
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) বিভিন্ন পদে চাকরি দেওয়ার নাম করে অন্তত অর্ধশত ব্যক্তির কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে লাপাত্তা হয়েছেন সংস্থাটির এক উচ্চমান সহকারী। তার নাম কাঞ্চন কুমার চৌধুরী। দুই মাস ধরে তিনি কর্মস্থলেও আসছেন না। এদিকে চাকরি না পেয়ে এবং অর্থ হারিয়ে বিপাকে পড়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। কাঞ্চন ও তার স্ত্রীর মোবাইল ফোন বন্ধ। কেউ কেউ বলেছেন, কাঞ্চন চৌধুরী সাধুর বেশ ধরে ভারতে বাড়ি করেছেন। তিনি সেখানেও চলে যেতে পারেন।
চসিক সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর কাঞ্চন কুমার চৌধুরী কিছুদিন অফিস করলেও ধীরে ধীরে তিনি অনিয়মিত হয়ে পড়েন। নভেম্বর মাসে এসে তিনি চসিক কর্তৃপক্ষের কাছে অবসরে যাওয়ার আবেদন করেন। যদিও তার চাকরির মেয়াদ আরও চার বছর আছে। এই খবর জানাজানি হওয়ার পর পাওনাদাররা তাকে খুঁজতে থাকেন। একপর্যায়ে কেউ কেউ তার বাসায় যান। চাকরি কিংবা টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য চাপ দেন। ভুক্তভোগীদের কয়েকজন বাসায় যাওয়া শুরু করলে তিনি নগরীর ঘাটফরহাদবেগ এলাকার বাসা ছেড়ে অজ্ঞাত স্থানে চলে যান।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানকালে খবরের কাগজ বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলেছে। কাঞ্চন চৌধুরী মূলত অফিস সহকারী, কম্পিউটার অপারেটর, সচিবের ব্যক্তিগত সহকারী, কর আদায়কারী, চসিক পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয়া, মেকানিকের সহকারীসহ বিভিন্ন ধরনের শ্রমিক পদে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। ভুক্তভোগীদের কেউ কেউ বলছেন, কাঞ্চন চৌধুরী তার শ্বশুরবাড়ি কক্সবাজারে অবস্থান করতে পারেন। কেউ কেউ ভারতে চলে যাওয়ার আশঙ্কাও করছেন।
চট্টগ্রাম শহরের পাথরঘাটা সেবক কলোনির বাসিন্দা ভুক্তভোগী উত্তম ভৌমিক খবরের কাগজকে জানান, তার স্ত্রী, শ্যালিকাসহ পরিবারের চারজনের চাকরি দেওয়ার জন্য ৫ লাখ টাকা দিয়েছেন। একইভাবে পাথরঘাটা ব্রিকফিল্ড এলাকার বাসিন্দা মো. সোহেল নিজের পরিবার এবং আত্মীয়স্বজনের আটজনের চাকরির জন্য দিয়েছেন ১০ লাখ টাকা। কাঞ্চন টাকা নেওয়ার পর বার বার সময় নিয়েছেন। কিন্তু টাকাও ফেরত দেননি, চাকরিও দেননি। কাঞ্চন চৌধুরী এখন আত্মগোপনে চলে গেছেন। শোনা গেছে, কাঞ্চন এখন কর্পোরেশনের চাকরি ছাড়ারও আবেদন করেছেন।
একসময় সেবক হিসেবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কাজ করতেন প্রতিবন্ধী মো. মজিবর। সেই কারণে বিভিন্ন সময়ে তাকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে যেতে হতো। আসা-যাওয়ার সুবাদে সংস্থাটির উচ্চমান সহকারী কাঞ্চন কুমার চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় হয়। পরিচয় সূত্রে মজিবুরের ভাইপো মো. ইমনকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরি দেওয়ার জন্য দুই দফায় ৫ লাখ টাকা নিয়েছেন কাঞ্চন। এর মধ্যে দুই লাখ ৪৫ হাজার টাকার ডকুমেন্ট হিসেবে ১০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প দিয়েছে। তিনি জমি বিক্রি করে টাকাটা দিয়েছেন। এখন জমিও গেছে, ভাইপোর চাকরিও হয়নি।
আরেক ভুক্তভোগী লিটন দাশ খবরের কাগজকে জানান, তিনি ৯ জনের চাকরির জন্য ১৫ লাখ টাকা দিয়েছেন। তিনিসহ বেশ কয়েকজন পাওনাদার টাকা ফেরত চাইতে কাঞ্চন চৌধুরীর বাসায় গেলে দুই মাস আগে তিনি সবাইকে নিয়ে স্থানীয় সাধু তারাচরণ সেবাশ্রম মন্দিরে ভুক্তভোগীদের ডাকেন। সেই বৈঠকে অন্তত ৩০ জন ভুক্তভোগী উপস্থিত ছিলেন। পরের সপ্তাহে সবাইকে টাকার ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তারপরের সপ্তাহে বাসায় তালা ঝুলিয়ে আত্মগোপনে চলে যান। এরপর বোয়ালখালির তার গ্রামের বাড়ি এবং কাট্টলী এলাকায় তার আত্মীয়ের বাড়িসহ সম্ভাব্য এলাকায় খোঁজ খবর নিয়ে তার হদিস মিলেনি। একজন উচ্চমান সহকারীকে এত টাকা কেন তুলে দিলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কাঞ্চন চৌধুরী তখন সাধুর মতো চলাফেরা করতেন। বাইরে কিছু খেতেন না। ধর্মপালন করতেন। এ কারণে তারা সবাই তাকে বিশ্বাস করেছেন। তিনি যে সাধুর বেশে চুরি করবেন, তা তারা কল্পনাও করতে পারেননি।
ভুক্তভোগী মোহাম্মদ সানিকে মেকানিক্যাল বিভাগে মেকানিকের সহকারী হিসেবে চাকরি দেওয়ার কথা ছিল। তার বিনিময়ে কাঞ্চন চৌধুরী নিয়েছেন দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা। ডকুমেন্ট হিসেবে ১০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করে দিয়েছেন। টাকা নেওয়ার পর থেকে মোবাইল বন্ধ। তার সঙ্গে আরো একজন ভুক্তভোগীর সচিবের পিএস পদে চাকরির জন্য সাড়ে তিন লাখ টাকার মৌখিক চুক্তি হয়। তবে তিনি দেড় লাখ টাকা দিয়েছেন। তাদের দুইজনের কারো চাকরি হয়নি। তারা টাকাও ফেরত পাননি।
এদিকে চসিকের সবিচ মোহাম্মদ আশরাফুল আমিন স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, সিটি কর্পোরেশনে সচিবালয় বিভাগের সাধারণ শাখার উচ্চমান সহকারী কাঞ্চন কুমার চৌধুরী বিভিন্নজনের কাছ থেকে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা নিয়েছেন। টাকা নেওয়ার দীর্ঘদিন পার হলেও চাকরি এবং টাকা ফেরত না দেওয়ার বিষয়ে পাওয়া অভিযোগগুলো তদন্ত করে দাখিলের জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গত ৬ জানুয়ারি গঠিত কমিটির আহ্বায়ক হলেন চসিকের স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট মনীষা মহাজন, সদস্য শিক্ষা কর্মকর্তা মোছাম্মদ রাশেদ আক্তার এবং সদস্য সচিব আজিজ আহমদ। কমিটিকে ৭ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম খবরের কাগজে বলেন, ‘কাঞ্চনের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ তারা পেয়েছেন। এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। যারা অভিযোগ করেছেন, তারা যদি তথ্য-প্রমাণ দিয়ে তার কাছে টাকা পাওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে কাঞ্চন কুমার চৌধুরীর অবসরের পর এককালীন পাওনা থেকে কেটে তাদের টাকা পরিশোধ করা হবে। এছাড়া কাঞ্চনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করারও প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।’