
সর্বক্ষেত্রে নারীর সমান অধিকারের বিষয়টি কয়েক দশক ধরে আলোচনায় থাকলেও সমাজে ও রাষ্ট্রে এখনো বিষয়টি স্বীকৃত হয়নি। বিশেষ করে সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকারের বিষয়টি এখনো অমীমাংসিতই রয়ে গেছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনও এ বিষয়ে সরাসরি কোনো প্রস্তাব দিতে পারছে না। কারণ দেশের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকারের বিষয়টিতে বিরোধিতা করছে। অথচ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সর্বক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করার অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছিল। এ জন্য রাষ্ট্রকাঠামো বিনির্মাণে নারী সংস্কার কমিশনসহ মোট ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। এসব কমিশনের সুপারিশ বা প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে সরকার নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেবে।
দেশের প্রচলিত আইনের যেসব ধারায় নারীর প্রতি বৈষম্য রয়েছে সেগুলোকে সংস্কার, প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন, কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নির্বাচনে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর মতো বিষয় ছাড়াও অভিন্ন পারিবারিক আইন ও সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকারের বিষয়েও নানা প্রস্তাব দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে নারী ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার পাশাপাশি সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করেছে কমিশন।
নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা গেছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনের বাইরে বড় কোনো সংস্কার করতে রাজি নয় কমিশন। তবে কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আলোচনা ও প্রস্তাবে থাকলেও বেশ কিছু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের সমর্থন না পাওয়ায় সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অমীমাংসিতই থেকে যাচ্ছে।
দেশের আইনে মুসলিমদের পারিবারিক বিধান ইসলামি আইনেই পরিচালিত হয়। মুসলিম পারিবারিক আইনে যেসব বিধান রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে উত্তরাধিকার ব্যবস্থা। মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ আইন ১৯৬১ সালে উত্তরাধিকার আইনে মৌলিক কিছু পরিবর্তন আনা হয়। তবে কোরআনের সুরা নিসার ১১ ও ১২ নম্বর আয়াতে বণ্টনের যে নীতি আছে, তার দ্বারাই মূলত মুসলমানদের উত্তরাধিকার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে দেশে।
এতে মৃত ব্যক্তির ছেলেমেয়ের সম্পত্তির বিধান হলো, প্রত্যেক মেয়ে প্রত্যেক ছেলের (১/২) অর্ধেক হারে পাবেন। যদি মৃত ব্যক্তির শুধু এক কন্যা থাকে, তবে তিনি মোট সম্পত্তির (১/২) অর্ধেক পাবেন। আর যদি একাধিক কন্যা থাকে, তাহলে সব মেয়ে মিলে (২/৩) দুই-তৃতীয়াংশ পাবেন।
এদিকে পিতা বা স্বামীর সম্পত্তিতে হিন্দু নারীদের অধিকার নেই। মৃত ব্যক্তির পুত্র, পৌত্র, প্রপৌত্র ও স্ত্রী থাকলে কন্যা তার পিতার সম্পত্তি পান না।
চলমান কার্যক্রমের বিষয়ে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরিন পারভিন হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা নারীর প্রতি চলে আসা বৈষম্য বিলোপে যথা সম্ভব কাজ করছি। নারী অধিকারসংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে কথা হচ্ছে। যেসব আইনে বৈষম্য আছে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এগুলো পরিবর্তনসহ বেশ কিছু পরিবর্তনের সুপারিশ আমরা করব।’
জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬। এর মধ্যে পুরুষ ৮ কোটি ১৭ লাখ ৬৯ হাজার ২৬৬ এবং নারী ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৮১ হাজার ২২৬ জন। অর্থাৎ দেশে পুরুষের চেয়ে নারী বেশি ১৬ লাখ ১১ হাজার ৯৬০ জন।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেও নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা কর্মীরা বলছেন, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার এই নারীদেরই বঞ্চিত করা হচ্ছে অর্থনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক, আইনগতসহ নানা অধিকার থেকে। তাদের মতে, সংখ্যায় বেশি হলেও ক্ষমতায়নে পেছনে রাখা হচ্ছে নারীদের।
অথচ গত ৫ আগস্ট-পরবর্তী বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সফলতায় গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে নিয়েছে বৈষম্য বিলোপের সংস্কার কার্যক্রম। কিন্তু সেই কার্যক্রমে নারী বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে ব্যক্তি মানুষের সব অধিকার সমানভাবে পাবেন- এটাই নারী অধিকারকর্মীদের প্রত্যাশা। তারা বলছেন, সম্পত্তিতে নারীর সমানাধিকার না দিয়ে অন্যান্য ক্ষেত্রে যতই বৈষম্য বিলোপ করা হোক, তা নারীর ক্ষমতায়নে কাজে আসবে না।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা অভিন্ন পারিবারিক আইন, সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকারসহ দেশের প্রচলিত আইনে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় যে বাধাগুলো আছে সেগুলো বিলোপের আহ্বান জানিয়েছি। এ ছাড়া সংবিধানে নারীকে একজন ব্যক্তি হিসেবে সমান অধিকার দেওয়ার কথা বলেছি। তবে নারীকে যদি তার সম্পত্তিতে সমান অধিকার দেওয়া না হয়, তবে তার বাকি অধিকারগুলো সে ভোগ করতে পারবে না।’
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপারসন ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, ‘আমরা আইন সংস্কারের কথা বলছি, আমরা নির্বাচনে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর কথা বলছি। কিন্তু তার হাতে অর্থ আসার কোনো পথ করে দিচ্ছি না। সম্পদে সমান অধিকার ছাড়া নারীর আর্থিক মুক্তি কখনোই মিলবে না। ফলে সে তার পূর্ণ মেধা দিয়ে একজন পুরুষের সমান লড়াই করতে পারবে না। কারণ সব জায়গায় অর্থের প্রয়োজন রয়েছে। যেকোনো আইনি লড়াইয়েও নারীর আর্থিক শক্তির প্রয়োজন হয়। তাই এটি ছাড়া নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করা সম্ভব নয়।’
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, অভিন্ন পারিবারিক আইন এবং দেশের প্রচলিত আইনে নারীর প্রতি যেসব বৈষম্য আছে, তা নিয়ে কাজ করছে কমিশন। এ ছাড়া সংবিধানেও নারীর অধিকার পরিস্কার করতে চায় কমিশন। এ ছাড়া সম্পত্তির উত্তরাধিকারে নারীর সমান অধিকার দেওয়া এবং সাক্ষ্য আইনসহ বৈষম্যমূলক অন্যান্য আইনেও পরিবর্তনের সুপারিশ করবে কমিশন। তবে ধর্মীয় ও সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে দেশের সমাজ এই আইন পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত নয় বলে উল্লেখ করছে বেশির ভাগ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলসহ সংস্কারসংশ্লিষ্ট একটি অংশ। ফলে সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকারের বিষয়টি অমীমাংসিতই রয়ে যাচ্ছে। ফেব্রুয়ারির শেষভাগে এই সুপারিশগুলো সরকারপ্রধানের কাছে দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।
এদিকে জাতিসংঘ ঘোষিত নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ দলিল- সিডও সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করলেও এর দুটি ধারায় সংরক্ষণ রাখে। যেখানে একটি ধারায় নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপে শরিক দেশগুলো আইনগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার এবং আইনের সংস্কার করার কথা বলা হয়েছে। অন্য ধারায় বিয়ে এবং বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে।
এ ক্ষেত্রে অভিন্ন পারিবারিক আইনের মাধ্যমে বিয়ে এবং বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও দায়িত্বের শর্তটি পূরণ হলেও সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ হবে না বলে মনে করেন নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ও নারী অধিকারকর্মীরা।