
বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা। রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের চার রাস্তার মোড়। কয়েক মাস আগেও এই সড়কের চারপাশে গাড়ির জটলা লেগে থাকত। তীব্র যানজট ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। একটি সিগন্যাল পার হতে ৩০ মিনিটেরও বেশি সময় লেগে যেত। এখন সেখানে সিগন্যাল সিস্টেমই তুলে দেওয়া হয়েছে। নেওয়া হয়েছে নতুন উদ্যোগ। দেওয়া হয়েছে ব্যারিকেড। দেখলে মনে হবে রাস্তা বন্ধ। আসলে যানজট নিরসনে এই সড়কে ডাইভারশনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে ট্রাফিক পুলিশ। ফলে এই সড়কে এখন যানজট নেই বললেই চলে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ জানিয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আলোচনা করে যানজট নিরসনে কিছু মোড়ে ডাইভারশন চালু করা হয়েছে। শুধু মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ নয়, রাজধানীর বিজয় সরণি, বিমানবন্দর সড়ক, তেজগাঁওসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক পর্যবেক্ষণে দেখা যায় প্রায় অভিন্ন চিত্র। তবে এসব সড়কে অস্বস্তি হিসেবে বর্তমানে চিহ্নিত হচ্ছে ‘ইউটার্ন’ পদ্ধতি।
এ বিষয়ে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের নতুন উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ও তেজগাঁও লাভ রোডে পরীক্ষামূলকভাবে ডাইভারশন বসানো হয়। এতে প্রাথমিকভাবে অনেকটা সুফল পাওয়া গেছে বলে মনে করছে ট্রাফিক বিভাগ। এ বিষয়টি আমরা পর্যবেক্ষণে রেখেছি। যেখানে প্রয়োজন হবে আমরা সেখানে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
গত বছরের অক্টোবর মাসে ঢাকার ব্যস্ত সড়কে যানজট নিরসনে পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ নেয় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, তেজগাঁও লাভ রোড ও চানখাঁরপুল এলাকায় চতুর্মুখী রাস্তায় ডাইভারশন করে একমুখী গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়। পরীক্ষামূলক এই পদক্ষেপে আশাতীত ফল পাওয়ার কথা জানিয়েছে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৫ জানুয়ারি থেকে বিজয় সরণি মোড়ে যানজট নিরসনে ডাইভারশন চালু করা হয়েছে।
চতুর্মুখী রাস্তায় ডাইভারশন করা এই সড়কগুলোতে চলাচল করা একাধিক যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোটি টাকার ইউটার্নে যানজট দূর না হলেও এখান থেকে অনেকটাই মুক্তি দিয়েছে ডাইভারশন ব্যবস্থা। এখন ডাইভারশন করা সড়কগুলোতে খুব কম সময়ে সিগন্যাল পার হওয়া যায় ও সময় বাঁচে।
ধানমন্ডি থেকে প্রতিদিন আসাদ গেট হয়ে গুলশান-১ এলাকায় অফিস করেন ব্যাংক কর্মকর্তা রিপন আশরাফ। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, আগে ধানমন্ডি থেকে গুলশান যেতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যেত। সকালে গাড়ির চাপ বেশি থাকায় আসাদ গেট চার রাস্তার মোড়ের সিগন্যাল পার হতে ৩৫ মিনিটের বেশি সময় লেগে যেত। এই সড়কে ডাইভারশন-ব্যবস্থা চালুর পর থেকে ৩০ মিনিটেই অফিসে যাওয়া যাচ্ছে। নতুন এই উদ্যোগে খুশি তিনি।
আড়ং আসাদ গেটে দায়িত্বরত পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের সদস্য জাহাঙ্গীর খবরের কাগজকে বলেন, প্রথমে ডাইভারশন-ব্যবস্থা চালু করা হলেও সাধারণ মানুষ তা বুঝতে পারেনি। প্রথমে ঘুরে যেতে হয় বলে অনেকে অস্বস্তি বোধ করতেন। এখন সাধারণ মানুষ সুফল ভোগ করছেন। তিনি জানান, এই সড়কে আগের মতো এখন আর যানজট নেই। আর সিগন্যালও পার হওয়া যায় চোখের পলকে।
গত বুধবার দুপুরে সড়কের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, নতুন নিয়ম অনুযায়ী জাহাঙ্গীর গেট থেকে বিজয় সরণিতে আসা যানবাহনগুলোকে ডানে মোড় নিতে দেওয়া হচ্ছে না। ডান দিকে অর্থাৎ মোহাম্মদপুর বা ধানমন্ডির দিকে যাওয়া গাড়িগুলো প্রধান উপদেষ্টার তেজগাঁওয়ের কার্যালয়ের সামনে দিয়ে নতুন রাস্তা হয়ে কিংবা কারওয়ান বাজার সোনারগাঁও সিগন্যাল দিয়ে যাচ্ছিল। এতে বিজয় সরণির সিগন্যালে যানবাহনের চাপ এবং যানজট অনেকটা কম দেখা যায়।
জাহাঙ্গীর গেট থেকে ফার্মগেটে আসা ৪ নম্বর গাড়ির যাত্রী আতিক খবরের কাগজকে জানান, বিজয় সরণির সিগন্যালে প্রচুর সময় লাগত। সম্প্রতি ডাইভারশন দেওয়ায় এখন সিগন্যালের ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে না, স্বস্তি লাগছে।
কোটি টাকার ইউটার্ন বিফলে
২০২২ সালে তেজগাঁও-আবদুল্লাহপুর সড়কে ৩১ কোটি টাকা খরচ করে ১১টি ইউটার্ন নির্মাণ করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। এতে যানজট তো কমেইনি বরং কোনো কোনো পয়েন্টে আরও বেড়েছে বলে মনে করেন ট্রাফিকসংশ্লিষ্টরা। প্রায় তিন কোটি টাকা করে ব্যয়ে নির্মিত আটটি ইউটার্ন একে একে বন্ধ করা হয়।
ঢাকার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান খবরের কাগজকে বলেন, যানজট নিরসনে ইউটার্ন অবশ্যই একটা ওষুধ। তবে সব জায়গায় ইউটার্ন সিস্টেম রাখা যায় না, এ জন্য জায়গা লাগে। ইউটার্ন একটি বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধান। কিন্তু এটা সব জায়গায় প্রয়োগ করা যাবে না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ইউটার্ন করতে গিয়ে একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যে, সরাসরি লেনে যানবাহন চলাচল যেন বাধাগ্রস্ত না হয়। যেখানে এই পদ্ধতি করা হবে, ওই জায়গা প্রশস্ত থাকলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। আবার ইউটার্নে রিকশাসহ ছোট ছোট যানবাহন চলাচল বা প্রবেশ করলে সেটা আবার ভালো কাজ করবে না।
এসব কৌশল থেকে কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সুফল মিলবে না উল্লেখ করে ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘ঢাকা সিটিতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে হলে কৌশলী হতে হবে। যানজট নিরসনে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের কোনো বিকল্প দেখছি না। এটি রাজনৈতিক ইস্যু, টেকনিক্যাল সমস্যা না। ঢাকা শহরে আমরা অনেক বিনিয়োগ করে ফেলেছি। কিন্তু ৪ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে লন্ডনের মতো ডাবল ডেকার বাস নিয়ে আসা সম্ভব। আমরা হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে ফেলেছি। তবে সুফল মেলেনি।’
তিনি বলেন, ‘ব্যক্তিগত একাধিক গাড়ি ব্যবহারের ওপরও নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত।’
মোটরসাইকেল ঠেকাতে রশি থেরাপি
ঢাকায় গত কয়েক বছরে মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে। সময় বাঁচানো দ্রুতগতির এই বাহনটি দিন দিন যেমন জনপ্রিয় হচ্ছে, তেমনি মোটরসাইকেল চালকদের বিরুদ্ধে বেপরোয়া আচরণের অভিযোগও জোরালো হচ্ছে। একই সঙ্গে মোটরসাইকেল আরোহীদের দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানও বেশি।
রাজধানীর বিজয় সরণি মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, বিজয় সরণির মোড় থেকে শ্যামলী, জাহাঙ্গীর গেট, সাত রাস্তামুখী সড়কগুলোতে রয়েছে মোটরসাইকেলের জটলা। অনেক সময় হঠাৎ করে রাস্তা ফাঁকা পেলেই ছুটে যায় এই বাহন। মোটরসাইকেলের যত্রতত্র চলাচল ঠেকাতে রশি বেঁধে রাখা হয়েছে।
বিজয় সরণির মোড়ে দায়িত্বরত একাধিক ট্রাফিক পুলিশ খবরের কাগজকে বলেন, মোটরসাইকেল চালকরা কোনো আইন মানতে চান না। তাদের গতি বেশি, তাড়াও বেশি। সুযোগ পেলেই ছুটে চলে। তাদের আটকাতেই এই রশির ব্যবস্থা।
এই মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ৩ নম্বর গাড়ির চালক মনির মিয়া জানান, সড়কে ফুটপাত থেকে শুরু করে সব জায়গাই মোটরসাইকেলের দখলে। ছোট গাড়িগুলোর সাবধানে চলা উচিত। কিন্তু তারা নিজেদের রাজা মনে করে। সামান্য যানজট থাকলেও অনেক সময় দেখা যায়, দুই বাসের ফাঁকে ঢুকে পড়ে মোটরসাইকেল। এই বাহনের জন্য আইন আরও কঠোর হওয়া উচিত বলেও মনে করেন তিনি।
৯৯৯-এ মিলবে আংশিক ট্রাফিক সেবা
জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর মাধ্যমে ঢাকা মহানগরীতে আংশিক ট্রাফিক সেবা চালু করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। গত মঙ্গলবার ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী স্বাক্ষরিত এক গণবিজ্ঞপ্তিতে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়।
ঢাকাবাসীকে অবগত করে জারি করা গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ আংশিক ট্রাফিক সেবা চালু করা হয়েছে। প্রায়ই লক্ষ্য করা যায় যে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠনের দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য রাস্তায় অবস্থান ধর্মঘট, অবরোধ অথবা সংঘর্ষ, সড়ক দুর্ঘটনা, রাস্তা খনন ইত্যাদি কারণে রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় যান চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ বা সীমিত হয়ে যায়। ফলে যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছাতে অস্বাভাবিক বিলম্ব হয়। এ ক্ষেত্রে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ ডাইভারশন দিয়ে যানবাহনগুলোকে বিকল্প গন্তব্যে পৌঁছানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। জরুরি গন্তব্যে পৌঁছানোর প্রয়োজন এমন নাগরিকদের জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ থেকে এ বিষয়ে তথ্য প্রদান করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।