
‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার...।’ নচিকেতার গানে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো বাবা তার ছেলেকে ভর্ৎসনা করেছেন ‘মস্ত অফিসার’ বলে। বৃদ্ধাশ্রমকেন্দ্রিক এ ঘটনায় ‘মস্ত অফিসার’ একজন প্রকল্প পরিচালক। শীর্ষ এই কর্মকর্তার দাপটে নয়ছয় করে সরকারি বৃদ্ধাশ্রম প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও অচল অবস্থায় পড়ে থাকায় প্রকল্প পরিচালককে বলা হচ্ছে মস্ত অফিসার। স্থানীয়ভাবে কেউ যাতে মুখ না খোলে সেই উদ্দেশ্যে প্রকল্প পরিচালক তার বাস্তবায়ন করা প্রকল্প লুকোছাপার মধ্যে রেখেছিলেন। তবে ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর অনিয়ম প্রকাশ হলে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্প সম্পর্কে তিনি বলছেন, ‘মনে নাই’!
এই প্রকল্প পরিচালকের (পিডি) নাম মো. সাদেকুল হক। অভিযোগ উঠেছে, কনসালটেনসি ফার্ম নামের নিজস্ব সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বৃদ্ধাশ্রম প্রকল্পে ‘প্রবীণ-প্রবীণা’ ভবন নির্মাণ কাজটি প্রকল্প পরিচালক সাদেকুল নিজেই করেছেন। তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাদের নিয়ে তিনি এ কাজ করেন। এর মধ্যে সুনামগঞ্জের প্রবীণা ভবন নির্মাণে প্রায় ৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকার অর্ধেকই ভাগবাটোয়ারা হয়েছে বলে অভিযোগ। কেবল গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া বাদে সুনামগঞ্জের মতো আর সাতটি ভবন নির্মাণে নয়ছয় হয়েছে।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এ প্রকল্পের বিষয়ে খবরের কাগজের সঙ্গে কথা হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমিন মুরশিদের। তিনি বলেছেন, যারা এতকাল ধরে অপকর্মগুলো করেছে, তাদেরকে প্রকল্প থেকে বের করে দেওয়া হবে।
‘প্রবীণ-প্রবীণা’ যেভাবে জানা
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেশের আটটি বিভাগে ২০২০-২২ অর্থবছরে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের তালিকায় রয়েছে ‘প্রবীণ-প্রবীণা’ (নারী ও পুরুষ বৃদ্ধাশ্রম) প্রকল্পটি। এর মধ্যে সিলেট বিভাগে রয়েছে ‘প্রবীণা’ (নারী বৃদ্ধাশ্রম)।
সেটির অবস্থান কোথায়? বিভাগীয় জেলা শহর সিলেটে নেই। হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারেও নেই। বাকি থাকে সুনামগঞ্জ। সেখানে সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত শিশু পরিবারের (সরকারি এতিমখানা) একটি অব্যবহৃত ভবন রয়েছে।
সেটি হতে পারে প্রবীণা! সংশ্লিষ্টরা কেবল এটুকু জানালেন। অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগ ও জেলা দপ্তরে কয়েকবার যোগাযোগের পরও মিলছিল না হালনাগাদ কোনো তথ্য। প্রায় এক মাস যোগাযোগের পর সরাসরি মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে লুকোচুরির কারণ। দেশের আটটি প্রবীণ-প্রবীণা প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট পরিচালক সাতটি ভবন নিজে নির্মাণ করেছেন। এর মধ্যে কেবল গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার ভবনটি সচল। বাকি সাতটির নির্মাণকাজ নিম্নমানের হওয়ায় সমাজসেবা অধিদপ্তরের স্থানীয় দপ্তর এগুলো গ্রহণই করেননি। নির্মাণকাজে নানা রকম ত্রুটি ও অনিয়মের কারণে ভবনগুলো অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, দেশে সরকারি পর্যায়ে সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত ছয়টি বিভাগে ছয়টি শান্তি নিবাস (বৃদ্ধাশ্রম) রয়েছে। এগুলো হচ্ছে ফরিদপুর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বাগেরহাট, বরিশাল ও সিলেট জেলায়। ৮৫টি সরকারি শিশু পরিবারের (এতিমখানা) মধ্যে ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন মেয়াদকালে নারী ও পুরুষ বৃদ্ধাশ্রম হিসেবে প্রবীণ-প্রবীণা প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়, লালমনিরহাট সদরে, নোয়াখালীর মাইজদী ও সুনামগঞ্জ সদরে প্রবীণা এবং ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জ, রাজশাহীর বায়া, খুলনার মহেশ্বরপাশা, বরিশালের সাগরণী প্রবীণ প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়। প্রতিটি প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ছয় থেকে আট কোটি টাকা। এই ব্যয় পরবর্তীত সময়ে বেড়ে ৮৭ কোটি টাকা হয়েছে। এর মধ্যে সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে একটি, যৌথ অর্থায়নে দুটি ও পিপিপির আওতায় পাঁচটির নির্মাণ ব্যয় মেটানো হয়।
সুনামগঞ্জে প্রবীণা ভবনটি ২৫ শয্যার। কাজ শুরু হয় ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময়। ২০২৩ সালের জুন মাসে ভবনটির নির্মাণ শেষ হলে ওই বছরই ছাদ বেয়ে পানি পড়ে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তখন ঠিকাদারি কাজ তদারককারীদের জানালে প্রকল্প পরিচালক ভবনটি স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে কাগজ-কলমে বুঝিয়ে দেন। একটানা ১৪ মাস অব্যবহৃত থাকার বিষয়টি ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। এই সূত্রে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হিসেবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মো. সাদেকুল হকের নাম প্রকাশ পায়।
প্রকল্পসঙ্গী ছাত্রলীগ
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মো. সাদেকুল হক প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নামসর্বস্ব একটি কনসালটেনসি ফার্মের কাজ বলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের স্থানীয় দপ্তরকে জানান। এরপর তিনি স্পটে না গিয়ে কনসালটেনসি ফার্মের স্থানীয় প্রতিনিধি ও ঠিকাদার হিসেবে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের মাধ্যমে স্থানীয় সাবেক নেতাদের দেখাশোনার দায়িত্ব দেন। প্রকল্প অনুযায়ী নির্মাণকাজ ২০২২ সালের জুনের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। প্রকল্প পরিচালক এক বছর গড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন মাসে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ বলে অক্টোবর মাসে তড়িঘড়ি করে ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ করে বুঝিয়ে দেন। এর মধ্যে কেবল গোপালগঞ্জের টু্ঙ্গিপাড়ার ভবন নির্মাণ যথাযথভাবে সম্পন্ন হয়। বাকি সাতটি ভবন নির্মাণে নয়ছয়ের অভিযোগ রয়েছে।
তথ্য দিতে লুকোচুরি
সুনামগঞ্জের স্থানীয় একজন সংবাদকর্মী ‘প্রবীণা’ সম্পর্কে তথ্য চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে একটি আবেদন করেন। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে কোনো তথ্য না দিয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে মৌখিকভাবে বলা হয়। এরপরও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী ঠিকাদারি সংস্থার পরিচয় জানতে চাইলে তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করা হয়।
ওই সংবাদকর্মী খবরের কাগজকে বলেন, ‘বৃদ্ধাশ্রমে কেউ নেই কেন! এমন কৌতূহল থেকে লিখিত আবেদন করেছিলাম। সেটি তাৎক্ষণিক বাইরে জানাজানি হয়। ঠিকাদারি কাজ করেন ছাত্রলীগের স্থানীয় কয়েক নেতা ও প্রকল্পসংশ্লিষ্ট পরিচয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা ফোন করে জানতে চান, কেন তথ্য সংগ্রহ করছি। প্রকল্পটি সরকারের ঊর্ধ্বতনদের জানিয়ে এড়িয়ে যেতেও বলেছেন।
প্রকল্প পরিচালক মো. সাদেকুল হকের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘কারা কাজ করেছেন আমার মনে নাই!’ তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেও তথ্য না পাওয়া, প্রকল্প নিয়ে লুকোচুরি কেন? এ প্রশ্নে তিনি পরে কথা বলবেন বলে ফোন কেটে দেন।
উপদেষ্টার ‘ঘর পরিষ্কার’ চেষ্টা
অন্তর্বর্তী সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমিন মুরশিদ গত রবিবার রাতে সিলেটে একটি অনুষ্ঠান শেষে মুখোমুখি হন স্থানীয় সাংবাদিকদের। এ সময় বৃদ্ধাশ্রম প্রকল্পের বিষয়টি উপদেষ্টার দৃষ্টিতে দেওয়া হলে তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিশেষ প্রকল্পের ব্যাপারে আলাদাভাবে কিছু বলব না। সবখানে একটা সার্বিক চিত্র আছে। সার্বিক চিত্রটা দুর্নীতি। এখানে (সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ে) যে দুর্নীতিটা আছে, সেটা বন্ধ করতে হবে এবং যারা এতকাল ধরে অপকর্মগুলো করেছে, তাদেরকে প্রকল্পের ভেতর থেকে বের করে দেওয়া হবে। যাকে বলে, ‘ঘর পরিষ্কার করা’।