
চারদিকে শুধু দাবি আর দাবি। দাবি আদায়ের আন্দোলনে রাজপথ অবরুদ্ধ হচ্ছে প্রতিদিন। বিপাকে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় এই চিত্র যেন নিত্যদিনের হয়ে দাঁড়িয়েছে। নানা প্রয়োজনে রাজধানীতে ছুটে চলা মানুষগুলোকে একধরনের ভোগান্তির মধ্যে ফেলে দিয়ে দাবি আদায়ের চেষ্টা করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষ আকস্মিকভাবে অবরোধ বা যানজটের মধ্যে পড়ছেন। অনেক সময় এসব পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে আটকে যাচ্ছে মরণাপন্ন রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সসহ জরুরি সেবার যানবাহনও। বিভিন্ন দাবির আন্দোলনে ক্লান্ত রাজধানী। অবস্থাটা এমন যে রাজধানী যেন এখন আর এ আন্দোলনের ভার বহন করতে পারছে না।
রবিবারও রাজধানী ঢাকায় অন্তত চারটি ব্যানারে বিভিন্ন পয়েন্টে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। মহাখালীর সরকারি তিতুমীর কলেজ, ‘ইনকিলাব মঞ্চ’, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতরা এবং চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যদের পরিবার নানা দাবিতে গতকাল সড়কে নামেন। এতে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিভিন্ন কাজে রাজপথে বের হওয়া সাধারণ মানুষ পড়েন মহাবিপাকে।
এর মধ্যে মহাখালীর সরকারি তিতুমীর কলেজকে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে বেশ কয়েক দিন ধরে অবরোধ-আন্দোলন চলছে। রবিবারও শিক্ষার্থীরা কলেজের সামনের সড়ক অবরোধ করেন। এতে সড়কের উভয় পাশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এই কর্মসূচির নাম দেওয়া হয় ‘বারাসাত ব্যারিকেড’ বা সড়ক ও রেলপথ অবরোধ কর্মসূচি। অবশ্য বিশ্ব ইজতেমায় আসা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কথা বিবেচনা করে দুপুরের দিকে রেলপথ ও বিশ্বরোড অবরোধ কর্মসূচি স্থগিত করা হয়। সন্ধ্যার পর আবারও অবরোধ জোরদার হয়।
অন্যদিকে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ায় গতকাল দুপুরে ‘ইনকিলাব মঞ্চ’ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করে। তারা মিছিল নিয়ে সচিবালয়ের দিকে যাওয়ার সময় হাইকোর্টের সামনে রাস্তায় আটকে দেয় পুলিশ।
যথাযথ চিকিৎসাসেবা ও সম্মানসহ নানা বিষয়ে রবিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত শ্যামলী-আগারগাঁও সড়কে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতরা। অবশ্য তাদের এই কর্মসূচিকে অনেকে যৌক্তিক ও মানবিক হিসেবে দেখেছেন।
অন্যদিকে রবিবার দুপুরে হাইকোর্ট মাজার এলাকায় চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্য (কনস্টেবল-এসআই) ও তাদের পরিবারের সদস্যরা চাকরি পুনর্বহালের দাবিতে সড়কে নামেন। তারা সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘ঢাকা মহানগর পুলিশ রাজধানীবাসীর নিরাপত্তা ও শান্তি-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু মাঝেমধ্যেই সড়ক অবরোধ বা আন্দোলনের কারণে কিছু সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যরা অত্যন্ত ধৈর্য ও পেশাদারত্বের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছেন।’
এ ছাড়া গত সপ্তাহে রাজধানীতে টানা অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষক ও চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যরা (কনস্টেবল থেকে এসআই)। গত সপ্তাহে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণেও বেশ বেগ পেতে হয়েছে নগরবাসীকে। এর বাইরেও অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই আনসার সদস্য, চাকরিচ্যুত বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি), ইন্টার্নি চিকিৎসক, নার্স, গ্রাম পুলিশ, অহিংস গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশসহ বিভিন্ন খাতের সংশ্লিষ্টদের দাবিগুলো প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। অনেক ক্ষেত্রে দাবির যৌক্তিকতা থাকলেও কিছু ক্ষেত্রে আন্দোলনকে অযৌক্তিক হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কেউ কেউ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ‘ঝোপ বুঝে কোপ মারার’ মতো অবস্থা হিসেবেও দেখছেন।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী খবরের কাগজকে বলেন, ‘যখন তখন, যেখানে সেখানে দাবি নিয়ে আন্দোলন বা রাস্তা অবরোধ করা কোনোভাবেই স্বাভাবিক বিষয় নয়। আগের সরকারের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য আচরণ মানুষ মেনে নিতে পারেনি, ফলে তারা সবাই একত্র হয়ে সরকার পতন ঘটিয়েছে। কিন্তু এখনকার সরকার তো কোনো রাজনৈতিক সরকার না। ৫ আগস্টের পর যে প্রেক্ষাপটে এই সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, সেখানে ঢালাওভাবে যে ধরনের দাবির আন্দোলন চলছে তার অধিকাংশই যৌক্তিক নয়। একই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারেরও ব্যর্থতা ও দুর্বলতা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। যেমন- এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা অটোপাসের দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করলেন, তারা সচিবালয়ে গেলেন, সরকারও তাদের দাবি সঙ্গে সঙ্গে মেনে নিল। এর পর থেকে আরও বিভিন্ন খাতের লোকজন আন্দোলনে নামলেন, তাদেরও কারও কারও দাবি মেনে নেওয়া হলো। এভাবে যারা মনে মনে চিন্তা করছিলেন, তারাও দাবির আন্দোলনে নামছেন। এসব মিলিয়ে এখানে সরকারের বিচক্ষণতা, দক্ষতা ও সমন্বয়ের যথেষ্ট অভাব দেখা যাচ্ছে।’
ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী আরও বলেন, ‘বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কেবিনেট থেকে নানা ধরনের আন্দোলনের বিষয়ে সবার উদ্দেশে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া উচিত। রাস্তায় দাঁড়ালেই বা যান চলাচল বন্ধ করলেই যে সব দাবি পূরণ হবে না, সেটাও পরিষ্কারভাবে জানাতে হবে। পাশাপাশি কী প্রক্রিয়ায় শান্তিপূর্ণভাবে দাবি জানানো যাবে, সেটারও স্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকতে হবে। তিনি বলেন, ‘অধিকার ক্ষুণ্ন হলে দাবি পূরণে যে কারও আন্দোলন করা তার সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু কিছু ব্যক্তিবিশেষের দাবি পূরণে লাখো মানুষের ভোগান্তি সৃষ্টি বা নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন করার সুযোগ নেই। ‘মব জাস্টিস’ করে কোনো কিছু করা গেলেও তাতে প্রকৃত ‘জাস্টিস’ বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয় না, এটা সবার মাথায় রাখা দরকার।’
একই প্রসঙ্গে সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে নতুন নতুন সংকট বা নানা সমস্যা সামনে আসছে। অনেকে তাদের না পাওয়া বা বঞ্চনার বিষয়গুলো দাবি আকারে সামনে আনছেন। কিন্তু এই দাবি পূরণের প্রক্রিয়াগুলো সব সময় সঠিকভাবে হচ্ছে না। নিজের দাবি আদায়ের জন্য সাধারণ মানুষকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষের চলাচলের পথকে রুদ্ধ করে বা কাউকে জিম্মি করে দাবি আদায়ের সংস্কৃতি কোনোভাবেই সুখকর নয়। সেটার ক্ষেত্রে একধরনের মানসিক বা চিন্তার পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।’
ঢাবির সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক আরও বলেন, ‘অতীতে যারা বঞ্চিত হয়েছেন বা আশ্বাস পেয়েও বাস্তবে কিছু পাননি তারা এখন সুযোগ পেয়ে রাস্তায় নামছেন। তাই বর্তমানে যারা সরকারে বা কর্তৃপক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের বুঝেশুনে কথা বলতে হবে। সেভাবেই বিষয়গুলো সমাধান করতে হবে। কোন দাবি ন্যায্য, আর কোনটি অন্যায্য বা অযৌক্তিক সেগুলো খতিয়ে দেখে পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার এবং আন্দোলনকারী উভয়কেই আরও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। বিভিন্ন দাবি নিয়ে যারা রাজপথে নামছেন, তাদের সঙ্গে সরকারকে বা সরকারের প্রতিনিধিকে নিবিড়ভাবে বসে আলোচনা করে বিষয়গুলো সমাধান করতে হবে।’
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এর পরই সরকারের কাছে দাবি আদায়ে নাগরিকদের ঢাল বানিয়ে বা একধরনের জিম্মি করে আন্দোলন শুরু হয়। নিরাপত্তা ও হামলার বিচারসহ আট দাবিতে ৯ আগস্ট রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন সনাতন ধর্মের অনুসারীরা। বেতন-ভাতা নিয়ে বৈষম্য দূর করার দাবি জানিয়ে ৮ আগস্ট থেকে কর্মবিরতি পালন করেন মেট্রোরেলের দশম-বিশ গ্রেডের কর্মচারীরা। অবশ্য পরে ২০ আগস্ট তারা কাজে যোগ দেন। গত ২৫ আগস্ট চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে সচিবালয়ে ঢুকে বিশৃঙ্খলা করেন আনসার বাহিনীর সদস্যরা। তারা সচিবালয় ঘেরাও করলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। ২৬ আগস্ট পৃথকভাবে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন প্যাডেল ও ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা। রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে তাদের আন্দোলন চলে কয়েক দিন। বেতন গ্রেড পরিবর্তনের দাবিতে ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে কর্মবিরতি পালন করেন অডিটররা। ফলে বেতন-ভাতাসংক্রান্ত কাজ থমকে যায়। ৩০ সেপ্টেম্বর চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা।
অক্টোবরে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হলে অটোপাসের দাবিতে আবার আন্দোলনে অংশ নেন পরীক্ষার্থীদের একটি অংশ। তারা সচিবালয়ে গিয়ে হট্টগোলও করলে সরকার দাবি মেনে নেয়। ওই মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করার দাবিতে আন্দোলন করেন রাজধানীর সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। পৃথকভাবে কর্মসূচি পালন করেন সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাদের অবরোধ থেকে চলন্ত ট্রেনে ঢিল নিক্ষেপ করা হলে শিশুসহ অনেকেই আহত হন। ১৫ অক্টোবর চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা। দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ নিয়ে ১১ নভেম্বর তিন দফা দাবিতে অবরোধ করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
এর বাইরেও ‘সচেতন নার্স ও মিডওয়াইফ সমাজ’, বিডিআর কল্যাণ পরিষদ, পুলিশের অধস্তন কর্মচারী পরিষদ, কমিউনিটি ক্লিনিকের মাল্টিপারপাস হেলথ ভলান্টিয়ার, ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়ন, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ক্ষতিগ্রস্ত ঠিকাদার সমন্বয় কমিটি, বৈষম্যবিরোধী মুদ্রণ ব্যবসায়ী, শিক্ষানবিশ আইনজীবী, প্রাথমিক শিক্ষক সমন্বয় পরিষদ, স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতি, বৈষম্যবিরোধী প্রাথমিক শিক্ষক সমন্বয় পরিষদ, সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ছাত্র-যুব ও সাধারণ জনগণ, প্রবাসী অধিকার পরিষদ, পোশাক শ্রমিক, ক্ষুব্ধ নারী সমাজ, সম্পাদক পরিষদ, অহিংস গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশ নামে বিভিন্ন সংগঠনসহ আরও একাধিক ব্যানারে নানা দাবিতে রাজপথে কর্মসূচি পালন করেছে।