
বইমেলা কি শুধুই বইমেলা? বইমেলা আসলে অনেক অনেক মেলা। অনেক কিছুর মেলা। বইমেলায় সেমিনার হয়। কবিতা পাঠ হয়। আবৃত্তিশিল্পীরা আবৃত্তি করেন। সংগীতশিল্পীরা সংগীত পরিবেশন করেন। লেখকরা নিজেদের কথা বলেন। এর সবই প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন। এই আয়োজনগুলো করে বাংলা একাডেমি। একমাত্র লেখকদের কথা ছাড়া এর সবই অনুষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমির মূল মঞ্চে। লেখকরা শুধু পাঠকের মুখোমুখি হন লেখকমঞ্চে। এখানেই শেষ নয়। বলছিলাম এক বইমেলায় অনেক মেলার কথা। গতকাল সেই বহু বর্ণিল মেলার একটা নতুন মাত্রা দেখতে পেলাম। নতুন যুক্ত হয়েছে।
গতকাল মেলার পঞ্চম দিনে টিএসসির দিক থেকে ঢুকছিলাম। ফুটপাতটা দেখলাম হকারমুক্ত। হকারদের চিরাচরিত অবস্থান নেই। স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছেন পুলিশের কয়েকজন সদস্য। আগের দিনও দেখেছি সোহরওয়ার্দীর গেটে রিকশা, মোটরসাইকেল এসে দাঁড়াতে। হকারদের ভিড় ঠেলে মেলায় ঢুকতে হয়েছে। একটু ভালো লাগল। সঙ্গে বিস্ময়। এক দিনে ওরা সব ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেল নাকি! নাকি ওদের নির্মমভাবে মেলার পরিমণ্ডল থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে? বইমেলা মানেই তো মূল প্রাঙ্গণে বই যেমন থাকবে, তেমনি বাইরে থাকবে নানা কিসিমের হকার। এই তো দেখে আসছি সেই ত্রিশ বছর ধরে। আজ ওদের হলো কী!
বিস্ময়ের ঘোর নিয়ে আর্চওয়ে যখন পার হলাম, তখনই চিরচেনা হকারদের চোখে পড়ল। আরে, এই তো! মূল মেলায় ঢুকে পড়েছে। মেলার বাইরে থেকে একেবারে ভেতরে। চুড়িওয়ালি, বাচ্চাদের খেলনা বিক্রেতা, ফুলওয়ালি, পুষ্পবালিকারা। বাংলা একাডেমি আর্চওয়ে পেরোনোর পর সাময়িকভাবে ইটের যে রাস্তা বানিয়ে দিয়েছে, সেই রাস্তার দুই পাশে হকারকুল। পুলিশও আছে পাহারায়, একটু পেছনে। মেলার এই জায়গাটা কিছুটা খোলামেলা। সেখানেই হকারদের সামান্য ব্যবধানে দায়িত্ব পালন করছে পুলিশ। আমার একটু কৌতূহল হলো। এগিয়ে গিয়ে একজন পুলিশকে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপার কী? আজ হকাররা ভেতরে? তিনিই আমার সন্দেহ দূর করলেন। ‘স্যার, ওদের আমরা ভেতরেই জায়গা করে দিয়েছি। অফিসারের নির্দেশ। বাইরে ভিড় করলে আপনাদেরই তো ঢুকতে সমস্যা হয়, তাই এই ব্যবস্থা। তবে শর্ত হচ্ছে ওরা এই যাওয়া-আসার পথটি ছাড়া মূল মেলা প্রাঙ্গণে ঢুকতে পারবে না।’ ব্যবস্থাটা আমার ভালোই মনে হলো। মেলার ভেতরের পথগুলোর বাঁকে বাঁকে স্পন্সরড কফিশপ আছে। আইসক্রিম পারলার আছে। আলাদা বিশাল জায়গাজুড়ে খাবারের দোকান আছে। তাহলে ওরা নয় কেন? ওদেরও তো জীবন-জীবিকা আছে। হতদরিদ্র চেহারার কত ছোট ছোট মেয়েশিশুকে দেখি ফুলের মালা বিক্রি করতে। কত মলিন চেহারার বৃদ্ধ নারীকে দেখি চুড়ির পসরা নিয়ে বসতে। এই তো বইমেলা। এক মেলার মধ্যে হরেক মেলা। মেলা তো একেই বলে। এই যে বইমেলাকে ঘিরে বারোয়ারি মেলা, যারা বইমেলায় আসেন, তারা ঠিকই উপভোগ করেন। আমি অন্তত করি।
বইমেলার আসা-যাওয়ার পথের ধারে লিটল ম্যাগাজিন চত্বর। চত্বরটা প্রথম চার দিন প্রায় অন্ধকার হয়ে ছিল। গতকাল দেখলাম, আলো এসেছে। স্টলের নামযুক্ত ব্যানারও লাগানো হয়েছে। বাংলা একাডেমিই স্ক্রিনপ্রিন্ট করে সেটা লাগানোর ব্যবস্থা করেছে। সেখানেই একেবারে ঢুকতেই ‘কবিতাচর্চা’র স্টল। ‘কবিতাচর্চা’ কবি ও কবিতার লিটলম্যাগ। এর বাইরে অন্য কিছু ছাপা হয় না। কথা হলো কবিতাচর্চার সম্পাদক বদরুল হায়দারের সঙ্গে। বদরুল ভীষণ কবিতা-অন্তপ্রাণ মানুষ। তাকে দুই দশক ধরে চিনি। একেবারে আত্ম-আগ্রহে, নিজের গরজে ট্যাবলয়েড সাইজের কাগজটি বের করেন। সেই ২০১১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ২৪ বছরে ৭১টি সংখ্যা বের করেছেন বদরুল। বদরুলের নিজেরও অনেক কবিতার বই আছে। তিনি প্রকাশক হিসেবে প্রতিশ্রুতিশীল কবিদেরও বই প্রকাশ করেন। এবার লিটলম্যাগ চত্বরের বিন্যাস নিয়ে বদরুল খুশি।
গত কয়েক দিন মেলায় পরিচিত লেখকদের দেখা মেলেনি। এ নিয়ে কয়েকজন পাঠককে আক্ষেপ করতে শুনেছি। বিগত মেলাগুলোতে অনেক লেখক আসতেন। প্রথমাতে নিয়মিত এসেছেন আনিসুল হক ও মাসরুর আরেফিন। মাওলা ব্রাদার্সে মশিউল আলম। অনন্যায় ইমদাদুল হক মিলন। কিন্তু এবার গতকাল পর্যন্ত কারও দেখা আমি পাইনি। মেলায় নতুন বই এসেছে। আনিসুল হকের ‘নিশি ট্রেনের ভূত’, আনোয়ারা সৈয়দ হকের ‘সময় বহিয়া গেল’, মাসউদ আহমাদের ‘তিতাসের বুনো হাঁস’, আন্দালিব রাশদীর ‘সিক্রেটস’, মোস্তফা কামালের ‘বিষাদ বসুধা’ ও ‘কাটামুণ্ডু’সহ বেশ কয়েকটি বই। কিন্তু তাদের কেউই মেলায় আসেননি। আশা করছি, সপ্তাহান্তের ছুটির দুই দিন- শুক্র ও শনিবার পাঠকরা মেলায় তাদের দেখা পাবেন। আজ অবশ্য বিদ্যাপ্রকাশে পেয়ে গেলাম কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালকে। তার কী বই প্রকাশিত হয়েছে, জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘আমার বই আমার বউ ও পুত্র আটকে দিয়েছে।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন?’ বললেন, ‘রহস্য আছে, পরে একদিন বলব।’ আমার ততক্ষণে মেলা ছেড়ে অফিসে আসার সময় হয়ে গেছে।
আসার পথে অনন্যার স্বত্বাধিকারী মনিরুল হকের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি তার প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বেশ কয়েকটি চমকপ্রদ বইয়ের কথা বললেন। সেসব বইয়ের কথা আগামীতে লিখব। আজ শুধু তার একটা কথা বলছি, ‘মানুষের জন্য কিছু অবদান রাখতে চাই বলে প্রকাশক হয়েছি। বই প্রকাশ করি। শুধু অর্থ উপার্জন করতে চাইলে তো সিন্ডিকেট করে আলু-পটোলের ব্যবসা করতাম।’
বইমেলা থেকে বেরোনোর সময় মনিরুলের কথাগুলো কানে বাজছিল। আলু-পটোল, সত্যিই তো। এসব ব্যবসায় কত্ত লাভ। কত্ত উপার্জন। সিন্ডিকেট করে সেটা তো দেখিয়ে দিচ্ছেন আমাদের কিছু ব্যবসায়ী। সেই তুলনায় বই প্রকাশকদের আয় তো নস্যি। তবে এরা আছেন বলেই বুদ্ধিবৃত্তিকচর্চা আর সৃজনশীলতার সংস্পর্শে আমাদের কেউ কেউ জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তুলতে পারছি। জয়তু প্রকাশকমণ্ডলী।