
প্রায় সাড়ে পাঁচ মাসেও জনপ্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর ভেতরের অস্থিরতা পুরোপুরি কাটেনি। দূর হয়নি সংকটও। কিছুটা গতিশীল হলেও নিয়োগ, পদায়ন-বদলি, পদোন্নতি বা চাকরিচ্যুতি, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-বিভক্তিসহ নানা ধরনের জটিলতা এখনো বিরাজ করছে রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই দুটি বিভাগে। এতে করে সারা দেশে নাগরিকসেবা, সামাজিক শৃঙ্খলা ও আইনি সুরক্ষার কাজটিও যথাযথভাবে হচ্ছে না। বরং কোথাও কোথাও পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকেও যাচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সরকারকে সম্পূর্ণভাবে গতিশীল করতে হলে রাষ্ট্রের এই দুই প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত সক্রিয় করতে হবে।
বিসিএসের ক্যাডারে বৈষম্য, জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ নিয়ে হট্টগোল, ৪৩তম বিসিএসে বহু প্রার্থী বাদ পড়াসহ নানা ইস্যুতে অভ্যন্তরীণ সংকট দেখা দেয় প্রশাসনে, যা এখনো পুরোপুরি দূর হয়নি। একইভাবে ভঙ্গুর এক পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়ানো পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরেও চলছে অস্থিরতা। নতুন পরিস্থিতিতে বদলি, চাকরিচ্যুতি, মামলা-গ্রেপ্তার, হামলার আশঙ্কায় পুলিশে এখনো কিছুটা আতঙ্ক রয়ে গেছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক সচিব ও বিপিএটিসির সাবেক রেক্টর এ কে এম আব্দুল আউয়াল মজুমদার খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রশাসনের মধ্যে অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা ও বিভাজন সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। এখন প্রশাসন বনাম ২৫ ক্যাডারে একটি জটিলতা বিদ্যমান। দুই পক্ষেরই কিছু নেতিবাচক দিকও আছে। যেমন: প্রশাসন ক্যাডার অন্য ক্যাডারদের ঠিকমতো মূল্যায়ন করে না, তাদের দাবিগুলো গুরুত্বের সঙ্গে নেয় না। দেখা যায়, প্রশাসন ক্যাডারে পদ না থাকলেও পদোন্নতি নিচ্ছে, বিপরীতে অন্য ক্যাডার সার্ভিসে শূন্য পদ আছে, যোগ্য কর্মকর্তাও আছেন অথচ তাদের পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে না। জনপ্রশাসন হবে সেবার ফেরিওয়ালা। প্রশাসনের লক্ষ্য এটাই হওয়া উচিত। কিন্তু এই চর্চা জনপ্রশাসনে হয় না। সবার প্রতি সুবিচার করতে হবে। কেউ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, বঞ্চিত না হন তা নিশ্চিত করা গেলেই এ ধরনের সংকট বা অস্থিরতা কেটে যাবে।’
এসব বিশৃঙ্খলার মাঝে প্রশাসন কোন পথে চলছে এমন প্রশ্নের জবাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে খবরের কাগজকে বলেন, “প্রশাসনে গতি ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। এটা কার্যক্রমের অংশ। তবে সবকিছু যে ‘স্মুথলি’ চলছে তা এখনই বলা যাবে না। কারণ আগের সরকার বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের কর্মকর্তাদের পদায়ন করে গেছে। এখন সব যদি বাদ দেওয়া হয় বা বদলি করে দেওয়া হয়, তবে তো প্রশাসন চলবে না। এ ছাড়া গত সরকারের আমলের অনেক কর্মকর্তাই কোনো না কোনো লাইনে বা পন্থায় উপদেষ্টাদের কাছে যাচ্ছেন। তারা তাদের দিয়ে পদায়ন বা পদোন্নতি বা অন্য কোনো তদবির করাচ্ছেন। এ ধরনের কিছু সমস্যাও এখন মোকাবিলা করতে হয়।”
অস্থির জনপ্রশাসন
গত ৮ আগস্ট বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তারা দাবি-দাওয়া নিয়ে সচিবালয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। এ সময় জনপ্রশাসন মন্ত্রণলয়ে ঘেরাওয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা। তাদের পথ ধরেই এ সময় আন্দোলনে নামে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ। পাশাপাশি আনসার বাহিনী, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্ররাও দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সচিবালয় ঘিরে আন্দোলন শুরু করেন। গতকাল সোমবারও সচিবালয়ের সামনে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বাদ পড়া পুলিশের এসআই ক্যাডেটরা।
এসব ঘটনাকে পাশ কাটিয়ে সারা দেশেই আলোচনায় গুরুত্ব পায় প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়সহ সারা দেশের প্রশাসনে বিশৃঙ্খলার বিষয়টি। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরেই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সুবিধাভোগী, দুর্নীতিতে অভিযুক্ত, অদক্ষ, দলবাজ কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করে। তাদের মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কিছু কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর, বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) নিয়োগ দিয়ে জনপ্রশাসনে সংযুক্ত করা, সচিবালয়ের বাইরে কর্মকর্তাদের দপ্তর বদল করা, মাঠ প্রশাসনের জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং অন্য কর্মকর্তাদের উঠিয়ে এনে কম গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করে সরকার। ফলে এমনও হয়েছে দীর্ঘদিন কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকেছে সচিবশূন্য। আবার মাঠ প্রশাসনে বেশ কয়েক দিন ডিসিশূন্য ছিল কয়েকটি জেলা। সরকারের এসব সিদ্ধান্তে অস্থিরতা শুরু হয় প্রশাসনে। এতে স্থবির হয়ে পড়ে সরকারের দিকনির্দেশনার বাস্তবায়ন।
তবে এই মূহূর্তে সারা দেশে আলোচনা হচ্ছে প্রশাসন ক্যাডার ও অন্য ২৫ ক্যাডার সার্ভিস কর্মকর্তাদের মাঝে বিভক্তি নিয়ে। এই বিভক্তির কারণে প্রশাসন ক্যাডার ও অন্য ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তারা নিয়েছেন পাল্টাপাল্টি অবস্থান। আরও রয়েছে ৪৩ বিসিএস ক্যাডারে যারা বাদ পড়েছেন তাদের আন্দোলন, যা নিয়ে ইতোমধ্যে সুরাহা করার কথা জানিয়েছে সরকার।
পুরোপুরি শক্ত হয়নি পুলিশের মনোবল
পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা পর্যায়ক্রমে অনেকটা উন্নতি হলেও সার্বিক নিরাপত্তাব্যবস্থা ও নাগরিকদের আইনি সুরক্ষার প্রশ্নে এখনো অস্থিরতা বিরাজ করছে। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রায় প্রতিদিনই পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের নানা পদে রদবদল হয়েছে। অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো ও ওএসডি করা হয়েছে। গত প্রায় পাঁচ মাসে পুলিশে বদলি বা পদায়নের সংখ্যাও অর্ধলাখের বেশি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হতাহত বা গুলি চালানোর ঘটনায় অনেক পুলিশ সদস্য ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন। অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। যারা চাকরি করছেন তাদেরও একটা অংশ নানা আতঙ্কে সময় পার করছেন। তার মাঝে আবার রাজনৈতিক প্রভাবও শুরু হয়েছে বলে আলোচনা হচ্ছে।
এদিকে পুলিশ বাহিনী বিগত আওয়ামী লীগের আমলে যেভাবে দলীয় নির্দেশনা বাস্তবায়ন করত এখনো আবার পুলিশের অনেকেই অন্য দল বা ক্ষমতার কেন্দ্রের মন জয় করার চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। দু-এক জায়গায় এখনো পুলিশের ওপর হামলার খবর আসছে। থানায় হামলা চালিয়ে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। গত ৬ জানুয়ারি চট্টগ্রামে পুলিশ পরিদর্শক নেজাম উদ্দিনকে প্রকাশ্যে মারধর করেন স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা-কর্মীরা। গত ২০ ডিসেম্বর সিলেটের আদালত চত্বরে এক পুলিশ কর্মকর্তাকে কিলঘুষি মারা হয়। এ রকম বিভিন্ন স্থানে পুলিশ আক্রান্ত হয়েছে। এর ফলে নিজের নিরাপত্তা শঙ্কায় দায়িত্ব পালনেও উদ্বিগ্ন থাকছেন পুলিশ সদস্যরা। ফলে মাঠপর্যায়ে নাগরিকের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দিতে গিয়ে পুলিশের দুর্বলতা প্রকাশ পাচ্ছে বারবার।
এ প্রসঙ্গে পুলিশের সাবেক আইজিপি মুহাম্মদ নুরুল হুদা খবরের কাগজকে বলেন, ‘৫ আগস্টের প্রেক্ষাপটে চরম অবনতি ঘটা দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি পুলিশ বাহিনী। তবে তারা চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে তা যায়নি। নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে এখানে সব শ্রেণির মানুষের সহযোগিতার বিষয় আছে। জনগণকে সহযোগিতা করতে হবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা জরুরি। এ ছাড়া এসব বিষয়ে সরকারের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও কঠোর পদক্ষেপ থাকতে হবে।’
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ৫ আগস্টের প্রেক্ষাপটে বর্তমানে পুলিশ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও তাদের কর্মকাণ্ডে নানা অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনাও ফুটে উঠছে। পদায়ন, বদলিসংক্রান্ত বিষয়গুলো এখন জটিল আকার ধারণ করছে। কাকে কোথায় দায়িত্ব দিলে ভালো কাজ হবে সেটার দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। তার মাঝে কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ বেশ ভালো উন্নতি করলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এখনো পুরোপুরি শৃঙ্খলা আনতে পারেনি। তিনি বলেন, এ পরিস্থিতি থেকে বের হতে আগের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে। জনগণের জন্যই প্রকৃতপক্ষে পুলিশকে কাজ করতে হবে। রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করলে ভবিষ্যতে আবারও নাজেহাল হওয়ার শঙ্কা থাকবে।
এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর খবরের কাগজকে বলেন, বর্তমানে পুলিশ সর্বোচ্চ পেশাদারত্ব ও আন্তরিকতার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। পুলিশ নাগরিকের সুরক্ষার জন্য কাজ করছে। পুলিশকে দায়িত্ব পালনে সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে।