
রাজধানীর গণপরিবহন খাতকে শৃঙ্খলায় আনতে ঢাকা মেট্রো যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটি (আরটিসি) ও বাস রুট র্যাশনালাইজেশন কমিটির (বিআরআরসি) মধ্যে সমন্বয়হীনতা আরও প্রকট হয়েছে। রাজধানীর বাস রুট পুনর্বিন্যস্ত করতে দুই কমিটি দুই ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে। বিআরআরসি রাজধানীর সড়কগুলো ৪২টি রুটে পুনর্বিন্যস্ত করার কথা বললেও আরটিসি থেকে নতুন করে ২৭টি রুট বিন্যাসের কথা বলা হচ্ছে। ঢাকার সড়ক নিয়ে দুই কমিটির এমন দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও সমন্বয়হীনতার সুযোগ নিচ্ছেন বাসমালিকরা।
আরটিসি কমিটির একটি কার্যপত্র থেকে জানা গেছে, ঢাকার বাসমালিকরা নতুন করে ১ হাজার ৭৪টি বাস নামানোর তোড়জোড় শুরু করেছেন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এসব বাসের অধিকাংশই ফিটনেসবিহীন। অর্থনৈতিক মেয়াদকাল তো ফুরিয়েছে; পাশাপাশি এসব বাসের রুট পারমিটও নেই। এক রুটের পারমিট বাতিল হওয়ায় অন্য রুটে ভিন্ন কোম্পানির ব্যানারে এসব বাস পরিচালিত হচ্ছে।
২৭টি রুট নিয়ে পরিবহনমালিকদের তোড়জোড়
আরটিসি অনুমোদিত বাস রুটের সংখ্যা ৩৮৮টি; এর মধ্যে এখন অচল হয়ে গেছে ২৭৮টি। সচল থাকা ১১০টি রুটে অনুমোদিত গাড়ির সংখ্যা ৭ হাজার ৪৩টি। সচল রুটে এখন গাড়ি চলছে ৪ হাজার ৫৪৬টি। এর মধ্যে ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা ১ হাজার ৫৩টি। আরটিসি কমিটির সদস্য ও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাঈফুল আলম খবরের কাগজকে জানান, আরটিসি অনুমোদিত রুটের মধ্যে এখন ৬০-৬৫টি চলমান আছে। বাকি রুটগুলোতে বাস চলছে না।
অন্যদিকে ঢাকার ৩৮৮টি রুটকে সমন্বয় করে প্রাথমিকভাবে ৪২টি রুটে পুনর্বিন্যাস করছে বাস রুট র্যাশনালাইজেশন প্রকল্প। র্যাশনালাইজেশন প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে ৯টি ক্লাস্টার (৯টি ভিন্ন ভিন্ন রঙের), ২২টি কোম্পানিতে রূপান্তরের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত ৮০টির বেশি কোম্পানি থেকে বিভিন্ন রুটে বাস পরিচালনার আবেদন পাওয়া গেছে।
কিন্তু ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি এই বাস রুট র্যাশনালাইজেশন প্রকল্প নিয়ে প্রবল আপত্তি তুলেছে। তারা বলছে, তারা এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত হতে চায় না।
আরটিসি কমিটির একাধিক সদস্য খবরের কাগজকে বলেন, আরটিসি কমিটিতে প্রভাব খাটিয়ে পরিবহনমালিকরা এখন নতুন করে ২৭টি বাস রুট অনুমোদন করিয়ে নিতে চান।
এ রুটগুলো হলো নন্দনপার্ক থেকে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার, নন্দনপার্ক থেকে কাঁচপুর; দিয়াবাড়ী থেকে ঘাটারচর; দিয়াবাড়ী থেকে সদরঘাট; গাজীপুরের শ্রীপুর থেকে ঢাকেশ্বরী মন্দির; কোনাবাড়ী থেকে কেরানীগঞ্জ; গাবতলী থেকে গাজীপুরের শিমুলতলী; ঘাটারচর থেকে গাজীপুরের সালনা; গাজীপুরের কালীগঞ্জ থেকে পোস্তগোলা; জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাভারের নবীনগর; নবীনগর থেকে বাবুবাজার ব্রিজ; সাভার থেকে কাঁচপুর; ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে হেমায়েতপুর; গাবতলী থেকে ডেমরা; গাবতলী থেকে পূর্বাচলের কুড়াতলী; ইসিবি চত্বর থেকে পোস্তগোলা; ইসিবি থেকে কেন্দ্রীয় জেলখানা; শিয়া মসজিদ থেকে সায়েদাবাদ; ইসিবি থেকে বাহাদুর শাহ পার্ক; চিড়িয়াখানা থেকে কাঁচপুর; দুয়ারীপাড়া থেকে সদরঘাট; ঘাটারচর থেকে সায়েদাবাদ; ঘাটারচর থেকে ডেমরাঘাট; গুলশান-২ থেকে পীরজঙ্গি মাজার; বেরাইদ থেকে সদরঘাট; ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে খিলগাঁও তালতলা মার্কেট; বালুঘাট থেকে সায়েদাবাদ।
বিআরটিএ, ডিটিসিএর কর্মকর্তারা বলেন, ঢাকার বিভিন্ন রুটে নতুন করে যে বাসগুলো নামানোর জন্য পরিবহনমালিকরা আবেদন করেছেন, সেসব বাসের অধিকাংশেরই মালিক তারা নন। বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী রুট পারমিটবিহীন, মেয়াদোত্তীর্ণ বাসগুলো তারা রাজধানীর সড়কে নামাতে চান।
আরটিসি কমিটির সদস্য ও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাঈফুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘আরটিসি যে ১১০টি চলমান রুটের হিসাব দিচ্ছে, তার মধ্যে ৬০-৬৫টি রুট কেবল সচল আছে। বাকিগুলোতে বাস চলাচল অনেক দিন ধরে বন্ধ আছে। তাই আরটিসি কমিটি রাজধানী ও শহরতলির রুট সমন্বয়ে ২৭টি নতুন বাস রুট পুনর্বিন্যাসের কথা বলছে, সেগুলোর মধ্যে মাত্র একটি রুটের বিষয়ে এখন আলোচনা চলছে। বাকিগুলো বিবেচনাধীন।’
আরটিসির সদস্যরা পরীক্ষামূলক প্রকল্প হিসেবে আব্দুল্লাহপুর থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত একটি মডেল রোড চালুর পরিকল্পনা করেছেন। এ রোডটি কুড়িলে এসে বিভক্ত হবে। একটি রুট চলে যাবে বাড্ডার দিকে। পরে মহাখালীতে এসে একটি রুট সোজা যাবে সাতরাস্তা হয়ে, আরেকটি মহাখালী ফ্লাইওভার হয়ে ফার্মগেটের দিকে।
সাঈফুল আলম বলেন, ‘আরটিসি অনুমোদিত রুটগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা ওভারল্যাপ করছে। কিছু রুটে কোনো বাসই চলছে না। এদিকে আবার বাস রুট র্যাশনালাইজেশন কমিটিতে ডিটিসিএ একটা রুট প্ল্যান দিচ্ছে। দুই কমিটি দুই রকম রুট দেওয়ায় বাসমালিকরা যে যার মতো করে রুট পারমিট চাইছেন। এভাবে বিশৃঙ্খলাই বাড়বে। তবে আমরা চাই, দুই কমিটিই সমন্বয় করে একটা রুট প্ল্যান করুক।’
বাস রুট র্যাশনালাইজেশন প্রকল্পের পরিচালক ও ডিটিসিএর ডেপুটি আরবান প্ল্যানার ধ্রুব আলম বলেন, ‘আরটিসি কমিটিতে ডিএমপি ও বাসমালিকরা নতুন করে তিনটি রুটের কথা আমাদের বলেছেন। তবে সেসব রুটের পূর্ণাঙ্গ বিন্যাস আমরা পাইনি। বিন্যাস পেলে আমরা এসব রুট নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করব।’
২৯১০টি বাস নামানোর উদ্যোগ; অধিকাংশের নেই রুট পারমিট, ফিটনেস
ঢাকার সড়কে বাস নামাতে বিভিন্ন বাস কোম্পানির মালিকরা আরটিসি কমিটিতে আবেদন জানিয়েছেন। সেই তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৫০টি বাস কোম্পানির ২ হাজার ৮৮৫টি বাস চলাচলের অনুমতি রয়েছে। এতে ২০ বছরের অর্থনৈতিক মেয়াদকাল ফুরানো বাসের সংখ্যা ৭০৪টি। রুট পারমিট রয়েছে ১ হাজার ৬৫৫টি বাসের। এই হিসাব বলছে, এই ৫০ জন বাসমালিকের ১ হাজার ২২০টি রুট পারমিটবিহীন বাস ঢাকার বিভিন্ন রুটে চলাচল করছে। এই বাসমালিকরাই আবার নতুন করে ২ হাজার ৯১০টি বাস ঢাকার বিভিন্ন সড়কে নামানোর তোড়জোড় শুরু করেছেন।
আরটিসি কমিটির সদস্যরা খবরের কাগজকে বলেন, এই ২ হাজার ৯১০টি বাসের মধ্যে প্রায় সবগুলোই ফিটনেসবিহীন। এ বাসগুলো ঢাকায় রুট পারমিট হারিয়ে ঢাকার আশপাশের বিভিন্ন জেলায় চলাচল করছে। লক্কড়-ঝক্কড় এসব বাসের ফিটনেস সনদ পেতে বিআরটিএ আর রুট পারমিট পেতে ডিএমপি কার্যালয়ে নানা লবিং করছেন মালিকরা। কারণ, পদাধিকারবলে ডিএমপির ১২ জন শীর্ষ কর্মকর্তা আরটিসি কমিটির সদস্য।
গত ২১ জানুয়ারি ডিএমপি কার্যালয়ে আরটিসি কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই সভা শেষে একজন পরিবহনমালিক খবরের কাগজকে বলেন, ‘নতুন করে এসব বাস নামানোর দাবিতে ডিএমপি কমিশনার (শেখ মো. সাজ্জাত আলী) সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বিআরটিএ থেকে ফিটনেস সনদ ও রুট পারমিটের সনদ না মিললে কোনো বাস ঢাকার সড়কে চলতে দেওয়া হবে না। সরকার ঘোষণা দিয়েছে, আগামী মে মাসের মধ্যে রাজধানী থেকে লক্কড়-ঝক্কড় বাস তুলে দেওয়া হবে। ডিএমপি সে মোতাবেক কাজ করবে বলে কমিশনার স্যার জানিয়ে দিয়েছেন বাসমালিকদের।’