
গেল মাসের ৯ তারিখে বাড়তি ভ্যাট ও শুল্কের বোঝা চাপানো হয়েছে মানুষের জীবনে। খরচ বেড়েছে জনজীবনে। বাড়তি খরচের এই ধাক্কা সামলিয়ে ওঠার আগেই ২২ দিনের মাথায় (৩১ জানুয়ারি) সব ধরনের জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছে। নতুন সরকারের সংশ্লিষ্টরা দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, শুধু গণশুনানি করেই জ্বালানির দাম বাড়ানো হবে। তবে তা বাস্তবায়ন হয়নি। খরচের চাপে দিশেহারা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়ল।
অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ীসহ অনেকেই বলেছিলেন, সরকার পরিবর্তনের পর প্রত্যাশা ছিল, জীবনযাত্রার ব্যয় হয়তো কমবে।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. তৌফিকুল ইসলাম খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বর্তমান সরকার গণশুনানি করে জ্বালানির দাম বাড়ানোর কথা বললেও তা মানেনি। আগের সরকারের মতো একক সিদ্ধান্তে জ্বালানির দাম বাড়িয়েছে। তাহলে সরকার পরিবর্তন করা হলো কেন?’
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সংগতি রেখে দেশের বাজারে জ্বালানির দাম বাড়ানোর কথা থাকলেও তা মানতে হবে কেন? নিয়ম তো সরকার করে। সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে সরকার প্রয়োজনে নিয়ম পাল্টাবে। তা করা হলো না।
ব্যবসায়ীরা বলেছেন, জ্বালানির দাম বাড়ানোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে পণ্যের দাম বাড়বে, যা শেষ পর্যন্ত ভোক্তাকে দিতে হবে। এর দায় ব্যবসায়ীদের ওপর চাপানো হলে তা ঠিক হবে না।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আশরাফ আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, অতীতে যতবার জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছে ততবারই পরিবহন ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। অতীতের মতো জ্বালানির দাম বাড়ানোর ফলে এবারও পরিবহন ব্যয় বাড়লে আমদানি করা পণ্য আনতে খরচ বাড়বে। একইভাবে দেশের মধ্যেও এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পণ্য আনা-নেওয়ায় খরচ বাড়বে। শিল্প খাতেও উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। এসব বাড়তি খরচ শেষ পর্যন্ত পণ্যের দামের সঙ্গে যোগ করে বিক্রি করা হবে। বাড়তি দামের দায় ব্যবসায়ীরা নিবেন না। এক কথায় বলা যায়, জ্বালানির দাম বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি উসকে দেওয়া হলো।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক আবদুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের দেশের অসাধু ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন অজুহাতে দাম বাড়িয়ে থাকেন। জ্বালানির দাম বাড়ানোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে খরচ যতটা না বাড়বে অসাধু ব্যবসায়ীরা এ অজুহাতে জিনিসপত্রের দাম আরও বেশি বাড়াবেন। বাড়তি দাম শেষ পর্যন্ত ভোক্তাকেই পরিশোধ করতে হবে।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘দাম বাড়লে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ে। করোনার পর থেকে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত সব ধরনের খরচ বেড়েই চলেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ডলারসংকটে সব ধরনের খরচ আরও বেড়েছে। সম্প্রতি ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানোর কারণে অনেক কিছুর দাম আরও একধাপ বেড়েছে। এরপর জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে পণ্যমূল্য যতটা না বাড়বে, তার চেয়ে বেশি বাড়াবেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। সব কিছু শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষকে বহন করতে হয়। আমাদের দেশে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের সফলতা নেই বললেই চলে।’
গত শুক্রবার জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম প্রতি লিটারে এক টাকা বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়, যা গতকাল শনিবার থেকেই কার্যকর হয়েছে। নতুন নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী ডিজেলের দাম প্রতি লিটার ১০৫ টাকা, কেরোসিন ১০৫ টাকা এবং অকটেন ১২৬ টাকা ও পেট্রল ১২২ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সুপারিশে সরকারকে জ্বালানির দাম বাড়ানোর মতো সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। আইএমএফ ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার সময় আগের সরকারকে একগুচ্ছ ঋণ মানার শর্ত দিয়েছিল। শর্ত মেনেই বাংলাদেশ ঋণ নিতে রাজি হয়। এসব শর্তের অন্যতম ছিল, ভর্তুকি হ্রাস করে দফায় দফায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়াতে হবে। শর্ত অনুযায়ী, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার দফায় দফায় গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করে।
গত ৫ আগস্টের পর থেকেই ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের পর বাসের আমদানি করা নানা যন্ত্রাংশের দাম বেড়ে গেছে। বাসমালিকরা সে জন্য ভাড়া বাড়ানোর চাপ দিয়ে আসছেন। এবার জ্বালানির দাম বাড়ানোয় তাদের সেই দাবি আরও জোরালো হয়েছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, ইতোমধ্যে মহানগর, আন্তজেলা ও দূরপাল্লার বাসের ভাড়া বাড়াতে একটি লিখিত আবেদন জমা দেওয়া হয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএ, ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ-ডিটিসিএ ও পুলিশের নেতৃত্বে একটি ভাড়া নির্ধারণ কমিটি রয়েছে। এই কমিটি এখন সেই আবেদনটি বিশ্লেষণ করে দেখবে।
বাসমালিকরা বাস ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ৪০ পয়সা বাড়াতে চান বলেও জানা গেছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে প্রতি কিলোমিটারে বাস ভাড়া হবে ৩ টাকা ৩৮ পয়সা। আর আন্তজেলা ও দূরপাল্লার বাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে বেড়ে দাঁড়াবে ২ টাকা ৯৬ পয়সা।
সাইফুল আলম বলেন, ‘প্রতি কিলোমিটারে বাস ভাড়া কত বাড়বে সেটা এখনই আমরা বলতে চাই না। বাস ভাড়া বাড়ানোর জন্য শুধু তেলের দাম বৃদ্ধিই একমাত্র কারণ না।’
তিনি বলেন, এর আগে যখন বাস ভাড়া বাড়ানো হয়েছিল তখন ডলারের রেট ছিল ১০২ টাকা। সেটি বেড়ে এখন ১২৫ টাকার মতো হয়েছে। গাড়ির মবিল, স্পেয়ার পার্টসের দামও অনেক বেড়েছে। আগে টায়ার, টিউব কিনতাম ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকায়, এখন সেটি কিনতে হচ্ছে ৫০ হাজার টাকায়। সে সময়ের তুলনায় এখন গাড়ির যন্ত্রাংশের দাম ৪৫ শতাংশ বেড়েছে। তাই সবকিছু মিলিয়ে এ মুহূর্তে বাস ভাড়া বাড়ানো না হলে পরিবহন মালিকরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বেন। এ ছাড়া বিআরটিএ থেকে লাইসেন্স, যানবাহনের নিবন্ধনের ফি, সড়ক করসহ সব ধরনের সেবার মূল্য বাড়ানো হয়েছে।
তেলের দাম বাড়ায় পণ্যবাহী ট্রাকের মালিকরাও ভাড়া বাড়াতে চাইছেন বলে জানান বাংলাদেশ বাস ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও শ্যামলী পরিবহনের কর্ণধার রমেশ ঘোষ। তিনি বলেন, বাজার পরিস্থিতির কথা তো আমাদের বিবেচনায় রাখতে হয়। বাজারের সঙ্গে মিলিয়ে ট্রাকের ভাড়া বাড়াতে হয়। কিছুদিন আগে যে ট্রাকটি দূরপাল্লার কোনো রুটে ১০ হাজার টাকা ভাড়ায় চলে গেছে, সেটি নিয়ে চালক এখন ১১ হাজার টাকার নিচে যেতে চাইছে না। সব জিনিসের দাম বাড়ছে।
রাজধানীর মেরুল বাড্ডা এলাকায় কথা হয় ভিক্টর পরিবহনের চালক মো. রেজাউলের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবহন খাতের নানা কিছুর দামও ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দেন।
এর আগে বাস-ট্রাকের জ্বালানি ডিজেলের দাম ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়ে প্রতি লিটারে দাঁড়ায় ১১৪ টাকা। ছোট গাড়ি ও মোটরবাইকের জ্বালানি পেট্রলের দাম ৫১ দশমিক ১৬ শতাংশ বেড়ে প্রতি লিটারে হয় ১৩০ টাকা, অকটেনের দাম ৫১ দশমিক ৬৮ শতাংশ বেড়ে প্রতি লিটারে দাঁড়ায় ১৩৫ টাকা। মহানগরীতে বিভিন্ন রুটের বাস ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৭০ পয়সা থেকে করা হয় ২ টাকা ১৫ পয়সা। মিনিবাসের ক্ষেত্রে ১ টাকা ৬০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা ৫ পয়সা করা হয়েছিল তখন।
অবশ্য এ ঘটনার ২৩ দিন পর ২৯ আগস্ট সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম প্রতি লিটারে ৫ টাকা করে কমানো হয়। কিন্তু বাসমালিকরা বাস ভাড়া কমাননি।