
প্রধান টার্গেট তিন কোটি তরুণ। অংশগ্রহণ থাকবে দেশের ডান, বাম মতাদর্শের বিভিন্ন বয়সী মানুষেরও। নেওয়া হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। ২৪-পরবর্তী নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরিতে মধ্যপন্থার দল গঠনে এভাবেই অগ্রসর হচ্ছেন জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্ররা। দলের দায়িত্ব গ্রহণে উপদেষ্টার পদ ছাড়তে পারেন তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। সবকিছু আলোচনার পর্যায়ে আছে। তবে ফেব্রুয়ারি মাসেই রাজনৈতিক দল ঘোষণা করার ইচ্ছা তাদের।
রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য তৈরি প্ল্যাটফর্ম জাতীয় নাগরিক কমিটির একাধিক নেতা খবরের কাগজকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন। তবে কোনোটাই এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামও কোনো কিছু চূড়ান্ত না হওয়ার কথা জানিয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ছাত্রদের দল গঠনের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। ছাত্ররা আন্দোলনে যেমন জীবন দিতে পারেন তেমনি দেশের জন্য কাজ করার সুযোগ নিতে দলও গঠন করতে পারেন বলে তিনি মনে করেন।
নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব খবরের কাগজকে বলেন, ‘দল গঠন নিয়ে আমাদের আলাপ চলমান। এটি মধ্যমপন্থার দল হবে। ডান, বাম সবার অংশগ্রহণ থাকবে। আমাদের প্রধান টার্গেট তরুণরা। এ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা হচ্ছে।’
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে দেশ ও প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়েন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। দল-মত নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণ থাকলেও এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এর সমন্বয়ক হিসেবে নাহিদ ইসলাম সরকার পতনের এক দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে। এ সময় তিনি ঘোষণা দেন নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্তেরও। অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হলে উপদেষ্টা পরিষদে ছাত্রদের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন তিনি।
অপরদিকে রাজনৈতিক দল গঠনের কার্যক্রম প্রস্তুত করতে গঠন করা হয় জাতীয় নাগরিক কমিটি। নতুন দল গঠন হলেও এই দুই প্ল্যাটফর্ম স্বতন্ত্রভাবে কাজ করবে বলে জানা গেছে।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিষ্ঠার পেছনে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপট ও উপলক্ষ রয়েছে। স্বাধীনতা-পূর্ব বিভিন্ন স্বাধিকার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগ। স্বাধীনতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা এই আন্দোলনের মূল প্রেক্ষাপট। আর পঁচাত্তর-পরবর্তী আওয়ামী লীগের পতনে প্রতিষ্ঠা হয় জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির। ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগের পতনের পরে সৃষ্ট রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ তথা আওয়ামী লীগের বিরোধী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় বিএনপি। ফলে তারা জনপ্রিয়তা পায়। জাতীয় পার্টি পরে দুই দলের সুবিধাবাদীদের নিয়ে দল গঠন করলেও বড় ধরনের সুবিধা করতে পারেনি। অপরদিকে ইসলামি আদর্শ নিয়ে দেশভাগের আগেই প্রতিষ্ঠিত হয় জামায়াতে ইসলামী। এ ছাড়া বাম আদর্শ নিয়ে রয়েছে দেশে একাধিক দল। প্রতিটি দলেই রয়েছে আদর্শের চর্চাকারী সমর্থক এবং বুদ্ধিজীবী পেশাজীবী সংগঠন। কিন্তু বাংলাদেশে বেশির ভাগ দলেরই সমর্থক বুদ্ধিজীবী নেই।
নতুন দল গঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ভাবনা, ২০২৪-এ কোটা সংস্কার আন্দোলন দেশের রাজনীতিতে ব্যাপক মোড় ঘুরিয়ে দেয়। আওয়ামী লীগের টানা শাসনে নানা অনিয়মে ক্ষুব্ধ ছিল জনগণ। যার কারণে তারা ছাত্রদের আন্দোলনে ব্যাপক সমর্থন দিয়ে অংশ নেয়। সরকার গঠন করলে নানা কাজে তাদের প্রতি জনসমর্থনও দেখা যায়। ফেনীসহ বিভিন্ন জেলার বন্যায় টিএসসির গণত্রাণ কর্মসূচিতে অভূতপূর্ব সাড়া পড়েছিল। অন্যদিকে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর গণহত্যার ঘটনায় আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ নেতারা জড়িত থাকায় রাজনীতিতে তাদের প্রত্যাবর্তন সময়সাপেক্ষ। নতুন করে গ্রহণযোগ্যতাও প্রশ্নের সম্মুখীন। তাই অভ্যুত্থানের শক্তি হিসেবে নতুন দল করার এখনই উপযুক্ত সময় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
অপরদিকে সব শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণের চেষ্টার মধ্যেও নতুন দলের প্রধান লক্ষ্য তরুণরা থাকবেন বলে জানা গেছে। বর্তমানে দেশের মোট ভোটারের মধ্যে প্রায় ৩ কোটি তরুণ ভোটার রয়েছে। যারা দেশের পরিবর্তন নিয়ে নানাভাবে চিন্তা করছেন। কিন্তু প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ড ও দৃষ্টিভঙ্গি এবং রাজনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে তাদের ব্যাপক ভিন্নমত রয়েছে। বিগত সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে আওয়ামী লীগের অধীনে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হওয়ায় এসব তরুণদের অনেকেই ভোটদান থেকে বিরত থাকেন বা ভোট দেওয়ার সুযোগ পাননি।
সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ছাত্রদের নতুন দল এখনই ক্ষমতায় যাওয়ার পরিকল্পনা নিচ্ছে না। দল গঠন করে আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তারা জনমত যাচাই করবেন। আগামী নির্বাচনের হিসাব জটিল হলেও বিএনপির অবস্থান ভালো এ কথা মানছেনও তারা। তবে সরকার গঠন করলে নেতা-কর্মীদের কর্মকাণ্ডে বিএনপির ‘ইমেজ’ খারাপ হতে পারে এমনটা ধরে নিয়েই নতুন দল গঠনের পথে অগ্রসর হচ্ছেন ছাত্ররা। তাদের মতে, সরকার গঠন না করেই নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে বিএনপির অনেক নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করার মতো সিদ্ধান্ত নিতে হয় দলের হাইকমান্ডকে। পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকলে দলটির ভুল-ভ্রান্তি আরও বাড়বে এবং জনপ্রিয়তা কমে যেতে পারে বলে ছাত্ররা মনে করেন। তাই পরবর্তী নির্বাচন বা চতুর্দশ নির্বাচনে তারা শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলার আশায় নতুন দল গঠন করতে চাইছেন।
নাগরিক কমিটি সংশ্লিষ্টরা জানান, দলের আদর্শ, গঠনতন্ত্র চূড়ান্ত করতে একাধিক কমিটি কাজ করছে। আন্দোলনে শহিদ ও আহতদের পরিবারের সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করে ইতোমধ্যে দেশের শতাধিক থানায় কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে গঠন হতে পারে আহ্বায়ক কমিটি। কমিটির আহ্বায়ক পদে কাকে রাখা যায়, তা নিয়েও আলোচনা চলছে। এ ক্ষেত্রে নাগরিক কমিটির সদস্যদের মধ্যে দুই ধরনের আলাপ চলছে বলে জানা গেছে। তবে আন্দোলনে ভূমিকার কারণে অধিকাংশই সদস্যসচিব হিসেবে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের কথা ভাবছেন। যদিও তিনি এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেননি। গতকাল বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নাগরিক কমিটির একজন নেতা খবরের কাগজকে বলেন, দল গঠনের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বলার মতো কিছু হয়নি। নাহিদ ইসলামের পদত্যাগ করার কথা আলোচনা হচ্ছে। তবে উপদেষ্টা আসিফ ও মাহফুজের পদত্যাগের বিষয়টি এখনো আলোচনায় নেই। একই সঙ্গে তারা উপদেষ্টার দায়িত্ব ছাড়লে সে জায়গায় কারা অন্তর্ভুক্ত হবেন এ বিষয়টি নিয়েও আলাপ চলছে।
সম্প্রতি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষ সরকার দরকার হতে পারে দেওয়া বক্তব্য নিয়েও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম সরকারের কেউ রাজনৈতিক দলে যুক্ত হলে পদত্যাগ করবেন বলেও উল্লেখ করেন ফেসবুক পোস্টে। অপরদিকে দুই ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগের সম্ভাবনার বিষয়টি গণমাধ্যমে এলে এর পক্ষে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
এক পক্ষ মনে করছে, অন্তর্বর্তী সরকারে ছাত্র উপদেষ্টাদের ভূমিকার কারণে অগ্রগতি আছে। অন্যথায় সংস্কার এবং গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হতো না। তাদের মতে, ক্ষমতায় থেকে যদি জনগণের জন্য ব্যাপকভাবে কাজ করা না যায় তাহলে ক্ষমতা ছেড়ে কাজ করা অনেক কঠিন। অনেকেই বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কথা উল্লেখ করেন। তিনি ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে সরাসরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নেন এবং জয়ী হন। আবার অনেকেই নতুন করে আরও ছাত্রদের পক্ষ থেকে উপদেষ্টা পরিষদে যুক্ত করার পক্ষে মত দেন।