
পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় শীর্ষ সন্ত্রাসীরা চাপের মুখে পড়েছেন। জানা গেছে, গ্রেপ্তার আতঙ্কে আলোচিত দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজেদুল হক ওরফে ইমন ও পিচ্চি হেলাল দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। কেউ কেউ পালানোর পথ খুঁজছেন এবং অন্যরা আত্মগোপনে চলে গেছেন। তবে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কারাগারের বাইরে থাকা এবং সাম্প্রতিক সময়ে চাঁদাবাজিসহ খুনখারাবির ঘটনার প্রেক্ষাপটে আতঙ্ক বিরাজ করছে জনমনে।
পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) অতিরিক্ত ডিআইজি আসাদুজ্জামান খবরের কাগজকে বলেন, ‘যাদের বিষয়ে বিভিন্ন সংস্থা থেকে আমাদেরকে ইনফর্ম করা হয়, অথবা টপ লিস্ট করা আছে, তাদের বিষয়ে আমরা সব সময়ই অ্যালার্ট আছি। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বিষয়ে ইমিগ্রেশন পুলিশ সতর্ক রয়েছে। তারা যেন দেশ ছেড়ে পালাতে না পারে সে জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
ইতোমধ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন ও পিচ্চি হেলাল দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন কি না জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান বলেন, ‘দু-একজন দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে। এ বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। দাগি অপরাধীদের ঠেকাতে আমাদের চেষ্টার ত্রুটি নেই।’
এদিকে, ইমনের মা অধ্যাপক ডা. সুলতানা জাহান খবরের কাগজকে জানিয়েছেন, ইমন পালিয়ে যায়নি। চিকিৎসার জন্য বিদেশে গেছে। চিকিৎসা শেষে সে দেশে ফিরে আসবে।
তবে ডিএমপির একাধিক কর্মকর্তা জানান, শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন ও পিচ্চি হেলাল জামিনে মুক্ত হওয়ার পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। এর মধ্যে সন্ত্রাসী ইমন থাইল্যান্ড ও পিচ্চি হেলাল সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতে পালিয়েছেন বলে জানা গেছে। যদিও গত ১৮ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে ইমনের মা ডা. সুলতানা জাহান দাবি করেন, এলিফ্যান্ট রোডে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে হামলার ঘটনায় ইমন জড়িত নয়। তাকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসানো হয়েছে।
এ সময় তিনি জানান, কারাগারে থাকা অবস্থাতেই শারীরিক নানা জটিলতার কারণে অসুস্থ ছিল ইমন। কারাগার থেকে জামিনে বের হওয়ার পর গত ডিসেম্বরে চিকিৎসার জন্য ব্যাঙ্কক গেছে সে। বর্তমানে সেখানেই অবস্থান করছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে অন্তত ছয়জন জামিনে মুক্তি পান। তাদের বেশির ভাগই এক থেকে দেড় যুগের বেশি সময় ধরে কারাগারে ছিলেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে গত ১৫ আগস্ট মুক্তি পান ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অন্যতম ইমন। ১৬ আগস্ট কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার-৪ থেকে জামিনে মুক্তি পান শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকার অন্যতম ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল। কারামুক্তির পর এই দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী নিজ এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ‘কিলার আব্বাস’ হিসেবে পরিচিত মিরপুরের আব্বাস আলী, তেজগাঁওয়ের শেখ মোহাম্মদ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম, খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন ও খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসুও কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
এসব দাগি অপরাধীর মুক্তির পর থেকেই ঢাকায় ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, খুনোখুনি ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানোর মতো ঘটনা বেড়েছে। সন্ত্রাসীরা খুনোখুনির পাশাপাশি নিজ নিজ এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য নেমে পড়েন। ফলে জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয়। একাধিক গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে সরকার নড়েচড়ে বসে। সর্বশেষ গত ১০ জানুয়ারি রাতে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে ইসিএস কম্পিউটার সিটির (মাল্টিপ্ল্যান সেন্টার) সামনে দুর্বৃত্তরা ব্যবসায়ী এহতেশামুল হককে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে পালিয়ে যান। চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কারণে তার ওপর হামলা চালানো হয়েছিল বলে অভিযোগ করেন এই ব্যবসায়ী। এ ঘটনায় শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে নিউমার্কেট থানায় মামলা হয়। এরপর থেকে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ধরতে সক্রিয় হয়।
এমন পরিস্থিতিতে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) রেজাউল করিম মল্লিক জানান, জামিনে জেল থেকে বের হওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কে কোথায় তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে তাদের অবস্থান শনাক্ত ও অপরাধে জড়িতদের গ্রেপ্তারে নিয়মিত অভিযান চলছে। ইতোমধ্যে পিচ্চি হেলাল ও ইমন গ্রুপের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা এখনো শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অবস্থান নিশ্চিত করতে পারিনি। তবে আমাদের শতভাগ চেষ্টা চলছে। পেলেই গ্রেপ্তার করব।
জনমনে আতঙ্ক
গত বছর শীর্ষ সন্ত্রাসীদের জামিনের পর থেকেই ঢাকায় ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ও খুনোখুনি বেড়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম শাখা থেকে খবরের কাগজকে জানানো হয়েছে, গত তিন মাসে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) রাজধানী ঢাকায় বিভিন্নভাবে ১৫৮ জন খুন হয়েছেন। ওই তিন মাসে ডাকাতির মামলা হয়েছে ১৭টি এবং ছিনতাইয়ের ঘটনায় ১২২টি মামলা হয়েছে।
ঢাকার একাধিক বাসিন্দা জানান, সম্প্রতি ছিনতাই ও চাঁদাবাজির ঘটনা বেড়েছে। এ জন্য রাতের বেলায় তারা বিশেষ কোনো কাজ ছাড়া ঘরের বাইরে বের হন না। এ ছাড়া শীর্ষ সন্ত্রাসীদের জামিনের পর থেকেই বিভিন্ন জায়গায় চাঁদা না পেয়ে খুনোখুনির ঘটনা ঘটে। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
ধানমন্ডির বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম জানান, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের জামিন দেওয়া কোনোভাবেই উচিত হয়নি। তাদের জামিনের পর থেকে সাধারণ মানুষ চলাফেরা করতে অস্বস্তি বোধ করছেন। এ ছাড়া এই জামিন সাধারণ মানুষের মনে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। দ্রুত সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে জোর দাবি জানান তিনি।
এমন পরিস্থিতিতে কারাগার থেকে বের হওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীদের জামিন বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে ডিএমপি। এ বিষয়ে সমাজ ও অপরাধ গবেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘দাগি আসামিদের জামিন দেওয়ার আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণ খুবই প্রয়োজন। এ ছাড়া জামিন দিলেও বাতিলেরও সুযোগ রয়েছে। শীর্ষ সন্ত্রাসীরা সব সময় সুযোগ বুঝে অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। সব সময় তাদের জগতে সক্রিয় থাকতে চান। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চান।’
শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর একটা সম্পৃক্ততা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করে। এতে তাদের অপরাধের জগৎ ও আধিপত্য আরও পাকাপোক্ত হয়। আইনশৃঙ্খবাহিনীসহ যাদের এসব অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা। তাদের অনেকে ভয়ে, আবার অনেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে মুখে কুলুপ দিয়ে থাকেন। ফলে এ ধরনের সন্ত্রাসীরা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যান।’
প্রায় ১৭ বছর বা তার চেয়ে বেশি সময় কারাগারে থাকার পরেও দাগি আসামিদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন না হওয়ার কারণ সম্পর্কে এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ বলেন, কারাগারে অপরাধীদের শাস্তির পাশাপাশি চারিত্রিক সংশোধনের জন্য কাউন্সেলিং করা হয়। আমাদের দেশের কারাগারে এসব ব্যবস্থা অপ্রতুল; আবার যা আছে তাও তেমন কার্যকর নয়। খাতা কলমে থাকলেও রাস্ট্রীয়ভাবে তাদের সংশোধনে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না।
তিনি বলেন, ‘দেশের প্রেক্ষাপট এমন দাঁড়িয়েছে যে- অপরাধী যে যত বড় তার কদর তত বেশি। অপরাধ করে তারা জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন। এ ছাড়া আধিপত্য ও ক্ষমতা ধরে রাখতে তারা নিজেদের সংশোধন করেন না। ফলে অন্ধকার জগৎ থেকে তারা বের হতে পারেন না।