
নির্বাচন প্রশ্নে আগের চেয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর আরও চাপ বাড়াবে বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলো।
গত বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকার নিয়ে দলগুলোর মধ্যে নতুন করে আলোচনা ও জল্পনা-কল্পনা চলছে।
বিশেষ করে ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ব্যাপারে ড. ইউনূস কতটা পক্ষে বা বিপক্ষে তা খতিয়ে দেখছে ওই দলগুলো। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্য নিয়ে বিএনপিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের মধ্যে নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। গত সোমবার স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নির্বাচনের দাবিতে ফেব্রুয়ারিতে নতুন কর্মসূচি নিয়ে মাঠের নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। এরই মধ্যে ছাত্রদের রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়ে ড. ইউনূসের অবস্থানের বিষয়টি সামনে এল। দু-এক দিনের মধ্যে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপি ও তার সমর্থিত দলগুলোর একাধিক নেতা খবরের কাগজকে বলেছেন, নির্বাচন প্রশ্নে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের বক্তব্য নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও ড. ইউনূস এ প্রসঙ্গে এতদিন সরাসরি কোনো অবস্থান ব্যক্ত করেননি। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ছাত্রদের সম্পর্কের একটা ভারসাম্য বজায় রেখে চলছিলেন। যেকোনো ইস্যুতে বিরোধ তৈরি হলে দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে তিনি পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন। দ্রুততম সময়ে নির্বাচনের দাবি করলেও দলগুলো এ কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য কোনো অবস্থান নেয়নি। গত কয়েক মাস তারা বলেছেন, সরকারকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হবে।
নেতারা আরও বলেন, রাষ্ট্রপতির অপসারণ, সংবিধান সংস্কার, জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র ঘোষণা, আগে সংস্কার নাকি নির্বাচন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধসহ নানা ইস্যুতে মতবিরোধ তৈরি হলেও বিএনপিসহ ওই দলগুলো সতর্ক থেকে তাদের অবস্থান ব্যক্ত করেছে। বলা হয়েছে, নির্বাচন প্রশ্নে সরকারকে চাপে রাখলেও বিরোধে জড়াবে না। কিন্তু ছাত্রদের রাজনৈতিক দল গঠন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের পর দলগুলোর মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে।
অনেকের মতে, অন্তর্বর্তী সরকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দল গঠনের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নিয়েছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, সরকারের অবস্থান এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট হয়নি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, প্রথমত বাংলাদেশের আইন মোতাবেক যে কেউ সংগঠন বা দল গঠন করতে পারে এবং ঘোষণাও দিতে পারে। গণতান্ত্রিক দেশে যে কারও রাজনৈতিক দল গঠনের অধিকার রয়েছে। কিন্তু তাদের আদর্শ, নীতি ও নেতৃত্ব কতটুকু গ্রহণ করা হবে, তা নির্ভর করছে জনগণের ওপর।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকার নিজেরা ঘোষণা দিয়েছে, তারা নিরপেক্ষ ও জনগণের সরকার। এই সরকারের কোনো উপদেষ্টা যদি রাজনৈতিক দল গঠন করে, তাহলে সেই দল সরকার-সমর্থিত প্রতিষ্ঠিত দল হিসেবে চিহ্নিত হবে। সহযোগিতা করলে সরকার নিরপেক্ষতা হারাবে। পরিচয় দিয়ে রাজনৈতিক দল গঠনের পর তাদের মূল্যায়ন করবে জনগণ।
অন্যরা যা বলছেন
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, ‘রাজনীতি করতে চাইলে তো আমি কোনো অসুবিধা দেখি না। রাজনীতি করতে চাইলে তারা করতে পারে। সে অধিকার তাদের আছে। জনগণ দেখবে কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ। তবে কিংস পার্টি দিয়ে রাজনীতি হবে না।’
সরকারি সম্পদ বা সরকারি কর্তৃত্ব ব্যবহার করে রাজনীতি করাটা জনগণ এবং অনেক রাজনৈতিক দল ভালোভাবে দেখবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। জি এম কাদের বলেন, ‘এমনটি হলে আগামী নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডও নিশ্চিত হবে না।’
তিনি বলেন, এবার গণ-অভ্যুত্থানের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ঐকমত্য হয়েছিল, সেটি হলো তারা রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। দাবি উঠেছিল, ইলেকশনের সময় যারা ক্ষমতায় থাকবেন তারা কোনো দল করতে পারবেন না। দল করতে চাইলে সরকারের বাইরে থেকে করতে হবে। এখন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করলে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নষ্ট হবে। সে রকম কিছু হলে আগামী নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার ঝুঁকি দেখা দিতে পারে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘ছাত্ররা দল গঠন করতে পারে, তারা আশা-আকাঙ্ক্ষা ও প্রতিশ্রুতি জনগণকে দিতে পারে। জনগণ যদি তাদের গ্রহণ করে তবে স্বাগতম। শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও ক্ষমতায় থেকে দল গঠন করেছেন। কিন্তু আমাদের প্রত্যাশা, যারাই ক্ষমতায় আসুন না কেন, তা যেন বৈধ প্রক্রিয়ায় হয়। জনগণ যদি ভোট দিয়ে কাউকে ক্ষমতার মসনদে বসায়, তাহলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।’
ভারতের কয়েক মাসব্যাপী নির্বাচনের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘ইসি শক্তিশালী হলে কে ক্ষমতায় আছে বা কে নেই, তাতে নির্বাচনের ওপর প্রভাব পড়বে না।’
যা বললেন বিএনপির মিত্ররা
বিএনপির মিত্র দলগুলো বলছে, দেশের গণতান্ত্রিক বিধিবিধান ও নির্বাচন কমিশনের আইন মেনে যে কেউ রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারে। উপদেষ্টাদের দল গঠনের আগে পদ ত্যাগ করা উচিত। কিংস পার্টি গঠন করলে ছাত্রদের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হবে।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার খববের কাগজকে বলেন, ‘গণতান্ত্রিক দেশের বিধিবিধান মেনে দল গঠন করলে আপত্তি নেই। আমি মনে করি, উনি (প্রধান উপদেষ্টা) ছাত্রদের সম্মান দেখিয়ে সুযোগ করে দিতে চাইছেন। তবে রাজনৈতিক দল গঠন করলে ছাত্রদের উপদেষ্টা পদে থাকা উচিত হবে না। এতে সরকারের নির্দলীয় চরিত্র থাকবে না, গ্রহণযোগ্যতা কমবে। তবে কোনো উপদেষ্টাকে দল গঠনের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কথা বলতে শুনিনি।’
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা ও নাগরিক ঐক্যর সভাপতি মাহামুদুর রহমান মান্না খবরের কাগজকে বলেন, ‘পদ্ধতির মধ্যে থেকে যে কেউ দল গঠন করতে পারে। প্রধান উপদেষ্টা হোক বা অন্য কেউ তাকে সাপোর্ট করতে পারে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ক্ষমতায় থেকে দল গঠন নিয়ে। তারা যদি রাজনৈতিক দল গঠন করতে চান, তাহলে এখনই ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু তারা বলছেন, এখনই তারা ক্ষমতা ছাড়বেন না। এটা তো সততা হলো না? এসব বিষয় উনি (প্রধান উপদেষ্টা) জানেন।’
তিনি বলেন, ‘উনি (প্রধান উপদেষ্টা) ছাত্রসংগঠনগুলোকে সুযোগ করে দিতে চাচ্ছেন। উনি যে দায়িত্বে আছেন, সেখান থেকে এভাবে বলতে (আমি সুযোগ দিতে চাই) পারা যায় কি না, তা ভেবে দেখতে হবে। জনগণ যদি ছাত্রদের রাজনীতি করার সুযোগ দেয়, তাহলে সরকার সুযোগ দিতে পারে। সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে সরাসরি জনগণের মধ্যে যেন প্রশ্ন না ওঠে। সেটা হলে তা আমাদের জন্য বড় বিপর্যয়কর হবে। জনগণ চাইবে, ক্ষমতায় থেকে সরকারের ছায়া, সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে কেউ যেন দল গঠন না করে। আর কাউকে যদি সমর্থন করার প্রয়োজন থাকে, তাহলে সরকারের উচিত নয় প্রকাশ্যে সমর্থন দেওয়া।’
১২-দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘বর্তমানে ছাত্রদের মধ্যে ক্ষমতার উচ্চাকাঙ্ক্ষা জাতিকে গভীর সংকটে ফেলবে। কিংস পার্টি গঠন করে তাদের মধ্যে ক্ষমতায় থাকার ইচ্ছা দেখা যাচ্ছে। খেয়াল রাখতে হবে, এর ফলে সরকারের নিরপেক্ষতা এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে যেন প্রশ্ন না ওঠে। পাশাপাশি কিংস পার্টি গঠন করে নির্বাচনে অংশ নিলে ছাত্রদের গ্রহণযোগ্যতাও থাকবে না।’ তিনি বলেন, ‘সরকারকে সঠিক পথে আনতে বিএনপির সঙ্গে রাজপথে থেকে সর্বোচ্চ চাপ সৃষ্টি করতে মাঠে থাকবে ১২-দলীয় জোট।’
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা আশা করি, প্রধান উপদেষ্টা তার পদে থেকে রাজনৈতিক দল গঠনে সাহায্য-সহযোগিতা করবেন না। যদি ছাত্রদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করেন, তাহলে নতুন বিতর্ক শুরু হবে।’
তিনি বলেন, ছাত্রদের উপদেষ্টা থেকে পদত্যাগ করে দল গঠন করা উচিত। তবে আগামী নির্বাচনে সরকার নিরপেক্ষ থাকতে পারবে কি না, তা পরিস্থিতি বলে দেবে।