
প্রকৃত বাজারমূল্যের চেয়ে অস্বাভাবিকভাবে বেশি মূল্যে মেশিনারিজ কেনা হয়েছে। এতে অতিরিক্ত ১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। দ্বিতীয় শিফটের ক্লাসের সম্মানীর নামে প্রায় ১৯ লাখ টাকা ওঠানো হয়েছে। প্রকল্পবহির্ভূত কাজে গাড়ি ব্যবহার করে জ্বালানি কেনা ও মেরামতের জন্যও বেশি খরচ করা হয়েছে। এভাবেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে নয়ছয় করেই বরিশালের গৌরনদীতে শহিদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে ছাত্র হোস্টেল, ছাত্রী হোস্টেল, প্রিন্সিপাল কোয়ার্টার, অফিসার্স কোয়ার্টার নির্মাণ করা হলেও এখনো সেগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। ফিজিবিলিটি স্টাডি (সম্ভাব্যতা সমীক্ষা) ছাড়াই অনিয়ম করে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে।
আইএমইডি থেকে গত ১০ ডিসেম্বর প্রকল্পটি সরেজমিনে মনিটরিং করা হয়। তার ভিত্তিতেই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে বস্ত্র অধিদপ্তর। সার্বিক ব্যাপারে জানতে সর্বশেষ প্রকল্প পরিচালক মো. ইফতেখার আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি হওয়ায় কোনো মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে বস্ত্র অধিদপ্তরের উপপরিচালক ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলম রেজা খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রকল্পটি সাড়ে তিন বছর আগে শেষ হয়েছে। কোনো অনিয়ম হলে ওই সময়ের প্রকল্প পরিচালক জানেন, তিনি বলতে পারবেন। আমি কিছু বলতে পারব না। বিল্ডিং নির্মাণে কোনো ত্রুটি থাকলে তা সারানো হবে।’
বস্ত্র অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. শহিদুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘আইএমইডির প্রতিবেদন আমি হাতে পাইনি। কাজেই কোথায় কী সমস্যা, তা জানি না। ডকুমেন্ট ছাড়া কোনো মন্তব্য করতে পারছি না। তবে সব বিল্ডিং ফাঁকা পড়ে নেই। অধ্যক্ষ তার পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন, এটা বলতে পারি।’
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, চুক্তিপত্র অনুযায়ী ঠিকাদার মেশিনারিজ সরবরাহ করতে ব্যর্থ হলেও প্রায় ৬৯ লাখ টাকা জরিমানা আরোপ করা হয়নি। উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান না করে পিপিআর-২০০৮-এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে প্রায় ২০ লাখ টাকার কম্পিউটার ও অফিস যন্ত্রপাতি কেনা হয়। শুধু তাই নয়, নকল (ফেক) ক্যাশমেমো তৈরি করে বিভিন্ন দোকানে প্রায় ৬ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সম্মানীর ওপর আয়কর কর্তন না করায় ৫ লাখ টাকার বেশি রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। ১ হাজার ৭৩৮টি আসবাবপত্র কেনা হয়েছে। তাতে খরচ হয়েছে ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। ৩ কোটি ৪২ লাখ টাকায় ৫ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।
দেশে দক্ষ লোকবল তৈরি এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়। কিন্তু কোনো ফিজিবিলিটি স্টাডি ছাড়াই প্রকল্পটির খরচ ধরা হয় ৬২ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এরপর বাড়তে থাকে টাকা। ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত অর্থাৎ তিন বছরে সম্পূর্ণ সরকারি অর্থে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু ওই সময়ে তো দূরের কথা, মাঝপথে তিনবার সংশোধন করে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়ে। শুধু তাই নয়, শেষবারের মতো ২০২১ সালের ২৬ এপ্রিল আন্তখাত সমন্বয়ও করা হয়েছে। সময় বাড়ানো হয়েছে ১৬৭ শতাংশ। খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ৯৯ কোটি টাকা বা ৫৯ শতাংশ। তবে প্রকৃত খরচ হয়েছে ৯০ কোটি ১১ লাখ টাকা বা আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৯০ শতাংশ এবং বাস্তব অগ্রগতি ১০০ শতাংশ। এভাবে খরচ বেড়েছে ৫৯ শতাংশ এবং সময় ১৬৮ শতাংশ।
প্রকল্পের প্রধান কাজ হচ্ছে ৪ তলা একাডেমিক ভবন নির্মাণ। তাতে খরচ হয়েছে ৯ কোটি ২ লাখ টাকা। ৬ তলার ছাত্র হোস্টেল নির্মাণে খরচ হয়েছে ৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। ৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা খরচ করে ছাত্রী হোস্টেল, ৯ কোটি ২২ লাখ খরচে দোতলা প্রিন্সিপাল কোয়ার্টার এবং ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা খরচে ৬ তলা স্টাফ কোয়ার্টার নির্মাণ করা হয়েছে। ২ কোটি ২২ লাখ টাকায় বাউন্ডারি ওয়াল ও ছাত্রীনিবাসের নিরাপত্তা দেওয়ালও করা হয়েছে। এভাবে আরও কিছু কাজ করা হয়েছে। তাতে লাখ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।
২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি- একনেক সভায় এ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। তখন খরচ ধরা হয়েছিল ৬২ কোটি ১৩ লাখ টাকা। বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছিল ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত তিন বছর। সে সময়ে বাস্তবায়ন হয়নি। তাই সংশোধন করা হয়। এতে এক লাফে খরচ বাড়িয়ে ধরা হয় ৯৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। সময় বাড়ানো হয় তিন বছর, অর্থাৎ ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত। তাতেও হয়নি কাজ। দ্বিতীয়বারের মতো ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর সংশোধন করা হয়। এতে খরচ বাড়িয়ে ধরা হয় ৯৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। সময়ও বাড়ানো হয় এক বছর। পরে আবার খরচ না বাড়িয়ে এক বছর সময় বাড়িয়ে ২০২০ সালের ৩০ জুন করা হয়। কিন্তু তারপরও কাজ অসমাপ্ত থাকায় শেষ সময়ে ২০২১ সালের ২৬ এপ্রিল বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় প্রকল্পটির আন্তখাত সমন্বয় করে ২০২১ সালের জুনে নিয়ে যায়।
প্রথমে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর থেকে ২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন মো. আব্দুস সাত্তার শিকদার। দ্বিতীয় প্রকল্প পরিচালক হিসেবে মো. এনামুল হক ২০১৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। সর্বশেষ পিডি ছিলেন মো. ইফতেখার আহমেদ ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। এভাবে পিডিরা দায়িত্ব পালন করলেও বরাদ্দ টাকার নয়ছয় করেছেন।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটির আওতায় একাডেমিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু তিন বছরের মধ্যেই দ্বিতীয় তলায় প্রশাসনিক শাখার রুমের দরজার ওপরের দেওয়ালে ফাটল ধরে। এই তলায় অন্য একটি রুমের বাথরুমের দরজা ভেঙে পড়েছে। এ ছাড়া কলাপসিবল গেট মরিচা পড়ে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। ভবনের ছাদেও পানি জমে থাকছে। একাডেমিক ভবন ও ছাত্র হোস্টেলের ডাইনিং রুমের এক পাশের দেওয়াল স্যাঁতসেঁতে অবস্থা। ১০০ জন ছাত্রী থাকার জন্য প্রায় ৬ কোটি টাকা খরচ করে হোস্টেল নির্মাণ করা হলেও মাত্র ১৮ জন ছাত্রী থাকেন। এত বড় ভবন ফাঁকা পড়ে আছে।
একইভাবে অধ্যক্ষের ভবন নির্মাণ করা হলেও তিনি থাকেন না। অতিথিদের বিশ্রামাগার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ১২টি পরিবারের বসবাসের জন্য ৬ তলা স্টাফ কোয়ার্টার নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু মাত্র একটি পরিবার বসবাস করে। এখন পর্যন্ত কোনো শিক্ষক বা কর্মকর্তা কোয়ার্টারে ওঠেননি। প্রকল্পটি গ্রহণের আগে কোনো ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয়নি। এতে অর্থের অপচয় হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।