
বিভিন্ন পণ্য ও সেবায় ভ্যাট-শুল্ক বৃদ্ধি এবং গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরকার সরে না এলে কারখানা বন্ধ করে দিয়ে রাজপথে নামার হুমকি দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের এমন ঘোষণায় বেকায়দায় পড়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে করণীয় জানতে চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে এনবিআর। এদিকে ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) কয়েকটি পণ্য ও সেবা খাতের ওপর থেকে বর্ধিত ভ্যাট ও শুল্ক হ্রাসের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। হজযাত্রীদের টিকিটের ওপর আরোপিত বর্ধিত আবগারি শুল্ক কমানোর ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে।
বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী সংগঠন ও শ্রেণি-পেশার মানুষের পক্ষ থেকে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর দাবি জানিয়ে বৃহস্পতিবার এনবিআরে আবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। আবেদনে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, করোনার আঘাতে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হতে বসেছিল। করোনা কমার পর অর্থনীতি কিছুটা ঘরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। ঠিক তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ডলারের মূল্য বেড়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় এলসি খোলা। অতীব প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করা হচ্ছে কয়েক গুণ বেশি দাম দিয়ে।
এসআরও জারি না করেই কিছু পণ্যের ভ্যাট কমানোর ঘোষণা
পোশাক ও মিষ্টির ওপর ভ্যাট হার ১৫ থেকে ১০ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নন-এসি হোটেলের ওপর ভ্যাট হার ১৫ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হচ্ছে। এটি আগে ছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। অন্যদিকে মোটরগাড়ির গ্যারেজ ও ওয়ার্কশপের ভ্যাটেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে ভ্যাট হবে ১০ শতাংশ। অন্যদিকে হজযাত্রীদের হজ পালনের ব্যয় কমাতে হজযাত্রীদের বিমান টিকিটের ওপর আবগারি শুল্ক পুরোপুরি প্রত্যাহার করেছে এনবিআর। ইন্টারনেট-মোবাইল ও ওষুধের কাঁচামালের ওপর বাড়তি ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্কও কমানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
এনবিআর সদস্য (ভ্যাট নীতি) বেলাল হোসেন চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে অধ্যাদেশ জারি করে ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানোর ফলে ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখছি। তারা ভ্যাট ও শুল্ক কমানোর দাবি জানিয়েছেন। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কোন খাতে কতটা কমানো সম্ভব, সে বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ নিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। তবে এটাও ঠিক যে একসময় সব খাতে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ করতে হবে। তিনি বলেন, ‘কিছু বিষয়ে ভ্যাট কমানোর প্রতিশ্রুতি আমরা তাদের দিয়েছি। পরে এসআরও জারি করা হবে।’
অর্থ মন্ত্রণালয়ে এনবিআরের পাঠানো চিঠি নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। তিনি জানান, কিছু পণ্য ও সেবার ভ্যাট ও শুল্ক কমানোর কথা বিবেচনা করা হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ফলে কে কী বলছেন বা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, তা আমরা পর্যবেক্ষণ করছি।’
ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর দাবিতে ব্যবসায়ীরা অনড়
ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকতে পারেনি এনবিআর। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে রাজস্ব ভবনের সামনে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে হোটেল, রেস্তোরাঁ ও মিষ্টান্ন খাতের কয়েক শ ব্যবসায়ী ভ্যাট কমানোর দাবিতে অবস্থান গ্রহণ করেন। তারা জানিয়ে দেন, ভ্যাট কমানো না হলে ঘরে ফিরবেন না। ব্যবসায়ীদের এমন অবস্থানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে এনবিআর এসআরও জারি না করেই সংশ্লিষ্ট খাতের ভ্যাট কমানোর ঘোষণা দেয়।
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান খবরের কাগজকে বলেন, ‘ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এমনিতেই হোটেল, রেস্তোরাঁর ব্যবসা চাপে আছে। এর মধ্যে রেস্তোরাঁর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করে আরও বিপদে ফেলা হয়েছিল। ভ্যাট কমানোর দাবিতে আমরা রাজপথে নেমেছিলাম। ভ্যাট না কমালে আমরা ঘরে ফিরে যেতাম না। এনবিআর আমাদের দাবি মেনে ভ্যাট কমানোর কথা জানিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘৭০ শতাংশ রেস্তোরাঁ এখনো ভ্যাটের আওতার বাইরে। তাদের না ধরে আমরা যারা ভ্যাট দিয়ে থাকি তাদের ওপর আরও চাপ বাড়ানো হয়েছিল। এসব না করে প্রশাসনের ব্যয় কমিয়ে ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিয়ে সরকার আয় বাড়াতে পারে। আইএমএফের শর্ত মানতে গিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো দেশের জনগণের ওপর ইচ্ছামতো করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া কোনো পূর্ণাঙ্গ সমাধান হতে পারে না।’
নতুন করে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি ও ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোর সমালোচনা করে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকার যে নীতি নিচ্ছে তা বাস্তবায়িত হলে আমরা কোথায় যাব? গ্যাসের দাম ও ভ্যাট বাড়ার আগে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এ নিয়ে কোনো আলোচনাও করা হয়নি। বিনিয়োগ কমেছে। অর্থনীতির এই পরিস্থিতিতে গ্যাসের দাম ও ভ্যাট বৃদ্ধির প্রভাব কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে তা চিন্তা করা উচিত। ব্যবসায়ী মানেই যেন অপরাধী। সবাই চুষে খেতে চায়।’
তিনি বলেন, ‘আসলে সব সরকারের চরিত্রই এক। গত সরকার বলেছিল গ্যাসের দাম বাড়িয়ে সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন করবে। কিন্তু তারা সেই প্রতিশ্রুতি রাখেনি।’
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী আহসান খান চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘আজকে আমরা সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছি যে প্রান্তিক কৃষকের আম, টমেটো, আনারস, কলা, পেয়ারা ও কলার পাল্প পণ্যগুলোর ওপর মূসক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন প্রান্তিক চাষিরা। এখন যদি ভ্যাট ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এসব পণ্যের দাম বেড়ে যায়, তবে অনেকেই এসব পণ্য কেনা থেকে বিরত থাকবেন। সরকারকে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যে বর্ধিত ভ্যাট ও শুল্ক প্রত্যাহার এবং গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার দাবি জানাচ্ছি।’
বাংলাদেশে অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সভাপতি এম এ হাশেম খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিস্কুট ও কেকের ওপর ভ্যাট বাড়ানোর সঙ্গে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। ৫ টাকার একটি বিস্কুট আর তৈরি করা সম্ভব হবে না। বিস্কুটের দাম বেড়ে যাবে। তাহলে ব্যবসা করব কীভাবে? ভ্যাট আর সম্পূরক শুল্ক না কমালে ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া আর উপায় নেই।’
অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য
ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকারের আয় বাড়ানোর অনেক পথ আছে। সরকারকে সেসব পথ খুঁজে নিতে হবে। তা না করে ইচ্ছামতো ভ্যাট আর সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে খরচ বাড়িয়ে দেওয়া হলো, যা ব্যবসায়ে খরচ বাড়িয়ে দিল। এতে শিল্পে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে।’
আরেক রাজস্ব খাতের বিশ্লেষক এনবিআর সদস্য ফরিদ উদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শিল্পের খরচ বাড়ানো হলো। এসব খাতে খরচ বাড়লে বাজারে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাকেও দাম বেশি দিয়ে জিনিসপত্র কিনতে হবে। এ ছাড়া ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে না পারলে রাজস্ব পরিশোধ করবেন কীভাবে?’