
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে টানা এক দশকে বান্দরবানে শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন ডজনখানেকেরও বেশি আওয়ামী লীগ নেতা। নিজেদের পৈতৃক সম্পত্তি এবং ব্যবসা-বাণিজ্য না থাকলেও শুধু দলীয় পদ-পদবি ব্যবহার করে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কাজ ভাগবাঁটোয়ারা করে বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন এমন বেশ কয়েকজনের নাম উঠে এসেছে অনুসন্ধানে।
এসব নেতা দলের শীর্ষ পদে অবস্থান করার কারণে এদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহসও ছিল না কারও। একচেটিয়া নিজেরা এবং নিজেদের আত্মীয়স্বজন এবং পছন্দের মানুষদের কাজ দিয়ে পাল্টে ফেলেছেন নিজের ও পরিবারের ভাগ্য। ১০ বছরের ব্যবধানে এরা অর্থসম্পদ কামিয়ে পরিণত হয়েছেন বান্দরবানের এলিট শ্রেণিতে।
ব্যবসায়ী থেকে নিজেদের সমাজসেবক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক ধর্মীয় সংগঠনের পদও ছিল এদের দখলে। জেলা উন্নয়ন বোর্ড, এলজিইডি, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, জেলা পরিষদ, সড়ক বিভাগ ও গণপূর্ত বিভাগের গত ১০ বছরের কাজের প্রাপ্ত তথ্য, দলীয় ত্যাগী নেতা-কর্মীদের স্বীকারোক্তি এবং স্থানীয় ঠিকাদারদের সঙ্গে কথা বলে যারা এই সময়ে নিজেদের অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছেন তাদের কথা এখানে তুলে ধরা হলো।
ক্য শৈ হ্লা :
একসময় তিনি কারাতে মাস্টার ছিলেন। ওস্তাদ ক্য শৈ হ্লা হিসেবে সবমহলে তার পরিচিতি ছিল। রাজনীতিতে তার উত্থান বেশি দিনের নয়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০০ সালে প্রথম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হন। তবে সেবার চেয়ারম্যান হওয়ার পর তেমন কিছু করতে পারেননি তিনি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আবার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হলে ধীরে ধীরে তার ভাগ্য পাল্টাতে থাকে। এরপর টানা ১৫ বছর চেয়ারম্যান থাকায় পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বিগত ১৫ বছরে জেলা পরিষদ থেকে ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকার বেশি লুটপাট করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে ক্য শৈ হ্লার বিরুদ্ধে। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হওয়ায় জবাবদিহিও ছিল না। নিজে দলের সভাপতি হওয়ায় দলের কোনো নেতা-কর্মী কিছু বলার সাহস পেতেন না।
একসময় দলের ক্রীড়া সম্পাদক ছিলেন তিনি। পরে চেয়ারম্যান হলে দলের সভাপতি বনে যান ক্য শৈ হ্লা। এরপর থেকে নিয়োগ-বাণিজ্য, জায়গা দখল, পার্টনারশিপে ঠিকাদারি করে কামিয়েছেন বিপুল অর্থ। শহরের কালাঘাটা এলাকায় সরকারি টাকায় গড়ে তুলেছেন বিশাল সাম্রাজ্য। এ ছাড়া জেলার বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে তার ৮০০ একরের বেশি জায়গা। ঢাকা শহরেও রয়েছে বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট। নিজের এক ছেলেকে পড়াশোনা করিয়েছেন অস্ট্রেলিয়াতে। পরে সে থাইল্যান্ডে বিয়ে করে। জানা গেছে টাকা পাচার করে থাইল্যান্ডেও বাড়ি করেছেন ক্য শৈ হ্লা। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে আত্মগোপনে রয়েছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত পাঁচটি মামলা হয়েছে।
অমল কান্তি দাশ:
দীর্ঘদিন ধরে বান্দরবান পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতির পদে আছেন অমল কান্তি দাশ। পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি হলেও স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে সখ্য থাকায় জেলার গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে পরিচিত।
হোটেল মালিক সমিতির সভাপতি, রেড ক্রিসেন্ট ইউনিটের সেক্রেটারি, ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি, বাজার ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদের সভাপতির পদও ছিল তার দখলে। মাত্র ১০ বছরে তার আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে চোখে পড়ার মতো। বেশ কয়েক বছর আগেও যিনি অন্যের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কেরানির চাকরি করতেন, মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে তিনি এখন বান্দরবানের প্রথম সারির ব্যবসায়ীদের একজন। সাবেক পার্বত্যমন্ত্রীর কাছের মানুষ হওয়ার সুবাদে এলজিইডি ও উন্নয়ন বোর্ড ছিল তার দখলে। বেশির ভাগ বড় বড় কাজ তার নামে বরাদ্দ থাকত।
গত ১০ বছরে শুধু এলজিইডি ও উন্নয়ন বোর্ডের বড় বড় কাজ করতেন অমল কান্তি। এখনো তার কোটি কোটি টাকার কাজ চলমান রয়েছে। গড়ে তুলেছেন অঢেল সম্পদ। জেলা শহরের রাজার মাঠ এলাকায় রয়েছে সাত তলা বাড়ি। নিউ গুলশান এলাকায় পাঁচতলা দুটি বাড়ি। কালাঘাটায় রয়েছে ২০ শতক জায়গার ওপর তিনতলা বাড়ি। শৈল শোভা হাউজিং সোসাইটিতে রয়েছে ১০ শতকের একটি প্লট, যার মূল্য কোটি টাকার বেশি।
এ ছাড়া জেলার বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে অসংখ্য ব্যবসায়িক প্লট, ফসলি জমি। প্রভাব খাটিয়ে লিজ নিয়ে নির্মাণ করেছেন হোটেল হিলটন ও হিলকুইন নামের দুটি তিন তারকা মানের হোটেল। ব্যবসায়ীরা জানান, প্রচুর নগদ টাকার মালিক তিনি। এই টাকা দিয়ে ‘উন্নয়ন’ কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন, যেগুলো চলমান রয়েছে। আছে দেশে-বিদেশে নামে-বেনামে বিশাল সম্পত্তি। ছেলেকে পড়াশোনা করার জন্য পাঠিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায়। অর্থপাচার করে সেখানেও বাড়ি কিনেছেন বলে অভিযোগ আছে। দেশের সম্পত্তি সাদা করতে বেশ কয়েকবার শ্রেষ্ঠ করদাতাও হয়েছেন তিনি। ৫ আগস্ট থেকে পলাতক। তার নামে এ পর্যন্ত ৫টি মামলা হয়েছে।
লক্ষী পদ দাস:
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের সদস্য হওয়ায় দলের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছ থেকে চাঁদাবাজি করে লক্ষী পদ দাস কামিয়েছেন বিপুল অর্থ। জেলা পরিষদের সদস্য হওয়ার সুবাদে নিজের আত্মীয়-স্বজনদের চাকরি দিয়েছেন বিভিন্ন দপ্তরে। নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য, জায়গা দখল, বিভিন্ন ব্যবসায়ীকে শেল্টার দেওয়া, ইটভাটার শেয়ার, বন বিভাগের গাছ কাটার পারমিট, বিভিন্ন ঠিকাদারের সঙ্গে পার্টনারশিপে ব্যবসাসহ নানা অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
তার দৃশ্যমান সম্পদ না থাকলেও শত শত একর জায়গা, নগদ টাকা, নামে-বেনামে ঢাকা চট্টগ্রামে ফ্ল্যাট, এমনকি বিদেশেও বাড়ি রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। দলে একচ্ছত্র আধিপত্য থাকায় তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পাননি দলীয় নেতা-কর্মীরা। ক্ষমতায় থাকা কালে তার অবৈধ সম্পদ নিয়ে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হলেও দুদকের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো হয়রানি করার জন্য ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করেন লক্ষী পদ দাস। সেই মামলা অবশ্য আমলে নেননি আদালত। গত ৫ আগস্টের পর থেকে পলাতক রয়েছেন তিনি। ইতোমধ্যে পাঁচ মামলার আসামি করা হয়েছে তাকে।
মোজাম্মেল হক বাহাদুর:
জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও জেলা পরিষদের সদস্য হওয়ায় প্রভাব খাটিয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কনভেনার হন মোজাম্মেল হক বাহাদুর। তিনি গত ১০ বছর পাবলিক হেলথের একচেটিয়া কাজ করে কামিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। নিজের ভাই ও আত্মীয়স্বজন ছাড়া কেউ এই কাজ করার সুযোগ পাননি।
পাবলিক হেলথের কাজ ভাগবাঁটোয়ারা করে শুধু কমিশন বাবদ কামিয়েছেন শতকোটি টাকা। এরপর সেই কাজে আবার ঠিকাদারের সঙ্গে পার্টনার হিসেবে থাকতেন। কাজ দেওয়া হতো বাহাদুরের পছন্দের ঠিকাদারকে। তার কাছ থেকে তিনি মোটা অঙ্কের কমিশন নিতেন। এ ছাড়া দলের শীর্ষনেতা হওয়ার কারণে এলজিইডি পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের বড় বড় কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন। শুধু নিজে নন, তার ভাই, আত্মীয়-স্বজনও তার ছত্রচ্ছায়ায় হয়েছেন কোটি টাকার মালিক।
শহরের ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় নির্মাণ করেছেন বান্দরবানের প্রথম লিফট দেওয়া আটতলা বাড়ি। চট্টগ্রামের ওয়াসার মোড়ে ২ হাজার স্কয়ার বর্গফুটের স্পেস কিনে গড়ে তুলেছেন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান- বাহাদুর ফেব্রিক্স অ্যান্ড টেইলার্স। থানচি বাজারে রয়েছে তিনটি প্লট। এ ছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রামে রয়েছে বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট। মালয়েশিয়াতেও বাড়ি কিনেছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
ক্য সা প্রু মার্মা :
বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও জেলা পরিষদ সদস্য ক্য সা প্রু মার্মা দলীয় প্রভাব খাটিয়ে গত ১০ বছরে শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন। জেলা পরিষদের কৃষি বিভাগের কনভেনার হওয়ার সুবাদে বিগত বছরগুলোতে কৃষকদের মধ্যে বিতরণের জন্য জেলা পরিষদের শত শত কোটি টাকার কৃষি যন্ত্রপাতি কেনার টেন্ডার, দুস্থদের মধ্যে গবাদিপশু বিতরণ, জঙ্গল পরিষ্কার, বৃক্ষ রোপণের মতো প্রকল্প থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন শতকোটি টাকা।
দলীয় প্রভাব খাটিয়ে উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে বিতরণ করা কৃষি যন্ত্রপাতি এবং সার বীজ উপকরণের টেন্ডারও বরাদ্দ নিতেন তিনি। জেলা পরিষদ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এগুলোর কোনো অডিটও হতো না। এভাবে গত ১০ বছরে নীরবে শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি।
এ ছাড়া কৃষি বিভাগের মাধ্যমে বরাদ্দ শতকোটি টাকার কফি কাজু বাদাম প্রকল্পে ভুয়া বাগান দেখিয়ে প্রকল্পের টাকা হাতিয়ে নেন। তার দৃশ্যমান সম্পদ না থাকলেও বান্দরবান শহরের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে রয়েছে বিলাসবহুল বহুতল বাড়ি। এ ছাড়া রুমা, থানচি, রোয়াংছড়ি ও সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় তার ৫০০ একরের বেশি জমি রয়েছে। গত ৫ আগস্টের পর জনরোষের ভয়ে তিনিও পলাতক রয়েছেন।
শফিউল্লাহ:
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শফিউল্লাহ। নাইক্ষ্যংছড়ি হাজী এমএ কালাম ডিগ্রি (বেসরকারি) কলেজে প্রভাষক হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করার পর নামের আগে অধ্যাপক ব্যবহার করতে থাকেন। একসময় আরএসও নেতা হিসেবে র্যাবের হাতে আটক হয়ে কারাগারেও ছিলেন। পরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে ক্য শৈ হ্লা চেয়ারম্যানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলে বনে যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি।
পরে ক্য শৈ হ্লাকে টাকা দিয়ে বাগিয়ে নেন উপজেলা চেয়ারম্যানের নমিনেশন এবং বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করে ভোট জালিয়াতি করে ২০১৯ সালের উপজেলা নির্বাচনে উপজেলা চেয়ারম্যানও হয়ে যান। এরপর থেকে জেলা পরিষদের বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ নিজের ভাগনে ও আত্মীয়স্বজনের নামে নিজেই করতেন। প্রভাব খাটিয়ে শত শত একর রাবারের প্লট নিজের নামে নেন তিনি। সোনাইছড়িতে বিশাল জায়গা দখল করে গড়ে তোলেন রিসোর্ট।
অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিয়ে এবং বাংলাদেশি পাসপোর্টের ব্যবস্থা করে দিয়ে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় তার রয়েছে হাজার একরের বেশি জমি। চট্টগ্রাম ও ঢাকায় বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট, কক্সবাজারের নামিদামি হোটেলের শেয়ার এবং বেশ কিছু জমিও রয়েছে বলে জানা গেছে। ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি পলাতক রয়েছেন।
তাহের কোম্পানি:
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও এমপির প্রতিনিধি হিসেবে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বেশির ভাগ উন্নয়ন কাজ করেছে তাহের কোম্পানি। এলজিইডি উন্নয়ন বোর্ডের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সব কাজ তার নামে বরাদ্দ থাকত। গত ১০ বছর দলীয় পদবি ব্যবহার করে এ দুটি ডিপার্টমেন্টের কাজ করে কামিয়েছেন শত কোটি টাকা। এ ছাড়া তার রয়েছে একটি ইটভাটা, কক্সবাজারে নামিদামি জায়গা, আবাসিক হোটেলের শেয়ার। চট্টগ্রাম শহরেও বাড়ি আছে বলে জানা গেছে। ৫ আগস্টের পর থেকে এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে আছেন তিনি।
প্রদীপ কান্তি দাশ:
লামা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রদীপ কান্তি দাশ। তিনিও গত ১০ বছর ধরে দলীয় পদ-পদবি ব্যবহার করে বনে গেছেন শতকোটি টাকার মালিক। উপজেলা পর্যায় থেকে এত অল্প বয়সে বিপুল সম্পত্তির মালিক হওয়ায় এলাকার অনেকের কাছে ঈর্ষার পাত্র তিনি। তবে ক্ষমতাশালী হওয়ায় তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস করেননি কেউ।
জানা গেছে, দেড় দশক আগেও লামা বাজারে একটি দোকানে দর্জির কাজ করতেন প্রদীপ কান্তি। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাজনীতিতে সক্রিয় হন। এরপর স্থানীয় সংসদ সদস্যের মন জয় করে হয়ে যান এলাকায় এমপির প্রতিনিধি। এরপর লামার উন্নয়নমূলক সরকারি কাজ, চাল-গমের ডিও আর চাঁদাবাজি করে গড়ে তোলেন বিপুল অর্থসম্পদ।
লামা উপজেলায় তার রয়েছে বেশ কয়েকটি ইটভাটা। লামা বাজারে ১০-১২টি প্লট। সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচনে দল থেকে ভাইস চেয়ারম্যানের নমিনেশন বাগিয়ে নেন এবং নগদ ২ কোটি টাকা খরচ করে নির্বাচনে জয়লাভ করেন। নামে-বেনামে তার রয়েছে অনেক জায়গা-জমি। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ফ্ল্যাট। গত ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি পলাতক রয়েছেন। এখন পর্যন্ত দুই মামলার আসামি তিনি।
এসব নেতা ছাড়াও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দলীয় পদ-পদবি ব্যবহার করে গত ১০ বছরে বান্দরবানে শূন্য থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন এমন অনেকের নাম শোনা গেছে মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে। দুদকের মাধ্যমে তদন্ত হলে এরকম কমপক্ষে শতাধিক নেতাকে খুঁজে পাওয়া যাবে বলে জানান তারা। তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে এসব নেতার সম্পর্ক না থাকলেও শুধু দলীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে টাকা কামানোর প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত ছিলেন তারা। শুধু নিজেই নন, আত্মীয়-স্বজনদেরও সুযোগ করে দিয়েছেন টাকা কামানোর।
গত ১৫ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, এলজিইডি জেলা পরিষদ, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, গণপূর্ত বিভাগসহ সরকারি প্রতিটি বিভাগ ও দপ্তর আওয়ামী লীগ নেতাদের দখলে ছিল। এরাই ঘুরেফিরে কাজ ভাগবাঁটোয়ারা করে নিয়ে কামিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। এদের প্রভাব ও সিন্ডিকেটের কারণে অন্য রাজনৈতিক দলের ঠিকাদার, দল-নিরপেক্ষ ঠিকাদার, এমনকি আওয়ামী দলীয় ঠিকাদাররাও কাজ করার সুযোগ পাননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, দলীয় নেতাদের ফোনকল পেয়ে রাজনৈতিক নেতাদের কাজ দিতে বাধ্য হয়েছেন তারা। এমনকি তাদের সঙ্গে বসে তাদের সুবিধামতো কাজের এস্টিমেট করতে বাধ্য করা হতো। অনেক ঠিকাদারকে অগ্রিম বিল দিতেও বাধ্য হতেন তারা। নেতাদের কথা না শুনলে দুর্ব্যবহার করতেন। বদলি করার হুমকিও ছিল। চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে দলের নির্দিষ্ট ঠিকাদারদের সুবিধা দিতে হতো বলে জানান নির্বাহী প্রকৌশলীরা।
এ বিষয়ে বান্দরবান জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি অং চ মং মার্মা বলেন, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগ প্রতিটি ডিপার্টমেন্টকে এমনভাবে দলীয়করণ, আত্মীয়করণ করেছে যে, দলের নেতারা ছাড়া অন্য কেউ কাজ করতে পারতেন না। সেই সুযোগে তারা শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন।
এ বিষয়ে বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও নাগরিক পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী মজিবর রহমান বলেন, গত ১০ বছরে বান্দরবানে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক তৎপরতা ছিল না। কর্মীদের খোঁজখবর কোনো নেতা নেননি।
সবাই ঠিকাদারি টেন্ডারবাজি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। একেকজন নেতা কোটি টাকার মালিক হয়েছেন আর আখের গুছিয়ে সটকে পড়েছেন। তবে এই অপকর্মের সঙ্গে বিভিন্ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীরাও জড়িত ছিলেন। কমিশনের লোভে তারা তাদের অন্যায়ভাবে প্রশ্রয় দিয়েছেন। ঠিকাদারদের আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি নির্বাহী প্রকৌশলীদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। তারাও কমিশন নিয়ে একেকজন শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এদেরও ছাড় দেওয়া যাবে না।
এ বিষয়ে বান্দরবানের আইনজীবী আবু জাফর জানান, গত ১৫ বছরে কোনো জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা না থাকায় আওয়ামী লীগের নেতারা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় কার্যালয়ে পরিণত করেছেন। আর এসব কাজ ভাগবাঁটোয়ারা করতে গিয়ে অনেক বেআইনি কাজও করেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। আর তদন্তের মাধ্যমে শুধু তাদের নয়, তাদের পরিবারের সম্পদের হিসাবও বের করাটা জরুরি।