
তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে আন্দোলন ও ছোটখাটো অবান্তর দাবি নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িছে পড়ছে চট্টগ্রামের পোশাক কারখানায়। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হলেও দিন দিন যেন ‘আবদার’ বাড়ছে। ফলে শ্রমিকদের নানা অজুহাতে কর্মবিরতি সড়ক অবরোধ, কাজে যোগ না দেওয়ায় চরম বিপাকে পড়তে হচ্ছে মালিকদের। এসব সংকটের কারণে কারখানা বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হচ্ছেন কর্তৃপক্ষ।
পোশাক কারখানার মালিকরা জানান, ম্যানেজারকে ছাঁটায়ের দাবি, দুপুরের ভাত, হিট অ্যালাউন্স (ভাতা), ওভার টাইমের অতিরিক্ত বিল, নাস্তার বিল এসবের জন্যও আন্দোলন করছেন শ্রমিকরা। কথায় কথায় কাজ বন্ধ করে দিচ্ছেন তারা। বর্তমানে শ্রমিকদের কাছে অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়ছেন মালিকরা। এক কারখানা অন্য কারখানার শ্রমিকদের মধ্যেও লাগছে সংঘর্ষ।
রবিবার (১২ জানুয়ারি) দুপুরে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) অ্যাডামস ক্যাপস অ্যান্ড টেক্সটাইলস লিমিটেডের শ্রমিকরা আন্দোলনে নামেন। দুপুরের বের হয়ে শ্রমিকরা আর কাজে যোগ দেননি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কাজ না করে সড়কের অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন দাবি আদায়ের মিছিলে অংশ নেন নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা। এ সময় তারা ১৩ দফা দাবি দিয়ে দাবি আদায়ের জন্য কারখানার ম্যানেজার ও মালিকদের সঙ্গে একটি পক্ষ বৈঠকে বসেন। কারখানার বাইরের সড়ক দিয়ে দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিকে যাওয়া চেষ্টা করা হলে শ্রমিকরা বাধা দেন। খবর নিয়ে জানা গেছে, বৈঠকের দাবি না মানায় বিকেলে শ্রমিকরা ওই কারখানা ভাঙচুর করেন।
এর আগের দিন শনিবার জেএমএস ও মেরিমো কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষে ৬০ জন শ্রমিক আহত হন। খবর পেয়ে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, সিএমপি ও শিল্প-পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। চীন-বাংলাদেশ যৌথ বিনিয়োগে পরিচালিত জেএমএস কারখানায় শ্রমিক আছে আড়াই হাজার। কোরিয়ান মালিকানাধীন মেরিমো কারখানায় শ্রমিক আছে ৪ হাজার ২০০। এ ঘটনায় মালিক কর্তৃপক্ষ তিনটি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হন।
সিইপিজেডের আরও আগে প্যাসিফিক জিন্সের কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলনে যান দুপুরের ভাতের জন্য। এশিয়া গ্রুপের পরিচালনাধীন সিস টেক্সের দুপুরের খাবারের মান ভালো না সেই জন্য শ্রমিকরা আন্দোলন করেছে। কোরিয়ান একটি কারখানায় বহিরাগত পুরুষ শ্রমিকরা আন্দোলন ও ভাঙচুর চালান চাকরির জন্য। এভাবে চট্টগ্রামের পোশাক কারখানায় আন্দোলন সংগ্রাম ও ভাঙচুর লেগেই আছে।
জানা যায়, ঢাকার গাজীপুর, আশুলিয়া ও নারায়ণগঞ্জের মতো চট্টগ্রামেও পোশাক শ্রমিকদের আবদার দিন দিন বাড়ছে। চট্টগ্রামের বড় শিল্প গ্রুপের কারখানাও শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতে না পারে কারখানা বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। সেখানে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে আন্দোলন ও কর্মবিরতি দুঃখজনক বলে দাবি করেছেন মালিক কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রামের ৬০৬টি গার্মেন্ট কারখানা রয়েছে। জুলাই-আগস্ট ছাত্র আন্দোলন ও দেশে বন্যার কারণে ১২ দিন বন্ধ ছিল। এতে এ খাতের ব্যবসায়ীরা ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়ে। এখন গার্মেন্ট মালিকরা শ্রমিকদের বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছেন।
চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) নির্বাহী পরিচালক মো. আবদুস সোবহান খবরের কাগজকে বলেন, ‘তুচ্ছ ঘটনায় মারামারিতে জড়িয়ে যাচ্ছেন শ্রমিকরা। কাল্পনিক দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনে নামছে। দেশের মধ্যে খুবেই নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে চলে ইপিডেজের বা বেপজার কারখানাগুলো। সেখানে শ্রমিকরা বারবার কাজ বন্ধ করে আন্দোলনে নামছে। কারখানা ভাঙচুর করছে, এটা খুবই দুঃখজনক। এখানে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন আছে বলে মনে হচ্ছে। এগুলো করে কেউ লাভবান হবে না, বরং দেশের জন্য ক্ষতি হবে। তাই আমি শ্রমিকদের শান্ত থাকার জন্য অনুরোধ করব। বেশি গরম পড়ছে এমন অজুহাতে গরমের জন্য ভাতা ‘হিট অ্যালাউন্স’ চায় শ্রমিকরা। এগুলো অবান্তর দাবি, দেশের কোথাও নেই, বিদেশে আছে কি না সন্দেহ।’
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক নেতা ও চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক এস এম আবু তৈয়ব খবরের কাগজকে বলেন, ‘চট্টগ্রামের গার্মেন্ট কারখানাগুলো খুব সুন্দরভাবে চলছিল। শ্রমিকরা মাস শেষে ঠিক সময়ে বেতন-ভাতা পেলে খুশি থাকে। তবে কোনো কোনো কারখানায় মালিক শ্রমিকদের চাহিদামতো বেতন-ভাতা পরিশোধ করে না। এতে সমস্যা দেখা দেয়। আমি মনে করি, ঢাকার আন্দোলনের কোনো প্রভাব চট্টগ্রামে নেই। চট্টগ্রামে যা আন্দোলন হচ্ছে, তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা।’
বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বায়ারদের কাছে টাকা আটকে যাচ্ছে। ব্যাংক থেকে টাকা তোলা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে চট্টগ্রামসহ দেশের সব পোশাক কারখানাতেই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপ ও আমেরিকার মতো দেশে সময়মতো পণ্য পাঠানো যায়নি। সব মিলিয়ে নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে পোশাক কারখানাকে। এর মধ্যে শ্রমিক অসন্তোষ তো আছেই।’