
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে এখন নজর বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর। পৃথক পৃথকভাবে তারা ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মিত্রতা গড়ে তুলতে তৎপর রয়েছে। পাশাপাশি জোট গঠনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে দল দুটি। যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোকে নিয়ে ‘অলিখিত’ জোটের পরিধি বাড়ানোর চেষ্টা করছে বিএনপি। ‘বৃহত্তর ইসলামি’ জোট গঠন করার আশায় রয়েছে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন। নির্বাচনের আগে বৃহত্তর জোট গঠন করা যায় কি না, তা নিয়ে ভাবছে দুই দলই। এ ছাড়া অনিবন্ধিত ইসলামি দলগুলোও জোটবদ্ধ হতে চালাচ্ছে নানা তৎপরতা। তবে সবকিছু ধীরগতিতে এগোচ্ছে। বুধবার (২২ জানুয়ারি) একাধিক দলের নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে এসব তথ্য।
নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে ইসলামি দলগুলো নিয়ে জোট গঠনের চেষ্টা করছে জামায়াত। এ ছাড়া ভবিষ্যতে বিএনপির সঙ্গে বনিবনা নাও হতে পারে, এমনটি ধরে নিয়েই ইসলামপন্থিদের নিয়ে জোট গড়তে তৎপরতা চালাচ্ছে দলটি। বর্তমানে দল দুটির মধ্যে কিছুটা দূরত্বও বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গত মঙ্গলবার দীর্ঘদিনের দূরত্ব কমিয়ে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান ও ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম চরমোনাই পীর প্রকাশ্য হাত মিলিয়েছেন। পরে দুজনই একসঙ্গে কাজ করার ঘোষণাও দিয়েছেন। তবে বসে নেই বিএনপিও। তারাও জোটের পরিধি বাড়াতে চায়। এই মুহূতেই বিএনপি ও জামায়াত নিজেদের মধ্যে কোনো বিরোধে জড়াতে চায় না।
বুধবার গুলশানে এক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘‘বাংলাদেশে যারাই রাজনীতি করেন, তারা রাজনীতিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যাদের সঙ্গে মতের মিল হবে, তাদের সঙ্গে কাজ করার চিন্তা করতে পারে, সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এ নিয়ে কারও কোনো দুশ্চিন্তা থাকার তো কোনো কারণ নেই। তারা (জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন) তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে যা উচিত মনে করবে, নিশ্চয়ই তা করবে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের আপাতত কোনো জোট নেই। সবাই যুগপৎভাবে ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের আন্দোলন করেছে। এখন আমরা একসঙ্গে আলোচনা করে কাজ করে যাচ্ছি।’ তিনি বলেন, জামায়াতের আদর্শ আলাদা, বিএনপির আলাদা দল। এখানে দূরত্বের কিছু নেই।
নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর এবার প্রথম ‘বৃহত্তর ইসলামি জোট’ গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো। জামায়াতের টার্গেট হলো- ইসলামী আন্দোলনের পাশাপাশি খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, খেলাফত আন্দোলন, নেজামে ইসলাম পার্টি, জাকের পার্টি, ফরায়েজী আন্দোলনসহ সমমনা বেশ কয়েকটি অনিবন্ধিত ইসলামি দলকে এই জোটে অন্তর্ভুক্ত করা। জোটের চমক হতে পারে হেফাজতে ইসলামের সমর্থন। ইতোমধ্যে প্রাথমিক বৈঠক ও যোগাযোগ চলছে। জোটের কার্যক্রম ধীরগতিতে এগোচ্ছে বলেও জানা গেছে। এ ছাড়া চরমোনাই পীরের নেতৃত্বে খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টি, খেলাফত আন্দোলন কওমি মাদ্রসাভিত্তিক ছয় ইসলামি দল একত্রিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে ‘ওয়ান-টু-ওয়ান’ বৈঠক করেছে ইসলামী আন্দোলন। বর্তমানে জোটের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা চলছে।
জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, তাদের লক্ষ্য আগামী নির্বাচনে ক্ষমতার অংশীদার হওয়া এবং সংসদে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। এ জন্য ইসলামি দলগুলো সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন এবং তাদের একটি ‘ভোট বাক্স’ নিশ্চিত করতে চাইছে। এ জন্য নিজেদের মধ্যে তারা প্রাথমিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তাদের দাবি, কার্যত ‘আকিদা’ ও ‘হক’ নিয়ে ইসলামী আন্দোলনসহ কওমি ধারার আলেমদের সঙ্গে জামায়াতের দীর্ঘদিনের বিরোধ বা বিতর্ক ছিল। তবে বর্তমানে সেটি অনেকটাই কমিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। ইসলামপন্থি দলগুলোর নিজস্ব ভোটব্যাংক রয়েছে। একজোট হলে তাদের ভোটব্যাংক আরও বাড়বে। প্রতিটি আসনে ইসলামি দলগুলোর একটি ব্যালট ও ভোট বাক্স নিশ্চিত করতে হবে। এতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ভোট কমবে। যদিও আওয়ামী লীগের ভোটে আসার সুযোগ নেই বলেও মনে করে দল দুটি। তাই সম্ভাব্য জোটের একটি রূপরেখা দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে ইসলামি দলগুলো।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার খবরের কাগজকে বলেন, ‘সব দলের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। বেশ কয়েকটি দলের সঙ্গে মতবিনিময় ও বৈঠক হয়েছে। তবে কোনো কিছুই এখনো চূড়ান্ত হয়নি। জোটের রূপরেখা কী হবে, কোন পদ্ধতিতে জোট হবে- এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে।’
ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম (শায়খে চরমোনাই) খবরের কাগজকে বলেন, ‘জামায়াতের আমিরের সঙ্গে সাক্ষাৎটি ছিল সৌজন্যমুলক। আমরা চাই ইসলামি পক্ষের শক্তিগুলো একসঙ্গে কাজ করুক।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত জোটের ব্যাপারে নীতিগত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ইসলামি বৃহত্তর জোট গঠনের চেষ্টা চলছে। নির্বাচনের আগে ইসলামি দলগুলোর মধ্যে জোট বা আসন সমঝোতা হোক- এটা আমরা চাই। প্রতিটি আসনে একটি ইসলামি ব্যালট বাক্স থাকবে।’
দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘জোটগতভাবে নয়, ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন করার কথা চলছে। আসনভিত্তিক আলোচনা করে ইসলামি দলগুলো থেকে একজন প্রার্থী হতে পারেন। সব দল সেই প্রার্থীকে ভোট দেবে। এটা নির্ভর করছে আগামী নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে, কোন প্রক্রিয়ায় হবে। আমাদের প্রথম চাওয়া, সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে ভোট দেওয়া হোক।’
বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী বলেন, ‘আমরা ইসলামী আন্দোলনের ঐক্য চাই। আমরা দেখছি যে বিভিন্ন দল বিভিন্ন দলের সঙ্গে বসছে। এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত কেউ কিছু বলেননি। আমরা বড় দলগুলোকে জানিয়ে রাখছি যে, যদি ঐক্য হয় তাহলে আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি। আমরা আশা করছি নির্বাচনের আগে ঐক্য হবে।’
ইসলামি দলগুলোর বাইরেও তাদের যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা দলগুলোকে কাছে টানার চেষ্টা করছে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন। বিশেষ করে ১২-দলীয় জোট, লেবার পার্টি, গণ অধিকার পরিষদ (নুর), ববি হাজ্জাজের এনডিএমের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে দল দুটির। বেশ কয়েকটি দলের নেতারা আলাপকালে জানিয়েছেন, যুগপৎ আন্দোলনে থাকা কয়েকটি দলকে জামায়াতের নেতৃত্বাধীন জোটেও দেখা যেতে পারে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের ভোটে আসার ওপর নির্ভর করবে জোটের হিসাব। আওয়ামী লীগ যদি ভোটে অংশ না নেয়, তাহলে জামায়াতসহ ইসলামি দলগুলোকে আসন ছাড় দেবে বিএনপি। সে ক্ষেত্রে যুগপৎ থাকা ছোট দলগুলো জামায়াতের সঙ্গে জোট বাঁধলে তাদের আসন বাড়বে বলেও মনে করে দলগুলো।
জোটের পরিধি বাড়াতে বিএনপির তৎপরতা
যুগপৎ আন্দোলনে থাকা প্রায় ৪০টি দল নিয়ে বিএনপির একটি ‘অলিখিত জোট’ রয়েছে। এই জোটের পরিধি বাড়াতে তৎপর হয়েছে বিএনপিও। তাদের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত মিত্র খেলাফত মজলিস ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসকে জোটে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে দলটি। পাশাপাশি যুগপৎ আন্দোলনের অন্য ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ রেখে চলেছে। গতকাল বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করেছে খেলাফত মজলিস। তবে আমন্ত্রণ পেলেও সরাসরি বিএনপির সঙ্গে এখনো বৈঠকে বসেনি মাওলানা মামুনুল হকের বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। তবে তাদের সঙ্গে বিএনপির যোগাযোগ রয়েছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব জালালুদ্দীন আহমদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘ইসলামি দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে। সব দলই ঐক্য চায়। তবে জোট চূড়ান্ত পর্যায়ে না গেলে কিছু করা যাবে না। আমরা চাই, ইসলামি দলগুলো এবার নির্বাচনে জোটবদ্ধ হোক।’ তিনি বলেন, ইসলামি দলগুলো প্রথম একমত হলে এরপর বিএনপির সঙ্গে আলোচনা হতে পারে।’
যুগপৎ আন্দোলনের শরিক এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে কোনো জোট করব না। এটা আমাদের দলীয় সিদ্ধান্ত। এর বাইরে থাকা অন্য দলগুলোর সঙ্গে জোট হতে পারে।’