতিক ব্যাপার। আমরা তা দেখার জন্য বাজার মনিটরিং করি, জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা হয়, জরিমানা করা হয়।’