
দেশে এখনো উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে সার্বিকভাবে গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। অন্যদিকে বিনিয়োগের অন্যতম নিয়ামক বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে সর্বনিম্ন অবস্থায় রয়েছে। গত অক্টোবর শেষে এই হার দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ। নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গত পাঁচ মাসে ৫০ বেসিস পয়েন্ট করে তিন দফা নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে, যা বর্তমানে ১০ শতাংশ রয়েছে। তবে নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হচ্ছে না। বরং এর প্রভাবে বাজারে সব ধরনের ঋণের সুদহার বেড়ে গেছে। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদাও তলানিতে নেমে এসেছে, যা দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এই অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী মুদ্রানীতিতে কী পদক্ষেপ নেবে, সেটাই দেখার বিষয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আবার নীতি সুদহার বাড়াবে, নাকি বিনিয়োগ বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেবে- সেটাই দেখার বিষয়।
জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি চলতি জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে ঘোষণা করা হবে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনাও শুরু করেছে। এ বিষয়ে গত রবিবার থেকে আলোচনা শুরু করেছেন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। এটা হবে বর্তমান গভর্নরের প্রথম মুদ্রানীতি ঘোষণা। এর আগে প্রথা অনুযায়ী গত রবিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন গভর্নর। এ সময় তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি না কমলে নীতি সুদহার আরও বাড়ানো হবে। গত মঙ্গলবার ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের সঙ্গেও বৈঠকে বসেন গভর্নর। সেখানেও একই মতামত তুলে ধরেন তিনি। যদিও অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘উন্নত দেশে কার্যকর হলেও আমাদের দেশের বাস্তবতায় নীতি সুদহার বাড়িয়ে মুদ্রানীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। তাই নীতি সুদহার না বাড়িয়ে বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব দিতে হবে। সেই সঙ্গে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করতে হবে এবং বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।’
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মঈনুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে খুব একটা সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। আগামীতেও কোনো সুফল আসবে বলে মনে হচ্ছে না। বরং বাংলাদেশ ব্যাংককে বাজার তদারকি বাড়ানোর মাধ্যমে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেট ভাঙার বিকল্প নেই।’ এই অবস্থায় নীতি সুদহার না বাড়িয়ে বিনিয়োগ বাড়ানোর দিকে বেশি নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
একই বিষয়ে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘উন্নত বিশ্বে সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হলেও আমাদের দেশে সেটা সম্ভব নয়। কারণ সেসব দেশে ৯০ শতাংশ ঋণই ভোক্তাঋণ। তারা বাড়ি, গাড়িসহ নানা কাজে ঋণ নেন। ফলে সেসব দেশে সুদহার বাড়িয়ে ভোগব্যয় কমানো যায়। আর আমাদের দেশে ৮৫ শতাংশ ঋণই ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য নেওয়া হয়। ফলে এখানে সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়, সরকারি তথ্যেই যার প্রমাণ পাওয়া যায়। বর্তমানে সুদহার সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। বরং বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধিও তলানিতে ঠেকেছে। অর্থাৎ দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে না। ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধিও কমে সর্বনিম্ন অবস্থায় নেমেছে। কারণ ১৫ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে আমাদের পক্ষে ব্যবসা করা প্রায় অসম্ভব। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে এলডিজি গ্র্যাজুয়েশনও সম্ভব হবে না।’
জানা গেছে, আগামী ২০ জানুয়ারি মুদ্রানীতি প্রণয়নসংক্রান্ত কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সেখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আর ২২ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে মুদ্রানীতি অনুমোদন করা হবে।
নীতি সুদহার বাড়িয়ে কেন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না- এই বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়। কেননা সর্বশেষ গত অক্টোবরে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে বলেই ডিসেম্বরে সামান্য মূল্যস্ফীতি কমেছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশ এমনিতেই দুর্বল, তার ওপর আবার নানা ধরনের চাপ আছে। নীতি সুদহার বাড়ানোর ফলে এমনিতেই ঋণের সুদহার বাড়ছে। এখন বলা হচ্ছে গ্যাসের দাম আবার বাড়ানো হবে। নীতি সুদহার বাড়ানোর পাশাপাশি যদি গ্যাস ও বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয়, তাহলে তো আর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।’
এ বিষয়ে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নূরুল আমিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরবরাহ ঠিক রেখে আমাদের মতো দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন। এ জন্য সব সময়ই যে নীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হবে তা নয়, মানুষের আচার-আচরণ, লোভ-লালসা এগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। বড় ৮-১০টা কোম্পানি নিত্যপণ্য আমদানির কাজ করে। এর বাইরে আমাদের দেশে উৎপাদন হয় এমন পণ্যের দাম হঠাৎ করেই বেড়ে যায়। ওই জায়গার কারসাজিগুলো চিহ্নিত করা এবং সেগুলো দূর করতে পারলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে বলে মনে করি।’ তিনি বলেন, ‘গত অক্টোবরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও অনেক কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ। যদিও একটা সময় এই লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৫ বা ১৬ শতাংশ। সেখানে ১৩ বা ১৪ শতাংশ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কম হওয়া আমাদের জন্য মোটেও ভালো না। কারণ আমাদের অর্থনীতির ৮০ শতাংশই বেসরকারি খাতনির্ভর। ফলে তাদের চাহিদা যদি পূরণ করতে না পারি, তাদের যদি বিনিয়োগের পরিবেশ দিতে না পারি, রাজনৈতিক পরিস্থিতি যদি ব্যবসার অনুকূলে না আসে, তাহলে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা আরও কমবে; যা দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আগামী মুদ্রানীতিতে এই বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া দরকার বলেই আমি বলে করি।’