
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা আলোচনা-সমালোচনা আছে। ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে ঘোষণাপত্র ঘোষণার ডেডলাইন দিয়ে বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তির কারণে পিছু হটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এরপর ঘোষণাপত্র তৈরির দায়িত্ব নেয় ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার। ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে পঞ্চম দফায় বৃহস্পতিবার (১৬ জানুযারি) সর্বদলীয় সংলাপে বসবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই সংলাপে আলোচনা ও প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হবে যে ঘোষণাপত্রটি দেওয়া হবে কি না? কিন্তু সংলাপ শুরুর আগেই ঘোষণাপত্রের কয়েকটি ধারা নিয়ে ঘোর দ্বিমত রয়েছে বিএনপিসহ বেশির ভাগ দলের। বিশেষ করে সংবিধান বাতিলসহ কয়েকটি ধারার বিপক্ষে তারা। তবে অন্যান্য ধারার ব্যাপারে তারা একমত।
তবে বুধবার (১৬ জানুযারি) রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কতটি দলকে আমন্ত্রণ করা হয়েছে কিংবা সর্বদলীয় সংলাপের স্থান ও সময় নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে বিস্তারিত কিছুই জানানো হয়নি। রাতে কয়েকটি দলের নেতারা জানান, তারাও সংলাপের বিষয়ে কিছুই জানেন না। তবে আমন্ত্রণ পেলে সংলাপে অংশ নেবেন এবং সুনির্দিষ্ট মতামত তুলে ধরবেন। তবে কয়েকটি দল নাও যেতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার জানান, তিনি সংলাপের বিষয়ে বিস্তারিত জানেন না। তবে বৈঠকের নির্ধারিত দিন ঠিক আছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের দাবি, অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের খসড়া আগে থেকে তৈরি করা হয়েছে। তাদের কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। দু-একটি দলকে ঘোষণাপত্রের খসড়া দেওয়া হলেও বেশির ভাগ দল ও জোট পায়নি। এমনকি দলগুলোও নিজেদের মধ্যে আলোচনা করার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগও পায়নি। ফলে এবারের সংলাপে অংশ নিয়ে লাভ কী?
গত মঙ্গলবার রাজধানীর গুলশানে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের কাছ থেকে ঘোষণার খসড়াপত্র পেয়েছি। উনি আমাদের মতামত জানাতে অনুরোধ করেছেন। বিষয়টা এত বেশি সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ যে এক দিনের নোটিশে এটা করা সম্ভব নয়। আমরা এ বিষয়ে আরও আলোচনা করব। অন্যান্য দল ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ যারা আছেন, তাদের সঙ্গেও কথা বলতে হবে। কারণ সংবিধানের ব্যাপারেও বহু কথা আছে, যেগুলো আমাদের দেখতে হবে।’
জানা গেছে, জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রে সংবিধান ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলো থেকে মতানৈক্য তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে বিদ্যমান সংবিধান সংশোধন নয়; বরং সংবিধান পুনর্লিখনের প্রস্তাব দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। তাদের প্রস্তাব, নির্বাচনের মাধ্যমে গণপরিষদ গঠন করতে হবে। সেখানেই নতুন সংবিধান অনুমোদন করা হবে। তবে বিএনপি সংবিধান সংশোধন বা সংস্কারের পক্ষে থাকলেও বাতিলের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। বিএনপির সঙ্গে মিল রেখে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা মিত্র ও বামদের বড় অংশই সংবিধান বাতিলের বিপক্ষে। তবে ইসলামপন্থি দল, গণসংহতি আন্দোলন ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন সংবিধান পুনর্লিখনের পক্ষে।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি হামিদুর রহমান আযাদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘তারা এখনো সংলাপের আমন্ত্রণ পাননি। ঘোষণাপত্র নিয়ে আগাম কিছু বলা ঠিক হবে না। তিনি বলেন, দেশ ও জাতির স্বার্থ বিবেচনা করে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমরা একমত। আলোচনা টেবিলে আমরা আমাদের মতামত তুলে ধরব।’
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘এবারের সংলাপে না যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ ঘোষণাপত্রে কী কী থাকবে তা জানি না। আমাদের কোনো খসড়াও দেওয়া হয়নি। আমরা কোনো আলোচনা করতে পারিনি। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলকে ঘোষণাপত্রের খসড়া দেওয়া হয়নি।’
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, ‘সংলাপের দাওয়াত অন্তত এক সপ্তাহ আগে দেওয়া উচিত। জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের চেয়ে এখন বেশি জরুরি জাতীয় নির্বাচন এবং তার রোডম্যাপ। কিন্তু সরকার অন্যদিকে ফোকাস করে কালক্ষেপণ করতে চাইছে। আমরা সরকারকে সহযোগিতা করছি। কিন্তু সরকার সেভাবে দলগুলোকে সহযোগিতা করছে না, এটা দুঃখজনক।’
১২-দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের খসড়া দু-একটি দল পেলেও তারা পাননি। তাই কীভাবে সংলাপে গিয়ে তারা একমত পোষণ করবেন? কারণ জোটের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে তো ঘোষণাপত্রের বিষয়ে একমত হতে পারেননি। তারা (সরকার) একটা খসড়া করে আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারে না?’
আলাদাভাবে ঘোষণাপত্র দেওয়ার উদ্যোগ বিএনপির
এদিকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বিষয়ে আলাদাভাবে ঘোষণাপত্র দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। শেখ হাসিনার পতনের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দল ও জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে দ্রুত সময়ের মধ্যে তা চূড়ান্ত করা হবে। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে কাজও শুরু হয়েছে। সমমনা দল এবং জোটের নেতারা জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে তাদের পরামর্শ বিএনপির কাছে দেবেন। সবকিছু বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করে বিএনপি চূড়ান্ত ঘোষণাপত্র দেবে।
বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর একাধিক নেতা জানান, ৩৬ জুলাই কিংবা ৫ আগস্ট বিজয়ের গল্পটা এক দিনের কিংবা ৩৫ দিনের নয়। গল্পটা শুরু হয়েছিল ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি (ওয়ান-ইলেভেন)। সে জন্যই তারা ‘ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে বিজয়গাথা’ শীর্ষক ঘোষণাপত্র তুলে ধরতে চান। যেখানে ওয়ান-ইলেভেনের ঘটনার নেপথ্য কাহিনি এবং ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়বস্তু তুলে ধরা হবে। এরপর আওয়ামী লীগের শাসনামল (২০০৯-১৩), ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচন, আওয়ামী লীগ শাসনামল (২০১৪-১৮), ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর প্রহসন ও ভোট ডাকাতির নির্বাচন, আওয়ামী লীগের দুঃসহ শাসনামল (২০১৮-২৩), ২০২৪ সালের ডামি তথা একতরফা নির্বাচন এবং নির্বাচন-পরবর্তী সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিএনপি ও বিরোধী দলের ভূমিকা, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি ও বিরোধী দলের ভূমিকা (২০০৮-২৪) এবং আগামীর প্রত্যাশা অন্তর্ভুক্ত থাকবে।