
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সবখানেই এখন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের বাড়বাড়ন্ত। ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতারাও দাপটের সঙ্গে সবজি, ফলমূলসহ সংসারের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করছেন। এ ছাড়া প্রায় প্রতিটি রাস্তার মোড়ে ফুচকা, মুড়ি ও পিঠাওয়ালাদের দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু এদের নেই কোনো ট্রেড লাইসেন্স বা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। অর্থাৎ তাদের সরকারি হিসাবে নিয়ে আসার সুযোগ নেই। তারা অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও সরকার তাদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করতে পারছে না।
গত কয়েক বছরে দেশে এ ধরনের ভ্রাম্যমাণ পেশায় নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে কয়েক গুণ। অর্থনীতির পরিভাষায় এটি হলো ইনফরমাল বা অপ্রাতিষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক খাত। দিনে দিনে এই খাতের আকার বাড়ছেই।
সম্প্রতি প্রকাশিত সরকারের অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৪-এ দেখা গেছে, দেশে খানাভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়েছে- এটি মূলত অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত হিসেবে পরিচিত। বাসাবাড়িতে কুটির শিল্পের মতো বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও ফুটপাতের অস্থায়ী দোকানসহ প্রভৃতিকে এ খাতে ধরা হয়েছে। শুমারিতে দেখা যায়, গত ১১ বছরে এ খাতের উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে ৭৮ শতাংশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, বর্তমানে দেশে ৫০ লাখের বেশি ইনফরমাল বা অনানুষ্ঠানিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ ছাড়া দেশে ই-কমার্সসহ অনলাইন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এখন ১ লাখ ১৬ হাজার ৯৭৮। শুমারির তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর কর্মজীবী শ্রমিকের সংখ্যা ২০ লাখ করে বাড়ছে, যার বড় অংশ চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে আর পাঁচ লাখ চলে যাচ্ছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। এর মূল কারণ হলো প্রাতিষ্ঠানিক খাতে ভালো চাকরি পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারি চাকরি সীমিত, আধুনিক সেবা খাতে যেমন- ব্যাংকিং, ওষুধ, গার্মেন্টস ও টেলিকম খাতে প্রত্যাশা অনুযায়ী কর্মসংস্থান হচ্ছে না। দেশে অনানুষ্ঠানিক খাত বড় হওয়া অর্থনীতির জন্য ভালো নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, একটি দেশের অর্থনীতির গুণগত মান কেমন, তা বোঝার অন্যতম মানদণ্ড হচ্ছে অর্থনীতির সংগঠিত প্রাতিষ্ঠানিক খাত। একটি দেশের সংগঠিত খাত কতটা বড়, তার সঙ্গে সেই দেশের মানুষের কর্মসংস্থান, বিশেষত শোভন কর্মসংস্থান, নিয়মিত আয়ের নিশ্চয়তা, শ্রম অধিকার ও সর্বোপরি সরকারের রাজস্ব আয়ের সম্পর্ক আছে। দেশের রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত যে পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম কম, তার অন্যতম কারণ অনানুষ্ঠানিক খাতের সম্প্রসারণ। কারণ অনানুষ্ঠানিক খাতে মানুষের চাকরি হচ্ছে ঠিক, কিন্তু সেই চাকরির নিশ্চয়তা বা নিরাপত্তা কম; একই সঙ্গে এসব মানুষের শ্রম অধিকার বলতে কিছু থাকে না। এই খাতের অবদানের ফলে অর্থনীতির যে প্রবৃদ্ধি হবে, সেটাও টেকসই হবে না।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, অর্থনীতিতে অনেক দিন ধরেই, বিশেষ করে ২০১৬ বা এর পর থেকেই এই ধারা দেখা যাচ্ছে। যদিও পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে আমাদের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, বিশেষ করে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কের ঘরে দেখানো হয়েছে, এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে উৎপাদন বা কর্মসংস্থান বাড়েনি। জিডিপিতে রাজস্বের অবদান কমেছে। এর মানে হচ্ছে, কর আদায় করা যায় এ রকম খাতের প্রসার ঘটছে না। কর্মসংস্থানের ৮৫ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে হচ্ছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের আকার বাড়ছে মূলত কর্মসংস্থানের দিক থেকে। উৎপাদন খাতে কর্মসংস্থান বাড়েনি। অর্থাৎ কর্মসংস্থান যে খাতে বেড়েছে, সে খাতে উৎপাদন বাড়েনি। আবার উৎপাদন যেখানে বেড়েছে, সেখানে কর্মসংস্থান বাড়েনি। জাহিদ হোসেন আরও বলেন, কম উৎপাদনশীল খাতে বেশি মানুষ কাজ করলে তা টেকসই হয় না; কোনো ধরনের বড় বিপর্যয় মোকাবিলা করতে পারবে না তারা। অনানুষ্ঠানিক খাতের কর ক্ষতি নিয়ে সিপিডির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, রাজস্ব ক্ষতির অন্যতম প্রধান কারণ অর্থনীতির অনানুষ্ঠানিক খাত। এটি ‘ছায়া অর্থনীতি, যার প্রকৃত হিসাব করা কঠিন। এসব খাত থেকে এনবিআর কর আদায় করতে পারে না। অনানুষ্ঠানিক খাতের কারণে ২০১০ সালে কর ক্ষতির পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এরপর প্রতিবছরই এই ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে। ২০২১ সালে এসে তা চার গুণ বেড়ে ৮৪ হাজার ২২৩ কোটি টাকা হয়েছে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, এর দুটি দিক রয়েছে। প্রথমত, এটি আমাদের অর্থনীতির কাঠামোগত দুর্বলতার প্রকাশ। সাধারণত আর্থসামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে অর্থনীতির প্রাতিষ্ঠানিক অংশ বড় হওয়ার কথা; কারণ সেখানে শ্রম অধিকার নিশ্চিত হয় এবং বিভিন্ন ধরনের সক্ষমতা তৈরি হয়। কিন্তু বাস্তবে প্রাতিষ্ঠানিক খাত বড় হচ্ছে না।
দ্বিতীয়ত, দেশের ৮৫ শতাংশ মানুষ এখন অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। এই খাতে শ্রমিকের জীবন মান উন্নয়নের সুযোগ কম থাকে। সেই সঙ্গে প্রবৃদ্ধি টেকসই হয় না। অর্থনৈতিক শুমারিতে যা দেখা গেল, অর্থাৎ অনানুষ্ঠানিক খাতের হিস্যা বৃদ্ধি দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে সরকারকে এই খাতে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। তাদের ঋণ সুবিধা দিতে হবে; নিশ্চিত করতে হবে বিভিন্ন অধিকার। নীতি সহায়তা দিয়ে তাদের যতটা সম্ভব প্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়ে আসতে হবে। অনানুষ্ঠানিক খাতের সম্প্রসারণসহ আরও বেশ কিছু উদ্বেগের বিষয় অর্থনৈতিক শুমারিতে উঠে এসেছে। দেখা গেছে, ২০১৩ সালে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উৎপাদন খাতের হিস্যার শতাংশ ছিল ১১ দশমিক ৫৪। গত ১১ বছরের ব্যবধানে উৎপাদন খাতের এ অবদান কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশে।
এদিকে উৎপাদন খাতে প্রবৃদ্ধি কমলেও বেড়েছে সেবা খাতে। বর্তমানে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ৯১ শতাংশের বেশি হচ্ছে সেবা খাতের; ২০১৩ সালে যা ছিল ৮৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ। মুদি দোকান থেকে শুরু করে অনলাইনের বেচাকেনা সবই সেবা খাতের অন্তর্ভুক্ত। সাধারণত শিল্প খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি থাকে। অর্থনীতির আকার বাড়াতেও এই খাতের ভূমিকা বেশি।
সামগ্রিকভাবে দেশে শোভন কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে প্রাতিষ্ঠানিক খাত সম্প্রসারণের বিকল্প নেই। সেটা হলে উৎপাদনশীলতা বাড়বে; বাড়বে সরকারের রাজস্ব আয়।