
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গতবছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এর পর সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযাগ পাওয়া গেছে সবচেয়ে বেশি। এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনও পিছিয়ে নেই। বিগত ১৫ বছরে যাদের বিরুদ্ধে কোনো রকম অভিযোগ তোলার সাহস কারও ছিল না, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, গুম, খুন ছাড়াও ব্যাপকভাবে এসেছে দুর্নীতির অভিযোগ। এসব মামলায় অনেকেই কারাবান্দি আছেন।
দুর্নীতিতে বরাবরই আমলাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বেশি। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিসংখ্যানেও বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। তবে ৫ আগস্ট থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেই হিসাব পাল্টে গেছে।
দুদক থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিরোধী দলের ৩ রাজনীতিকের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। ৫ আগস্ট থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৩ জন সাবেক মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। তবে চলতি বছরের ১ থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অর্ধশতাধিক রাজনীতিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে দুর্নীতিসংক্রান্ত অভিযোগ দাখিলের প্রবণতা লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। ভুক্তভোগী ছাড়াও সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে দুদকে অভিযোগ দাখিল করছেন। বিশেষ করে গতবছর ৫ আগস্টের পর প্রতিদিন শত শত অভিযোগ দাখিল হতে দেখা গেছে। এসব যাচাই-বাছাইয়ের পর দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধসংক্রান্ত অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪-এ পুরো বছরে দুদকে অভিযোগ এসেছে ১৫ হাজার ৮৪২টি। যার মধ্যে জানুয়ারি থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত ৭ মাসে অনুসন্ধানের জন্য নেওয়া হয়েছে মাত্র ৫৩৩টি। পুরো বছরে ১৫ হাজার ৮৪২টি অভিযোগের মধ্যে ৫ আগস্ট থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এসেছে ৮ হাজার ৬২৫টি অভিযোগ। এর মধ্যে অনুসন্ধান শুরু করা হয়েছে ১ হাজার ৩৬১টির। সাবেক মন্ত্রী-এমপি, তাদের পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন ও তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত-সংশ্লিষ্ট ৫ শতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। যদিও নভেম্বরসহ দেড় মাস পদত্যাগের কারণে কমিশনহীন দুদকে কোনো কাজ হয়নি।
এদিকে দুদকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর মোট ৩৭৪টি মামলা করে দুদক। এসব মামলায় মোট আসামির সংখ্যা ৯৫৮ জন। এর মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী ৩৮১ জন ও রাজনীতিক ২৩ জন। বাকিগুলো বেসরকারি চাকরি, ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি ও অন্যান্য। একই বছরে ৩৫৪টি মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। এতে মোট আসামি ১ হাজার ৪১৫ জন। আসামির তালিকায় সরকারি চাকরিজীবী ৫৬০ জন, রাজনীতিক ১৪ জন, বাকিরা বেসরকারি চাকরি, ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি ও অন্যান্য।
এ বিষয়ে দুদকের মুখপাত্র ও মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, মূলত ৫ আগস্টের পর দুদকে অভিযোগ দাখিলের সংখ্যা বেড়েছে। সে অনুযায়ী, আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কারণ তারা এখন কারাগারে আছেন, জামিন নিয়ে যাতে বেরিয়ে যেতে না পারেন সে জন্য গুরুত্ব বিবেচনায় তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। তবে আগামীতে অভিযোগ অনুযায়ী সরকারি চাকরিজীবীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দুদক সূত্র জানায়, গত বছর ৫ আগস্টের পর দুদকে আসা অভিযোগের ভিত্তিতে প্রথম ধাপেই শতাধিক সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। এর মধ্যে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ, সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম, সাবেক প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, সাবেক বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, সাবেক শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, সাবেক স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, সাবেক ডেপুটি স্পিকার সামছুল হক টুকু, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, আ হ ম মুস্তফা কামাল, সাবেক গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম এবং সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। এ ছাড়া সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, ডা. এনামুর রহমান, মোহাম্মদ আলী আরাফাত, জুনাইদ আহমেদ পলক, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, জাকির হোসেন, জাহিদ আহসান রাসেল, সাবেক এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারী, আলাউদ্দিন নাসিম, নাঈমুর রহমান দুর্জয়, মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, শামীম ওসমান, নূরুন্নবী চৌধুরী শাওন, সরওয়ার জাহান, শরীফুল আলম জিন্নাহ, শহীদুল ইসলাম বকুল, শেখ আফিল উদ্দিন, কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, কাজী নাবিল আহমেদ, ছলিম উদ্দীন আহমেদ, এনামুল হক, মামুনুর রশীদ কিরণ, মহিবুর রহমান, মেহের আফরোজ চুমকী, আজিম উদ্দিন আহম্মদ, আনোয়ার হোসেন, নূর-ই-আলম চৌধুরী, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, শেখ হেলাল, কামরুল ইসলাম, জিয়াউর রহমান, শামসুল হক চৌধুরী, সাইফুল ইসলাম, ইকবালুর রহিম, আব্দুল আজিজ, মাহাবুবউল আলম হানিফ, সাকিব আল হাসান, আমানুর রহমান রানা, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মাইনুল হোসেন খান নিখিল, মির্জা আজম, জান্নাত আরা হেনরী, ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল, শফিকুল ইসলাম শিমুল এবং পিরোজপুরের মহিউদ্দিন মহারাজের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়। এই তালিকার অধিকাংশের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন, মানি লন্ডারিংসহ দুর্নীতির নানা অভিযোগে ইতোমধ্যে মামলা করা হয়েছে। বাকিদের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি চলছে।
এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন পুনর্গঠনের পর গত ১০ ডিসেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আরও শতাধিক সাবেক মন্ত্রী-এমপির দুর্নীতি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। অনুসন্ধান শেষে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যসহ কয়েকজন মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করা হয়েছে। বাকিদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে।
>আ.লীগের লুটপাটের চিত্র দেখছি
>ইনকোয়ারি করতে হবে
>সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে